কোরান জীবন বিধান নয়। ইহা একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন। সাধক ব্যতীত কেহই এই দর্শনের সন্ধান পাইতে পারে না। সালাত এই দর্শন জ্ঞানের মূল উৎস। ইহার দর্শনে যিনি পরিপক্ক তিনি যখন যে বিধান যাহাকে দান করিবেন তাহাই তখন তাহার জন্য কোরানের বিধান। বিধান পরিবর্তনশীল কিন্তু দর্শন অপরিবর্তনশীল। জীবন-দর্শন ও জীবন বিধান এক নহে। জীবন বিধান তথা ধর্ম পরিবর্তনশীল কিন্তু জীবন দর্শন পরিবর্তনীয় নহে। প্রত্যেক নবি যে যুগের জন্য যেরূপ জীবন বিধান প্রযোজ্য তাহাই যুগোপযোগী করিয়া উহাকে পূর্ণতা দান করিয়া গিয়াছেন যেন মানুষের কর্মের উপর আল্লাহই জাহের হইয়া উঠেন। অর্থাৎ কর্মের বন্ধন জাহের না হইয়া উহা হইতে মুক্তি জাহের হইয়া তাহা কর্মের উপরে কর্তা হইয়া থাকে।কেতাবের পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জনের দ্বারাই জীবন-দর্শন লাভ হয়। প্রত্যেক নবি মানসিকভাবে অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে বাস করেন। নবীগণ জীবন-দর্শনের অধিকারী তাই তাঁহারা যে সময়ের জন্য যাহাকে যে বিধান দান করে তাহাই তাহার জন্য সত্য ধর্ম। দর্শনবিহীন যে সকল বিধান মানুষ নিজেরা রচনা করিয়া থাকে তাহা সত্য ধর্ম নহে। এই সব ধর্মের উপর অর্থাৎ আমাদের খাওয়া-পরা, চলা-ফেরা ইত্যাদি সর্বপ্রকার কর্মকাণ্ড ও চিন্তা-ভাবনার উপর আল্লাহ্র প্রেরিত রাসুলগণ অর্থাৎ প্রতিনিধিগণ তাঁহাদের বিধান জারি করিয়া তাহাকে সত্যধর্মে পরিণত করিয়া থাকেন। অতএব দর্শন-ভিত্তিক সর্বযুগের সকল ধর্মই সত্যধর্ম এবং সুফলপ্রদ। অপর পক্ষে আত্মদর্শনহীন মানুষের রচিত জীবন ব্যবস্থা তথা ধর্ম অবশ্য ত্রুটিযুক্ত হইয়া থাকে। কোরানের সুক্ষ্ম জীবন-দর্শন সর্ব-সাধারণের জ্ঞাতব্য বিষয় নহে। ইহা শুধু মুক্তিপাগল সাধকের জন্য। মুক্ত পুরুষগণ সমাজকে যেরূপ জীবন বিধান দান করিবেন তাহাই হইবে জনগনের ধর্ম বিধান। ধর্ম বিধান দানের অধিকার একমাত্র মুক্ত পুরুষগণের জন্যই সংরক্ষিত থাকিতে হইবে। ইহার ব্যতিক্রম হইলে সঠিক ধর্মের প্রতিষ্ঠা এবং সমাজে ধর্মীয় শৃংখলা বজায় থাকিতে পারে না।ইতিপূর্বে বলা হইয়াছে যে, জীবন দর্শন এবং জীবন বিধান এক নয়, কোরআন একটি ধর্ম বিধান নয়। ইহা মানব জাতির জন্য একমাত্র পরিপূর্ণ জীবন দর্শন। জ্ঞানীগণ ইহার নির্দেশ অনুযায়ী ধর্ম বিধান বা জীবন বিধান রচনা করিলে তাহা হইবে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। প্রচলিত ইসলাম ধর্ম অপূর্ণাঙ্গ এবং বিকৃত একটি জীবন ব্যবস্থারূপে বিভিন্ন পরিস্থিতির চাপে সৃষ্ট হইয়া আসিয়াছে। জীবন দর্শন হইতে জীবন-বিধান রচনা কার্যটি ধর্মনিরপেক্ষ পরম জ্ঞানী ব্যক্তি দ্বারা রচিত না হইলে ইহার পরিণতি এইরূপ হইয়াই থাকে। এবং এই অবস্থায় জীবন দর্শন হইতে জীবন-বিধান বা “ধর্ম” বিচ্ছিন্ন হইয়া উহা মুক্তিমুখী না হইয়া মূলত অনুষ্ঠানমুখী হইয়া থাকে।
প্রকৃতপক্ষে মোহাম্মদী ইসলাম একটি ফিৎরাতী ধর্ম। অর্থাৎ প্রাকৃতিক ধর্ম বা আল্লাহ্র স্বভাব ধর্ম (৩০:৩০ দ্রষ্টব্য). বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গে স্বভাবের সমন্বয় সাধনের সর্বাঙ্গীণ সুন্দর ব্যবস্থা কোরানে দান করিয়াছেন। অতএব কোরআন ফিৎরাতী ধর্ম সাধনের পরিপূর্ণ একটি রূপরেখা (Guide Line). মানুষ এবং জ্বীনের মন ব্যতীত পৃথিবীর সমগ্র সৃষ্টি প্রকৃতির নিয়মের অর্থাৎ প্রাকৃতিক ধর্মের সঙ্গে মিশিয়াই চলিয়াছে। প্রবল আমিত্বের কারণে মিশতে পারে না মানুষ এবং জ্বিন। এই দুই জাতি যখন আমিত্বের বর্জন করিয়া প্রাকৃতিক স্বভাব ধর্মের সঙ্গে কোরানের বিধান মত মনের সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করে কেবল তখনই বিষয়-বস্তুর বন্ধন হইতে মুক্তির দিকে অগ্রসর হইতে পারে।
কোরআন ফিৎরাতী জীবন-দর্শন। ইহা ধর্ম নয়। ইহা হইতে মোমিনগণ (অর্থাৎ সিদ্ধ-সাধুপুরুষগণ, সম্যক গুরুগণ, ধর্মবিজ্ঞানীগণ) ধর্ম-বিধান বা জীবন-বিধান রচনা করিয়া জনগণকে মুক্তির দিকে আগাইয়া নিবেন। মোমিন ব্যতীত অন্য কাহারও রচিত ধর্ম মুক্তির দিশারী হইতে পারে না। রসুলাল্লাহ বলিয়াছেনঃ আলী যে দিকে মোড় নেয় আল্লাহ্র দ্বীন সে দিকেই মোড় নেয়।
ফিৎরাত অর্থ ভাঙ্গিয়া যাওয়া বা ধ্বংস। মন এবং দেহের ধ্বংসকেই ফিৎরাত বলে। যেহেতু আল্লাহর সৃজিত প্রকৃতির নিয়মে দেহ-মনের এই ধ্বংস স্বাভাবিক নিয়মের দ্বারা হইয়াই চলিয়াছে সেইজন্য যে বিধানের দ্বারা দেহ ও মন সহজে ধ্বংস হইয়া যায় অর্থাৎ পুনরায় উভয় সংযোজিত হইয়া পুনর্জন্মে আর আসে না সেই বিধানকে ফিৎরাতী ধর্ম বলে।আল্লাহ্ হইলেন “ফাতেরীস্ সামাওয়াতে অল্ আর্দ” অর্থাৎ দেহমনের ধ্বংসকারী। দেহ-মনের সংমিশ্রণের দ্বারা পুনর্জীবনে না আসিয়া দেহ-মনের ধ্বংসের মাধ্যমেই মানুষ মুক্তি পাইয়া থাকে। ইসলাম দেহ-মনের ধ্বংস সাধন বিষয়টি সহজে সম্পন্ন করিয়া এই মুক্তির ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করে বলিয়াই ইহাকে ফিৎরাতী ধর্ম বলে।
গুরুকেন্দ্রিক সালাতের আত্মিক অনুশীলনের কথা কোরানে সর্বত্র পরিব্যক্ত আছে। সালাত প্রক্রিয়ার সাহায্যে জন্মান্তরবাদের পরিচয় জ্ঞান পরিস্ফুট হইয়া উঠে এবং বিষয়-দর্শনের উপর জ্ঞানচক্ষু উদিত হয় বা উন্মীলিত হয়। এই সকল কথা কোরানে সর্বত্র থাকা সত্ত্বেও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করিলে কোরানের কোন দর্শন উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। বস্তুবাদী অর্থের মধ্যে অসংখ্য আত্মবিরোধী ভাব এবং গরমিল বিদ্যমান।
আল কোরআন হইল সৃষ্টি-রহস্য-জ্ঞাপক সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ এবং ইহা মানব জীবনের একটি প্রতিচ্ছবি। ইহার দর্শন প্রকাশের মৌলিক ভিত্তি ছয়টিঃ
১. জন্মান্তরবাদঃ – কোরানের অঙ্কতি জীবন দর্শন পুনর্জন্মবাদের উপরে সুপ্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। যে কোন ধর্মাবলম্বী প্রকৃত ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করিলে (অর্থাৎ আপন রবের নিকট বা সম্যক গুরুর নিকট সঠিক আত্মসমর্পণের ধর্ম অনুসরণ করিলে) তাহাদের মানে মোমিন ও প্রকৃত মুসলমানের জন্য পুনর্জন্ম নাই। এইরূপে বলা যাইতে পারে যে, প্রকৃত ইসলামে পুনর্জন্ম নাই। তাঁহারা জন্মচক্রে হইতে মুক্ত। পুনর্জন্মের কথা কোরানের ভাষা চাতুর্যে প্রচ্ছন্ন করিয়া রাখা হইয়াছে। রসুলের শিষ্যবর্গের মধ্যে মোমিনের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। মোমিনগণ চক্ষুষ্মান হওয়া সত্ত্বেও রসুলাল্লাহর নির্দেশ ক্রমে উহা প্রকাশ করেন নাই। ইহা সহজ ভাষায় সাধারণভাবে প্রকাশ করিলে তৎকালীন পশু-প্রকৃতির মূর্খ মরুবাসী আরবগণ যাহারা ছিল সংখ্যায় অত্যাধিক, তাহারা ধর্ম গ্রহণ করিত না এবং করিলেও আত্মশুদ্ধির ব্যাপারে একেবারেই শিথিল থাকিত। রাষ্ট্রীয় গোলযোগের কারণে খেলাফত কালে ইহার প্রকাশ হয় নাই। তারপর যদিও মিশরে ফাতেমী রাজত্ব কালে এই মতবাদ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেখানে প্রচলিত হইতে পারিয়াছিল, তথাপি ইহা বেশি দিন সেখানেও টিকিয়া থাকিতে পারে নাই। প্রায় আড়াই শত বৎসর ফাতেমী রাজত্ব করেন। সুলতান সালাউদ্দিন সেই দেশ জয় করেন এবং এই মতবাদ পুনরায় সেখান হইতে নিশ্চিহ্ন করিয়া দেওয়া হয়।জন্মান্তরবাদ শব্দটি কোরানে নাই। যাহা আছে তাহাকে রূপান্তর বাদ বলা যাইতে পারে। জৈব এবং অজৈব সবকিছুর রূপান্তর ঘটিতেই আছে। কোন কিছুই আপন অবস্থায় স্থির থাকিতেছে না। এই রূপান্তরকে আমরা স্থূলভাবে পুনর্জন্ম বলিয়া থাকি। এইরূপ রূপান্তরের কারণেই আমি, তুমি বা সে বলিতে কিছুই নাই। যাহা আছে বলিয়া আমরা দেখিতেছি তাহা অদ্বৈত আহাদ রূপেরই একক প্রকাশ বা লীলা-ভঙ্গি। ইহাকেই বিভিন্ন জাতি জন্মান্তর বাদ Transmigration of the Soul বলিয়াছে। কোরানে জন্মান্তর কিংবা রূপান্তর এইরূপ কোন একটি শব্দ ব্যবহার করিয়া বিষয়টির প্রকাশ কোথাও করেন নাই। অথচ রূপক বর্ণনার সাহায্যে বিষয়টি অত্যন্ত বিস্তৃত ও ব্যাপকভাবে প্রকাশ করা হইয়াছে। কোরানে যেভাবে রূপান্তর বিষয়টি নিখুঁতভাবে অঙ্কন করিয়াছেন তাহা বিজ্ঞান সম্মত এবং তাহাই জীবন দর্শনের সম্যক বা আসল রূপ।
সালাত প্রক্রিয়ার সাহায্যে জন্মান্তরবাদের পরিচয় জ্ঞান পরিস্ফুট হইয়া উঠে।
কোরানে জন্মান্তরবাদ/পুনর্জন্মবাদ/রুপান্তরবাদঃ-
..................................................................
সূরা বাকারাঃ২৮। তোমরা কেমন করিয়া আল্লাহ্র সঙ্গে মিথ্যা আরোপ কর? এবং তোমরা ছিলে মৃত,সুতারাং তিনি তোমাদিগকে জীবিত করিলেন। তারপর তোমাদিগকে মৃত্যুদান করেন, তারপর তোমাদিগকে জীবনদান করেন, তারপর তাঁহার দিকে প্রত্যাবর্তন করেন।
ব্যাখ্যাঃ- প্রাকৃতিক মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুবরণ না করিতে পারিলে মানুষ মুক্তিলাভ করিতে পারে না, যাহার ফলে মৃতের জগতেই সে বাস করে এবং জন্ম-মৃত্যুর আবর্তে সে বন্দী হইয়া থাকে। প্রথমেই বলা হইতেছে “এবং তোমরা ছিলে মৃত” ‘এবং’ শব্দটি মানব জীবনের অতীতের ইঙ্গিত হিসাবে উল্লেখ হইয়াছে। সেখানে হইতে তিনি তোমাদিগকে জীবন দান করিলেন। তারপর তোমাদিগকে মৃত্যু দান করেন। তারপর তোমাদিগকে জীবন দান করেন। তারপর তাঁহার দিকে প্রত্যাবর্তন করেন। “তাঁহার দিকে প্রত্যাবর্তন করা” অর্থ সংশোধনের জন্য নবজন্মে আনয়ন করা। ‘তারপর’ কথাটি তিনবার উল্লেখ করিয়া জন্ম-মৃত্যুর পুনরাবৃত্তির ইঙ্গিত দিতেছেন। কোরানে অন্যত্র আছেঃ “আল্লাহ্ জন্ম-মৃত্যু সৃষ্টি করিয়াছেন মানুষকে পরিক্ষা করিবার জন্য (৬৭:২)
সূরা বাকারাঃ ৫০। এবং যখন আমরা তোমাদের সঙ্গের সমুদ্রটিকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দিলাম, তারপর তোমাদিগকে মুক্ত করিলাম (বা উদ্ধার করিলাম) এবং ফেরাউনের দলকে ডুবাইয়া দিলাম এবং তোমরা (ইহা) দেখিতেছ (অর্থাৎ বনি ইসরাইলরা ইহা দেখিতেছ)
ব্যাখ্যাঃ সপ্ত ইন্দ্রিয় দ্বারপথে দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ ইত্যাদি রূপে যেই সকল ধর্ম আগমন করে সেইগুলিকে সালাতের সঙ্গে সঠিকভাবে গ্রহণ-বর্জন না করিলে সেইগুলি হয় শেরেক(*1) বা সংস্কার। এই শেরেক বা সংস্কারকে রূপকভাবে সমুদ্র বলা হইয়াছে। সংস্কারের যে সমুদ্র মানুষের সঙ্গে সংলগ্ন হইয়া আছে সালাতী ব্যক্তি ব্যতীত সবাই ইহাতে ডুবিয়া যায়। অর্থাৎ পুনর্জন্ম লাভ করে। বনি ইসরাইলগণ সত্যদ্রষ্টা মহাপুরুষ। তাঁহারা এই সমুদ্র হইতে গুরুর কৃপায় বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছেন। অপরপক্ষে ফেরাউনের দলবল সালাত না করিবার কারণে সংস্কার সাগরে ডুবিয়া মরে এবং পুনর্জন্মে আসে। বনি ইসরাইলগণ এই সত্য অহরহ দেখিতে পান। তাঁহারা মনের রাজা। তাঁহাদের দৃষ্টিতে মানব মনের এই শেরেক অবস্থা সর্বদা দৃশ্যমান।সংস্কার সাগরে ডুবিয়া মরাকে সায়াত(*2) বা ধবংসাত্মক মৃত্যু বলা হয়। মহাপুরুষগণ ‘সায়াত’-এর জ্ঞানে জ্ঞানী (৪৩:৬১)
শব্দ সংজ্ঞাঃ (*1) শেরেক অর্থ সংযুক্তি, কিছুর সঙ্গে শরীক হওয়া, মনের অংশীবাদ। গায়ারাল্লাহর সঙ্গে অর্থাৎ গুরু ব্যতীত অন্য কিছুর সঙ্গে মন সংযুক্ত বা সম্পৃক্ত হইলে কোরানে সেই মনকে ‘মোশরেক’ বলে। জিন এবং মনুষ্য জাতির মধ্যে শেরেকের এই অপরাধ ব্যাপক ও সুক্ষ্মভাবে বিরাজ করে। সকল প্রকার পাপের মূল হইল এই শের্ক। এইজন্য ইহা গুরুতর অপরাধ।
(*2) সায়াতের ভাষাগত অর্থ হইল এক ঘণ্টা হইতে অল্প অধিক একটি কাল- যেমন আমরা বলিয়া থাকি প্রহর। কোরানের পরিভাষাগত অর্থ হইলঃ জাহান্নামগামী অকৃতকার্য ব্যক্তির ধ্বংসাত্মক মৃত্যুকাল। কেবল মহাপুরুষগণ সায়াত হইতে মুক্ত হইয়া যান। অতএব সায়াত অর্থ একদিনের একটি অংশ অথবা ধ্বংসাত্মক মৃত্যুকাল।
সূরা নেসাঃ৫৬। নিশ্চয় আমাদের পরিচয়ের সঙ্গে যাহারা মিথ্যা আরোপ করে শীঘ্রই আমরা তাহাদিগকে সংশোধনের আগুনে জ্বালাইয়া থাকি। যতবার তাহাদের ত্বক রোদে পুড়িয়া পরিপক্ক হইবে ততবার উহা বদলাইয়া তাহাদিগকে নূতন ত্বক দিব যেন তাহারা ভোগ করে শাস্তি। নিশ্চয় আল্লাহ্ শক্তিশালী বিজ্ঞানময় বিচারক।
ব্যাখ্যাঃ মানুষের ইন্দ্রিয়পথে আগমনকারী ধর্মরাশি ‘আল্লাহ্র আয়াত’. এইগুলি উপর সালাত প্রয়োগ আল্লাহ্র পরিচয় লাভ করা যায় এবং সালাত না করিলে এখান হইতে আল্লাহ্র পরিচয় লাভ করা যায় না। এইগুলিকে মিথ্যায়িত করা হয়।যিনি বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ্, তাঁহার উপর মিথ্যা আরোপ করিবার শক্তি কাহারও নাই। আপন সত্ত্বার মধ্যে যে আল্লাহিয়াত আছে তাহার উপর মিথ্যা আরোপ হয়। সালাত কর্ম দ্বারাই কেবল এই মিথ্যা দূর করা সম্ভব। সালাত না করিলে আগমনকারী বিষয়সমূহের প্রতি আসক্তি এবং মোহ জন্মায় এবং তাহা দ্বারা নিজের মধ্যেই আল্লাহ্র বিকাশ প্রচ্ছন্ন হইয়া যায়। ইহাকেই বলা হইয়াছে “আল্লাহ্র উপর মিথ্যা আরোপ করা”.ইহা দ্বারা জন্মচক্রে জাহান্নামের আগুনে আবদ্ধ হইয়া থাকে। যতবার তাহাদের নূতন কচি ত্বক রোদে পুড়িয়া পরিপক্ক হইবে, মুক্তি অর্জন না করিলে ততবার তাহা বদলাইয়া তাহাদিগকে নূতন ত্বক দেওয়া হইবে, শান্তি ভোগের জন্য।(মন্তব্যঃ আলোচ্য বাক্যটিতে ‘কাফারু’ বলতে মিথ্যা দ্বারা আবৃত বা মিথ্যা আরোপ করা বুঝায়। কাফের শব্দটি ‘কাফেরুন’ ধাতু থেকে আসিয়াছে; এর আভিধানিক অর্থ আবৃত করা বা ঢেকে ফেলা। কোরানেরর পরিভাষায় সত্যকে যাহারা সত্য জানিয়াও ঢাকিয়া রাখে তাহারা কাফের। ইহা ছাড়া সত্য যাহার মধ্যে ঢাকা পড়িয়া আছে সে-ই কাফের। কোরানে উল্লেখ আছেঃ ওয়াল্লাহু মুহিতুম বিল কাফেরিন- এবং আল্লাহ্ কাফেরদের দ্বারা আবৃত হয়ে আছেন।(২:১৯) প্রত্যেকের ভিতরে আল্লাহিয়াত সুপ্ত হয়ে আছে, কিন্তু আল্লাহিয়াতকে নাফসানিয়াতের স্বেচ্ছাচারীতা দ্বারা আবৃত করে রাখা হয়েছে বলিয়া কাফেরদের মধ্যে আল্লাহিয়াতের প্রকাশ বাধাপ্রাপ্ত, তাই তারা কাফের।বাক্যটিতে ‘নুসলি’ শব্দটি লক্ষ্য করার মতো। ‘নুসলি’ অর্থ আগুনে সেক দেয়া অর্থাৎ জাহান্নামের আগুনে সেক দেয়া। প্রচলিত ধারনামতে, জাহান্নামের আগুনে সেক দেওয়ার মতো কোন বিষয় নাই, সেখানে বরং লাকড়ি পোড়ানের মতো করে পড়ানোর ব্যবস্থা থাকবে। প্রকৃত অর্থে, সংশোধন বুঝাতে ভাষা চাতুর্যে আগুনে সেক দেয়া বলা হয়েছে। সেক দেয়া মানেই হল- পূর্বাবস্থায় বা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। জাহান্নামের আগুনে সেক দেয়া মানে হল সংশোধনের নিমিত্তে সেক দেয়া; সংশোধিত না হয়ে কেহ জান্নাতে প্রবেশাধিকার পায় না। কোরানে উল্লেখ আছেঃ এবং তোমাদের কেহ নাই যে ইহাতে না অাসিবে, (ইহা) তোমার রবের উপর (ন্যাস্ত) জরুরী একটি গৃহিত সিদ্ধান্ত। (১৯:৭১) জাহান্নাম অতিক্রম করিয়াই জান্নাতে যাইতে হয়। জাহান্নাম অতিক্রম করাইয়া জান্নাতে উত্তরণ করিবার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবার বিষয়টি প্রত্যেকের মধ্যে অবস্থিত আপন রবের নিকট রহিয়াছে।
(সূরা নেসাঃ১১৯) এবং তাহাদিগকে অবশ্য পথভ্রষ্ট করিব এবং তাহাদিগকে (মিথ্যা) আশা দিব এবং তাহাদিগকে আদেশ-নির্দেশ করিব- অতএব তাহারা অবশ্য পশুর কান কাটিবে এবং তাহাদিগকে আদেশ নির্দেশ দিব- অতএব তাহারা অবশ্য পরিবর্তন করিবে আল্লাহ্র রূপান্তর সৃষ্টি। এবং যে দুর্বল আল্লাহ্র অংশ হইতে শয়তানকে একজন বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তবে সে স্পষ্ট একটা ক্ষতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ব্যাখ্যাঃ বস্তুবাদী শয়তান(*1) তার অনুসারীদিগকে বিষয় মোহের দিকে এমন উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়া থাকে যে, তখন তাহারা অবশ্য পশুর কান কাটিবে এবং তাহাদিগকে এমন সব আদেশ নির্দেশ দিবে যাহাতে তাহারা আল্লাহ্র(*2) রূপান্তরিত সৃষ্টিকে অবশ্য পরিবর্তন করিবে। “পশুর কান কাটা এবং আল্লাহ্র রূপান্তরিত সৃষ্টিকে পরিবর্তন করা” কথা দুইটি একই ভাব বহন করে।“কান কাটা” কথাটি অপমানজনক একটি কথা। পশুর কান কাটিয়া তৎকালীন আরবগণ যেমন সেই পশুকে আল্লাহ্র পরিবর্তে দেব-দেবীর দিকে উৎসর্গের জন্য চিহ্নিত করিত শয়তানও তেমনই মানুষপশুর কান কাটিয়া তাহাকে নিম্নগতি করে। ইহা একটি সুন্দর রূপক কথা। এইরূপে আল্লাহ্র রূপান্তরিত সৃষ্টি ইনসানকে(*3) তাহারা পরিবর্তন করিয়া পশুর পর্যায়ে নামাইয়া আনে। কোরান মানুষকে সর্বোচ্চ মানের পশু বলিয়াছেন (সূরা আনাম দ্রষ্টব্য)।আল্লাহ্ ও তাঁহার প্রতিনিধিগণ সাধারণ জীবদিগকে উত্তোরিত করিয়া ইনসানিয়াতে পৌঁছাইয়া থাকেন। ইনসানগনই কেবল নিজ আমল দ্বারা মুক্তিপথে অগ্রসর হইবার যোগ্য। মিথ্যা আশায় আশান্বিত হইয়া ইনসানগণ আল্লাহ্ ও রসুলের নীতিবাদ গ্রহণ করিলে অধঃপতিত হয়। আল্লাহ্ ও তাঁহার প্রতিনিধিগণ জীবগণকে ‘খালাকা’ করেন ইনসানিয়াতের দিকে আর শয়তান ও তাহার দলীয়গণ ইনসানকে ‘খালাকা’(*4) করে পশুত্বের দিকে।
টীকাভাষ্যঃ- (*1)শয়তান(২৩:৯৭)কলুষিত, অশুদ্ধ মন বা আম্মারা নফসকে (চিত্তবৃত্তির সামগ্রিক অভিব্যক্তিকে নফস বলে) অর্থাৎ ভ্রান্ত মানুষকে সাধারণত ভাবে শয়তান বলা হইয়াছে। জ্বিন যেহেতু মানুষের মধ্যে নিম্নমানের জীব সেইহেতু জ্বিনদের মধ্যে ভ্রান্তির পরিমাণ অধিক। মানুষের মধ্যে যে কোন পর্যায়েই কেহ থাকুক না কেন যদি সে গুরুর নীতিমালার অবাধ্য হয় তবেই সে শয়তান নামে আখ্যায়িত হয়। অবাধ্যতার পর্যায় অনুসারে শয়তানের শয়তানী কম-বেশী হইয়া থাকে। সম্যক গুরুই আর-রহমান রূপে নিম্নমানের মনুষ্য জীবকে শিক্ষা ও দীক্ষা দান করিয়া তাহাদিগকে ইনসান বানাইয়া থাকেন (৫৫:১).সুতারাং যে নফস বা ব্যক্তি সম্যক জ্ঞান অর্জন করে নাই অথবা সম্যক গুরুর নির্দেশিত পথে চলে নাই সেই মন বা ব্যক্তি শয়তান। শয়তান বাহিরের অন্য কোন জীব নহে। শয়তান মনুষ্য এবং জিন জাতি হইতে উদ্ভূত হইয়া থাকে। আল্লাহ্ ও তাঁহার রসুলের নির্দেশিত পথের না হইলেই তাহাকে শয়তান বলা চলে।পূর্ণতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি, পরিশুদ্ধ মন বা মোৎমায়েন্না নফস ছাড়া প্রত্যেকটি মানুষের আপন নফসই কম-বেশি শয়তান।সকল প্রকার দুঃখ ভোগের একমাত্র কারণ হইল শয়তান। মানুষের আমিত্বই শয়তান। ‘আমি ও আমার’ ইহাই শয়তানের কথা। আমিত্বের আশ্রয়ে থাকা জাহান্নাম। আল্লাহ্র আশ্রয়ে থাকা জান্নাত। যে যত বেশি আমিত্ব প্রকাশ করে সে তত বেশি জাহান্নামের গভীরে বাস করে।প্রত্যেকটি বিষয়ের দুইটি রূপ আছেঃ একটি বহির্মুখী রূপ, বস্তুবাদ অপরটি অন্তর্মুখী রূপ, আধ্যাত্মবাদ। এই ক্ষেত্রে আমরা মনে করি, শয়তানের বহির্মুখী রূপটি হইল ব্যক্তি নিজেই আর অন্তর্মুখী রূপটি হইল তাহার কলুষিত, অশুদ্ধ মন। অবশ্য প্রচলিত মতে, শয়তান স্বতন্ত্র অস্তিত্ব সম্পন্ন।
(*2)আল্লাহঃ- (আর্দ ও সামা) সৃষ্টির ও মনের কেন্দ্রবিন্দুটি হইলেন আল্লাহ্। আল+ইলাহ। অর্থাৎ একমাত্র উপাস্য।ইলাহ্ অর্থ কর্তা, নেতা, অধিকারী, তাই উপাস্য। সৃষ্টিময় আল্লাহ্ ব্যতীত কোন ইলাহ্ নাই। মোহাম্মদ (আ.) ব্যতীত নিরাকার আল্লাহ্র পরিচয়ের কোন প্রকাশ নাই। সৃষ্টি পরিচালনার জন্য তাঁহারই উপর সকল নেতৃত্ব কর্তৃত্ব এবং অধিকার ন্যস্ত রহিয়াছে। সুতারাং তিনিই হইলেন আল ইলাহ্'র প্রকাশ্য অভিব্যক্তি। সকল মহাপুরুষ ঐ জাহেরী ইলাহ্'রই পরিচয় প্রকাশক।একমাত্র সেই ইলাহ্'র নির্দেশ ব্যতীত মনুষ্য জীবনের নির্ভরের অন্যান্য বস্তু ও ব্যক্তিগনকে মানুষ যেইরূপ কর্তৃত্বের আসনে বসাইয়া থাকে কাল্পনিক বা মিথ্যা ইলাহ্; যেহেতু এই ইলাহ্সমূহ নিজেরাই অস্থায়ী এবং আল ইলাহ্'র নিয়ন্ত্রণাধীন।
(*3)ইনসানঃ- যে মানুষ তার ত্রুটি সম্বন্ধে জাগ্রত এবং একটা বাস্তব এবং সত্য মনোভাবের উপর দাঁড়ায়। ইনসান অলিক মনোভাবকে কোন গুরুত্বই দেয় না। ইনসানের মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে যাহা অন্যের নাই। ইনসান গুরুর গুরুত্ব বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন এবং কমবেশী গুরুর সাহচর্যে থাকে। রহমান প্রভুগুরু রূপে জিনকে কোরান শিক্ষা দিয়া ইনসানে রূপান্তর করেন। তারপর তাহাকে সর্ববিষয়ের ব্যাখ্যা দান করেন (৫৫:১-৪). গুরু এবং ইনসানের সম্পর্কে আন্তরিকভাবে ঘনিষ্ঠ এবং ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গুরুর বাহিরে সে কোন অস্তিত্ব মানে না, যদিও অতীত কর্মের কারণে গুরুকে পূর্ণভাবে অনুসরণ করিতে সক্ষম হয় না। এই সংজ্ঞার বহির্ভূত মনসূমহ সবাই জিন। গুরুর বাহিরে কোন ইনসান নাই। ইনসানের বহুবচন নাস।ইনসান জান্নাতের প্রথম পর্যায়ে উন্নীত হইলে তাহাকে আদমও বলা যাইতে পারে। সুতারাং আদম পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব সর্বযুগেই বিদ্যমান।
ইনসান জীবশ্রেষ্ঠ। তাই সে জ্ঞানে গরিমায়, কৃষ্টি সভ্যতা ইত্যাদি সর্বদিক হইতে অন্য সকল জীবকুল হইতে নিজেকে ধনবানরূপে দেখিতে পায়। এইগুলি অবশ্য স্বর্গীয় গুণ এবং গৌরবের বিষয়। গুরুগণ হইতে এইগুলি অর্জন করিয়াই সে নিজেকে আপন গৌরবে গৌরবান্বিত দেখিতেছে। আসলে তাহার মস্তিষ্ক যে সকল উন্নতমানের উপার্জন দ্বারা ভরপুর হইয়া আছে, তাহা যে পুনর্জন্মের উপাদান হইয়াই মস্তিষ্কে জমা হইয়া আছে এইকথা বুঝিতে সে বোকামি করিতেছে। নিন্মমানের মানুষ এবং ইতর জীবকুল ইহা না বুঝিতে পারে কিন্তু ইনসান ইহা বুঝিবার যোগ্যতা রাখে। এইজন্য লা-মোকার কথা না বুঝিতে চাহিলে ইনসানকে বোকা বা বলদ বলিয়া আখ্যায়িত করা হইতেছে।মানুষ স্বভাবতই সালাত বিরোধী। সালাত মস্তিষ্কের মধ্যে মহাশূন্যতা আনয়ন করে। বিপরীত দিকে শেরেক আনয়ন করে প্রাচুর্য এবং মনের বহুমুখী ধন সম্ভার, যাহা আপাতদৃষ্টিতে অধিক সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। এই জন্য ইনসান জান্নাতমুখী হইতে ভালবাসে এবং গুণগ্রাম সহকারে নিজেকে জান্নাতের ধনে ধনীরূপে দেখে। মুক্তিলাভের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে না। বিশ্বের সুসভ্য গুরুবাদী ইনসানগণ কল্যাণমুখী কিন্তু মুক্তিমুখী নয়, তথা জান্নাতমুখী কিন্তু লা-মুখী নয়। ইহা সালাতের বিরোধীতা বা সালাতের প্রতি অনীহা।
(*4) রূপান্তরিত সৃষ্টিকে খালাকা বলে। খালাকা দ্বারা মৌলিক সৃষ্টি বুঝায় না। জীবজগতে ইনসান একটি গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। মানুষের মধ্যে যাহারা সম্যক গুরুর শিক্ষা লাভ করিয়া সাধারণ জীব পর্যায় বা জিন পর্যায় অতিক্রম করিয়া গুরুভক্ত হইতে পারিয়াছে তাহারাই ইনসান। ইনসান সম্যক অবস্থা লাভ করে নাই কিন্তু মুক্তি পথের যাত্রী হইবার উপযুক্ত মন-মানসিকতা অর্জন করিয়াছে। ‘খালাকা’ অর্থ প্রথম বা মৌলিক সৃষ্টি নয়। ‘খালাকা’ কথা দ্বারা রূপান্তরিত সৃষ্টি বুঝায় যাহাতে গুনগত এবং প্রকৃতিগত পরিবর্তন ঘটে। আদি সৃষ্টি বুঝাইবার জন্য ব্যবহৃত শব্দ হইল ‘বদি’।
২. সুফিবাদ বা আধ্যাত্মবাদঃ –জগতের মধ্যে আধ্যাত্মবাদ বলিয়া একটি কথা আছে, তাহা জগতবাসী তো বুঝেই না, এমন কি যাহারা আধ্যাত্মবাদী বলিয়া নিজদিগকে প্রচার করেন তাহারাও এই শব্দের আসল স্বরূপ সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান রাখেন না। ইহার ফলে ধার্মিক ব্যক্তিগণের ধর্মপথ কুয়াশাচ্ছান্ন থাকে। ইহাতে ধর্মপথে যাত্রার নামে অধর্ম পথেই যাত্রা হইয়া থাকে। ইহার ফলে কলুর বলদের মত জন্মচক্রে অনন্তকাল পর্যন্ত ঘুরিতেই থাকে। আধ্যাত্মবাদ সম্যক গুরুর কাছে জানিয়া লওয়া ব্যতীত অন্য কোন উপায় নাই। প্রত্যেক বিষয়েরই দুইটি রূপ আছেঃ একটি বহির্মুখী অপরটি অন্তর্মুখী রূপ। বহির্মুখী রূপটি বস্তুবাদ এবং অপরটি আধ্যাত্মবাদ বাদ অন্তর্মুখী। প্রত্যেকটি বহির্মুখী বিষয়ের অনুরূপ বা এক মিলের অন্তর্মুখী একটি অবস্থা আছে। Every external affair of a matter has a corresponding internal condition or conception of the mind.
৩. মাওলাতন্ত্র বা মোমিনতন্ত্র বা গুরুবাদঃ – গুরুবাদ হইল ধর্মজগতের মূলভিত্তি। সম্যক গুরু হইতেই কেবল অবিরাম ভাবে ধর্ম দেশনা হইয়া থাকে। হেকমতপূর্ণ কোরানে উল্লেখিত গুরুবাদ না বুঝিয়ে যাহারা কোরানের কথার উপর মন্তব্য পেশ করিবেন তাহারা কোরানের দর্শন প্রকাশে কখনও সত্যাশ্রয়ী হইতে পারিবেন না। অতএব তাহাদের ধর্ম দেশনা সঠিক হইতে পারেনা।আল্লাহ্ এবং তাঁহার রাসুল হইলেন বিশ্বাসীগণের মাওলা। “মাওলা” অর্থ আল্লাহ্র নিয়োজিত প্রভু। ইহা আল্লাহ্র দেওয়া প্রভুত্ব যাহাকে ইংরেজীতে Overlord বলা হয়। ইহা হইল vesterd lordship.ইসলামে রহিয়াছে আল্লাহতন্ত্র বা নবিতন্ত্র যাহা রূপায়িত হইবে “মোমিনতন্ত্রে’’ অর্থাৎ সীমাবদ্ধ গণতন্ত্রে কিন্তু কখনও তাহা জনতন্ত্রে হইতে পারিবে না। ইহাকে রবতন্ত্রও বলা যাইতে পারে। এইরূপ সীমাবদ্ধ গনতন্ত্র বা মোমিনতন্ত্রের নেতা থাকিবেন আল্লাহ্র তথা নবির একজন প্রতিনিধি যাহাকে বলা হয় “ইমাম।’’ মোমিনতন্ত্রের শীর্ষস্থানে আল্লাহ্র মনোনীত ইমাম (বা নেতা) নিযুক্ত থাকিবেন। ইমামের নির্দেশের কারনেই এই মোমিনতন্ত্র সত্যিকার মোমিনতন্ত্র রূপে সুদুঢ় থাকিতে পারিবে। উচ্চ পর্যায় প্রতিষ্ঠিত মোমিন নেতা না হইলে “মোমিনতন্ত্র” টিকিয়া থাকিতে পারে না। এইজন্য ইসলামী রাষ্ট্রের নেতা অর্থাৎ ইমাম আল্লাহ্ এবং তাঁহার রাসুলের হাতে-গড়া ব্যক্তি হইতেই হইবে। মানবীয় চিন্তা আল-কোরআন অনুযায়ী ইসলামী রাষ্ট্রে রাজতন্ত্র নাই এবং তাহা নিষিদ্ধ। কোরানে আল্লাহকেই মানুষের রাজা বলিয়া ঘোষণা করিতেছেন। ইসলামে জনগণ দ্বারা নির্বাচনের গনতন্ত্র অথবা খেলাফততন্ত্র নাই। বর্তমান যুগের সমাজতন্ত্র অথবা কমিউনিজমতন্ত্রের স্বীকৃতিও সেখানে নাই। ইহা ছাড়া জনকল্যাণ উদ্দেশ্যে যে কোনরূপ নতুন তন্ত্র মানুষ উদ্ভাবন করিয়া লউক না কেন তাহা আল-কোরআন দ্বারা অনুমোদিত হইবে না, যদি উহা আল্লাহতন্ত্রের অনুযায়ী না হয়।রাজতন্ত্র বলিতে আমরা মানুষের একনায়কত্ব বুঝি, তাহা বংশগত একনায়কত্ব হোক বা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত একনায়কত্ব হোক। এইরূপ একনায়কত্ব ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহ্ ও তাঁহার রসুলের প্রতিনিধি স্থানীয় মোমিনের (সম্যক গুরু) এক নায়কত্বই কোরানের ব্যবস্থা। কারণ মোমিনের শাসন আল্লাহ্র শাসন। আল্লাহ্র ইচ্ছা সমাজে কার্যকরী তুলিবার ধারা বুঝিবার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নাই এবং উহার প্রতি তাহাদের শ্রদ্ধাবোধও থাকে না। থাকে শুধু মোমিনের।ইসলামে ব্যক্তি মালিকানা থাকিবে না, যেহেতু মালিক একমাত্র আল্লাহ্। আল্লাহ্র মেহমানরূপে মানুষের ভোগের অধিকার রহিয়াছে মাত্র। এইজন্য ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করিতে চাহিলে উহার সার্বভৌমত্ব আল্লাহ্র জন্যই ঘোষণা করিতে হয়। পরিচালকগণ ধন-সম্পদের ব্যবস্থামাত্র। সকল ব্যবস্থাপনার মূল উৎস আল্লাহ্ হইতে আসিবে। তিনটি শাখা বা উৎস হইতে এই সার্বভৌমত্ব আত্মপ্রকাশ করিবে, যথাঃ আল্লাহ্, রসুল, এবং উলিল আমর। নবির জাহেরি অনুপস্থিতিতে সর্বযুগে নবির মনোনীত রসুল, এবং নবি-রসুলগণের মনোনীত উলিল আমরগণ শাসন বিষয়ে পূর্ণ অধিকার প্রাপ্ত হইয়া থাকিবেন।
আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের দ্বারা অনুমোদিত মাওলাতন্ত্রই একমাত্র তন্ত্র যাহা বহিয়া আনিবে সর্বাঙ্গীন জনকল্যাণ এবং অসীম রহমত ও বরকত; ত্বরান্বিত করিবে দৈহিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধন। সর্ব প্রকার জাগতিক, বৈষয়িক ও পারত্রিক কল্যাণ বৃদ্ধি পাইবে এবং তখনই আল্লাহ্র ফজল ও করম লাভ করিয়া মানব জীবন সহজ, সুন্দর ও সার্থক হইয়া উঠিবে। মাওলাতন্ত্রই একমাত্র তন্ত্র যাহা সময় উপযোগী হইবে এবং সকল সমস্যা সমাধানের যথাযোগ্য কল্যাণকর বিধান দানে সক্ষম হইবে।
গুরুবাদী রাষ্ট্র দ্বারা চিহ্নিত বা তালিকাভুক্ত ব্যক্তি ব্যতীত অর্থাৎ মোমিন ব্যতীত কেহই কাহারও মোর্শেদ (অর্থাৎ নির্দেশদাতা ধর্মগুরু) হইতে যাইবে না। ইহার ফলে পীরপ্রথা বা গুরুবাদ দোষমুক্ত হইয়া সমাজকে ধর্মজ্ঞানে বলিয়ান করিয়া তুলিবে। মোমিনের অনুমোদন ব্যতীত গায়কগণ কোন প্রকার মিথ্যা ধর্মীয় কাহিনী গাহিতে পারিবে না, কারণ ইহাতে ব্যাপকভাবে মানুষ বিভ্রান্ত হইয়া থাকে।
৪. দায়েমি সালাতঃ –
আত্মদর্শন উদ্দেশ্য শেরেক হইতে মুক্ত হইবার জন্য দায়েমি সালাত পালনের আহ্বান।সালাত বলিতেই দায়েমি সালাত বুঝায়। আল্লাহ্ ও তাঁহার রসুলের সঙ্গে সংযোগ প্রচেষ্টার নাম সালাত। রসুলের সংযোগই আল্লাহ্র সংযোগ। এই সংযোগ অর্থাৎ সালাত যে ব্যক্তি পালন করে তাহাকে মুসল্লি বলে। মুসল্লির পরিচয় দিতে যাইয়া কোরানে বলা হইয়াছে সেই ব্যক্তি মুসল্লি, যে ব্যক্তি দায়েমি সালাত পালন করে (মুসল্লির সংজ্ঞা ও তাঁর পরিচয় দ্রষ্টব্য ৭০:২২-৩০,৩২-৩৫). ইহাও একটি কারণ যাহার জন্য কোরানে পাঁচ বা ছয়বারের ওয়াক্তিয়া সালাতের উল্লেখ নাই। কোরান মূলনীতি প্রকাশক। খণ্ড খণ্ড পাঁচবেলার নামাজ কোরানে অগ্রাহ্য। একটানা দায়েমি সালাতের নির্দেশ দান করা কোরানের লক্ষ্য।
কর্মই সালাতের উপদান। এই কারণে ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলিয়াছেনঃ “সম্যক কর্ম সম্যক সময়ে যথাবিহিত সম্পাদনের নাম সালাত।” সকল কর্ম ও চিন্তাকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে তাহার স্বরূপকে জ্ঞান দ্বারা বিস্তারিত দেখিবার নাম সালাত। কর্মকে যতই ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করিয়া দেখা যায় ততই সালাতের গভীরতা আসে।
আনুষ্ঠানিক ওয়াক্তিয়া সালাত হইল গুণ-কীর্তন, আর দায়েমি সালাত হইল জ্ঞানগুণ অর্জন।
সালাতের মূলনীতিকে জীবনে রূপায়িত করার ব্যবস্থা হিসাবে আনুষ্ঠানিক পাঁচবেলার বাধ্যতামূলক এবং ভোররাত্রের একবেলা তাগিদমূলক সালাত পালনের ব্যবস্থা রসুলুল্লাহ (আ.) দান করিয়া গিয়াছেন, যেন মানুষ তাহার সারাদিনের কর্মগুলিকে আল্লাহ্র এবাদতে রূপান্তরিত করিয়া তুলিতে পারে। মুসল্লি হওয়ার জন্য কোরান মজিদের দায়েমি সালাতের নির্দেশ দিতেছেন। কাজেই ধর্মীয় ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠিত না হইলে সরকারী কর্মচারীগণ দায়েমি সালাত পালন করিয়া মুসল্লি হইতে পারিবেন না। ইহার কারণ যে সময়টুকু তাহারা সরকারের কাজে লিপ্ত থাকিবে সেই সময়টুকু সালাতরূপে গণ্য হবে না। এবং তাহা আল্লাহ্র এবাদতরূপে গণ্য হয় না যতকাল সমগ্র কর্ম এবাদতরূপে গৃহীত না হয় ততকাল মুসল্লিরূপে এবং সৎকর্মশীল দাসরূপে আল্লাহ্ গ্রহণ করেন না।
এই জীব ও জড় জগতের উদ্ভাবনের মূল কারণই হইল মানুষ নামক জীবকে জীবের ঊর্ধ্বে করিয়া আল্লাহ্র শক্তিশালী স্তরের সহিত মিলাইয়া লওয়া। মানুষের মধ্যে দুইটি স্তর, যথাঃ জ্বীন ও ইনসান। পশু প্রবৃত্তির ইন্দ্রিয়পরায়ণ মানুষ হইল জ্বীন পর্যায়ের। আর মোমিনের নিকট সমর্পণকারী ও মোমিনদের অনুসরণকারী মানুষ হইল ইনসান পর্যায়ের। এই উভয় প্রকার মানুষকে মোমিনগণ সালাত শিক্ষা দানের মাধ্যমে অবতার পর্যায়ে উন্নীতকরণের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। এই কার্য সমাধা করিবার জন্যই একটি ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্র বানাইয়া লওয়ার প্রয়োজন, যাহাতে সালাতের শিক্ষা নির্বিঘ্নে দান করা যায়। নতুবা দুনিয়াদার মানুষ মমিনগনকে এবং তাঁহাদের অনুসারীগণকে আক্রমণ করিয়া মারিয়া ফেলে অথবা তাঁহাদের সালাত অনুশীলন কার্যক্রমকে কঠিন ও কষ্টসাধ্য করিয়া তুলে। তাই ইসলামী রাষ্ট্রে গঠনের মূল লক্ষ্যই হইল সালাত শিক্ষা দান করা। সালাত কর্ম যতক্ষণ দায়েমী না হয় ততক্ষণ একজন সাধকের মুক্তি আসে না।শুরুর পর্যায়ে সালাতকে দায়েমী করিবার জন্য একজন মানুষকে তাহার দৈনন্দিন বৈষয়িক কাজকর্ম বন্ধ রাখিয়া একজন মোমিন গুরুর নির্দেশমত ঘরে এবং মসজিদে বসিয়া সালাত প্রশিক্ষণ লইতে হয়। এই জন্যই নবী-রসুলগণ প্রতি সাতদিনের যেকোন একটি দিনকেই তাই সপ্তম দিবস হিসেবে গ্রহণ করা যাইতে পারে। রাষ্ট্রের সবাই এই নির্দিষ্ট দিনে নিজ নিজ মোমিন গুরুর নির্দেশমত সালাত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করিলে সামাজিক কার্যক্রম অচল হইয়া যাইতে পারে, তাই কিছু লোক দৈনন্দিন কাজকর্ম চালিয়ে যাইবে এবং তাহাদের জন্য সপ্তাহের অন্য কোন একটি দিন বৈষয়িক কাজকর্ম হইতে অব্যাহতি দিয়া দায়েমী সালাতের ব্যবস্থা করিতে হইবে।এইভাবে সপ্তাহের একটি দিনে যখন একটি মানুষ নিরবচ্ছিন্ন সালাত প্রশিক্ষণে আগাইয়া যায়, তখন ধীরে ধীরে ২৪ ঘণ্টার একটি দিনের পুরো ২৪ ঘণ্টাই সে নিরবচ্ছিন্নভাবে সালাতী হালে থাকিতে অভ্যস্ত হইয়া যায়। ইহা সম্পন্ন হইলে সপ্তাহের অন্য ছয়টি দিনেও তাহার এই সালাতি হাল বিস্তার লাভ করে।এই পর্যায়ে তাহাকে আর বৈষয়িক কার্যক্রম হইতে বিরত হইবার প্রয়োজন হয় না; বরং তাহার উঠা-বসা, খাওয়া-দাওয়া, লেনদেন, ঘুম-জাগরণ ইত্যাদি সমস্ত কাজেই সালাত ক্রিয়া বিস্তার লাভ করিতে থাকে। এইভাবে একজন মানুষের জীবনে দায়েমী সালাত প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
*গুরুকেন্দ্রিক সালাতের আত্মিক অনুশীলনের কথা কোরানে সর্বত্র পরিব্যক্ত আছে। সালাত প্রক্রিয়ার সাহায্যে জন্মান্তরবাদের পরিচয় জ্ঞান পরিস্ফুট হইয়া উঠে এবং বিষয়-দর্শনের উপর জ্ঞানচক্ষু উদিত হয় বা উন্মীলিত হয়। এই সকল কথা কোরানে সর্বত্র থাকা সত্ত্বেও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করিলে কোরানের কোন দর্শন উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। বস্তুবাদী অর্থের মধ্যে অসংখ্য আত্মবিরোধী ভাব এবং গরমিল বিদ্যমান।
(দ্রষ্টব্য *https://www.youtube.com/watch?v=xJhXXASGzZk)
৫. রূপক ভাষাঃ – কোরানুল হাকিমের অনেক কথাই মূলত রূপক করিয়া ব্যবহার করা হইয়াছে। রূপক অর্থ বুঝিয়া পাঠ করিবার চেষ্টা করিলে ইহার গভীর জীবন দর্শন উপলব্ধি করা যাইবে এবং মনের সৌন্দর্যবোধের উৎকর্ষ লাভ হইবে। ব্যাপকভাবে রূপক ভাষার ব্যবহার ইহার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ইহাতে সাহিত্যিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাইয়াছে। ভাব-গাম্ভীর্য সৃষ্টি করিয়া সর্বসাধারণের চিন্তা-চেতনা হইতে অর্থাৎ ইতর জনতা হইতে কৌশলের সহিত ইহার তথ্য ও তত্ত্ব দূরে রাখিয়া ইহার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হইয়াছে। রূপকভাবে তুলনার অবতারণা করিয়া এক কথাদ্বারা অন্য কথা বুঝাইবার পদ্ধতি গ্রহণ করা হইয়াছে। এই পদ্ধতি মোতাশাহেবা। আল্লাহ্ এবং তাহার মনোনীত খাস ব্যক্তিগণ যাহাদিগকে জ্ঞানের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন তাঁহারাই কেবল রূপক কথার সঠিক পরিচয়দান করিতে সক্ষম। তাহাদিগ হইতে ব্যাখ্যা গ্রহণ না করিলে কোরানের ও কেতাবের কোনও ব্যাখ্যাই সঠিক হইবে না। তাঁহারা ব্যতীত অন্য সবার অন্তরে বক্রতা রহিয়াছে। সঠিক পথে চিন্তাধারা পরিচালনা করিবার শক্তি যাহাদের নাই, ধর্ম চালনার অধিকার তাহারা হস্তগত করিয়া রাখিলে ধর্মজগতে ‘ফেৎনা’ অর্থাৎ অবাঞ্ছিত আপদের সৃষ্টি হইয়া থাকে। কোরানের এই মন্তব্য প্রচলিত ইসলাম ধর্ম বিষয়ে সর্বাংশে প্রযোজ্য। রূপক কথা না বুঝিবার ফলে যেই আপদ ও আবর্জনা স্তূপীকৃত হইয়াছে তাহার দুর্ভোগ আমাদিগকে ভুগিতেই হইবে।
রূপক গ্রহণ না করিয়া শুধু ‘মোহ্কামাত’ এর ধারা গ্রহণ করিলে ধর্মের প্রকাশ মাধুর্যপূর্ণ হইত না এবং তাহাতে জনসাধারণও ধর্ম গ্রহণ করিত না। সর্ব সাধারণের নিকট হইতে অনেকে কথা প্রচ্ছন্ন থাকিবার প্রয়োজন ছিল এবং এখনও আছে। রূপকের ব্যবহার প্রচ্ছন্নতা সৃষ্টি এবং সাহিত্য সৃষ্টির বিষয়ে অত্যন্ত উপযোগী।
ধর্ম অল্প কয়েকজন জ্ঞানী ব্যক্তির পরিচালনায় অবশ্যই থাকিতে হইবে। কিন্তু আজ লক্ষ লক্ষ তথাকথিত আলেম নামধারী ব্যক্তি ইহার ধারক ও বাহক সাজিয়াছে। ইহা আমাদের পূর্বকৃত অপরাধের জন্য অদৃষ্টের পরিহাস। অপর পক্ষে সূরা আল ইমরানের ৭নং বাক্যটি দ্বারা আল্লাহতালা কেতাব ও কোরানের মধ্যে অঙ্কিত জীবন বিধান দান করিবার এবং উহার ব্যাখ্যা প্রকাশের অধিকার দিয়াছেন শুধুমাত্র গুটিকয়েক সেই পর্যায়ের মানুষকে যাঁহার স্বর্গীয় জ্ঞানের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছেন অর্থাৎ মোমিন হইয়াছেন।
#কোরানে #মানবদেহঃ
কোরানুল হাকিমে জীবন দর্শন দুই প্রকারে প্রকাশ করা হইয়াছে। একটি ‘মোহকামাত’ অপরটি ‘মোতাশাবেহা’। অর্থাৎ নির্দেশমূলক উক্তি এবং রূপক উক্তি।
দেহের আরবি শব্দ হইল যিসিম ও যাসাদ। ইহা ছাড়া কোরানে মানবদেহকে অবস্থাভেদে বিভিন্ন প্রকার রূপক শব্দ অবলম্বন করিয়া প্রকাশ করা হইয়াছে। যথাঃ পৃথিবী, কবর, পর্বত, বিছানা, সাইদ অর্থাৎ উন্নত মৃত্তিকা, বৃক্ষ।
গুণের তারতম্য অনুসারে বা মর্যাদা অনুসারে বৃক্ষ শব্দটি তিন প্রকার নামে উল্লেখ করা হইয়াছে; যেমনঃ শাজারাতু তুয়া, সিদরাত এবং শাজারাতু জাক্কুম। জাহান্নামে অবস্থিত মানবদেহ জাক্কুম গাছ; জান্নাতে অবস্থিত মানবদেহ সিদরাত এবং লা-মোকামে স্থিত মানবদেহ তুয়াগাছে। তাহাছাড়া জান্নাতি দেহকে খেজুর গাছ, কলাগাছ, কণ্টক অপসারিত পদ্ম, ভিতরে রেশম খচিত গালিচা ইত্যাদি নানা প্রকার রূপকের সাহায্যে উল্লেখ করা হইয়াছে।
জান্নাতে অবস্থিত মানবদেহকে সিদরাত বলা হইয়াছে। মর্যাদা অনুসারে সিদরাত সাতটি স্তরপ্রাপ্ত। শেষ উন্নত স্তরকে (যাহা আকাশের অর্থাৎ মনের সপ্তস্তরে অবস্থিত থাকে তাহাকে) সিদরাতুল মোন্তাহা বলা হয়। উহার ঊর্ধ্বে মুক্তির স্তর। সেই স্তরে স্থিত মানবদেহকে বলা হয় ‘শাজারাতু তুয়া’। শাজারাতু তুয়ার ছায়ায় আশ্রিতগণ জান্নাতবাসী।
সাইদ অর্থ উন্নত মাটি, কবর। মানবদেহ মাত্রই সাইদ। সাইদ শব্দের সঙ্গে বিশেষণ যোগ করিয়া ইহাকে আরও তিন প্রকারে প্রকাশ করা হইয়াছে। যথাঃ ‘সাইদ তাইয়েবা’ অর্থাৎ পবিত্র উন্নত মাটি বা একজন কামেল পুরুষ। ‘সাইদান জালাকা’ অর্থাৎ গাছপালাহীন উন্নত মাটি বা নবজাত শিশু, যাঁহার স্মৃতিপট হইতে সমস্ত গাছপালা অর্থাৎ তাহার সৃজিত পূর্বস্মৃতি সকলই মুছিয়া ফেলা হইয়াছে। ‘সাইদান জুরুজা’ অর্থাৎ আহত ও নিঃস্ব উন্নত মাটি তথা একটি নবজাত শিশু যে নবজন্মের পূর্বে স্মৃতির মধ্যে আঘাত খাইয়া সমস্ত পূর্বস্মৃতি হারাইয়া নিঃস্ব হইয়া গিয়াছে। মানব মস্তিষ্কের স্মৃতিপটে যাহা কিছু জন্মায় বা টেপ হইয়া থাকে তাহাকে গাছপালা ও তৃণগুল্ম বলা হইয়াছে।
আপন দেহের মধ্যে সমাধিস্থ থাকাই ‘কাহাফে থাকা’ বলে। সুতরাং দেহকেই কাহাফ বলা হইয়াছে। কাবাগৃহকে মানবদেহের প্রতীক করা হইয়াছে। এইজন্য কাবাকে মসজিদুল হারামরূপে কেবলা করিবার আদেশ দেওয়া হইয়াছে। মসজিদুল হারামরূপে কাবার দিকে তাকাইয়া থাকা এবাদত।
মাওলা আলীর (আ.) দিকে তাকাইয়া থাকা আর মসজিদুল হারামের দিকে তাকাইয়া থাকা দুই-ই এবাদত (হাদিস)। ইহাদের মধ্যে প্রভেদ হইল এই যে, কাবাকে মসজিদুল হারাম হইল কাবার কল্পিত রূপ। অর্থাৎ ভাবিয়া লইতে হয়, সুতরাং মসজিদুল হারাম হইল কাবার কল্পিত রূপ। অর্থাৎ মনের দ্বারা আরোপিত স্থান মাহাত্ম্য। অপরপক্ষে শুদ্ধ একজন মানবদেহ মসজিদুল হারামের বাস্তব রূপ, যেহেতু সেই দেহের মধ্যে দুনিয়া-প্রবেশ নিষিদ্ধ হইয়া গিয়াছে। কল্পিত মসজিদুল হারামের ‘হুরমত’ (অর্থাৎ পবিত্রতা) জালেমগণ বিনষ্ট করিতে পারে কিন্তু শুদ্ধ মানবদেহের হুমরত (অর্থাৎ মানসিক শুদ্ধি) বিনষ্ট করিবার সাধ্য কাহারও নাই।
৬. ‘মদ’ - ‘মদ’ এর ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ‘মদ’ নামক দুই প্রকার সাঙ্কেতিক চিহ্ন ইঙ্গিতপূর্ণ অর্থ বহন করে। দীর্ঘায়িত পাঠ করিবার ইঙ্গিত ইহা বহন করে না। ছোট মদ দীর্ঘস্থায়ী ভাব বহন করে এবং বড় মদ চিরস্থায়ী এবং সার্বজনীন ভাব বহন করে।
------
কোরান সম্বন্ধে তিনটি মন্তব্যঃ
১. মানব জীবনের উত্থান-পতনের পরিপূর্ণ একটি আলেখ্য ব্যতীত কোরান অন্য আর কিছু নয়। ভবিষ্যতে স্বর্গ নরকের বয়ান কোরানে নাই। মানব জীবনে যাহা স্বর্গ ও নরকরূপে উপস্থিত আছে তাহারই বিশদ এবং সুক্ষ্ম বর্ণনা হইল বিজ্ঞানময় কোরান, তাই ইহা সম্পূর্ণ কেতাবভিত্তিক বিষয়।
২. আল-কোরানে প্রাচীন কোন ঘটনা খবর হিসাবে উল্লেখিত নাই, যেহেতু পৌরাণিক কোন ঘটনার সঙ্গে পরিচিত করা কোরানের উদ্দেশ্য নয়। পৌরাণিক ঘটনাগুলি শিক্ষামূলক দৃষ্টান্তরূপেই শুধু উল্লেখ করা হইয়াছে এবং সকল যুগেই মানব সমাজে সেইরূপ অবস্থার এবং সেইরূপ ঘটনার উদয় হইতেছে। এইসবের সমাধানের উদ্দেশ্যেই সেইসবের বর্ণনা বিধৃত হইয়াছে।
৩. কথার বা ঘটনার পুনরাবৃত্তি কোরানে নাই। যাহা আছে বলিয়া মনে হয় তাহার প্রত্যেকটির ভাবমূর্তি অন্যটি হইতে ভিন্ন প্রকার বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ। অতএব, আল-কোরানের উপর পুনরাবৃত্তির অপবাদ কোরান বিষয়ে অজ্ঞলোকের মিথ্যা উক্তি ব্যতীত আর কিছু নয়।
(কোরান দর্শনঃ সদর উদ্দিন আহ্মদ চিশতী)
ইয়া মুর্শিদ! আপনার অপার করুনা আজ এই জ্ঞান সগরে স্নান করাইলেন। যারা এর উদ্যোক্তা তাদের মুক্তি ও কল্যাণে আপনার করুনা প্রার্থী ...
ReplyDeleteএকটা বিষয় একটু দেখুন তো।।নিচের কোট করা লেখার অংশ টুকু দেখুন।।
"----------ইনসানগণ আল্লাহ্ ও রসুলের নীতিবাদ গ্রহণ করিলে অধঃপতিত হয়। আল্লাহ্ ও তাঁহার প্রতিনিধিগণ জীবগণকে ‘খালাকা’ করেন ইনসানিয়াতের দিকে আর শয়তান ও তাহার দলীয়গণ ইনসানকে ‘খালাকা’(*4) করে "
পশুত্বের দিকে।"
-- গ্রহণ এর পর কি একটা " না " ছুটে গেছে মনে হয় না?????