Sunday, 24 May 2015

কারবালা পরবর্তী ঘটনা

0 Comments
ভূমিকা
“উফ্ এ কালো মেঘে ঢাকা অমাবস্যার রাত। চতুর্দিকে ভীতিকর আঁধার আর ভয়ানক নিস্তব্ধতা! পরš‘ এ ভয়াল বিরান ভূমিতে মানুষের এ শব্দ কোত্থেকে আস্ছে ”। একজন মুসাফির আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আদমের বেটা ! তুমি জনবসতি ছেড়ে এখানে কোথায় এসে গেলে? কেউ একজন উত্তর দিল, নিজে আসিনি, দুর্ভাগ্য টেনে নিয়ে এসেছে। কিš‘ এ ঘন আঁধারে তুমি হোঁচট খাবে, তোমার সন্তানদের হিংস্র জš‘ থাবা মেরে নিয়ে যাবে। তোমার কি প্রাণের নিরাপত্তারও চিন্তা নেই?কাফেলাপতি বল্লেন, হোঁচটতো খেয়েই বসেছি, আবারও কি হোঁচট খাব? হোঁচট না খেলে আমার কাফেলা এখানে মাথা ঠুকছে কেন? নিরাপত্তার চিন্তারকথা বলোনা, এটি বড়ই বেদনাদায়ক অধ্যায়। মুসাফির বল্লেন, তুমি কি বলছো? একটু খুলে বল। তোমার কথায় মনে হ”েছ যে,তোমার পরাভূত জীবনের এমন কোন গভীর রহস্য রয়েছে, যা তুমি গোপন করছো। কাফেলাপতি শীতল শ্বাস নিয়ে বল্লেন, হ্যাঁ এমন কিছু ধরে নাও! অধিকš‘ তুমি আমার ব্যর্থতার দুঃখময় কাহিনী শুনে কি করবে? এ উপাত্যকার সহস্র বছর চলে গেল, আমরা উ™£ান্ত ঘুরছি। তোমার মত বহু সহমর্মি পথিক এ পথ দিয়ে গিয়েছেন এবং কিছু সময় আমাদের সাথে অপেক্ষা করেছেন। তোমার মত তারাও আমাকে এ বিপদসংকুল বন্দিখানা হতে বের করার চেষ্টা করেছে। পরš‘ আমি যখন মুসিবতের হৃদয়বিদারক কষ্ট তাদের বল্লাম, তখন একথা বলে চলেগেলেন যে, তোমার এ জখমের ঔষধ মানুষের কাছে নেই। অপেক্ষা কর, হয়তো আসমান হতে তোমার জন্য কোন প্রতিষেধক অবতীর্ণ হতে পারে। এ জন্য বলছি যে, বায়না ধরোনা। আমাদের অবাককরা শোচনীয় কাহিনী শুনে তুমিও ওই কাজ করবে, যা তোমার পূর্বগামীরা করেছে। তুমি একজন মুসাফির, যাও নিজের পথ ধর। তোমার সমবেদনার জন্য বহু বহু কৃতজ্ঞতা। কাফেলার দলপতি ¯ি’র সিদ্ধান্তের ভঙ্গিতে বল্লেন, “এখনতো তোমার কথাআমাকে আপাদমস্তক আগ্রহ বানিয়ে দিয়েছে। এখন আমি তোমাদের দুঃখগাঁথা শুনা ব্যতীত এখান হতে নড়তে পারবোনা। বিশ্বাস কর, আমি ওই পথিকদের অš‘র্ভূক্ত নয়, যারা তোমার সজল নয়নে শুধু আপনআঁচল রেখে চলে গিয়েছে। আমি নিজেও দুঃখ-বেদনার দোলনায় পালিত হয়েছি। এ কারণে তোমার হৃদয়ের ছটফট রহস্য আমার নিকট গোপন থাকতে পারেনা। এখন তুমি আপন দুঃখগাঁথা শুনাতেই হবে”। মুসাফির স্নেহমাখা কন্ঠে বলে গেলেন বাক্য কয়টি। মানব স্বভাবে কতইনা মিল থাকে। ঠিক এ চিত্রই ছিল ওই সব পথিকদেরও, যারা তোমার ভাষায় আমার সজল চোখে আপন আঁচল রেখে চলে গিয়েছে। তারাও আমার পরীক্ষার কাহিনী শুনার জন্য এরূপ ব্যাকুল ছিল, ঠিক তুমি যেমন। আগ্রহ প্রকাশের ক্ষেত্রে তুমি ও তারা সম্পূর্ণ এক বরাবরদেখা যা”েছ। পরবর্তী পর্যায়ে তুমি তাদের থেকে ভিন্ন হলে আমি বলতে পারি। “যা হোক, তুমি আমার কাহিনী শুনতে একগুঁয়ে হয়েছো তো শুন! পরš‘ এ আশায় বলছিনা যে, আমাদের সমস্যার জট খুলে দেবে, বরং শুধু এ জন্যই বলা যে আমাদের কাফেলা হতে ভগ্নান্তর যেন না যাও”। এতটুকু কথোপকথনের পর কাফেলার  
লুন্ঠিত কাফেলা কারবালার দ্বিপ্ররান্তের লোমহর্ষক কাহিনী শুনার আগে এক হৃদয়বিদারক ও বেদনাদায়ক দৃশ্য দৃষ্টির সামনে নিন। সকাল হতে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত খান্দানে নবূয়তের নয়ন মণি ও বংশের প্রদীপ এবং সকল সমর্থক-সাহায্যকারী একে একে শহীদ হয়ে গেলেন। সবাই শেষ নিশ্বাসান্তে হৃদয়ের আঘাত জর্জরিত ময়দানে এক একটি নূতন দাগকেটে গেল। প্রত্যেক ধড়ফড়মান লাশের শেষ গড়গড়ায় ইমামে আলী মকাম ময়দানে পৌছে কোলে তুলে নিয়ে তাবু পর্যন্ত আনেন, জানুতে মাথা রেখেই প্রাণোৎসর্গী প্রাণ সপে দেন। দৃষ্টির সামনে যে লাশের ¯‘প, তাতে কলিজার টুকরাও আছে নয়নের তারাও, ভাই-বোনের আদরের দুলালও এবং পিতার চিহ্নও রয়েছে। ওই গোর-কাফনহীন লাশের মাতম কে করবে, কে অশ্র“ ভাসাবে এবং কে জ্বলন্ত আঁখিতে সান্তনারপ্রলেপ দেবেন? একা এক হুসাইন আর দুই জগতের আশা-আকাঙ্খার ভিড়; এক অত্যাশ্চর্য বেদনাবিধুর অসহায়ত্বের জগৎ। পদে পদে এক নূতন কিয়ামত খাঁড়া হ”েছ দমে দমে দুঃখ বেদনার নূতন নূতন পাহাড় ভেঙ্গে পড়ছে। অন্য দিকে হরমে নবূয়তের রমণীগণ রয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (দ.)’র কন্যারা রয়েছেন। শোকাহতমা ও ব্যথাতুর বোন রয়েছেন। তাদের মাঝে উনারাও আছেন, যদের কোল শূণ্য হয়েছে, যাদের বক্ষহতে সন্তানের বি”েছদের আঘাত পৌঁছছে, যাদের কোল হতে দুগ্ধপোষ্য শিশুও ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, যাদের ভাই, ভাতিজা ও ভাগ্নের গোর-কাফনহীন লাশসামনে পড়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে। আধমরা শরীরে ছটফট করার শক্তিও অবশিষ্ট নেই। নারী জাতির মন এমনিতে কোমল হয়, টুকুআঘাতও সইতে পারেনা; তার ওপর আজ পাহাড় ধ্বসে পড়েছে। সবাই শাহাদতের পেয়ালা পান করেছেন। একা এক ইবনে হায়দারের সত্ত্বাই বাকিরয়েছেন, যিনি লুন্ঠিত কাফেলার শেষ ভরসা। হায়! এখন তিনিও সফরের প্র¯‘তি নি”েছন। তাবুতে হৈচৈ পড়ে গেল। কখনো বোনকে সান্ত্বনা দি”েছ, কখনো শহরবানুকে দীক্ষা দি”েছন, কখনো কলিজার টুকরো অসু¯’ আবেদকে গলায়লাগা”েছন আবার কখনো অল্প বয়সী বোন ও প্রিয় কন্যাদের প্রতি নৈরাশ্যভরা দৃষ্টিতে দেখছেন। আশা-নৈরাশ্যের দোলাচাল, দায়িত্বের তাড়া, রক্তসম্পর্কে দামান টানছে আর ঈমান বধ্যভূমির দিকে ডাকছে। কখনো এ ধারণা আসে যে, আমারপর তাবুবাসীর কি অব¯’া হবে? পরদেশে হরমের ইয়াতিম ও বিধবাদের সাথে শত্র“রা কেমন আচরণ করবে? অন্য দিকে শাহাদাতের আকর্ষণ, মিল্লাতের পবিত্রকরণও সত্য-প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব বর্শাগ্রে চড়েডাকছে। অবশেষে আহলে বায়তের কান্ডারী, বায়তুল্লাহর রক্ষক, নানাজানের শরীয়তের সংরক্ষক হযরত ইমাম হুসাইনও আপন শিরে কাফন বেঁধে রণে যেতে প্র¯‘ত হলেন। আহলে হরমকে ধড়ফড়াতে-ফুঁফাতে-কাঁদতে রেখে হযরত ইমাম শত্র“দের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। এবার একটু দাঁড়াও এবং চোখ বন্ধ করে দৃশ্যপট অবলোকন কর“ন। পুরো কাহিনীতে এটি ওই ¯’ান যেখানে মানুষের কলজে ফেটে যায় বরং পাথরের বক্ষ পানি হয়ে প্রবাহিত হতে শুর“ করে। তিন দিনের ক্ষুধার্ত-পিপাসার্ত মুসাফির একাকী বাইশ হাজার তরবারীর ভিড়ে, শত্র“দের পেশাদার খুনী চতুর্দিক হতে এগিয়ে আসছে। দরজায় দাঁড়িয়ে আহলে বায়তের পর্দানশীন রমণীরা অশ্র“ভেজা নয়নে এ দৃশ্য দেখছেন। ক্ষণে ক্ষণে দুঃখ-বেদনার অথৈ সাগরে অন্তর নিমজ্জিত হ”েছ। কখনো মুখ হতে চিৎকার বের“”েছ আবার কখনো চোখ বন্ধ হ”েছ। হায়রে সমর্পণ-সন্তোষের অরক্ষিত ময়দান! ফুলের পাপড়িতে পা রেখে চলাচলকারী শাহযাদীরা, আজ অঙ্গারের ওপর লুটে পড়ছে,যাদের সম্ভ্রমের ইঙ্গিতেডুবন্ত সূর্য পল্টে আসে, আজ তাদের আশার তরী দৃষ্টির সামনে ডুবে যা”েছ কিš‘ মুখ খুলছেনা। দর্শনার্থী চক্ষু আপন দেশ-নায়ক, আপন আশার কেন্দ্র, প্রিয় হুসাইনকে অনুশোচনা ভরা দৃষ্টিতে দেখছে যে, একটি মাত্র নিশানায় সহস্র তীর চলছে, তরবারী কোষমুক্ত হ”েছ, আকাশে বর্শার ফলা চমকা”েছ আর দেখতে দেখতেই ফাতেমার চাঁদ আড়ালে এসে গেল। আঘাতে চুরচুর, রক্তে রঞ্জিত সাইয়্যেদায়ে কায়েনাত খাতুনে জন্নাতের আদরের দুলাল যখনই ভূমিতে নিপতিত হল, জগতের বক্ষ কেঁপে ওঠল, কাবার দেওয়াল হেলে গেল, আকাশের আঁখি রক্তপাত করল,সূর্য লজ্জায় মুখ ঢেকে নিল এবং ধরিত্রীর সমস্ত আকাশ মাতম ও দুশ্চিন্তায় ভরে গেল। অপর দিকে পবিত্র আত্মাসমূহ ও দয়ার ফিরিশতাদের সমভিব্যাহারে শহীদে আযমের পবিত্র রূহ যখন উর্ধ্ব জগতে পৌঁছল, তখন চতুর্দিকে ইবনে হায়দারের ইমামত-সালতানাত-নেতৃত্বের জয়ধ্বনি বুলন্দ হ”িছল। এ দিকে তাবুতে চতুর্দিকে আগুন আর আগুন। ধৈর্য-সহ্যের ভান্ডার জ্বলছে, ইয়াতিম, বিধবা ও শোকাহতদের আহাজারিতে ধরিত্রীর কলজে ফেটে গেল, আশার রাজ্য লুুন্ঠিত হল। আহ! মাঝদরিয়া কিস্তির কান্ডারীও চলে গেলেন! এখন বনু হাশিমের ইয়াতিমরা কোথা যাবে? কার দিকে তাকাবে? নবূয়ত ঘরণার ওই শাহযাদীরা, যাদের পবিত্র গৃহে জিব্রাঈলও বিনানুমতিতে প্রবেশ করেনি, প্রত্যুষের সমীরণও যাদেরআঁচলের নিকট পৌঁছে আদবে নত হয়ে গতিপথ পাল্টাত; আজ কারবালার ময়দানে কে তাদের অন্তরঙ্গ, যাকে আপনদুঃখ-বেদনার কথা বলতে পারবে। একটু বুকে হাত দিয়ে চিন্তা কর“ন যে, আমাদের এখানে একজন মারা গেলে গৃহবাসীর কি অব¯’া হয়? সাহানুভূতিশীলদের ভিড় ওসাহায্যকারীদের ধৈর্যের দীক্ষা সত্ত্বেও অশ্র“ থামেনা, অ¯ি’রতার আগুন নিভেনা, আহাজারি ও ফরিয়াদের শোর কমেনা। ফের কারবালার ময়দানে অন্তঃপুরের শোকাহত রমণীদের ওপর কি বয়ে গেল;যাদের সামনে ছেলে, স্বামীও প্রিয়জনদের লাশের ¯‘প ছিল, যারা সমব্যথী, সাহানুভূতিশীলদের ভিড়ে নয় রক্তপিপাসু শত্র“ হিংস্র জš‘দের মজমায় ছিল। ইমাম আলী মকামের মস্তক দ্বিখন্ডিত করার পর কূফাবাসীরা পরণের জামা খুলে নিল। পবিত্র শরীরে বর্শার ৩২ আঘাত এবং তরবারীর ৩৪ ঘা ছিল। ইবনে সা’দের নির্দেশে ইয়াযিদী সৈন্যের দশ কাপুর“ষ খাতুনে জন্নাতেরকলিজার টুকরার লাশ ঘোড়ার খুরে দলিত করল। হযরত যয়নব ও শহরবানু তাবু হতে এ লোমহর্ষক দৃশ্য দেখে হুহু রবে কেঁদে ওঠলেন এবং চিৎকার দিয়ে ভূপতিত হলেন। অতঃপর শিমার ও ইবনে সা’দ সগর্জনে তাবুর দিকে বাড়ল।
বদবখত শিমার ভিতরে ঢুকে পর্দাবর্তী অন্তঃপুরবাসীদের চাঁদর ছিনিয়ে নিল, মাল-সম্বল লুটে নিল। হযরত যয়নব বিনতে আলী আত্মসম্ভ্রমবোধ ও অ¯ি’রতার আগুনে জ্বলে ওঠেবল্লেন, শিমার! তোমার চক্ষু কানা হয়ে যাবে। তুমি রাসূলুল্লাহর কন্যাদের পর্দাহীন করতে চা”ছ। আমাদের চেহরার হেফাজতকারী শহীদ হয়ে গেলেন। এখন দুনিয়ার বুকে আমাদের কেউ নেই। এটিমানি যে, আমাদের অসহায়ত্ব তোমাদের দুঃসাহসী করে দিয়েছে, কিš‘ কলেমা পড়ানোর অনুগ্রহও ভুলে গিয়েছ? পাষাণান্তর জালেম! মুহাম্মদ (দ.)’র ইজ্জতের অমর্যাদা করে আল্লাহর গজব ডেকে এনোনা। তোমাদের কি এতটুকু শরমও নেই যে, আমরা ওই রাসূলের দৌহিত্রী যিনি হাতেম তাঈ’র বন্দি কন্যাকে আপন চাঁদর দিয়ে দিয়েছেন। হযরত যয়নবের গর্জন শুনে অসু¯’ আবেদ টলতে-টলতে আপনবিছানা হতে ওঠে দাঁড়ালেন এবং শিমারের ওপর তরবারী চলাতে চাইতেই দুর্বলতা ও অক্ষমতায় ভূমিতে পতিত হলেন। তাঁকে ইমাম হুসাইন (রা.)’রশেষ নিশানা জেনে শিমার আপন সিপাহীদের নির্দেশ দিল যে, তাঁকেও হত্যা কর; যাতে হুসাইনের নাম-নিশানাও জগতের বুক হতে মুছে যায়। পরš‘ ইবনেসা’দ এ রায়ের সাথে একমত হলনা এবং এ বিষয়টি ইয়াযিদের নির্দেশের ওপরসীমাবদ্ধ রইল। সন্ধ্যা নেমে এল। ইয়াযিদী বাহিনীর সেনাপতি বিজয়-উল্লাসে মেতে ওঠল। রাত্রি এক প্রহর পর্যন্ত আনন্দ-উম্মাদনার মজলিস গরম রইল। এ দিকে তাবুর অধিবাসীদের জন্য এ মুসাফিরী সন্ধ্যা ক্বিয়ামত অপেক্ষা কম ছিলনা। বায়তুল্লাহর রক্ষকদের ঘরে প্রদীপও জ্বললনা। সমস্ত এলাকা শোকের ছায়ায় ঢাকা। বধ্যভূমিতে ইমামের দলিত লাশ গোর-কাফনহীন পড়ে রয়েছে। তাবুর নিকটে গুলশনে ফাতেমার দলিত-মথিত পুষ্পরাজির ওপর বেদনাদয়ক অনুশোচনা বর্ষিত হ”েছ। রাতের ভয়ানক ও ভীতিকর আঁধারে তাবুবাসীরা কেঁপে-কেঁপে ওঠছে। জীবনের এ প্রথম শোকহত রজনী হযরত যয়নব ও শহরবানুর পোহাতেই চা”েছনা। সারা রাত তাবু হতে হাঁফানি-ফুঁফানির শব্দ আসছিল। অনুতাপের ধোঁয়া ওঠতেছিল আর রূহজগতের আত্মাসমূহ অবতীর্ণ হতে ছিল। আজ প্রথম রাত ছিল যে, আল্লাহর ঘর সাজাবার জন্য অন্তঃপুরবাসীর সবকিছুই লুটে দিয়েছেন। পরদেশ, মর“ময়দান, বধ্যভূমি, মাটি আর রক্তে লেপ্টে থাকা চেহরা, মৃতেরঘর, নিকটেই অসু¯’ আবেদের কুঁই-কুঁই, ক্ষুধা-পিপাসার যন্ত্রণা, রক্তভুক জানোয়ারদের ভিড়, ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা, বিরহ-বি”েছদের আগুন; আহ! বক্ষবিদীর্ণকারী সকল উপকরণ বধ্যভূমিতে এ প্রথম রাতে উপ¯ি’ত। বড় মুশকিলে রাত পোহাল, আলো ফুটল। বেলা ক্ষাণিক গড়াতেই ইবনে সা’দ কতেক সিপাহী সহ উট নিয়ে এল এবং তার নগ্ন পিঠে যয়নব,শহরবানু ও যয়নুল আবেদীনকে সাওয়ার করাল। পুষ্পের ন্যায় কোমল হাতে বেড়ি লাগল। অসু¯’ আবেদকে মা ও ফুফির সাথে এমন ভাবে বেঁধে দিল যে, নড়াচড়ারও সাধ্য নেই। আরেকটি উটে অন্যান্য রমণী ও শিশুদের একই ভাবে বেঁধে তুলে দেওয়া হল। আহলে বায়তের এ লুন্ঠিত কাফেলা যখন কারবালার ময়দান থেকে বিদায় হ”েছ তখনকার প্রলয়ংকরী দৃশ্যপট লেখা সাধ্যাতীত। কারবালার ঘটনার এক চাক্ষুষ স্বাক্ষীর বর্ণনা যে, খুলী ফাতেমার কলিজার টুকরা হুসাইনের শির মোবারক বর্শাগ্রে লটকিয়ে অন্তঃপুরের বন্দিগনের উটের আগে আগে ছিল। পেছনে বাহাত্তর শহীদের মস্তক অন্যান্য পাপিষ্ঠরা নিয়ে চল্ল। খান্দানে রেসালতের এ লুন্ঠিত কাফেলা বধ্যভূমিঅতিক্রম কালে হযরত ইমাম (রা.)’র গোর-কাফনহীন লাশ এবং অন্যান্য শহীদগণের  জানাযায় দৃষ্টি পড়তেই আহলে বায়তের রমণীগণ ব্যাকুল হয়ে গেলেন। অন্তরের আঘাত সহ্য করতে পারলেননা। আহাজারিতে কারবালার ময়দান হেলে ওঠল। অসু¯’ আবেদ অতি অ¯ি’রতায় বারবার মূর্ছিত হ”িছলেন এবং হযরত শহরবানু তাঁকে সামলানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ক্বিয়ামতের এ হৃদয়বিদারক দৃশ্য হেরে পাথরের বক্ষও বিদীর্ণ হয়ে গেল। ফাতেমা তন্বয়া যয়নবের অব¯’া সবচেয়ে শোচনীয় ছিল। অসহনীয় মনোবেদনায়অ¯ি’র হয়ে তিনি মদীনার দিকে মুখ করে হৃদয় বিদীর্ণ করা আওয়াজে নানাজানকে ডাক দিলেন। “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আহ! আপনার ওপর আসমানের ফিরিশতাদের সালাম। এ দেখুন আপনার প্রিয় হুসাইন মর“বালিতে পড়ে আছে। মাটি আর রক্তে মলিন শরীর, টুকরো-টুকরো লাশ; গোর ও কাফন পর্যন্ত পায়নি। নানাজান! আপনার সমস্ত আওলাদ কতল করে দেওয়া হয়েছে। বায়ু তাদের ওপর বালি ওড়া”েছ। আপনার মেয়েরা বন্দি, হাতবাঁধা, দড়িতে কষা। পরদেশে তাদের কোন বন্ধু-বান্ধব নেই। নানাজান! আপনার ইয়াতিমদের ফরিয়াদ শুনুন”। ইবনে জরীর বর্ণনা করেন যে, দোস্ত-দোশমন নির্বিশেষে হযরত যয়নবেরএ আহাজারিতে অশ্র“সিক্ত হয়নি এমন কেউ ছিলনা। বন্দি আহলে বায়ত অশ্র“সিক্ত নয়ন আর হিয়া বেরিয়ে আসা হেঁচকি নিয়ে কারবালা হতে বিদায় হয়ে কূফার দিকে রাওয়ানা হলেন। সন্ধ্যা নেমে এল। এক পাহাড়ের পাদদেশে ইয়াযিদী সৈন্যদের নেতারা তাবু ফেল্ল। বন্দি আহলে বায়তদের আপন আপন বাহন হতে নামানো হল। চাঁদনী রাত ছিল, রশিতে বাঁধা হেরমের এ কয়েদিরা সারা রাত দীর্ঘশ্বাস আর ফুঁফিয়ে-ফুঁফিয়ে কেঁদেছিল। সিজদার জন্য অ¯ি’র ললাট ¯’াপনের জন্যও জালেমরা বাঁধন ঢিল করলনা। শেষ প্রহরে হযরত যয়নব মুনাজাতে মশগুল ছিলেন। অমনি মুহূর্তে ইবনে সা’দ নিকটে এসে বিদ্র“পের সুরে জিজ্ঞাসাকরল, ‘কয়েদীদের কি অব¯’া?’ কয়েক বার জিজ্ঞাসার পর হযরত যয়নব মুখ ঢেকে উত্তর দিলেন, আল্লাহর শোকর। নবীর বাগান লুন্ঠিত হয়েছে, তাঁর আওলাদদের বন্দি করা হয়েছে। রশিতে সমস্ত শরীর নীলাভ হয়ে গিয়েছে। এক অসু¯’, যে আধমরা হয়েছে, তার প্রতিওতোমাদের দয়া হলনা। এখন আমাদের অসহায়ত্বের তামাশা দেখানোর জন্য ইবনে যিয়াদ ও ইয়াযিদের রাজদরবারে নিয়ে চলছো। এতটুকু বলতে বলতে তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। হযরত জয়নুল আবেদীন ফুফিকে সান্ত্বনা দিয়ে বল্লেন, হন্তারকের কাছে জোর-জুলুমের অনুযোগ কি ফুফিজান! “বেশ একটিই আকাঙ্খা যে, আব্বাজানের শির কেউ আমার কোলে এনে দিক, আমি তাকে বুকে লাগাব”। ইবনে সা’দ বল্ল, কোলে নয়,তোমার পদপ্রান্তে এনে দিতে পারি, রাজি থাকলে বল। জালেম আবার ক্ষত¯’ানে নুনের ছিটা দিল। ফের হেরমের কয়েদীরা অ¯ি’র হয়ে ওঠলেন। ব্যাকুলতায়অস্ফুট এক আওয়াজ কানে এল।

“বদবখত! জন্নাতের যুবককুল সরদারের সাথে বেয়াদবী করছ। তোমার কি খবর আছে যে, এ কর্তিত মস্তক এখনও দু’জগতের মালিক। একটু ভাল করে দেখ,রাসূলের চুমোর ¯’ানে নূর ও তজল্লীর কি রূপ বারি বর্ষণ হ”েছ। শুধু শরীরের সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে আর্শের সম্পর্কতো অটুট রয়েছে।” এ আওয়াজে চতুর্দিকে নীরবতা ছেয়ে গেল। ওই বেদনাভারাক্রান্ত অব¯’ায় বন্দি আহলে বায়তের লুন্ঠিত কাফেলা কূফায় পৌঁছল। লজ্জা ও ভয়ে ইবনে সা’দ শহরের বাইরে জঙ্গলে অব¯’ান নিল। রাতের নীরবতায় হযরত যয়নব মুনাজাত ও দু‘আয় নিমগ্ন ছিলেন, ক্ষীণ এক শব্দ কানে এল, “বিবি আমি আসতে পারি?” দৃষ্টি তলে দেখলেন এক বৃদ্ধা মাথায় চাঁদর দিয়ে মুখ লুকিয়ে সামনে দাঁড়ানো। অনুমতি পেতেই কদমে লুটে পড়ল এবং সকাতরআবেদন জানাল, “আমি এক নিঃস্ব-দুঃখী মেয়ে। ক্ষুধার্ত-পিপাসার্ত আলে রাসূলের জন্য অল্পটুকু আহার্য ও পানীয় নিয়ে এসেছি। বিবি আমি পর নই, বহুদিন পর্যন্ত শাহযাদীয়ে রাসূল সাইয়্যেদাহ ফাতেমার দাসত্বের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এটি ওই সময়ের কথা, যখন সাইয়্যেদার কোলে একটি তুলতুলে আদুরে কচি মেয়ে ছিল; যার নাম যয়নব।” হযরত যয়নব আবেগ সংবরণ করে উত্তর দিলেন, তুমি এ জঙ্গল ও পরদেশে আমাদের আতিথ্য করেছ, আমাদের দু‘আ তোমার সঙ্গে আছে; আল্লাহ তোমাকে উভয় জগতে আনন্দিত করবেন। বুড়ি যখন জানতে পারলেন যে, ইনিই যয়নব, তখন এক চিৎকার দিয়ে গলার সাথে লেপ্টে গেল এবং নিজ প্রাণবিনতে রাসূলের কদমে সপে দিল। প্রেম ও আন্তরিকতার ইতিহাসে আরো একটি নূতন শহীদ যুক্ত হলেন। দ্বিতীয় দিন যুহরের সময় আহলে বায়তের লুন্ঠিত কাফেলা কূফার জনবসতিতে প্রবেশ করলেন। বাজারের দুই দিকে পাষাণ তামাশাদর্শীদের ভিড় লেগে ছিল। খান্দানে নবূয়তের রমণীগণ লজ্জা-সম্ভ্রমে কুঁকড়ে যা”িছলেন। সিজদায় মাথা নত করে নিলেন যেন নিস্পাপচেহরায় অপরিচিতের দৃষ্টি না পড়ে। দুঃখ-বেদনায় আঁখি সজল ছিল, হৃদয় হুহু করে কাঁদছিল। এ অনুভূতিতে আঘাতের জ্বালা আরো বেড়ে গেল যে, কারবালার ময়দানেযে ক্বিয়ামত আসার ছিল এসে গিয়েছে, এখন মুহাম্মদ আরবী মর্যাদা গলি-গলি ফেরানো হ”েছ। কলেমা পড়–য়া উম্মতের আত্মমর্যাদাবোধ কবর¯’ হয়ে গিয়েছিল। আনন্দের উৎসব সমস্ত কূফা উলঙ্গ নাঁচছে। ইবনে যিয়াদের লজ্জাহীন সিপাহী বিজয়েরস্লোগান দিতে দিতে আগে আগে চলছে। আহলে বায়তের বাহন কিল্লার নিকটে পৌঁছলে ইবনে যিয়াদের মেয়ে ফাতেমা আপন মুখে নেকাব ঢেলে বের হল এবং অনতিদূরে নীরব দাঁড়িয়েঅনুশোচনাদগ্ধ দৃষ্টিতে এদৃশ্য দেখছে। ইবনে যিয়াদ ও শিমারের নির্দেশে আহলে বায়তের রমণীদের অবতরণ করা হল। অসু¯’ আবেদ মা ও ফুফির সাথে বাঁধা ছিল। জ্বরের প্রকোপে দুর্বলতা ও ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছেছিল। উট হতে নামানোর সময় অচৈতন্য এসে গেল এবং বেহাল হয়ে ভূমিতে পড়ে গেল। মস্তক জখম হল এবং রক্ত ফোয়ারা বইতে লাগল। দেখেই হযরত যয়নব অ¯ি’র হয়ে গেলেন। অন্তর ভারাক্রান্ত হল, ছলছল নয়নে বল্লেন, আলে ফাতেমার এক মাত্র অসু¯’ আবেদের রক্তই সংরক্ষিত ছিল। কূফার জমিনে এ ঋণও পরিশোধ হয়ে গেল। হেরমের বন্দিদের সাথে পুরোনো একটা চাঁদর লেপ্টে হযরত যয়নব এক কোণায় বসা ছিলেন, অন্যান্যরা তাঁকে নিজেদের মধ্যখানে নিয়ে নিলেন। ইবনে যিয়াদের দৃষ্টি পড়তেই জিজ্ঞাসা করল, এ মহিলাটি কে? বার কয়েক জিজ্ঞাসার পর এক দাসী উত্তর দিল, “যয়নব বিনতে আলী”। ইবনে যিয়াদ হযরত যয়নবকে সম্বোধন করে বল্ল, আল্লাহ তোমাদের উদ্ধত সরদার এবং তোমাদের আহলে বায়তের অবাধ্য বিদ্রোহীদের দিক থেকে আমার দিল ঠান্ডা করে দিয়েছে। এ কষ্টদায়ক বাক্যে হযরত যয়নব নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না। অ¯ি’রতায় কেঁদে ওঠলেন। “আল্লাহর শপথ! তোমরা আমাদের সরদারকে কতল করেছ, আমাদেরখান্দানের নিশানা মুছে দিয়েছ, আমার শাখা কেটে দিয়েছ, আমার মূল উপড়ে ফেলেছ; যদি এতে তোমার অন্তর ঠান্ডা হতে পারে হোক”। অতঃপর ইবনে যিয়াদের দৃষ্টি অসু¯’ আবেদের ওপর পড়ল। সে তাঁকে হত্যা করেদিতে চা”িছল যে, হযরত যয়নব ব্যাকুল হয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠলেন। “আমি তোমাকে আল্লাহর দোহাই দি”িছ, যদি তুমি তাঁকে কতল করতেই চাও তবে আমাকেও তাঁর সাথে হত্যা করে ফেল”। ইবনে যিয়াদের ওপর দীর্ঘক্ষণ মূর্ছাভাব চালু ছিল। সে লোকদের সম্বোধন করে বলল, “রক্তেরসম্পর্কও কেমন আশ্চর্য ব¯‘, আল্লাহর শপথ! আমি নিশ্চিত বিশ্বাস করি যে, ইনি সত্যই সন্তানের সাথে মরতে চায়। আ”ছা তাকে ছেড়ে দাও। সেও খান্দানের রমণীদের সাথে যাক। (ইবনে জরীর) ইবনে যিয়াদের দরবার অত্যন্ত জাঁকজমক করে সাজানো হয়েছিল। বিজয়েরনেশায় মাতাল ইবনে যিয়াদ আপন সিংহাসনে বসে আপন ফৌজের নেতাদের মুখে কারবালার ঘটনা শুনছে। সামনে একটি থালে ইমামে আলী মকামের শির মোবারক ছিল। ইবনে যিয়াদের হাতে একটি লাঠি ছিল। সে বারবারহযরত ইমামের ওষ্ঠদ্বয়েরসাথে বেয়াদবী করতে করতে বলছিল যে, এ মুখেই খেলাফতের দাবীদার ছিলে। দেখলেতো আল্লাহর ফয়সালা, সত্যের শির বুলন্দ হয়েছে, বাতিলের অপমান-লাঞ্ছনা ভাগ্যে জুটেছে। আল্লাহর রাসূলেরসাহাবী যায়েদ বিন আরকম (রা.) তখন দরবারে উপ¯ি’ত ছিলেন। তিনি এ বেয়াদবী সহ্য করতে পারলেন না। ভক্তির আবেগে চিৎকার দিয়ে ওঠলেন। “জালেম! এ কি করছ? লাঠি সরিয়ে নাও! নবীর সম্পর্কের সম্মান কর! আমি নবীকে বহুবার দেখেছি এ মুখে চুমো খেতে”।


দুই ইয়াতীমের রধির আজ খান্দানে নবূয়তের সুপ্রিয় আঁখি ও রবি হযরতইমাম মুসলিম (রা.)’র পবিত্র রক্তে কূফার ভূমি রঞ্জিত হয়ে গিয়েছিল। নবীযাদার আগমনের শুভে”ছায় নয়নের গালিচাবিস্তারণকারী জনপথ তাঁর ছট্ফট্রত লাশের সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে। তরবারীর ধার, বর্শার ফলা ও তীরের নখে এখনও  রক্তচিহৃ মওজুদ। ইবনে যিয়াদের নির্দেশে হযরত ইমাম মুসলিমের লাশ মোবারক রাজপথে টাঙ্গিয়েদেওয়া হয়েছে। কয়দিন ধরেই লটকানো আছে আর নবী (দ.)’র কলেমা পড়–য়ারা খোলা চোখে এ ভয়াবহ দৃশ্যদেখতে আছে। আলে রাসূলের প্রাণ নিয়েও তাদের পিপাসা মিটলনা! হায়রে অদ্ভুত জগৎ! ভূ ও নভোমণ্ডলের বিস্তীর্ণ বিস্তৃতি যে ঘরের মালিকানাধীন ছিল, আজ তাঁরই কবরের জন্য কূফার ভূমিতে সাড়ে তিন হাত জায়গা মিলছেনা! যার দয়ার প্রাচুর্যে ঈমানদারদের প্রাণের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছিল, আজ তারই নয়নমণির রক্ত সস্তা হয়ে গিয়েছে! লজ্জায় সূর্য মুখ লুকিয়েছে। জগৎ শোকের কাল চাদরে আ”ছাদিত। সন্ধ্যা হতেই সমস্ত কূফা ভয়ানক আঁধারে ডুবে গেল। অতিথির সাথে প্রতারণা কূফাবাসীদের ক্ষেত্রে মহাপ্রলয় পর্যন্তের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। নিষ্ঠরতার শেষ এখানেও হয়নি। জুলুম অত্যাচারেরজনপথে দুর্ভাগ্যের ঘন আঁধার আরো বাড়তে রইল। রাতের নীরবতায় হঠাৎ ইবনে যিয়াদের কুশাসনের এক ঘোষক ঘোষণা দিল, “মুসলিমের দুই শিশু, যারাসঙ্গে এসেছিল; কোথাও আত্মগোপন করেছে। সরকারেরপক্ষ থেকে সাধারণ-অসাধারণ সকলকে সতর্ক করা হ”েছ যে, যে ব্যক্তিই তাদের আশ্রয় দেবে, তাকে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দেওয়া হবে। আর যে গ্রেফতার করে আনবে, তাকে রাজপুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত করা হবে।” হযরত ইমাম মুসলিমের দুই শিশু মুহাম্মদ (৮) ও ইব্রাহীম (৬) কূফার প্রসিদ্ধ আশেকে রাসূল কাজী শুরায়হ এর ঘরে আশ্রিত ছিল। এ ঘোষণা শুনেকাজী শুরায়হ এর কলিজা কেঁপে ওঠল। হযরত ইমাম মুসলিমের কলিজার টুকরোদের পরিণতি চোখের সামনে নগ্ন নৃত্য করছে। বহুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করতে রইল যে, কী করে জালেমের থাবা থেকে তাঁদের রক্ষ করা যায়! বহু চিন্তা-ভাবনার পর রাতারাতি দুই শিশুকে কূফার জমিন হতে বাইরে পৌঁছানোর মাধ্যমে রক্ষা করা যেতে পারে বলে ধারণা হলে অতি অ¯ি’রতায় নিজ পুত্রকে ডাক দিলেন। ছেলেকে চুপি-চুপি বললেন, ‘অতি সাবধানতায় কোন নিরাপদ পথে শিশু দু’টিকে কূফার বাইরে পৌঁছে দাও। রাতে মদীনার দিকে গমনকারী কাফেলা জনবসতির নিকট দিয়ে যা”েছ; যে কোনউপায়ে তাদের সঙ্গে মিশিয়ে দাও’। পথসম্বল যোগাড়ের পর বিদায় দেওয়ার জন্য দুই শিশুকে নিকটে ডেকে নিলেন। তাঁদের প্রতি দৃষ্টি পড়তেই দু'চোখ ভিজে ওঠল। দুঃখ-শোকে ধৈর্যের বাঁধন ভেঙে পড়ল। মুখ হতে এক চিৎকার বের“ল আর দুই শিশুকে বুকেজড়িয়ে নিল। লালাটে চুম্বন দিল, মাথায় হাত রাখল এবং মূর্ছিত অব¯’ায়বহুক্ষণ র“দ্ধশ্বাস রইল। পিতার শাহাদত সম্পর্কে দুই শিশুকে এতক্ষণ পর্যন্ত বেখবর রাখা হয়েছিল। এ সংবাদও তাঁদের দেওয়া হয়নি যে, এখন স্বয়ং তাঁদের কচি গর্দনও রক্তপিপাসু তরবারীর টার্গেটে রয়েছে। কাযী শুরায়হ এর এমন আচরণে শিশুদ্বয় আশ্চর্যহয়ে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। বড়ভাই হতচকিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমাদের দেখে ব্যাকুল ক্রন্দনের কারণ বুঝে আসছেনা! এত রাতে ডেকে হঠাৎ আমাদের শিরে স্নেহমাখা হাত চঞ্চালন অহেতুক নয়। এ রূপ  হৃদয়গলা সমবেদনাতো আমাদের খান্দানে ইয়াতিমদের জ্ঞাপন করা হয়”। তীক্ষè শরের ন্যায় হৃদয়বিদারক এ বাক্য শেষ হতে-না হতে আরেকটি বিকট শব্দে ফের ধরণী প্রকম্পিত হল। কাযী শুরায়হ বর্ষণমুখর  চোখে বাকর“দ্ধপ্রায় উত্তর দিলেন, ‘গুলশানে রসুলের ফুটন্ত কলি! কলিজা ছিঁড়ে মুখে আসতে চাইছে, মুখে বলার ভাষা নাই। কী করে সংবাদ দিই যে, বাগানের শোভা উজাড় হয়েছে, আপনাদের আশার নীড় দিনদুপুরে জালেমরা লুটে নিয়েছে! হায়! আপনারা পর দেশে ইয়াতিম হয়ে গিয়েছেন। আপনাদের বাবাকে কূফাবাসীরা শহীদ করে দিয়েছেন, এখন আপনাদের প্রাণও ঝুকিপূর্ণ। আজ সন্ধ্যা হতেই রক্ত পিপাসুরা হন্যে হয়ে আপনাদের খুঁজছে। নগ্ন তরবারী নিয়ে হুকুমতের কুকুররা আপনাদের পিছে লেগেছে। এ সংবাদ শুনে দুই শিশু ডরে-ভয়ে কাঁপতে লাগল। কচি কলজে ভীত হল। ফুলের সতেজ মুকুল কুঁকড়ে গেল। মুখ হতে বিকট শব্দ বের“ল আর মূর্ছিত হয়ে ভূমিতে পড়ে গেল। হায়রে ললাটের তামাশা! আজ কয়েক দিন মাত্র হল যে, মাতৃ মমতা-স্নেহের শীতল পরশে মদীনা হতে বিদায় দিয়েছিল। আব্দার মেটানোর জন্য পিতৃস্নেহ সঙ্গি ছিল। এখন না বাবার দামান আছে যে, ধরে লেপ্টেযাবো; না মায়ের আঁচল রইলযে, ভয় পেলে মুখ লুকাবো! এখন কাচা ঘুম ভাঙ্গলে তাঁরা কাকে ডাকবে? কে রইলতাঁদের ভেজা পলকের আপন আস্তিনে মুছে নেবে? হায়! মুকুলের সে কোমল পাপড়ি, যা শিশিরের ভার বইতেও অপারগ; তার ওপর আজ দুঃখের পাহাড় ভেঙ্গে পড়েছে! পর দেশে পিতার শাহাদতের সংবাদ কচি প্রাণের জন্য কিয়ামতের চেয়ে কি কম ছিল যে, এখন স্বয়ং আপন জানেরও ভয়; ভাগ্য নগ্ন তরবারী হাতে শিরে দাঁড়ানো। চোখের সামনে আশার প্রদীপ নিভছে। শিশুদ্বয়ের আহাজারি ও চিৎপাত ছটফট কাযী শুরায়হ এর সহ্য হলনা। সান্ত্বনার বুলিও মুখে আসছেনা। বড় কষ্টে বল্লেন, বনু হাশিমের কোমলমতি, এ রূপ ফুঁসে-ফুঁসে কেঁদনা; শত্র“রা দেওয়ালের সাথে কান লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আপনার  আপন মজলুম পিতার স্মারক, তাজেদারে মদীনা (দ.)’র পবিত্র আমানত, কোমলমনের আয়না কোথাও আঘাত পেয়ে গেলে আমি ক্বিয়ামতের দিন মুখ দেখাতে পারবোনা। অতএব মদীনার নিরাপদ নগরী পর্যন্ত আপনাদের  পৌঁছে দেওয়াই আমার একমাত্র প্রচেষ্টা। এমতাব¯’ায় রাতের নির্জনতায় আপনারা উভয় আমার ছেলের সাথে কূফার বাইরে বেরিয়ে যান এবং যেকাফেলা মদীনার দিকে যা”েছ তাদের সঙ্গে মিলিত হোন। আপন নানাজানের দয়ার প্রতিবেশে পৌঁছে আমার পক্ষ থেকে দুরূদ-সালামের হাদিয়া পেশ করবেন। “আ”ছা যান, খোদা আপনাদের হেফাযত ও নিরাপদ রাখুন”। আদ্র নয়নে কাযী শুরায়হ শিশুদ্বয়কে বিদায় দিলেন।
ওয়েবসাইট
প্রহরী ও গোয়েন্দাদের নজর হতে চুপিয়ে কাযী শুরায়হ এর পুত্র পূর্ণ হেফাজতে তাঁদেরকে কূফার নগর দ্বার পার করে দিলেন। সম্মুখে অনতিদূরে কাফেলার ছায়া দেখা যা”িছল, আঙ্গুলের ইশারায় শিশুদ্বয়কে দেখিয়ে দিল। ইঙ্গিত পেতেই শিশুদ্বয় কাফেলারদিকে দ্র“ত এগোল এবং দৃষ্টি হতে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। রাতের ভয়ার্ত নির্জনতা, ভায়ানক আঁধার, ভয়-ভীতিতে নিমজ্জিত পরিবেশ আর মাতৃকোল হতে সদ্য বিচ্যূত দুই কচি প্রাণ; না হাতে আছে বিবেক-অভিজ্ঞতার দীপ, না সঙ্গে আছে সঙ্গী কোন গাইড, কিছু দুর গিয়েই তাঁরা পথ ভুল্ল। হায়রে কালের ঘোর বিপাক! কাল পর্যন্ত  যে আদুরেদেরকদমনীচে পুস্পশয্যা ছিল, আজ তাঁদেরই পথে কাঁটার বর্শা-বল্লম খাঁড়া। যারবাবার আঙ্গুলের সাহায্য ছাড়া নানাজানের রওজা পর্যন্ত যেতে পারতেন না, আজ তাঁরা একা-নিঃসঙ্গ ভিন দেশে বিজন প্রান্তরে ঘুরপাক খা”েছ। কখনো অভ্যাস ছিলনা, চলতে-চলতে চিৎপাত হ”েছ, কদমে-কদমে হোঁচট খা”েছ, পা কন্টক হতেই উফ্ করে বসে যেত, বায়ুর  শনশনে ভয়ে কাঁপত, পাতার মর্মর ধ্বনিতে কোমল কলজে সন্ত্রস্ত হত, জীব-জš‘র  শব্দ পেলেই হতচকিত হয়ে একে অপরের সাথে জড়িয়ে যেত, কখনো ভয় পেলে থরথরিয়ে ওঠত ফের চলতে শুর“ করত। কখনো ব্যাকুল হয়ে মাকে স্মরণ করত আবারকখনো আকুল হয়ে বাবাকে ডাকত। কখনো ব্যগ্র হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করত আবার কখনো ছলছল নয়নে আকাশ পানে দেখত। যতক্ষণ পায়ে চলৎশক্তি ছিল ওই অব¯’াতেই চলতে রইল। অবশেষে নৈরাশ হয়ে এক ¯’ানে বসে পড়ল। ভাগ্যের পরিহাস দেখুন যে,রাতের শেষ প্রহর ছিল, পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়া চাঁদের আলো চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে। ইবনে যিয়াদের পুলিশ বাহিনীর এক টহলদাতা দল, যারা ওই শিশুদ্বয়ের তালাশে বেরিয়েছিল, তারা ঘুরতে-ঘুরতে ঠিক ওই ¯’ানে এসেই জিজ্ঞাসা করল, “তোমরা কার?” শিশুরা ইয়াতিমের প্রতি সকলের সাহানুভূতি থাকে মনে করে নিজেদের সমস্ত অব¯’া খুলে  বলে দিল। হায়রে শৈশবের সারল্য! ওই সরল-সোঝা শিশু কি জানতযে, খুনপিপাসীকেই আপন পরিচিত বলছে। পরিচয় পাওয়ার পর জল্লাদরা তাঁদের গ্রেফতার করল এবং শক্ত করে বেঁধে টেনে-হেঁচড়ে সাথে নিয়ে চল্ল। এ হৃদয়বিদারক দৃশ্য  দেখে ডুবন্ত তারার আঁখিতে পলক পড়ল। চাঁদের মুখ মলিন হল। অসহনীয় কষ্টে আক্বীল তম্বয় মুসলিমের দুই ইয়াতিম শিশু কেঁদে ওঠল। হৃদয় হেলানো ফরিয়াদ সাহরায় গুঞ্জরিত হল। ‘আমরা পিতাহারা শিশু, আমাদের অনাথত্বের প্রতি দয়া কর“ন, রাতভর চলতে-চলতে পায়ে ফোসকা পড়ে গিয়েছে, আমাদের বাধন খুলে দিন। এখন কষ্ট সহ্য করার শক্তি নেই। নানাজানের দোহাই, আমাদের আঘাত চূরচূর দেহের প্রতি একটু মায়া কর“ন। ঘহীন অরণ্যে ইয়াতিমের ফরিয়াদ শুনুন। এ বেদনা বিধুর ক্রন্দনে যুগের কলজে হেলে গেল, কিš‘পাষাণ পাতকদের একটুও প্রভাবিত করলনা। দয়া-মায়া করার পরিবর্তে জালেমরা  পুস্পাননে থাপ্পড় দিয়েবল্ল , “তোমাদের খুঁজে কয়েক দিন ধরে চোখের নিদ্রা ওড়ে গেল, খানা-পিনা হারাম হয়ে গেল আর তোমরা পলানোর পথ অবলম্বন করে চুপে-চুপে জঙ্গলে ফিরছ। যতক্ষণ তোমরা আপন কর্মফল ভোগ করবেনা, ততক্ষণ তোমাদের প্রতি কোন দয়া করা হবেনা।” চপোটাঘাতে নূরের চাকে গড়া সুরতে দাগ পড়ে গেল,চেহরায় আঙ্গুলের চিহৃ ফুলে ওঠল। কাঁদারও অনুমতি ছিলনা যে,হৃদয়ের বোঝা হাল্কা হবে। বন্দি পাখির ন্যায় দীর্ঘশ্বাস ফেলতে-ফেলতে,হাঁফতে-কাঁপতে, মাথা নুয়ে, শিকল পড়ে, পদে-পদে শত্র“দের জুলুম-অত্যাচার চোখ বুজে হজম করতে ছিল। এখন আশার প্রদীপ নিভে গেল, মনের আশা চুরমার হল, সকলকে ডাকতে-ডাকতে দমে গেল, কোথাও হতে কোন সাহায্যকারীর  উদয় হলনা,অবষেশে কোমলান্তর নৈরাশ্যের অথৈ সাগরে ডুবে গেল। এখন মৃত্যুর ভায়নক ছায়া দিবসের আলোতে নজরে আস্ছে। অমনি নৈরাশ্যে ধুঁকতে-ধুঁকতে কূফার দিকে অগ্রসর হ”িছল। আপন চাউনিতে পৌঁছে সিপাহীরা ইবনে যিয়াদকে সংবাদ দিল। নির্দেশ হল, জেলখানায় বন্দি করতে এবং দামেশ্ক হতে কোন নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত কঠোর প্রহারায় রাখতে। হুকুমতের সিপাহীরা ইবনে যিয়াদের নির্দেশ মতে উভয় শিশুকে জেলখানার দারগার হস্তান্তর করে চলে গেল। দারগা অতি কোমলান্তর ও আহলে বায়তের প্রতি উৎসর্গপ্রাণ ছিলেন। তিনিঅতি ভক্তি-বিশ্বাসে হাশেমী শাহযাদাদের আরাম-আয়েশের  ব্যব¯’া করলেন।

No comments:

Post a Comment

 
back to top