১। চৈতে-নিত্যে-অদ্বৈ-লালন।
কলিকালে এসেছেন চৈতন্য। জাত-পাতে নিপীড়িত গরীব মানুষের গৌরাঙ্গ-জাতহীন। নারী পুরুষ এক দেহে ধারণ করে আবির্ভূত। নদীয়াতে বেজে উঠে ভেদাভেদ ভুলে মানুষে-মানুষে মিলনের গান। লালনের গানে এসব ভাব ধারাই বিকশিত।
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা তীরে চাষবাস করা মানুষেরা হিন্দু , বৌদ্ধ, ইসলাম ইত্যাকার ধর্মের অধীনস্ত হয়েছে নানাভাবে। এসব ধর্মের মিথের বাউলিকরণ হয়েছে বাংলায়। বৈষ্ণব ধর্ম, সহজিয়া মতবাদ, সূফী মতবাদের মিলনে বাংলার বাউল ভাবধারা।
অদ্বৈতাচার্য ও নিত্যানন্দরা নারী-পুরুষ মিলিত সাধন ধারার সাধক। বীরভদ্রের সময় হতে বাউলরা বিকশিত হয়, এবং ছড়িয়ে পড়ে বাংলার বাইরেও।
বাউল সাধনার তিন স্তর
প্রবর্ত-- ভগবানের নিকট দৈন্য ও গুরুর নজর প্রার্থনা।
সাধক-- দেহতত্ত্ব, মনের মানুষ, সাধনার স্বরূপের জ্ঞান লাভ।
সিদ্ধ--সাধনার পূর্ণতার স্বরূপ।
২। বাউল সাধন।
বাউলরা দেহকে মনে করে সাধনার আধার। আর এখানেই সাঁইজির বারামখানা। লালনের গানের বিশাল অংশ জুড়ে দেহতত্ত্বের গান। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নারী-পুরুষের মিলিত ধারার সাধনা করে বাউলরা। ডঃ উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে-''কিভাবে পুরুষ-প্রকৃতি (নারী-পুরুষ) বিভক্ত হ'ল এবং কিভাবে দুই দেশে না থেকে একত্রে রইল। পদ্ম কোথায় প্রস্ফুটিত হয়, পদ্ম পুস্পের রসে কিভাবে সাধন হয় এবং সহস্রদল হতে রজঃস্রোতের সঙ্গে রসরাজ লীলা করতে করতে অগ্রসর হয়ে তিন দিন তিন রূপ ধারণ করে শেষে 'সহজ মানুষ' রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। তারপর প্রকৃতি-পুরুষের শৃঙ্গার দ্বারা উর্ধ্বগত হয়ে স্বস্থানে যেয়ে যুগল হয়ে নিত্যরস লীলা আস্বাদন করেন- বাউল সাধনার মূলভাবটি মোটামুটি এর মধ্যে ব্যক্ত।"
বাউলরা নিজেদের সাধন পদ্ধতির ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষা করে।
লালনের গানে শোনা যায় সহজ মানুষ, অটল রূপ, মনের মানুষ, অচিন পাখি, আলেকজনার কথা। সহজ ভাবে বললে এর দ্বারা গুরু, মুর্শিদ, রাসুল, আদম, ভগবান, আল্লা, ঈশ্বর ইত্যাদিকে বুঝায়। বাউল-ফকিরেরা ঈশ্বরের সর্বোচ্চ রূপ মানবদেহের প্রাণের ধারার সাথে কিভাবে মিশে থাকে সে রহস্য উৎঘাটনে সচেষ্ট ছিলেন। বীজ-রজঃ মিলিত হয়ে মানবের জন্ম। আর এই দু'য়ের উৎপত্তি সঙ্গমকালে। উত্তেজনার চূড়ান্ত পর্যায়ে সহজ মানুষ উপস্থিত হয়। বাউলরা এই স্তরে পৌঁছে স্থির থেকে সাধন করতে চায়। কাম নদীর নিন্মমূখী ধারাকে ঊর্ধমূখী করে যারা সহজ মানুষ সাধন করতে পারে, তারা হলো সিদ্ধ পুরুষ। লালন তার গানে বলছে-
আমি কি সন্ধানে যাই সেখানেমনের মানুষ যেখানে।আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতিদিবা রাতি নাই সেখানে।
যেতে পথে কাম নদীতেপারি দিতে ত্রিবিণেকত ধনীর ধারা যাচ্ছে মারাপইড়ে নদীর তোড় তুফানে।
রসিক যারা চতুর তারাতারাই নদীর ধারা চিনেউজান তরী যাচ্ছে বেয়েতারাই স্বরূপ সাধন জানে।
লালন বলে মইলাম জ্বলেমইলাম আমি নিশি দিনেআমি মনিহারা ফণির মতোহারা হলাম পিতৃধনে।
এমন অসংখ্য গানে গানে লালন বা বাংলার অন্যান্য বাউলরা নিজেদের প্রেম,কাম, সাধনের কথা বলে গেছেন। রূপ থেকে স্বরূপে ওঠাই বাংলার বাউলদের সাধনা। রবি ঠাকুরের গানে, কবিতায় এসব ভাব ধারার সরব উপস্থিতি। সোনার তরীর হিং টিং ছট কবিতায় রাজা হবুচন্দ্র ভূপের স্বপ্নের খোয়াব নামায়, গৌড়ের গুরুমারা চেলার উলট-পালট তাফসির-
নিতান্ত সরল অর্থ , অতি পরিষ্কার ,বহু পুরাতন ভাব , নব আবিষ্কার । ত্র্যম্বকের ত্রিনয়ন ত্রিকাল ত্রিগুণশক্তিভেদে ব্যক্তিভেদ দ্বিগুণ বিগুণ ।বিবর্তন আবর্তন সম্বর্তন আদিজীবশক্তি শিবশক্তি করে বিসম্বদী ।আকর্ষণ বিকর্ষণ পুরুষ প্রকৃতিআণব চৌম্বকবলে আকৃতি বিকৃতি ।কুশাগ্রে প্রবহমান জীবাত্মবিদ্যুৎধারণা পরমা শক্তি সেথায় উদ্ভূত ।
ত্রয়ী শক্তি ত্রিস্বরূপে প্রপজ্ঞে প্রকট —সংক্ষেপে বলিতে গেলে , হিং টিং ছট্ । 'স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
৩। তাহে এক পাগলা ব্যাটা বসে একা একেশ্বরে।
লালনের খুবই পরিচিত একটি গান-
ধন্য ধন্য বলি তারেবেঁধেছে এমনও ঘর শূন্যের উপরআ মরি শুন্যের উপর পোস্তা করেধন্য ধন্য বলি তারে।
খুব সুন্দর বুঝা যাচ্ছে সাঁইজি তার বারামখানা এই মানব দেহ শক্ত করে তৈরী করেছে। কিন্তু কোথায়? শূন্যের উপর। শূন্য কী? এর কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। যে কোন কিছুকে আমরা আপেক্ষিকভাবে শূন্য ধরতে পারি। শূন্যের জন্মভূমি ভারত। বুদ্ধের মূল দর্শনই হলো শূন্যবাদ। নাগার্জুন শূন্য সম্পর্কে বলেছেন " অস্তি-নাস্তি-তদুভয়ানুভয়চতুষ্কোটি বিনির্মুক্তং শূন্যরূপম"। সহজ ভাবে বললে দাঁড়ায়-আছে যে তা নয়নাই যে তাও নয়আছে নাই উভয়ই তাও নয়আছে নাই উভয়ই যে নয় তাও নয়।
এই চার মুক্ত কোন কিছু হলো শূন্য। এরই উপর সাঁইজি পোস্তা করে ঘর বেঁধেছে। তাই ফকির লালন বলছে-ধন্য ধন্য বলি তারে।
ঘরে মাত্র একটি খুঁটিখুঁটির গোড়ায় নাইকো মাটিকিসে ঘর রবে খাঁটিঝড়ি-তুফান এলে পড়ে।
ঘরের একটি খুঁটি বলতে কী বুঝায়?
প্রাণিবিজ্ঞানে পড়েছি সমস্ত প্রানিজগতকে মোটা দাগে দুভাগে ভাগ করা যায়- মেরুদণ্ডী, অমেরুদণ্ডী। এই মেরুদণ্ড প্রাণির বিবর্তনের খুবই বড় একটি ধাপ। মেরুদণ্ডের কশেরুকার ভিতর দিয়ে তিনটি স্নায়ু পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে (কুণ্ডলী স্ত্রীবাচক কুণ্ডলিনী) মাথায় গিয়ে মিলেছে। যা ভারতীয় তান্ত্রিকদের কাছে অনেক সময় ত্রিবেণী নামেও পরিচিত। সুষুন্মা, ইড়া,পিঙ্গলা। সুষুন্মা অক্ষের মতো যাকে পেঁচিয়ে বাকি দুটি। ইড়া বাম শুক্রাশয় থেকে ডান নাসারন্ধ্র পর্যন্ত। শ্বেত বর্ণের শান্ত সৌম্য ও চাঁদের সাথে তুলনীয়। পিঙ্গলা (লাল) ডান শুক্রাশয় থেকে বাম নাসারন্ধ্র পর্যন্ত বর্ধিত। ইহা ভয়াবহ শক্তিশালী ও সূর্যের সাথে তুলনীয়।
ত্রিবেণীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্তরে স্তরে বিভিন্ন কুঠুরী বা পদ্ম ফুলের বর্ণনা করা হয়েছে। পদ্ম গাঙ্গেয় অঞ্চলের খুব সাধারণ ফুল এবং প্রচুর মিথ। বিষ্ণু স্বপ্ন দেখেন তার নাভিমূল থেকে পদ্ম ফুল ফুটে। স্বরস্বতী পদ্মফুলের উপর আবির্ভূত হন। প্রাণির দেহে ফুলের সনাক্তকরণ যাদের গ্রামদেশে বাড়ী তারা সহজেই করতে পারবেন। গরু ছাগলের বাছুর হওয়ার পর লোকজন পাহাড়া থাকে যেন ফুল না খেয়ে ফেলে। গরু তৃণভোজী কিন্তু এই আমিষ জাতীয় খাদ্য সরিয়ে না ফেললে সে অবশ্যই খায়। লালন তার গানে সরাসরি ফুল শব্দটিও ব্যবহার করেছেন।
কমল কোঠা কারে বলিকোন মোকাম তার কোথা গলিসেইখানে পড়ে ফুলিমধু খায় সে অলি জনা।
একমাত্র খুঁটি সুষুন্মার শুরু থেকে শেষ অবধি কুণ্ডলিনীর (ত্রিবেণী) বিভিন্ন স্তরে সাধনার মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন চৈতন্য জাগ্রত করে শেষে ঈশ্বরের সাথে লীন হওয়াই দুনিয়ার সমস্ত সাধকের উদ্দেশ্য। সাধকের রূপান্তরের এই স্তর বা চক্র বা ফুল বা কুঠুরী বা আসমান উপমায় কখনও সাত কখনও আট বা নয় ধরনের স্তরের কথা বলা হয়ে থাকে। লালন ৭, ৮, ৯, সবই ব্যবহার করেছে-
দেশ দেশান্তর দৌড়ে কেন মরছ রে হাপিয়েআদি মক্কা এই মানব দেহেদেখনারে মন ধ্যেয়ে।মানুষ মক্কা কুদরতি কাজউঠেছে আজগবি আওয়াজ সাত তলা ভেদিয়ে।আছে সিং দরজায় তারি একজন নিদ্রা ত্যাগি হয়েদেখনারে মন ধ্যেয়ে।
অথবা যে গানটি ধরে আলোচনা করছি তার পরের অন্তরায়-
মূলাধার কুঠুরী নয়টাতার উপরে চিলে কোঠাতাহে এক পাগলা ব্যাটাবসে একা একেশ্বরে।
ভারতীয় মিথে সাধনার এই স্তরসমূহকে মুলতঃ সাত চক্রেই আলোচনা করা হয়েছে। কোথাও বা উপবিভাগ করেছে আট বা নয় চক্রে।
সুষুন্মার ভিত্তি বা মূলকে বলা হয় মূলাধার চক্র।
মূলাধারের অবস্থান যৌনাঙ্গ ও পায়ু পথের মাঝে। চিত্রে বৃত্তের ভিতর চতুর্ভূজের দ্বারা বুঝানো হয়েছে পার্থিব বিষয় আশয়। হাতির পিঠের উপর নিন্মগামী ত্রিভূজ দ্বারা যোনী তথা বিশ্বমাতা, এর মাঝখানে পুরুষ প্রতীক শিবলিঙ্গ যাকে সাড়ে তিন প্যাচে জড়িয়ে সর্প দেবী কুণ্ডলিনী। এবার আসা যাক হাতির কথায়। হাতি ভারতে একটি মিথিক চরিত্র। মিথ অনুসারে একদা হাতি মেঘের মতো রূপ পরিবর্তন করতে পারতো, উড়তে পারতো। একদিন সে উড়ে গিয়ে বসলো এক ডালে। ঐ গাছের নীচে এক সাধু তার শিস্যদের পড়াচ্ছিলেন।এমন সময় ডাল ভেঙ্গে কয়েকজন শিস্য মারা গেল আর হাতি সুন্দর উড়ে গিয়ে বসলো অন্য ডালে। সাধু সাথে সাথে রেগে গিয়ে সমস্ত হাতি জাতিকে অভিশাপ দিলেন। হাতি তার রূপ পরিবর্তন ও উড়ার ক্ষমতা হারালো। এর পর থেকে হাতি পৃথিবীতে হেঁটে চলা একখণ্ড অভিশপ্ত মেঘ।' হাতির এই সিম্বল থেকে বুঝা যায় শর্তমুক্ত হলে সহজেই পৌঁছা যায় পরবর্তি কুঠুরীতে। মূলাধার স্তর সাধকদের কাছে খুবই স্থুল পর্যায়। এর দ্বারা পরিচালিত মানুষজন সক্রিয় নয়।এরা নিষ্ক্রয় বা প্রতিক্রিয়াশীল।
পরের চক্র স্বধিস্থান(Svadisthana) ।
এটি কুণ্ডলিনীর বিশেষ আবাস। শরীরের যৌনাঙ্গ বরাবর এর অবস্থান। এই চক্রে কুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে জীবনের প্রধান লক্ষ্য হয় সেক্স। চিত্রে পানির অসুর মকর এর প্রধান উপাদান। ফ্রয়েড জীবনের এই চক্রের আলোচনা করেছেন ভালোভাবে। ভারতীয় সাধকেরা এই কুঠুরী উত্তরণের ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত। একটি ধারা কামকে হ্যা বলেছে অন্যটি না। বাউলরা প্রথমটি।
৩য় তলা হলো মনিপুর-
নাভির লেভেলে এর অবস্থান। মানুষের ভোগবাদীতা, দখল মনোবৃত্তি ইত্যাদির প্রকাশ এখানে। বর্তমান পশ্চিমা জগতের জীবনে এই চক্রের প্রাধান্য।
উল্লেখিত চক্রসমূহ সাদামাঠা। যারা এর মধ্যে জীবন যাপন করে তাদের জাগতিক চাওয়া পাওয়াই নির্ধারণ করে জীবনের সুখ-দুঃখ। গুরুরা বলেছেন 'পনের আনা মানুষ আসে খায় সন্তান উৎপাদন করে মারা যায়।'
পরবর্তি চক্র সমূহ উঁচু স্তরের। অনেকটা শরিয়ত-মারিফতের পার্থক্যের মতো। নতুন জীবনের শুরু।
চক্র চারঃ অনাহত(Anahata)
হৃদপিণ্ডের বরাবর এই পদ্ম। অনাহত মানেই আঘাত হীন। আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতা হলো আঘাত ছাড়া শব্দ অসম্ভব। কিন্তু বিজ্ঞানের Big Bang আল্লার কুন বা ভারতের ওঁম এই সব শব্দ আমাদের চেনা বস্তুর আগে। সাধকেরা চিরন্তন সেই আঘাতহীন শব্দ শোনার সাধনা করে। রাবেয়া বসরী বলেছেন নৈশব্দই সেরা ইবাদত। তিনি নদীর পারে বসে এই ইবাদতই করতেন। অনাহত শব্দ শুনার পরে পরবর্তি কুঠুরীতে গমন।
চক্র পাঁচ: বিশুদ্ধ ( Vishuddha)
এর অবস্থান গলায়। কুণ্ডলিনী যখন এই তলে পৌঁছা্য় তখন সাধকের সাথে ঈশ্বরের কথাপকথোন হয়। চিত্রে নিন্মমূখী ত্রিভূজের ভিতর পূর্ণবৃত্ত হলো পূর্ণ চন্দ্র। লালন তার বহু গানে বলেছে এই চাঁদের কথা। এখানকার দেবতা হলো অর্ধনরেশ্বর শিব। সাধকেরা দেখতে পান পারে যাওয়ার তরী। লালন অসংখ্য গান লিখেছে পারাপার তত্ত্বের। চির মুক্তি লাভের এই যাত্রা খুবই বিপদ সংকুল। ঠিক সেই ফুলসেরাতের পুলের বর্ণনা। ওপারে আছে চির যৌবন অনন্ত ভূমি এক কথায় স্বর্গ।
অহনা(Ajna) ষষ্ঠ চক্র:
দুই ভ্রুর মাঝে উপরে মেয়েরা যেখানে টিপ পড়ে সেখানে এই চক্রের অবস্থান। সূফীদের ফানা ফিল্লা্হ বা ঈশ্বরের সাক্ষাৎ বা দিদার। রামকৃষ্ণের বর্ণনায় এ স্তরে কিছুটা আমি বা (Ego) থেকে যায়। তিনি বলেন এ যেন ঠিক কাঁচে ঘেরা বাতি। সবই দেখা যায় তবু থেকে যায় বাধা। মোহাম্মদের মিরাজে আল্লা ও তার মাঝে একটি পর্দা ছিল।
সহস্র( Sahasrara) ৭ম চক্রঃ
এই স্তর হলো বাকা বিল্লাহ। ইউসুফ হাল্লাজের 'আয়নাল হক' বা আমিই সত্য। রামকৃষ্ণের বর্ণনায় কোন ধরণের বাধার অস্তিত্ত্ব নেই। শুধুই আলোর ঝলকানী। লালনের মতে দিবা রাতি নাই সেখানে। লালনের গানে দেখুন সহস্রের কথাযে রূপে সাঁই বিরাজ করে দেহ ভূবনে
গুরুর দয়া যারে হয় সেই জানে।
শহরে সহস্র পারা তিনটি পদ্মার এক মহেরা
আলেক ছোঁয়ার পবন খোড়া ফিরছে সেখানে।
গুরুর দয়া যারে হয় সেই জানে।
সহস্রের উপরে চিলে কোঠায়ই পাগলা ব্যাটা থাকেন। এর পর লালন বলে-
উপর নীচে সারি সারি
সাড়ে নয় দরজা তারি
লালন কয় যেতে পারি
কোন দরজা খুলে ঘরে।
সাড়ে নয় দরজা বলতে দুই চোখ, দুই কান, দুই নাক, মুখ, যৌনাঙ্গ, পায়ু। যৌনাঙ্গে নারীর দুই দরজা পুরুষের একটা, গড়ে সাড়ে নয়।
ধন্য ধন্য বলি তারে
বেঁধেছে এমনও ঘর শুন্যের উপর
আমরি শুন্যের উপর পোস্তা করে
ধন্য ধন্য বলি তারে।
৪। সাধন সহায়ক।
বাউলদের সম্পর্কে যে সব অভিযোগ পাওয়া যায় গাঁজা টানা তাদের অন্যতম। এ অভিযোগ সমাজের সাধারণ মানুষেরা করে না, করে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষিত লোকেরা। গরমের দেশে মদ্যপানে যদিও নিমরাজি, কিন্তু গরীব মানুষের নেশা গাঁজার ব্যাপারে বলে-কী সব গাঁজাখুড়ি কান্ড! বাংলা তথা সমগ্র ভারতে নেশা হিসবে তেমন কোন নেশাই ছিল না গাঁজা। গাঁজা ছাড়া শিবের পূজাই হয় না। আর সিদ্ধিদাতা গণেশতো ভাংখোর। ভারতের সেরা জমিনদার রবি ঠাকুরের মুখে লালনের নাম শুনার আগে মধ্য বা উচ্চবিত্তরা ঐ তলার খবরই জানতো না। আর অধুনা পণ্যের ব্যাপ্তির প্রয়োজনে বেনিয়ারা যখন লালনকে ব্যবহার করছে তখন মধ্যবিত্ত 'সংস্কৃতিমনা' লোকেরা একে বলছে লালনের 'নবজাগরণ'।
বাংলার সকল প্রান্তের মানুষ শত শত বছর ধরে যে বাউল অথবা লালনের গান ধারণ করতো বা গেয়ে বেড়াতো এটা মধ্যবিত্তের কনসার্ন না, এটা বাউলদের প্রভাব না। মিডিয়া সর্বস্ব এই মানুষেরা মিডিয়ায় লালনকে দেখে বলছে নবজাগরণ। যেমন ধরা যাক লোকনাথ ব্রহ্মচারীর কথা। বারুদির মেলায় গেলে বুঝা যায় কি পরিমাণ শক্তিশালী ব্যক্তি এই লোকনাথ। অথবা চাঁদপুরের লেংটা বাবা। কোন মিডিয়ার প্রচারণা নাই কিচ্ছু নাই, অথচ হাজারে হাজারে মানুষ ছুটে যাচ্ছে। আমরা শিক্ষিতরা এগুলাকে প্রভাব বলবো না, যতদিন না মিডিয়া আমাকে বলছে তাদের কথা। এসব কথা থাকগে, গোলমাল বেধেছে অন্যখানে। দেশভাগ ও স্বাধীনতার ফলে দুদফায় হিন্দুদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তির লুটপাট, রাষ্টীয় ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতি, আর সম্প্রতি শ্রমিকদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার কারণে গত অর্ধশতকে ফুলে ফেপে উঠেছে মধ্যবিত্ত। এরা আবার মুসলমান। জাতীয়তাবাদের তোড়ে মাঝখানে আওয়াজ উঠেছিল বাঙগালি মুসলমান তকমার। বাংলায় ইসলাম ধর্মের রূপ বদলটি খুব চমৎকার। হকারদের হাতে জন্ম নেওয়া ইয়াহুদী ধর্ম, এবং এর ধারাবাহিকতায় ব্যবসায়ী ও শহুরেদের ধর্ম ইসলাম, ভারতে আসে সম্পুর্ণ ভিন্নরূপে। কৃষিভিত্তিক সমাজে ইসলাম হয় মূলত মাজারকেন্দ্রিক। শহুরে লোকের বৃদ্ধি তথা পরজীবি মধ্যবিত্তের বাড়-বাড়ন্তের সাথে সাথে বিস্তার লাভ করে ওহাবী ইসলাম। টক্কর লাগে মাজারের সাথে। ক্ষমতা যেহেতু শহুরে বেনিয়া ওহাবী মুসলমানদের হাতে এরা প্রচার করতে থাকে মাজারকেন্দ্রিকতা শিরক (যদিও মদিনায় না গেলে হজ্ব পুরা হয় না!), এরা বসে বসে গাঁজা খায়, মাইজভান্ডারীরা মেয়ে মানুষ নিয়ে বেলাল্লাপনা করে!
মানব জাতি যত পুরনো নেশাও ততো পুরনো। সকল আঁকর গ্রন্থেই পাওয়া যায় এর খোঁজ। তওরা, বেদ বা ইলিয়াড, ওডিসি অথবা রামায়ন, মহাভারত আরও পরে বাইবেল বা কোরান সর্বত্রই এর সরব উপস্থিতি। ঈসা নবী লাস্ট সাপারের দৃশ্যে তার শিস্যদের সহিত রুটি খাচ্ছেন ও পান করছেন মদ। সেমেটিক সকল মিথে আনন্দ ফুর্তির সাথে বলা হয়েছে আঙ্গুর বাটার কথা। বলা হয়ে থাকে আলীর মাতলামির কারণে, তড়িঘড়ি করে যে দিন মদ নিষিদ্ধ হয়, সে দিন নাকি মদের নহর বয়ে গেছে মক্কায়। বেদে সোমরস নামে এক ধরণের নেশার কথা জানা যায়। যা নাকি পাওয়া যেত সোমলতায়। সেই সোমলতার ইয়ত্তা পরে আর পাওয়া যায় নি, অনেকে মনে করে এটি ভাংয়ের আগের নাম। আদি কাল থেকে এশিয়া ও ওসেনিক দ্বীপসমূহে চালু আছে পান খাওয়ার রীতি। আল বিরুনী ১১ শতকের গোড়ার দিকে ভারত সফরে এসে বন্দরে নেমে খুব অবাক হন যখন দেখেন মানুষের মুখ দিয়ে রক্ত পড়ে অথবা মুখগুলো রক্তের মতো লাল। পরে জিজ্ঞাসাবাদে জানেন ইহা বিশেষ সৌখিন খাবার পানের পিক আর তার রং। চা চীন থেকে কফি আফ্রিকা থেকে পাওয়া বহু পুরাতন নেশা দ্রব্য।
রাসায়নিক বিবেচনায় সমস্ত নেশাই ক্ষারীয় জৈব পদার্থ। নাইট্রোজেনঘটিত অ্যালকালয়েড অথবা অক্সিজেনঘটিত অ্যালকোহল। চা কফি তামাক সুপারিতে প্রাকৃতিক অ্যালকালয়েড এবং যত আধুনিক নেশার নাম শুনা যায় মেথ, ইয়াবা, হিরোইন ইত্যাদি সবই সিনথেটিক অ্যালকালয়েড। ভাং বা গাঁজা আর মদ হলো অক্সিজেন ঘটিত অ্যালকোহল।
গাঁজাসহ সকল নেশা দ্রব্যই কাজ করে সেন্টাল নার্ভাস সিস্টেমে, সাধকরা যাকে বলে ত্রিবেণী। যত প্রকার নেশার কথা আলোচনায় এসেছে বৈজ্ঞানিক গবেষকদের মতে গাঁজা তাদের মাঝে সবচেয়ে কম ক্ষতিকর, এমন কি চা কফি পান অপেক্ষাও।
লালন গাঁজা খেতেন বা খেতেন না এর হদিস পাওয়া যায় না। লালন শিষ্য দুদ্দু শাহের গানে গাঁজার কথা পাওয়া যায়। লালনের একটি গান-
ফের পইলো তোর ফকিরিতে
যে ঘাট মারা ফিকির-ফাকার
ডুবে মলি রে মন সেই ঘাটেতে।
ফকির ছিল এক নাচারি
অধর ধরে দিতাম পাড়ি,
পাস্তা নি খোলা দুয়ারী
তাই দেখে রেখেছি পেতে।
না জেনে ফকিরি আঁটা
মাথাতে বাড়ালি জটা,
সার হলো ভাং ধুতুরা গুটা
ভজন সাধন সব চুলোতে।
ফকিরি ফিকিরি করা
দরগা নিশান ঝান্ডা গাড়া,
লালন ফকির নেংটি এড়া
আঁট বসে না কোন কাজে।
এই গানে বুঝা যায় গাঁজা, ভাং বা ধুতুরার গুটার চল ছিল। কিন্তু লালন এসব দেখেছেন ক্রিটিকালি। বলেছেন জটা, ভাং আর ধুতুরা গুটা যেন সার না হয়। ভজন সাধন যেন চুলোতে না যায়। ফকিরি সহজ নয়! ফকিরিতে যেন ফের না পড়ে।
No comments:
Post a Comment