বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মীর মশাররফ হোসেন রচিত `বিষাদ সিন্ধু’ গ্রন্থটির একটু আলাদা পরিচয় আছে বহুদিন ধরে। শহুরে পাঠক থেকে শুরু করে একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামের নিতান্ত সাধারণ বিশেষত অল্পশিক্ষিত মুসলমান আমপাঠক সমাজে সমাদৃত বহুদিন ধরে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এটির জনপ্রিয়তা শুধু লেখকের স্বকালেই যে ছিল তা নয়; আজও এর আবেদন এতটুকু ম্লাণ হয়নি। এখনও গ্রামের বাজারে ফুটপাতের বইয়ের দোকানেও এ বইয়ের দুই এক কপি দেখা যায়। বিশেষ করে এর কাহিনি কারবালার বিষাদময় ঘটনা নিয়ে রচিত বলে বাঙালি মুসলমান পাঠকের কাছে এর বিশেষ আবেদন চিরকালীন।
কারবালার বিষাদময় নবীবংশ নিধনের ঘটনার প্রায় দেড় হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও প্রতিটি মুসলমানের কাছে এটি চিরবর্তমান ঘটনা। নিদারুণ এই একটি ঘটনাই মুসলমানদের কাছে কখনও পুরনো মনে হয় না। যতবারই এ ঘটনা শোনে, ততবারই তারা চোখের জলে বানভাসে। একে ঠিক যুদ্ধ বলা যায় না বরং পাইকারী হত্যাকান্ড বলা যেতে পারে। যেভাবে এজিদী সৈন্যরা যুদ্ধের সমস্ত নিয়মকানুনকে লঙ্ঘন করে নির্বিচারে হামলে পড়েছিল হোসাইনবংশের উপর তাতে একে যুদ্ধ বললে যুদ্ধকেই অপমান করা হয়। তাদের করাল থাবা থেকে রক্ষা পায়নি ছয়মাসের শিশু আলী আসগরও। তাই কারবালার ঘটনা বিগত প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে সারা বিশ্বের মুসলমান তো বটেই অনেক অমুসলমানকেও কাঁদিয়ে যাচ্ছে। হৃদয়বিদারক সেই ঘটনাকে আশ্রয় করে রচিত বিষাদ সিন্ধু নিয়ে তাই আলোচনা হয়ে এসেছে, এখনও হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হতে থাকবে।
‘বিষাদ সিন্ধু’ ইতিহাসের বই নয় যতটা এটি কাহিনি উপন্যাস। অর্থাৎ সাহিত্যিক বিচারে এর মূল্য আছে বৈকি। ইতিহাস এবং সাহিত্যের সংমিশ্রণ ঘটেছে এ গ্রন্থে। তবে সাহিত্যিক এ গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে সব সময় ঐতিহাসিক সত্যকে সাহিত্যের সমান্তরালে টেনে আনতে চায়নি বা পারেনি। তাই সত্যের আদলে ঠাঁই পেয়েছে অবিশ্বাস্য মিথ্যার বাড়াবাড়ি। এটি যে তার অজ্ঞতার ফলে নয় বরং স্বেচ্ছায় ঘটেছে তা বিচার করতে হলে অল্প পরিসরে সম্ভব নয়, একটা গবেষণাগ্রন্থ রচনা করতে হয় পৃথকভাবে। আপাতত আমরা সেদিকে না এগিয়ে ইতিহাসের সঠিক নিরিখে বিচার-বিশ্লেষণের প্রাথমিক অনুসন্ধান চালাতে পারি। এ গ্রন্থে লেখক মূলত কারবালার ঘটনার মূল দুই প্রতিপক্ষ ও ঘটনাকে ঠিক রেখে আগাগোড়া নিজের ইচ্ছেমতো মনগড়া কল্পকাহিনি বিস্তার করে করে বিভ্রমের দিকে এগিয়েছেন। আমাদের এ মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মূল প্রতিপাদ্যই হলো, ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত তথ্যসত্য থেকে লেখক মীর মশাররফ হোসেনের দূরে সরে যাবার অবস্থানগত দূরত্বগুলো নিরূপণ করা এবং সেসব ক্ষেত্রে সাহিত্যিক অমর্যাদার মানদন্ডটিও বিচার করা।
পাঠকের অনুধাবনের সুবিধার্থে প্রথমে বিষাদ সিন্ধু গ্রন্থে উল্লিখিত ঘটনার সারসংক্ষেপ আগে এক ঝলকে উল্লেখ করে তারপরে ঐতিহাসিক সত্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করা যাক। চুম্বক কথায় বিষাদ সিন্ধু গ্রন্থের সংক্ষিপ্তসার হলো, কোনও এক ঈদের দিন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) সাহাবীদের নিয়ে বসে আছেন। কথাচ্ছলে তিনি বললেন, তাঁর প্রাণপ্রিয় দুই দৌহিত্র হাসান ও হোসাইন তাঁরই এক শিষ্যের পুত্রের হাতে নির্মমভাবে নিহত হবেন। তাঁর কথা শুনে সবাই জানতে চাইল, তাহলে কে সে? তিনি একান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও বললেন, মাবিয়ার একপুত্র জন্ম নেবে যে জগতে পরিচিত হবে এজিদ নামে। তার মাধ্যমেই ঘটবে নারকীয় সে হত্যাকান্ড। একথা জেনে মাবিয়া শপথ করল, সে কখনও বিয়েই করবে না। কিন্তু বিধির বিধান যে অলঙ্ঘনীয়। তাই ঘটনাচক্রে তাকে বিয়ে করতেই হল। হাসান-হোসাইনের মঙ্গল কামনায় তাই সে আলীর (আ) অনুমতি নিয়ে তারই অধিকৃত সিরিয়ার দামেস্কে চলে গেল, যাতে হাসান-হোসাইন তার সন্তানের মুখোমুখি কখনও না হয়। কিন্তু মহানবী (স) বললেন, “মাবিয়া! দামেস্ক কেন, এই জগৎ হইতে অন্য জগতে গেলেও ঈশ্বরের বাক্যলঙ্ঘন হইবে না”।
সেখানে তার এক পুত্রসন্তান জন্মাল। তার নাম রাখা হলো এজিদ। কালক্রমে এজিদ হয়ে উঠল। কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ করল।
নবযৌবনের তাড়নায় সে জয়নাব নাম্নী এক গৃহবধুর রূপে পাগল হয়ে উঠল। যে কোনও মূল্যে সে জয়নাবকে চায়। তার সেই কথা পিতাকে সে স্পষ্ট করে বলতে না পারলেও আকারে-ইঙ্গিতে অন্যভাবে বলতে চায়। পিতা না বুঝলেও মাতা ঠিকই বুঝতে পারে পুত্রের অভিপ্রায়। কিন্তু মাতা কী আর করতে পারে তার পুত্রের জন্য! মাতা না পারে পুত্রের কষ্ট সহ্য করতে। আবার না পারে পুত্রের বাঞ্ছা পূরণের উদ্যোগ নিতে। ফলে পুত্র এজিদ নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়ে জয়নাব প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে পড়ে থাকে। তবে তার আজীবন সহযোগী হিসেবে দেখা যায় মারওয়ানকে। মারওয়ান ঠিকই একটা ব্যবস্থা করে ফেলল। জয়নাবের স্বামী আবদুল জাব্বারকে দিয়ে তার স্ত্রীকে তালাক দিতে সম্মত করায় যাতে করে এজিদের পথের কাঁটা দূর হয়।
সমস্ত বাধা অপসারিত হলে এজিদ তার কাসেদ মোসলেমকে জয়নাবের কাছে বিয়ের পয়গাম দিয়ে প্রেরণ করে। সে বারবার তাগাদা দেয় যাতে কোনোক্রমেই খবর নিয়ে আসতে তার দেরি না হয়। কিন্তু ঘটনাচক্রে মোসলেমের সঙ্গে ইমাম হাসানের দেখা হয়। মোসলেমের কাজের কথা শুনে তিনি বললেন, সে যেন সকলের শেষে জয়নাবের কাছে তাঁর পক্ষেও বলে। যদিও তাঁর ধারণা তাঁর দৈন্যদশা দেখে হয়ত জয়নাব তাঁকে বিয়ে করতে এমনিতেই রাজি হবে না।
কিন্তু হায়, এ কী হয়ে গেল! এজিদের শাহী তখতে রানী হিসেবে সম্মানিত হওয়ার চেয়ে জয়নাব যে আজীবন দারিদ্র্যকেই গ্রহণ করে নিল। তবে একই সাথে সে যে এক মহাযুদ্ধের বীজও বপন করে দিল। জয়নাবের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এজিদের সমস্ত রাগ-ক্ষোভ গিয়ে পড়ল ইমাম হাসানের ওপর। তার কাছে মনে হলো, হাসানের কারণেই সে জয়নাব লাভে সক্ষম হয়নি। ফলে সে এক কঠিন শপথ করে বসল, “যে হাসানের একসন্ধ্যা আহারের সংস্থান নাই উপবাস যাহাদের বংশের চিরপ্রথা, একটি প্রদীপ জ্বালিয়া রাত্রের অন্ধকার দূর করিতে যাহাদের প্রায় ক্ষমতা হয় না, সেই হাসানকে এজিদ মান্য করিবে? মান্য করা দূরে থাকুক, জয়নাব লাভের প্রতিশোধ এবং সমুচিত শাস্তি অবশ্যই এজিদ তাহাদিগকে দিবে। আমার মনে যে ব্যথা দিয়াছে, আমি তাহা অপেক্ষা শতসহস্রগুণে তাহাদের মনে ব্যথা দিব! এখনি হউক বা দুইদিন পরেই হউক, এজিদ বাঁচিয়া থাকিলে ইহার অন্যথা হইবে না। এই এজিদের প্রতিজ্ঞা”।
মীর মশাররফ হোসেন কল্পিত এজিদ চরিত্রের তথাকথিত এ প্রতিজ্ঞাই বিষাদ সিন্ধুর সমস্ত ঘটনার নিয়ন্ত্রক হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। তারপরের ঘটনাক্রম অতিদ্রুত ঘটতে লাগল। প্রতিশোধস্পৃহায় এজিদ সব আইন কানুন, ইষ্ট-অনিষ্ট ভুলে অন্ধের মতো শুধু উপায় খুঁজতে লাগল। কিন্তু তার পিতা মাবিয়া তাকে এহেন কাজ থেকে বারবার বিরত থাকতে বলে। ফলে পিতার প্রতি স্বাভাবিক আবেগ-অনুভূতিও সে বিস্মৃত হলো। সে এও ভাবতে থাকে যে, তার পিতার মৃত্যু না হলে সে সব কাজ ঠিকভাবে করতে পারবে না। এর কিছুদিনের মধ্যেই মাবিয়া পৃথিবী থেকে বিদায় নিল। মাবিয়ার মৃত্যু এজিদকে যেন সব কিছুর স্বাধীনতা দিয়ে গেল। পিতার মন্ত্রী হামান তার কাজে একটু উচ্চবাচ্য করতে চাইলে তাকে বন্দি করা হয়। নতুন মন্ত্রী করা হয় তারই আবাল্য সব কাজের মন্ত্রণাদাতা ধূর্ত মারওয়ানকে।
এজিদ দামেস্কের রাজসিংহাসনে বসে সর্বপ্রথম হাসান-হোসাইন দু ভাইয়ের উদ্দেশে চিঠির মাধ্যমে ফরমান জারি করল, তাঁরা যাতে এজিদের বশ্যতা স্বীকার করে নেয় এবং নিয়মিত কর প্রদান করে। কিন্তু এ ফরমান মদিনাবাসী সহ্য করতে পারল না। কেননা মদিনাবাসীদের কাছে রাষ্ট্রীয় কর চাইতে পারে এমন দুঃসাহস কারও আছে বলে তারা কখনও বিশ্বাস করতে পারেনি। প্রথমে ইমাম হাসান এজিদের চিঠির উত্তর দেয়া থেকে বিরত থাকলেন। কিন্তু এতে এজিদের ক্ষোভ আরও বেড়ে গেল। সে মদিনা আক্রমণ করতে মনস্থ করল। সে মারওয়ানের নেতৃত্বে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করল মদিনার লোকদের প্রকারান্তরে হাসানের প্রতিবিধান করতে।
মদিনার লোকজন এজিদের সৈন্যবাহিনী দেখে একটুকুও ভয় না পেয়ে জেহাদের অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে উঠল। যুদ্ধের ময়দানে এজিদবাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হলো। তারা এক পর্বতগুহায় আশ্রয় নিল। মারওয়ান এ পরাজয় সহজে মেনে নিতে পারল না। আরও সৈন্য পাঠানোর জন্য এজিদের কাছে লোক মারফত খবর পাঠিয়ে দিয়ে নিজে ছদ্মবেশে রাতে মদিনা শহরে প্রবেশ করল। খুঁজে খুঁজে মায়মুনা নামের এক বৃদ্ধা মহিলাকে বের করল। তাকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার লোভ দেখিয়ে হাসানবধের সমস্ত বন্দোবস্ত করে ফেলল।
স্বর্ণমুদ্রার লোভে মায়মুনা ইমাম হাসানের দ্বিতীয় স্ত্রী জায়েদার কানে সপত্নীবাদের বিষ ঢেলে দিল। সপত্নীবাদের বিষ যে ভয়ঙ্কর বিষ যা পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত বস্তুর চেয়ে মারাত্মক। এ বিষ না ঢাললে কি জায়েদার পক্ষে স্বামী হত্যায় প্রবৃত্ত হওয়া কখনও সম্ভব হতো? একবার নয়, দুইবার নয় পরপর তিনবার সে স্বামী হাসানকে বিষপান করিয়ে তবে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। মৃত্যুর আগে সকলের কাছে ইমাম হাসান একে একে বিদায় নেন। সবশেষে জায়েদাকে বলে যান, “আমি তোমাকে ক্ষমা করিলাম, কিন্তু যিনি সর্বসাক্ষী, সর্বময়, সর্বক্ষমার অধীশ্বর, তিনি তোমাকে ক্ষমা করিবেন কি না বলিতে পারি না। তথাপি তোমার মুক্তির জন্য সর্বপ্রথমে আমি সেই মুক্তিদাতার নিকট পুনঃপুনঃ প্রার্থনা করিব। যে পর্যন্ত তোমাকে মুক্ত করাইতে না পারিব সে পর্যন্ত আমি স্বর্গের সোপানে পা রাখিব না”।১
এরপর কাউকে না জানিয়ে জায়েদা এজিদের রাজদরবারে পুরস্কারের আশায় গিয়ে উপস্থিত হয়। কিন্তু যে নারী হাসানের মতো স্বামীকে হত্যা করতে পারে তার জন্য যে এজিদ অনেক বড় পুরস্কার রেখে দিয়েছিল। এজিদ জায়েদাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। হাসানের মৃত্যুর পর এজিদের পরবর্তী কাজ হলো হাসানের কনিষ্ঠ ভ্রাতা হোসাইনকে হত্যা করা। সে কাজেও এজিদের সদাবিশ্বস্ত সহচর হিসেবে এগিয়ে আসে মারওয়ান। হোসাইন তখন হযরত মোহাম্মদের রওজায় অবস্থান করছিলেন। গোপনে মারওয়ান ঐ সমাধিমন্দিরে গিয়ে হোসানইকে স্থান পরিত্যাগ করতে বলে। কেননা সে জানতে পেরেছে, এজিদের সেনাবাহিনী শীঘ্রই ঐ স্থান আক্রমণ করবে। হোসাইন নিজেও বিশ্বাস করতেন, তাঁর মৃত্যু ঘটবে কারবালার প্রান্তরে। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত হোসাইন হযরতের সমাধিস্থল ত্যাগ করেন। মদিনার সবাই তাঁকে মদিনা ছেড়ে কোথাও না যেতে বারবার অনুরোধ করে। সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে কুফার শাসনকর্তার আমন্ত্রণে হোসাইন কুফা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। এর আগে অবশ্য কুফাবাসী হাসানের হাতে বায়াতগ্রহণের জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানায়। কুফাবাসীদের মনোভাব বুঝে উঠার জন্য আগেই তিনি মোসলেম নামে এক দূতকেও কুফায় প্রেরণ করেন। কুফার শাসনকর্তা আবদুল্লাহ জেয়াদের ষড়যন্ত্রে মোসলেম তাঁর দুই শিশুপুত্রসহ নিমর্মমভাবে নিহত হন। কিন্তু এতসব ঘটনার খবর হোসাইনের কাছে এসে পৌঁছেনি। তিনি তাঁর যাত্রায় অবিচল থাকেন। কুফায় যাওয়ার পথে ভুলক্রমে হোসাইন এবং তাঁর অনুচরবর্গ কারবালার দিকে অগ্রসর হন। কারবালায় পৌঁছেই ইমাম হোসাইন নানা আভাস ইঙ্গিতে বুঝতে পারলেন এটাই সেই কারবালা!
হোসাইন বুঝতে পারলেন এ প্রান্তরেই তাঁকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হবে। কেননা তাঁর নানাজানের বাণী যে অলঙ্ঘনীয়। সেখানে এজিদের সৈন্যবাহিনী কর্তৃক হোসাইন ও তাঁর পরিবারপরিজনসহ অন্যান্য সঙ্গীরা বাধাপ্রাপ্ত হন। এজিদের সেনাবাহিনীর সঙ্গে অবশ্য হোসাইনবাহিনী সংগ্রামে লিপ্ত হন। কিন্তু অসম এ লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত হোসাইনের সঙ্গীরা পরাজিত হন। এজিদবাহিনী যুদ্ধের সব মানবিক নিয়মভঙ্গ করে নির্মমভাবে হোসাইনবাহিনীকে হত্যা করে। এদিকে পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঐ যুদ্ধক্ষেত্রেই হোসাইনকন্যা সখিনাকে হাসানপুত্র কাসেম বিবাহ করেন। কাসেমও যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেন। সর্বশেষে হোসাইন নিজেও যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং সীমার কর্তৃক নিহত হন। হোসাইনের খণ্ডিত মস্তক নিয়ে সীমার ঊর্ধ্বশ্বাসে দামেস্ক অভিমুখে রওয়ানা হয়।
পথিমধ্যে সীমার হোসাইনের খণ্ডিত মস্তক নিয়ে আজর নামক এক অমুসলমান ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এখানে মানবতার পূজারী আজরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং আজর পরিবারের সবাইকে তার হাতে মৃত্যুবরণ করতে হয়। মরে গেলেও এ পরিবারের প্রতিটি সদস্য মানবপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যান। এরপর হোসাইনের কর্তিত মস্তক নিয়ে সে দামেস্কে ফিরে আসে।
এজিদ এ খণ্ডিত মস্তক নিয়ে হাসানের স্ত্রী জয়নাব, হোসাইনের ছেলে জয়নাল আবেদিন ও কনিষ্ঠা কন্যাকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে। জয়নাবের মুখোমুখি হয়ে নানা বাক্যবাণে জর্জরিত করে তোলে। এমনিভাবে নানা ক্রীড়াকৌতুক-হাস্য-পরিহাস করতে করতে এক সময় সবার সম্মুখে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। হোসাইনের খণ্ডিত মস্তক মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। এ খণ্ডিত মস্তক অলৌকিকভাবে কারবালা প্রান্তরে গিয়ে হোসাইনের ধড়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। তারপর লেখক হোসাইনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার একটি দৃশ্যে লেখক সমস্ত নবীদের এনে এক লাইনে দাঁড় করিয়েছেন উদ্ভটভাবে।
এজিদ হোসাইনপুত্র জয়নাল আবেদিনকে বশ্যতা স্বীকার করাতে চেষ্টা করে। কিন্তু জয়নাল আবেদিন আনুগত্য স্বীকার না করায়ে তাঁকে বন্দি করে রাখা হয়। হোসাইনের বৈমাত্রেয় ভাই হানিফা ছিলেন আম্বাজের অধিপতি। তিনি সৈন্যসামন্ত নিয়ে মদিনার দিকে অগ্রসর হন। মদিনাবাসীদের তিনি এজিদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেন এবং এজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। হানিফার বীরত্বের সামনে কেউ দাঁড়াতে সাহস করল না। হানিফা যেন এজিদবাহিনীর জন্য সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত আজরাইল হয়ে এসে দাঁড়ায়। একে একে এজিদের প্রধান প্রধান সেনাপতিরা মৃত্যুবরণ করতে থাকল। সীমার, ওতবে অলিদ, মারওয়ান এরাও হানিফার হাতে মৃত্যুবরণ করে। হানিফা দামেস্ক আক্রমণ করলে জয়নাল আবেদিন বন্দিখানা থেকে মুক্ত হয়ে হানিফার সঙ্গে মিলিত হন। হানিফা এবং জয়নাল দুজনে তখন এজিদকে জীবন্ত বন্দি করার জন্য তার রাজপ্রাসাদের দিকে অগ্রসর হয়। হানিফার ভয়ে এজিদ পলায়ন করে।
এরপরে দামেস্কের বন্দিশালায় হোসাইন পরিবারের বন্দিদের দুর্দশার কথা চিত্রিত হয়েছে। হানিফা দামেস্ক শহরে প্রবেশ করলে সব প্রহরীরা পলায়ন করে। এ অবসরে সবাই বের হয়ে পড়ে। হোসাইন পরিবারের লোকজনদেরও উদ্ধার করা হলো। হানিফা এজিদের সন্ধানে তার রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করে। কিন্তু এজিদ ভূগর্ভস্থ এক গোপন কক্ষে আশ্রয় নেয়। হানিফা তাকে আর খুঁজে পায় না। এক দৈববাণীতে হানিফাকে বলা হয়, এজিদ তার বধ্য নয়। তখন ক্রোধান্বিত হানিফা বহু নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করে। নিরপরাধ লোককে হত্যার শাস্তিস্বরূপ তাই তাকে ওখানে দু পাহাড়ের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকতে হয়। এজিদও মাটির নিচে এক জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে জ্বলবে। অতঃপর উপসংহারে লেখকের মন্তব্য, পাপীরা পরিণামে শাস্তি পাবে এবং সত্য একদিন জয়ী হবেই। ইমাম পরিবারসহ সকল মুসলিম জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব ইমাম জয়নাল আবেদিনের হাতে এসে পড়ল।
মীর মশাররফ হোসেন আদিসত্য না খুঁজে মানবেতিহাসের সবচেয়ে নির্মম ও হৃদয়বিদারক কারবালার মহাট্র্যাজেডিকে ভিত্তি করে বিষাদ সিন্ধু নামক কাহিনি উপন্যাস লিখলেও তা ইতিহাসের মূলধারাক্রম উল্টেপাল্টে এবং পাল্টেউল্টে কুটিল জগাখিচুড়ি পাকানো অপন্যাসে পর্যবসিত হয়েছে। আমরা নিরপেক্ষভাবে প্রকৃত ইতিহাসের কষ্টিপাথরে উপরোল্লিখিত ঘটনাবলিকে যাচাইয়ের মাধ্যমে সঠিক বিশ্লেষণের দ্বারা বুঝতে পারি সত্যমিথ্যার প্রকৃত স্বরূপ। কারবালার ট্র্যাজেডি বৃত্তান্ত স্পষ্টভাবে বুঝতে হলে শুরু করতে হয় এজিদের পিতা মাবিয়া থেকেই।বিষাদ সিন্ধু কাহিনির শুরুতেই লেখক মাবিয়া এবং ইমাম হাসান-হোসাইনের পিতা মাওলা আলীর সাথে যে সম্বন্ধের অবতারণা করেছে তা সম্পূর্ণরূপে ইতিহাসবিরুদ্ধ মানে ডাঁহা মিথ্যাচার। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এদের সম্পর্ক কখনও প্রভু ভৃত্যের মতো আনুগত্যপূর্ণ ছিল না, যেমনটা লেখক বর্ণনা করেছেন। হযরত আলী যখন ইসলামী বিশ্বের খলিফা পদে বসেন তখন থেকেই মাবিয়া তাঁর বিরোধিতা করে আসছিল এবং নানা ছলেবলে কুটকৌশলে চেয়েছিল ইসলামী বিশ্বের খলিফা হতে। সেজন্য মাবিয়া খলিফা আলীর বিরুদ্ধে একটি অন্যায়যুদ্ধের প্ররোচনা দেয় এবং অন্যটি নিজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিল।
ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধটির নাম ‘জামালের যুদ্ধ’ এবং দ্বিতীয়টির নাম ‘সিফফিনের যুদ্ধ’। দুটি যুদ্ধেই মুসলিম বিশ্বের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। হাজার হাজার লোক এ দুটি যুদ্ধে মারা যায়। আলীর মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তার যুদ্ধ প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে চলতেই থাকে। ফলে হযরত আলীর প্রকৃত রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা বিশ্ববাসীর তুলে ধরা আর সম্ভবপরই হয়ে উঠল না। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ইলস্নার বলেন, “আলীকে যদি শান্তিতে শাসন করতে দেওয়া হতো তাহলে তাঁর সৎ গুণাবলি, নৈতিক দৃঢ়তা, তাঁর চরিত্রের উচ্চ মহিমা আর অনাড়ম্বর বৈশিষ্ট্যগুলোকে চিরস্থায়ী করতে পারত”।২
একই প্রসঙ্গে মেজর ওসবর্ন কর্তৃক মাবিয়া সম্পর্কে করা উক্তিটি উদ্ধৃতির লোভ সামলাতে পারলাম না। তিনি মাবিয়া সম্পর্কে লিখেছেন, “বিচক্ষণ, বিবেকহীন আর নিষ্ঠুর। প্রথম উমাইয়া খলিফা নিজের অবস্থা নিশ্চিত করার জন্য কোনও অপরাধ করতেই পিছপা হতো না। যে কোনও শক্ত শত্রুকে অপসারণ করার জন্য তার স্বাভাবিক পদ্ধতি ছিল খুন। রসুলাল্লাহর দৌহিত্রকে তিনি শেষ করেন বিষ দিয়ে; আলীর বীর সহকারী মালিক আশতারকেও নিধন করেন ঐ একইভাবে। তার পুত্র এজিদের পক্ষে উত্তরাধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য আলীর জীবিত পুত্রের সঙ্গে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে তাঁর একবিন্দুও আটকায় না”।৩
অবশেষে কুফা মসজিদে ২১ শে রমজান প্রভাতে ইবাদতরত অবস্থায় খলিফা হযরত আলীকে পেছন থেকে আবু মজলেম নামক মাবিয়া নিযুক্ত গুপ্তঘাতক বিষাক্ত তলোয়ার দিয়ে আঘাত করলে মারাত্মকভাবে তিনি আহত হন এবং পরে ২৩ শে রমজান তিনি দেহত্যাগ করেন। তাঁকে হত্যার পর মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলের জনগণ তাঁর জ্যৈষ্ঠপুত্র হযরত ইমাম হাসানের হাতে বায়াত গ্রহণ করতে থাকে। তা সত্ত্বেও থেমে থাকেনি মাবিয়ার প্রাসাদ ষড়যন্ত্র; বরং তা আরও ভয়াবহ মাত্রায় বেড়ে যায়। কেননা ইমাম হাসান পিতা আলীর মতো অত দৃঢ়চেতা নন, তিনি অত্যন্ত অন্তর্মুখী তন্ময়ভাবে বিভোর ও অতিশান্ত প্রকৃতির কোমল মানুষ। ঔদার্যের পরিচয় দিতে গিয়ে মুসলিম বিশ্বের শান্তির স্বার্থে তিনি কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে মাবিয়ার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হন। এসব শর্তের মধ্যে একটি ছিল, মাবিয়ার মৃত্যুর পরপরই খেলাফত আবার নবীবংশের উপস্থিত হযরত ইমাম হাসানের অথবা তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা মহাপুরুষ হোসাইনের হাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চলে আসবে আর কোনও রকম আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই। কিন্তু পরে ধূর্ত মাবিয়া চুক্তির সেই মূলশর্ত সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘন করে নিজপুত্র এজিদকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে ঘোষণা দেয়। অথচ বিষাদ সিন্ধু পাঠে কিনা দেখা যাচ্ছে একেবারে উল্টো এক চিত্র, মাবিয়া স্বেচ্ছায় হাসান-হোসাইন ভ্রাতৃদ্বয়কে ডেকে পাঠিয়েছেন তাঁদের হাতে তাঁদের পিতৃরাজ্য ফিরিয়ে দেবার জন্য! মাবিয়া তার মন্ত্রী হামানের মাধ্যমে একটি চিঠি লিখে তা কাসেদ মারফত হাসান-হোসাইনের কাছে প্রেরণ করেন।
কিন্তু এ চিঠি পাঠানোর কথা ইতিহাস সম্মত তো নয়ই বরং চিঠিতে ফুটে ওঠা কথার সাথেও মাবিয়ার বাস্তবিক চরিত্রের সাথে কোনও মিলই পাওয়া যায় না। মাবিয়া সব সময় আলী এবং তাঁর বংশধরদের প্রতি চরম বিদ্বেষপোষণ করে এসেছে। মাবিয়া স্পষ্টভাবেই জানত, যে শর্তের অধীনে সে খলিফাপদে বসেছে তাতে তার মৃত্যুর পরে খেলাফত আলী পরিবারের হাতে চলে যাবে। তাই ছলেবলে ও বদ্কৌশলে চেয়েছে ক্ষমতা হস্তান্তর ঠেকিয়ে রাখতে জোর-জবরদস্তি করে ইসলামী বিশ্বের অধিকাংশ জনগণকে মাবিয়া বশ করতে পারলেও মক্কা ও মদিনাবাসীদের তার কুপুত্র এজিদকে খলিফা হিসেবে গ্রহণে রাজি করাতে পারেনি।
এজিদ জয়নাবের প্রেমে অন্ধ হয়ে যে কোনও প্রকারে যেন তাকে পায় তার প্রয়াসী হয়। জয়নাবের স্বামীকে বাধ্য করে স্ত্রীকে তালাক দিতে। সব আয়োজন যখন সমাপ্ত, এজিদ যখন প্রহর গুণছে কখন জয়নাব একান্তই বধূ হয়ে তার ঘরে আসবে ঠিক সে সময় জয়নাব কি না আলী তনয় হাসানকে বিয়ে করে বসে। ক্ষুধার্ত বাঘের সামনে থেকে মুখের গ্রাস কেড়ে নিলে বাঘের যে অবস্থা হয়, এজিদের অবস্থাও তখন ঠিক সে রকমই হলো। সে ক্রোধে অন্ধ হয়ে যায়। তার সমস্ত রাগক্ষোভ গিয়ে পড়ে হাসানের ওপর। পুত্রের এমন কুমনোভাব দেখে মাবিয়াকে বলতে দেখা যায়, সবকিছু মেনে নিতে এবং হাসান-হোসাইনের প্রতি ক্রোধান্বিত না হতে। এমনকি মাবিয়া নানাভাবে পুত্র এজিদকে বোঝাতে চায় সে যেন হাসান-হোসাইনের অনুগত হয়ে থাকে। কেননা হাসান-হোসাইনই মূলত ইসলামী সাম্রাজ্যের প্রকৃত শাসক। শুধু তাঁদের দয়ায় মাবিয়া সিরিয়া রাজ্য শাসন করছে। কিন্তু পিতার এমন দাসত্বভাব এজিদ কোনোমতেই মেনে নিতে পারে না। কেননা সে দেখেছে, হাসান-হোসাইনের দু বেলা দু মুঠো খাবারই জোটে না। তাঁদেরকে সমীহ করে চলার কিছু আছে বলে তার কাছে মনে হয় না। ফলে তার ক্রোধ দিনে দিনে শুধু বাড়তেই থাকে। এক পর্যায়ে সে শপথ করে বসে, তাকে জয়নাবলাভে যে বঞ্চিত করেছে তার বংশের কোনও চিহ্নই পৃথিবীর বুকে রাখবে না। সে পিতা মাবিয়ার কথা অমান্য করেই তাঁর সামনেই স্পষ্ট করে তার মনের কথা জানিয়ে দেয়, “আমি যার জন্য প্রাণ পর্যন্ত পরিত্যাগ করিতে প্রস্তুত, আমি যার জন্য রাজ্যসুখ তুচ্ছ করিয়া এই কিশোর বয়সে জীবন পর্যন্ত বিসর্জন করিতে অগ্রগামী, যার জন্য এতদিন এত কষ্ট সহ্য করিলাম সেই জয়নাবকে হাসান বিবাহ করিবে? এজিদের চক্ষে তাহা কখনই সহ্য হইবে না। এজিদের প্রাণ কখনই তাহা সহ্য করিতে পারিবে না। যে হাসানের একসন্ধ্যা আহারের সংস্থান নাই উপবাস যাহাদের বংশের চিরপ্রথা, একটি প্রদীপ জ্বালিয়া রাত্রের অন্ধকার দূর করিতে যাহাদের প্রায় ক্ষমতা হয় না, সেই হাসানকে এজিদ মান্য করিবে? মান্য করা দূরে থাকুক, জয়নাব লাভের প্রতিশোধ এবং সমুচিত শাস্তি অবশ্যই এজিদ তাহাদিগকে দিবে। আমার মনে যে ব্যথা দিয়াছে, আমি তাহা অপেক্ষা শত সহস্রগুণে তাহাদের মনে ব্যথা দিব! এখনি হউক বা দুদিন পরেই হউক, এজিদ বাঁচিয়া থাকিলে ইহার অন্যথা হইবে না, এই এজিদের প্রতিজ্ঞা”।৪
মীর মোশারফের লেখা অনুযায়ী পুত্রের এহেন কথায় মাবিয়াকে অত্যন্ত বিচলিত দেখা যায়। পুত্রের কথায় সে বিশাল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কায় ভুগতে থাকে। পুত্রের কথায় সে অত্যন্ত ব্যথিত হয়। সে এতটাই শঙ্কিত হয় যে, এজিদ একুলওকুল দুকুলই হারাবে বলেই তার ধারণা। পুত্র এজিদকে তাই জোর দিয়েই মাবিয়া বলে তার প্রতিজ্ঞা থেকে সরে আসতে। পুত্রের মুখে এমন প্রতিজ্ঞা মাবিয়া শুনতে চায় না। তাই তো প্রাণের চেয়ে প্রিয় পুত্রকে সে তার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যেতে বলে। পুত্র এজিদের সাথে পিতা মাবিয়ার সে কথায়ও মাবিয়াকে আলী পরিবারের প্রতি যথেষ্ট সম্মান ও প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক বজায় রাখতে দেখা যায়। কিন্তু এজিদ তার পিতার কথা কোনোটাই মানতে পারেনি। সে ভাবতে থাকে কবে তার পিতা তার চোখের সামনে থেকে বিদায় হবে আর সে রাজ্যের সর্বময় কর্তা হয়ে বসবে। কেননা পিতা বেঁচে থাকতে তার পক্ষে সব কিছু করা সম্ভব হবে না এটা সে স্পষ্টই বুঝেছে। পুত্রের আচরণ সহ্য করতে না পেরে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মাবিয়া দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে পরপারে চলে গেল। এজিদ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এখন তার সামনে বাধা দেয়ার কেউ নেই। তাই সে তার প্রতিজ্ঞা পুরণে প্রয়াসী হয়ে ওঠে।
এজিদের সাথে মাবিয়ার আলোচনার প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাই, আলী পরিবারের প্রতি মাবিয়ার একনিষ্ঠ ভৃত্যের মতো আচরণ। কিন্তু আমরা ইতোপূর্বেই কয়েকটি ঘটনার মাধ্যমে দেখিয়েছি ইতিহাসের প্রকৃত মাবিয়া চরিত্র এবং বিষাদ সিন্ধু গ্রন্থে চিত্রিত মাবিয়া চরিত্র কীভাবে হয়ে দাঁড়িয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত। বরং মাবিয়া বাস্তব জীবনে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আলী পরিবারের সাথে প্রকাশ্যে ও গোপনে শত্রুতাই করে গেছে এবং তার মরণের পর কোন কোন কৌশলে নবীবংশকে জগত থেকে সরিয়ে দিয়ে উমাইয়া রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে সেসব চালাকি শিখিয়ে যায় ধূর্ত এজিদকে।
‘বিষাদ সিন্ধু’তে আমরা দেখি, এজিদ কূটকৌশল করে আলীপুত্র হাসানকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে। সে এ কাজে ব্যবহার করে হাসানের দ্বিতীয় স্ত্রী জায়েদাকে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইমাম হাসানকে হত্যা করা হয় এজিদ ক্ষমতায় বসার অনেক আগে অর্থাৎ তার পিতা মাবিয়া ক্ষমতায় থাকাকালে। ইতিহাস আরও সাক্ষ্য দেয়, হাসানকে মাবিয়াই কৌশলে হত্যা করে। কেননা সে জানত, এজিদকে পরবর্তী খলিফা করতে হলে আলীপরিবারকে ধ্বংস করা ছাড়া কোনও উপায় নেই। হাসানের কাছে মাবিয়া তো শর্তবদ্ধ যে, সে মারা গেলে হাসান অথবা হোসাইনের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু সে তো মনে মনে চেয়েছে স্বীয় পুত্র এজিদকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা বানাতে। তাই পথের কাঁটা দূর করতেই হাসানের স্ত্রীকে লোভে ফেলে স্বামীহত্যায় প্ররোচিত করেছিল। সেই প্ররোচনার ফলেই সে তার স্বামী হাসানকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করে। হযরত আল্লামা নূরউদ্দিন আবদুর রহমান জামী এ ব্যাপারে বলেছেন, “সর্বসাধারণের মধ্যে সুস্পষ্ট যে, হযরত ইমাম হাসান (অ) কে মাবিয়ার আদেশেই তাঁর স্ত্রীর মাধ্যমে বিষ দেওয়া হয়েছিল”।৫ মাবিয়া হাসানকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, এরপর হোসাইনকেও যে কোনও মূল্যে বশে আনার জন্য পুত্র এজিদকে সব কিছু করতেও বলে যায় একথা আমরা আগে উল্লেখ করেছি। মাবিয়া জানত, হাসানকে হত্যা করলেই সব সমস্যার সমাধান করা যাবে না। কেননা হাসানের ভাই হোসাইন বেঁচে থাকতে এজিদকে যে খলিফা হিসেবে মোটেও মেনে নেবেন না-সেটা সে খুব ভাল করেই জানত। তাই তো তিনি মৃত্যুর আগে এজিদকে হোসাইনের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে যায় বিশেষভাবে। তাহলে আমরা স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছি যে, মীর মশাররফ হোসেন বর্ণিত আলীপরিবারের সাথে মাবিয়ার আনুগত্যের সম্পর্ক ইতিহাসের সাথে সঙ্গতি রক্ষা তো করেই না বরং বিকৃত ইতিহাস পয়দা ও মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করতে চরমভাবে উদ্যত।
এবারে আসা যাক,বিষাদ সিন্ধু গ্রন্থের বর্ণিত ঘটনাবলির মূল নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রীয় ঘটনায়। যে কেউ বিষাদ সিন্ধু পাঠ করলে এ সিদ্ধান্তেই উপনীত হবে যে, এত মর্মান্তিক রক্তক্ষয়ী ট্র্যাজডির পেছনে দায়ী মূলত একটি নারীমাত্র – জয়নাব। গ্রন্থের নিয়ামক শক্তিই হচ্ছে রূপক কামমোহে উন্মত্ত এক যুবকের স্বেচ্ছাচারিতা। এজিদ হলো সেই স্বেচ্ছাচারী যুবক। ক্ষমতার দাপটে সে এক পরনারীকে না পাওয়ার প্রতিশোধ নিতে নবীবংশের রক্তে কারবালা প্রান্তরে সাগর বইয়ে দেয় যার ফলে ফোরাত নদীর পানিও রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু আসলেই কি ইতিহাসের এই রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের মূলে কোনও নারী ছিল? এ প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই এসে পড়ে। এজিদ কি তার ঈপ্সিত নারী জয়নাবকে না পেয়ে ক্রোধে অন্ধ হয়েই অমন রক্তস্রোতে মুসলিম বিশ্বকে ভাসিয়ে দিয়েছিল? নাকি অন্য কোনও ঘটনা এর পেছনে সক্রিয় ছিল? কেউ কেউ অবশ্য এটাকে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখাতে চায়। তাহলে সঠিক কারণ কোনটি? বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের আলোকে এ বিষয়ে আলোকপাত করে দেখা যেতে পারে।
ইতিহাসমতে এজিদের পিতা মাবিয়া ইসলামী বিশ্বের বৈধ খলিফা আলীকে নানাভাবে পদচ্যুত ও হত্যার মাধ্যমে খলিফা হতে চেয়েছিল। এর পূর্বে খেলাফত নিয়ে এমন সরাসরি কঠোর যুদ্ধে কাউকে লিপ্ত হতে দেখা যায়নি। তাই একথা বলা ভুল হবে না যে, মাবিয়া যা কিছুই করেছে শুধুই ইসলামী সালতানাতের প্রধান হওয়ার লোভেই করেছিল। তার এ অপপ্রচেষ্টার পথে যে-ই বাধা হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছেন তাঁকেই সে কোনও না কোনোভাবে সরিয়ে দিতে সদা ওঁৎ পেতে ছিল। তবে তার সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধ হলো, নবীবংশের সাথে সম্পাদিত চুক্তির শর্তলঙ্ঘন করে নিজের অযোগ্য, লম্পট, মদ্যপায়ী ও সমকামী কুপুত্র এজিদকে তাঁর উত্তরাধিকারীরূপে নিযুক্ত করে যাওয়া। এ মহাপাপ না করলে হয়তো তাঁর কৃত অনেক জঘন্য অপরাধ ইতিহাসের চোরাবালিতে হারিয়ে গেলেও যেতে পারত।
ইতোপূর্বে ইসলামী খলিফা যারাই হয়েছেন তারা সবাই কমবেশি মুসলিম উম্মাহর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। ফলে সে খলিফাদের ক্ষমতারোহণের ব্যাপারে নানা জটিলতা ও প্রশ্নবোধকতা থাকলেও তাদের ব্যক্তিত্বের কারণে অথবা যেহেতু তারা প্রত্যেকেই রসুলাল্লাহর সাহাবী ছিলেন তাই তারা উম্মাহর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পান। কিন্তু এজিদ তো কোনোদিক বিবেচনায় যোগ্য ছিল না। ফলে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে একমাত্র দামেস্ক ছাড়া আর কোথাও তাকে সহজভাবে মেনে নিতে চায়নি। আর মাবিয়া ইমাম হাসানের কাছে যে ওয়াদা করেছিল (সে মারা গেলে হাসান অথবা হোসাইন খলিফা হবেন) তাও মুসলিম বিশ্বের অনেকের কাছেই অজানা ছিল না। কিন্তু’ মাবিয়া স্বীয় উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠায় এত বেশি অন্ধ ছিল, যে কোনও মূল্যে এজিদকে ক্ষমতার মসনদে বসাতে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।
এজিদকে যে সবাই খলিফা হিসেবে মানতে রাজি হবে না এ ব্যাপারে মাবিয়া ওয়াকিফহাল ছিল বলেই সে বেঁচে থাকতেই অনেকটা জোর করে বিভিন্ন প্রদেশে অবস্থানরত প্রধান প্রধান ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে নানা ছলচাতুরি করে (প্রয়োজনে জোর করে অথবা ভয় দেখিয়ে) এজিদের পক্ষে বায়াত গ্রহণ করিয়ে যায়। তারপরও ইমাম হোসাইন, ইবনে আবু বকর, ইবনে ওমর, ইবনে জুবায়েরসহ অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তির বায়াত নিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। তাই মৃত্যুর পূর্বে এঁদের ব্যাপারে পুত্র এজিদকে খুব সতর্ক করে দিয়ে যায় বিশেষ করে আলীপুত্র ইমাম হোসাইন সম্পর্কে। কেননা সে জানত যে, তার অন্যায় কাজের সবচেয়ে বড় পাল্টা আক্রমণ এ ব্যক্তি থেকেই আসবে। এ ঘটনা সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনে আসীরের গ্রন্থে উল্লিখিত এজিদের কাছে আমীর মাবিয়ার অসিয়তনামাটি সঙ্গত কারণেই উল্লেখ করা যেতে পারে, “বেটা, আমি তোমার পথ থেকে সকল বাধা অপসারণ করেছি। তোমার শত্রুদের দমন করেছি এবং গোটা আরবের মাথা তোমার সামনে নত করিয়েছি। এখন হিজাযের অধিবাসীদেরকে তোমার উত্তম আচরণ দিয়ে বশীভূত করে রাখ। তারা যদি প্রতিদিন গভর্নর পরিবর্তন করতে বলে তাই করবে। সিরিয়াবাসীদেরকে তোমার আস্থাভাজন বানিয়ে নাও। শুধু তিনব্যক্তির পক্ষ থেকে আশঙ্কা আছে। তাঁদের একজন হচ্ছেন ইবনে ওমর (রাঃ)। ইবাদত-বন্দেগী তাঁকে ক্লান্ত করে ফেলেছে। দ্বিতীয়জন হচ্ছেন হোসাইন (আঃ)। তাঁকে সাথে নিয়ে ইরাকীরা অবশ্যই তোমার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। তুমি সফল হলে তাঁকে ক্ষমা করে দেবে। কারণ তিনি আমাদের নিকটাত্মীয়। আমাদের উপর তাঁর হক আছে। তাছাড়াও তিনি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কলিজার টুকরা। কিন্তু আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ)এর বিরুদ্ধে বিজয়ী হলে তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে”।
অসিয়তনামাটি একটু খেয়াল করে দেখলেই বোঝা যায়, এজিদের জন্য সরাসরি আঘাত যে একজনের কাছ থেকেই আসার সম্ভাবনা আছে তিনি আলীপুত্র হোসাইন এ ব্যাপারে মাবিয়া কিন্তু নিশ্চিতই ছিল। কেননা মাবিয়া নিশ্চিতভাবেই জানত অসত্য, অন্যায় ও সর্বপ্রকার বাতেলের বিরুদ্ধে ইমাম হোসাইন অবশ্যই মরণপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হবেন। ইমাম হোসাইন সত্যিসত্যিই এজিদের মতো দুরাচারের হাতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর শাসনভার অর্পিত হোক সেটা নবীবংশের সর্বশেষ প্রকাশ্য উত্তরসূরি তথা যুগের মহান ইমামরূপে কখনও মেনে নিতে পারেননি। ফলে সংঘাত ছিল অনিবার্য। এজিদও অতিতৎপর ছিল এ ব্যক্তিকে বশ্যতায় আনার জন্য। যে কোনও মূল্যে ইমাম হোসাইনের বায়াত সে কামনা করেছিল। কারণ সে ভাল করেই জানত তার প্রকৃত বৈধতা এ ব্যক্তির বায়াত গ্রহণের উপরই সর্বাংশে নির্ভর করছে। কিন্তু ইমাম হোসাইন স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানাতে রাজি হতে পারলেও এজিদের মতো দুরাচারের হাতে বায়াত গ্রহণে কোনোদিনও রাজি হতে পারেন না এটাই তো খুব স্বাভাবিক।
আমরা স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছি, ইমাম হোসাইন ও এজিদের দূরত্ব এবং দ্বন্দ্বের পেছনে কোনও রূপসী নারীর বিন্দুবৎ অবদান নেই যেটাকে কল্পকাহিনিকার মীর মশাররফ হোসেন বিষাদ সিন্ধুতে প্রধান উপজীব্য করে তোলেন আপন চিন্তাভাণ্ডারে সঞ্চিত পুতিগন্দময় গোবরপূর্ণ উর্বরা সারের মিশেলে। মনে রাখা দরকার, কারবালার যুদ্ধ তথাকথিত রাষ্ট্র ক্ষমতার দ্বন্দ্বও ছিল না। এখানে মুসলিম উম্মাহর মূলদর্শনগত জীবনজিজ্ঞাসা বিজড়িত ছিল। এটা অবশ্যই কঠিন এক জীবনজিজ্ঞাসার বিষয় ছিল, লোকেরা একজন শুদ্ধমুক্তবুদ্ধ মহাজ্ঞানী ইমামের অধীনে থেকে জাগতিক ও পারত্রিক কল্যাণমুখী দ্বীনদুনিয়ার ব্যবস্থাপনা মেনে চলবে নাকি নিকৃষ্ট কীটতুল্য খুনী, দুরাচারী, মদ্যপায়ী, লম্পট, চরিত্রহীন ও ইতরের শাসনাধীন থাকবে? মানুষ নবীর আদর্শিক ধারা মাওলাইয়াত বা ইমামতের আনুগত্য গ্রহণ করবে না লৈঙ্গিক উত্তরাধিকারীর রাজত্ব তথা উমাইয়া-আব্বাসীয়-সৌদি রাজতন্ত্রের পদলেহী কুকুর হয়ে ইহকাল ও পরকাল ধ্বংস করবে? সর্বধর্মের সাধারণ জনগণ সার্বজনীন শান্তিবাদী অহিংস ইসলামের সুমহান ছায়াতলে স্বর্গীয় জীবনযাপন করবে না ভোগবাদী-বস্তুবাদী নিষ্ঠুর জালেমদের হাতে ধর্মকর্ম সব তুলে দিয়ে চিরতরে রসাতলে যাবে এ প্রশ্নটিই ছিল কারবালাযুদ্ধের মৌলিক এবং প্রধান প্রশ্ন।
মহানবী প্রবর্তিত ইসলামের মৌলিক নীতিমালার উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত পরিশুদ্ধজ্ঞানী ইমাম হোসাইনের সাথে বর্বর ও বেপরোয়া ঘাতক এজিদের যেখানে তুলনা করাই গর্হিত মূর্খতা সেখানে কারবালা ট্র্যাজেডিকে ক্ষমতাদ্বন্দ্ব হিসেবে চিত্রিত করা তার চেয়েও জঘন্য মহাপাপ। কেননা ইসলাম কোনও কালসীমা বা খণ্ডভৌমিক রাজত্ব দখলে বিশ্বাসী নয়। সুমহান মানবীয় আদর্শের উপর আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত নবী-রসুলগণ কর্তৃক নির্ধারিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ মুসলমান সমাজে যাঁরা উলিল আমর তাঁদের দ্বারা ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হবে। এ ব্যাপারে আমরা পবিত্র কোরানের সুরা নেসায় দেখি, “তোমরা আল্লাহকে অনুসরণ কর এবং অনুসরণ কর রসুলকে এবং তোমাদের মধ্যকার উলিল আমরগণকে”।৬
কোরানে উল্লিখিত উলিল আমরের ব্যাখ্যায় সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী তাঁর অখণ্ড কোরানদর্শ’ গ্রন্থে লিখছেন, “উলিল আমর অর্থ যাঁহারা আল্লাহ ও রসুলের অনুমোদনক্রমে আদেশ নির্দেশ দানের অধিকারী অর্থাৎ আল্লাহ ও রসুলের অনুমোদিত শাসনকর্তা”। সুতরাং সহজেই বোঝা যায়, এজিদের মতো অযোগ্য, দুরাচার, লম্পট ও মদ্যপায়ী ব্যক্তি কোনও মতেই ইসলামী সাম্রাজ্যের খলিফা হতে পারে না। তাই ইমাম হোসাইনের লড়াই ছিল বাতিলের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও অসত্যের বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধকে তাই নেহাত এক নারীলাভ অচরিতার্থর প্রতিশোধ গ্রহণের যুদ্ধ বা ক্ষমতা ভোগের দ্বন্দ্ব বলার কোনও অবকাশই নেই। এ লড়াই ছিল অবধারিত ও পূর্ব নির্ধারিত। মহানবীর তিরোধানের পর যেদিন খলিফা ওমর বলেছিল, সেদিন কবে আসবে যখন সাখারের (মানে মাবিয়ার) পুত্র কেড়ে নেবে মাওলাইয়াতের ক্ষমতা, ঐদিনই তো নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল কারবালায় নবীবংশের পরিণতি। স্মর্তব্য, ওমরই মুয়াবিয়াকে সিরিয়ার গভর্নর নিযুক্ত করেছিল যা ইতিহাসসিদ্ধ। অথচ ইমাম হোসাইন যে আল্লাহর উচ্চতম পরিষদের মহান সদস্য এবং আহলে বাইতে রসুল, যাঁর সম্বন্ধে স্বয়ং মহানবী বলেন: “আমি হোসাইন হতে, হোসাইন আমা হতে” এবং “কোরান এবং আমার আহলে বাইত কখনও একে অপরকে ছাড়বে না”।৭ তাই যেখানেই কোরানের আইনের লঙ্ঘন হবে সেখানেই আহলে বাইতে রসুলগণ অবশ্য প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন এটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক। ফলে কারবালার লড়াইকে নিতান্তই এক নারীর দৈহিক ভোগমোহে উন্মত্ত কোনও ব্যর্থকাম যুবকের অপরিণামদর্শী পাগলামি বলার মীর মর্শারফীয় সস্তা প্রচার চক্রান্ত পক্ষান্তরে মাবিয়ার পক্ষে উলঙ্গ দালালী আর কী হতে পারে? পরিণামে যা আসল সত্য থেকে মানুষের মন ও নয়নকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাজতন্ত্রের পাপকে বৈধতা দেয় রাষ্ট্র ও সমাজে। বস্তুত কারবালার লড়াই ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের অদম্য মহাশক্তির লড়াই, মিথ্যার বিরুদ্ধে পুরুষোত্তম সত্যের বিদ্রোহ, বাতিলের বিরুদ্ধে হকের চরম পরীক্ষাক্ষেত্র। এবং সর্বোপরি তথাকথিত খেলাফতের বিরুদ্ধে ইমামত বা মাওলাইয়াতের অঘোষিত চিরযুদ্ধ। এ লড়াইয়ে আপাত হারজিৎ বড় কথা নয় আদর্শগত অটল স্থিরতা ও দৃঢ়তাই হচ্ছে বড় কথা। মাওলা হোসাইন সেটাই করেছেন। কাপুরুষের মতো এজিদের বশ্যতা স্বীকারের পরিবর্তে বীরদর্পে লড়ে আপন সর্বস্ব উৎসর্গিত করাকেই মর্যাদাপূর্ণ আত্মত্যাগরূপে প্রতিষ্ঠিত করে গেলেন মানবধর্মের অলিখিত ইতিহাসে। তিনি মাথা দিলেন কিন্তু দিলেন না হাত। জীবন দিয়েছেন কিন্তু আদর্শকে মরতে ও মারতে দেননি। অন্যদিকে এজিদের আচার-আচরণ সম্পর্কে একটি ঘটনার উদ্ধৃত করছি।
৬২ হিজরিতে মদিনার গভর্নর উসমান ইবনে মুহাম্মাদ মদীনার বিশিষ্ট ও সম্মানিত ব্যক্তিদের একটি প্রতিনিধি দল সিরিয়ায় প্রেরণ করলে, তাঁরা ফিরে এসে এজিদ সম্পর্কে বলেন, “আমরা এমন এক ব্যক্তির নিকট থেকে আসছি যার সাথে দ্বীনের কোনও সম্পর্কই নেই। মদ্যপান, গানবাজনা এবং ভ্রমণ ও শিকার তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। চরিত্রহীন লোকদের সাহচর্য তার কাছে অতিপ্রিয়”।৮ এমন দুঃশ্চরিত্র ও হীনপ্রকৃতির লোকের শাসন বা বশ্যতা নবীজির প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইন মেনে নিতে পারেন কোনও মতে? কস্মিনকালেও তা পারেন না। তাই এ সংঘর্ষ ছিল অপরিহার্য বাস্তবতা।
এবারে আসা যাক কারবালাযুদ্ধ প্রসঙ্গে। কারবালা ময়দানের যুদ্ধচিত্র আঁকতে গিয়ে লেখক যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে সত্যকার ইতিহাসের সাথে খুব একটা সঙ্গতি পাওয়া যায় না। যেমন শেষ মুহূর্তে সীমার যখন ইমাম হোসাইনের মাথা কেটে নিতে তাঁর বুকের উপর চড়াও হয় তখন ইমাম হোসাইন কর্তৃক কৃত লেখকের বানোয়াটী ওয়াদা (তোমাকে বেহেশতে না নিয়ে আমি বেহেশতে প্রবেশ করব না) সম্পর্কে ইতিহাসে কোনও রকম প্রমাণই পাওয়া যায় না। ইমাম হোসাইনের মহৎ চরিত্রের বিশেষত্ব দেখাতে গিয়ে লেখক এটি করেছেন যা সূক্ষ্মবিচারে হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়।
দ্বিতীয় খণ্ডে তথা উদ্ধারপর্বে আমরা দেখতে পাই, ইমাম হোসাইনের তথাকথিত (লেখক কল্পিত) বৈমাতৃক ভাই মোহাম্মদ হানিফা সৈন্যসামন্ত নিয়ে এসে এজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সেই যুদ্ধে এজিদের চরম পরাজয় ঘটে। এখানে যে বানোয়াট ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতে মরে যাওয়া রাজশক্তির ভয়ে ভীত লৌকিক পুঁথিলেখকদের কাছ থেকে উদ্ভট উপকরণ চুরি করে লেখক লোকোত্তর মহাপুরুষ হোসাইনের উপর যে লেপন করেছেন তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। কেননা পুঁথিসাহিত্যে কারবালার ঘটনার প্রতিশোধযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি হিসেবে হানিফা নামের আজব কল্পগল্প পাওয়া যায়। কিন্তু কারবালা বিষয়ক নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোয় হানিফার উপস্থিতি কোথাও আছে? অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, যে মহাত্মা কারবালার ঘটনার প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন তাঁর নাম মুখতার। তিনি এজিদের একান্ত সহযোগীদের সাথে লড়াই করে বিজয়ী হন, বিশেষ করে কুফার শাসনকর্তা আবদুল্লাহ জেয়াদের বিরুদ্ধে। তাকে তার কৃতকর্মের সমুচিত জবাব দেয়া হয়।
এ খণ্ডেই ইমাম হোসাইনের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান নিয়ে লেখক যে অবিশ্বাস্য দৃশ্যের অবতারণা করেছেন, তা পুরোটাই সত্যবিরুদ্ধ; কাল্পনিক এবং অলীক আতিশয্যে পর্যুদস্ত। বানোয়াট সে অনুষ্ঠানে আদম থেকে শুরু করে প্রাচীন পয়গম্বরগণ, ইমাম হোসাইনের নানা আখেরী নবী মোহাম্মদ (সঃ), ইমামের পিতামাতা শেরে খোদা আলী হায়দার এবং খাতুনে জান্নাত মা ফাতেমাসহ অসংখ্য মহাত্মার উপস্থিতি এত বাস্তবতা বিবর্জিত যে গাজাখুরিকেও হার মানায়। কুমারখালী কুষ্টিয়াবাসী লেখক মীর মশাররফ ব্যক্তিগতভাবে শাঁইজি লালনের ফকিরী মতবাদের প্রবল বিরোধী, বিদ্বেষপূর্ণ কটুক্তিকারী এবং কাঠমোল্লাদের অনুসারী ভোগবাদী এজিদী অহাবী ছিলেন বলেই এমন উদ্ভট অলৌকিকতার অবতারণা করেছেন যেখানে অতিভক্তি হয়ে যায় জুতো চোরের লক্ষণতুল্য।
এজিদবধ পর্বে দেখানো হয়েছে, মোহাম্মদ হানিফার মাধ্যমে ইমাম পরিবারের বন্দি সদস্যদের সবাইকে মুক্ত হতে। এরপর প্রাণভয়ে ভীতবিহ্বল এজিদকে প্রাণভয়ে দামেস্কের রাজপ্রাসাদ থেকে পালিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখানো হচ্ছে যাকে হত্যা করতে পিছুপিছু মোহাম্মদ হানিফাকে দৌঁড়াতে দেখা যায় উদ্যত তরোয়াল হাতে। কিন্ত আহা, নিয়তির কী নির্মম পরিহাস; তাকেই কিনা দুই পাহাড়ের মধ্যে হতে হলো চিরবন্দি! একটি দৈববাণী নাজেল হয়ে তার সমস্ত প্রচেষ্টা শেষ মুহূর্তে এসে হঠাৎ বিফল করে দেয়, “হে হানিফা! এজিদ তোমার বধ্য নহে” এ কথায় চঞ্চল হানিফা অকস্মাৎ থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। এ আজব ক্লাইমেক্স-কেমোফ্লেজ তৈরি করার উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, আল্লাহকে এজিদের সমর্থক হিসেবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিষ্ঠুর এজিদী রাজতন্ত্রের অনুকূলে পাঠকের মনকে ঠেলে দিয়ে গোলকধাঁধায় ফেলার চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, যাতে থ্রিলার উপন্যাসের কল্পনাবিলাস থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু সত্যের লেশমাত্রও নেই।বিষাদ সিন্ধু গ্রন্থের যেসব জায়গায় লেখক মীর মশাররফ অতিকল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন তার মধ্যে গ্রন্থের শেষখণ্ডের এ ঘটনাটি অন্যতম যার সাথে ইতিহাসের গ্রন্থগুলোর কোনও সঙ্গতি নেই। শুরু থেকে বইটির নানা পর্ব নিয়ে একে একে তুলোধুনো করলে মীর মর্শারফের সাহিত্যিক কম্বল সম্পূর্ণ উজাড় হয়ে যাবে। আর সেটা বৃহৎ একটি গ্রন্থে পরিণত হবে। তাই এ যাত্রায় আপাত বিরতি।
মোদ্দাকথা, আমরা ‘বিষাদসিন্ধু’ গ্রন্থটিকে ধর্মীয় ইতিহাসের পাঠ্যগ্রন্থ হিসেবে নেব নাকি শুধুই কল্পনানির্ভর একটি সাহিত্যকর্ম হিসেবে গ্রহণ করব? সিদ্ধান্তটি নেয়া অনেকের পক্ষে একটু কঠিনই বটে। কারণ এ গ্রন্থে আমরা একই সাথে ইতিহাস এবং সাহিত্যের উপস্থিতি লক্ষ্য করি। কিন্তু এ গ্রন্থ পাঠকদের বিরাট এক অংশ মনে করে, গ্রন্থে উল্লিখিত প্রতিটি ঘটনাই সত্যি এবং এটি বুঝি মর্মান্তিক কারবালা বিষয়ক একটি নির্ভরযোগ্য তথ্যপূর্ণ গ্রন্থ। তাই আমরা ইতোমধ্যে প্রমাণিত করেছি যে, ইতিহাসের মরিচিকাময় ঝাপসা আভাসমাত্র এতে পাওয়া গেলেও সত্য মেলে না। কারণ লেখক মশার্রফ কারবালা ইতিহাসের ঘটিত ঘটনাবলির প্রকৃত কোনও সঠিক ধারাবাহিকতা অনুসরণ ও সত্যাসত্য রক্ষা করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন তার চরম মাবিয়াপ্রীতি এবং ভ্রান্ত একদেশ দর্শিতার কারণে।
তাহলে আমাদের সিদ্ধান্ত কোন দিকে যাবে? হয়তো আমাদের সামান্য ভ্রান্ত সিদ্ধান্তের কারণেই আমরা সত্য থেকে বিচ্যুত হব। তবে নির্দ্বিধায় এটুকু বলা যায় যে, সঠিক ইতিহাসের নিরিখে বিচার করলে বিষাদ সিন্ধুকে সত্যদ্রোহী ও কঠিন ইতিহাসবিকৃতির বিষাক্ত তীরচিহ্নিত একটি গ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করতে বিশেষ কোনও অসুবিধে নেই কারও।
পাদটীকা:
১. এডওয়ার্ড গিবন বলেছেন, “কোনও দূরবর্তী যুগ ও আবহাওয়ায়ও হোসেনের মৃত্যুর মর্মান্তিক দৃশ্য অত্যন্ত নিরুত্তাপ পাঠকের মনেও সমবেদনা জাগাবে” (সৈয়দ আমীর আলী রচিত দ্য স্পিরিট অব ইসলাম গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত)।
বাঙালি অমুসলমান কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত “If a great poet were to rise among the Musalmans of India he could write a magnificient Epic on the death of Hossain and his brother. He could enlist the feelings of the whole race on his behalf. We have on such subject” (সাঈদা জামান ও মহসিন হোসাইন রচিত বৈরীস্রোতে মধুসূদন’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত)।
২. লেস ইফেক্টস দ্য লা রিলিজিয়ন দ্য মোহাম্মেদ : ইলস্নার (সৈয়দ আমীর আলী রচিত দ্য স্পিরিট অব ইসলাম গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত)।
৩. ইসলাম আন্ডার দি অ্যারাব্স : ওসবর্ন (সৈয়দ আমীর আলী রচিত দ্য স্পিরিট অব ইসলাম গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত)।
৪. মুয়াবিয়ার শাসনামল থেকে শুরু করে কয়েক দশক ধরে মুসলিম বিশ্বের সমস্ত মসজিদে জুমার খুৎবায় হযরত আলী এবং তাঁর বংশধরদের উদ্দেশ্য করে গালাগালি ও অভিশাপ বর্ষিত হতে থাকে (তারিখে ইসলাম : মুফতি সাইয়্যেদ আমীমুল ইহসান)।
৫. শাওয়াহেদুন নবুয়ত : আল্লামা নূরউদ্দিন জামী
৬. আল কোরান, সুরা নেসা, বাক্য # ৫৯
৭. সহীহ তিরমিযী, হাদিস # ৩৭২৬ (মীনা বুক হাউস)
৮. তারিখে ইসলাম : মুফতি সাইয়্যেদ আমীমুল ইহসান
তথ্যসূত্র:
১. বিষাদ সিন্ধু : মীর মশাররফ হোসেন
২. মীর মশাররফের গদ্য রচনা : মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল
৩. কারবালা ও মুয়াবিয়া : সৈয়দ গোলাম মোরশেদ
৪. নাহজ আল বালাঘা : মূল: হযরত আলী ইবনে আবি তালিব, অনুবাদ: জেহাদুল ইসলাম
৫. ঐতিহাসিক কারবালা : ড. এস. এম. ইলিয়াছ
৬. তারিখে ইসলাম : সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আমীমুল ইহসান
৭. অখণ্ড কোরানদর্শন : সুফি সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী
৮. বৈরী স্রোতে মধুসূদন : সাঈদা জামান ও মহসিন হোসাইন
৯. দ্য স্পিরিট অব ইসলাম : সৈয়দ আমীর আলী
১০. সহীহ তিরমিযী : বাংলা অনুবাদ, প্রকাশক মীনা বুক হাউস
১১. শাওয়াহেদুন নবুয়ত : আল্লামা নূরউদ্দিন জামী
No comments:
Post a Comment