Tuesday, 14 June 2016

নজরুলের ধর্মমত ও অসাম্প্রদায়িকতা

2 Comments
নজরুল ইসলামকে কেউ খুবই ভালোবেসেছেন, কেউ বা অসম্ভব ঘৃণা করেছেন। কিন্তু কেউই তাকে অবহেলা করতে পারেননি। তিনি যখন জনপ্রিয়তার একেবারে তুঙ্গে, তখনো কেবল প্রশংসার জোয়ারে ভাসেননি, বরং তীব্র নিন্দা আকর্ষণ করেছেন অনেকের তরফ থেকে। যেমন, মৌলবীরা (নজরুলের ভাষায় মৌ-লোভীরা) ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, তিনি কাজী হলেও কাফের। আর হিন্দুরা তাকে উপাধি দিয়েছিলেন পাত নেড়েতাঁর ভাষায় পুরুষরা তাঁকে গান দিয়েছেন, মেয়েরা তাকে অভিশাপ দিয়েছেন নারীবিদ্বেষী বলে চরকার গান লিখেছেন বলে তার নিন্দা করেছেন বিপ্লবীরা, আর কংগ্রেসীরা তাকে অবিশ্বাস করেছেন বিপ্লবী ঠাহর করে। তা হলে নজরুল আসলে কী ? আপাতদৃষ্টিতে তার পরস্পরবিরোধী ব্যক্তিত্বের পেছনে আছে তার প্রবল পছন্দ-অপছন্দ। তিনি যা বলেছেন, চীৎকার করে বলেছেন। তিনি যে-পথে চলেছেন, তার মাঝখান দিয়ে চলেছেন। আপোশ করে চলা, পাশ কাটিয়ে চলা তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য নয় আরও একটু খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, তীব্রতাই তার বিশ্বাসের একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়, তার বিশ্বাস অটল, ধ্রুবতারার মতো। কখনো তিনি এলিয়ে পড়েননি, কারণ একটা শক্ত ভিত্তি ছিলো তার বিশ্বাসের। সেই ভিত্তিটা মানবতার। সব মত, সব পথের উর্ধ্বে মানুষকে নিতান্ত মানুষ হিশেবে দেখার ক্ষমতা ছিলো তার। সে শক্তি তিনি সম্ভবত অর্জন করেননি, সেটা ছিলো তার স্বভাবেরই অংশ। তার যে মানবপ্রীতির জন্যে তিনি মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা লাভ করেছিলেন, সেই মানবপ্রীতিই তাকে আবার অনেকের কাছে, অনেক গোষ্ঠীর কাছে অপ্রিয় করে তুলেছিলো। তিনি মানুষে মানুষে সাম্যের কথা বলেছেন, কিন্তু কমিউনিষ্ট হতে পারেননি। এমন কি, তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুললেও, তিনি তাতে যোগ দিতে পারেননি। কারণ, তার মানবপ্রীতিকে কতোগুলো বিধান অথবা একটা কট্টর আদর্শের ছকে ফেলতে পারেননি তিনি। এক সমাজকে মানলে, করবে / আরেক সমাজ নির্বাসন। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, কোনো রাজনৈতিক দল, কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে তিনি একাত্ম হতে পারেননি। তার মানবতার সংজ্ঞার সঙ্গে কারো ষোলো আনা মিল হয়নি নজরুল হয়তো ঠিকই বলেছেনতিনি বর্তমানের কবি, ভবিষ্যতের নবী নন। হয়তো তার সাহিত্য চিরকালীন সাহিত্য নয়। কিন্তু তিনি যে-মানবতার কথা বলেছিলেন, তা চিরকালের তার আগে অথবা পরে কোনো বাঙালি সাহিত্যিক, কোনো দার্শনিক, কোনো ধর্মীয় নেতা, এমন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মানবতার জয় গান করতে পারেননিমানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। সত্য বটে, তার অন্তত দু শতাব্দী আগে চণ্ডীদাস বলেছিলেন, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। কিন্তু চণ্ডীদাসের মানুষ এবং নজরুলের মানুষ এক নন। চণ্ডীদাস মনের মানুষের কথা বলেছিলেন। 
নজরুল বলেছিলেন রক্তমাংসের মানুষের কথা। মানুষের প্রতি এই অকৃত্রিম ভালোবাসার জন্যেই নজরুল বলতে পেরেছিলেন যে, জগতের সব পবিত্র গ্রন্থ এবং ভজনালয়ের চেয়ে একটি মানুষের ক্ষুদ্র দেহ অনেক বেশি পবিত্র। মানুষকে ঘৃণা করে যারা ধর্মগ্রন্থ পড়েন, তিনি তাদের কাছ থেকে ধর্মগ্রন্থ কেড়ে নেওয়ার আহবান জানিয়েছিলেন। মন্দির-মসজিদ ভেঙে ফেলার জন্যে কালাপাহাড় এবং গজনি মামুদকে আহবান জানিয়েছিলেন। সকল সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে তার এই যে-মানবপ্রীতি, তা- তাকে হিন্দু নয়, মুসলমান নয়, খাটি বাঙালিতে পরিণত করেছিলো অথচ নজরুল রীতিমতো মুসলমান হতে পারতেন। তিনি যে-অশিক্ষিত পরিবারে জন্মেছিলেন, সে পরিবারে আনুষ্ঠানিক ইসলাম ধর্মই পালিত হতো। আর, ছেলেবেলা সেই ধর্মের শাস্ত্র পড়েই মাত্র দশ বছর বয়সে মসগিদে নামাজ পড়ানোর চাকরি পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি যেসব ইসলামী গান লিখেছিলেন, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কোরান-হাদিস তিনি ভালোই জানতেন। কিন্তু ছেলেবেলার এই শিক্ষা সত্ত্বেও তিনি মোল্লাহ হলেন না, বরং কয়েক বছরের মধ্যে কাফের কাজীউপাধি লাভ করেন পরিণত নজরুল যে কেবল ইসলাম ধর্মের কতোগুলো বিধানের বিরোধিতা করলেন, তাই নয়; আনুষ্ঠানিক ধর্মেরই তিনি পদচিহ্ন এঁকে দিলেন। কি করে এটা সম্ভব হয়েছিলো, বলা শক্ত। ছাত্রজীবনে এবং সেনাবাহিনীতে থাকার সময় তিনি অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের ঘনিষ্ঠতায় এসেছিলেন-- এই একটি তথ্য দিয়েই ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। হতে পারে বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতিতে যে সমন্বয়বাদী এবং ভক্তিবাদী ধর্ম প্রচলিত ছিলো, নিজের অজ্ঞাতেই সেই ধর্ম দিয়ে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু সেভাবেই হোক তার দৃষ্টিভঙ্গিতেই একটা অসাধারণ মানবতাবাদী ঔদার্য্য ছিলো। সাধনা করে অথবা বৈদগ্ধ্য দিয়ে এটা তিনি আয়ত্ত করেছিলেন বলে মনে হয় না। তার ফলে মাত্র তেইশ বছর বয়সেই তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, কোনো আনুষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস আন্তরিক হলে সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে ওঠা যায় না অথবা মানুষকে সমান চোখে দেখা যায় না সত্যিকারভাবে সাম্প্রদায়িকতার উপরে উঠতে পেরেছিলেন বলেই, জাতিভেদের মানবতা-বিরোধী বিকট চেহারা এবং ভণ্ডামির স্বরূপ তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পেরেছিলেন। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বলতে পারিস বিশ্বপিতা ভগবানের কোন সে জাত ? / কোন ছেলের তার লাগলে ছোওয়া অশুচি হন জগন্নাথ ? তিনি আপসোস করেছেন, মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া তার আগেকার আট শো বছরের বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত লালন ফকিরই জাতের এই মানবতা-বিরোধী চেহারা দেখতে পেয়েছিলেন এবং তিনিও তা দেখতে পেয়েছিলেন ভূমিজ সন্তান ছিলেন বলে। কিন্তু নজরুল জাতের নামে বজ্জাতির কথা লেখার পর যে-আশি বছর চলে গেছে, তার মধ্যে অন্য কেউ-আর এমন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জাতের বিভেদমূলক স্বরূপ তুলে ধরেননি। নজরুল রাজনীতিক ছিলেন না। কিন্তু সমকালের রাজনীতি দিয়ে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়েছিলেন। তার চারদিকে যেসব ঘটনা ঘটছিলো, সে সম্পর্কে তিনি সাহিত্যিক নির্লিপ্ততা অথবা নীরবতা পালন করতে পারেননি।

সে জন্যেই চিত্তরঞ্জন দাশ হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের যে-প্রয়াস দেখিয়েছিলেন, তাকে তিনি যেমন উদাত্ত কণ্ঠে স্বাগত জানিয়েছিলেন, অন্য কেউ তা জানাননি। চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পর তিনি একটি কবিতায় লিখেছিলেন যে, মুহাম্মদের আগে তার জন্ম হলে কোরানেও তার নাম থাকতো এমন সাহসের কথা বোধ হয় পরাধীন ভারতবর্ষেই লেখা সম্ভব ছিলো এখন ধর্মীয় উন্মত্ততার যুগে স্বাধীন ভারত অথবা স্বাধীন বাংলাদেশকোথাও কথা বলার জো নেই। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য অথবা অনৈক্য নজরুলের মনে যে কী প্রবল ভাবাবেগ এবং প্যাশনের জন্ম দিতো, তা আভাস পাওয়া যায় চিত্তরঞ্জন মারা যাওয়ার পরের বছর। ১৯২৬ সালের এপ্রিলে কলকাতায়, বলতে গেলে, সুপরিকল্পিতভাবে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা বাধিয়ে দেওয়া হয় মসজিদের পাশ দিয়ে যাবার সময়ে সবাই বাজনা বাজানো বন্ধ করেছিলো, একটি লোক ছাড়া। তার জবাবে মসজিদের ভেতর থেকে একদল লোক বেরিয়ে আসা অসম্ভব নয়। কিন্তু তারা লাঠিসোটা এবং ধারালো অস্ত্র কি করে পেলো কোনো পরিকল্পনা ছাড়া, বলা মুশকিল। সে যাই হোক, এই দাঙ্গাই ছিলো বঙ্গদেশের প্রথম সবচেয়ে ভয়াবহ দাঙ্গা। এতে বন্দুকও ব্যবহৃত হয়েছিলো। এর অল্প দিন পরেই কৃষ্ণনগরে কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। নজরুল এই দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে গান লেখেনকাণ্ডারী হুঁশিয়ার গানে তিনি রাজনীতিকদের মনে করিয়ে দেন তাদের দায়িত্বের কথাঅসহায় জাতি ডুবে মরছে। সময়ে ওরা হিন্দু, না মুসলিম প্রশ্ন তোলা অসঙ্গত, কারণ ওদের একমাত্র পরিচয় ওরা দেশমাতার সন্তান। কংগ্রেসের সম্মেলনে নজরুল আর দিলীপকুমার রায় গান উদাত্ত গলায় গেয়ে শোনান। কিন্তু রাজনীতিকরা তাদের আবেদনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখিয়ে চিত্তরঞ্জনের হিন্দু-মুসলিম প্যাক্ট বাতিল করেন। কেবল রাজনীতিক নন, অন্যরাও দাঙ্গার সময়ে নিজেদের গা বাচিয়ে চলেছিলেন। কলকাতায় তখন ছোটােবড়ো সংস্কৃতিকর্মী, বুদ্ধিজীবী, শিল্পীহিন্দুমুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরকম ছিলেন না। এমন কি, রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্রের মতো সাহিত্যিকও ছিলেন। সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, এই দাঙ্গার সময়ে ঠাকুরবাড়ির ভিস্তি আবদুলের দু কান কেটে দিয়েছিলো দাঙ্গাকারীরা। রক্ত ঝরতে থাকা কান নিয়েই আবদুল জোড়াসাকোর বাড়িতে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছিলো। আর-একদিন জনাচল্লিশ মুসলমান দাঙ্গাবাজদের তাড়া খেয়ে দেওয়াল টপকে বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলো। সুতরাং বাড়ির কারো দাঙ্গার কথা অজানা ছিলো না। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথেরও নয়। কিন্তু সমাজের বিশিষ্ট হিন্দু-মুসলমান কেউই নজরুলের মতো জোর গলায় কাণ্ডারী হুশিয়ার গাওয়া দূরে থাক, গুনগুন করেও হিন্দুমুসলিম ভ্রাতৃত্বের সুর ভাঁজেননি। রবীন্দ্রনাথ, ধরা যাক, খবরের কাগজে একটা বিবৃতি অন্তত দিতে পারতেন। বঙ্গভঙ্গের সময়ে তিনিই তো রাখী পরিয়েছিলেন মুসলমানের হাতে! একমাত্র কাণ্ডারী হুশিয়ার গান নয়, ১৯২৬ সালের দাঙ্গা দেখে নজরুল এতো ব্যাকুল হয়েছিলেন যে, তিনি মন্দির মসজিদ এবং হিন্দু-মুসলমাননামে দুটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন। মন্দির মসজিদ প্রবন্ধে আবেগে আপুত হয়ে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অনুসারীদের ধিক্কার দিয়েছেন।
ধর্ম যে মানুষের তৈরি এবং অর্থহীন, তারও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। হত-আহতদের ক্ৰন্দনে মসজিদ টলিল না, মন্দিরের পাষাণ দেবতা সাড়া দিল না। শুধু নির্বোধ মানুষের রক্তে তাহদের বেদী চিরকলঙ্কিত হইয়া রহিল।' কিন্তু হতাশা দিয়েই তার বক্তব্য তিনি শেষ করেননি। আশা করেছেন সেই রুদ্র আসিতেছেন, যিনি ধর্ম-মাতালদের আডডা মন্দিরমসজিদ-গীর্জা ভাঙিয়া সকল মানুষকে এক আকাশের গম্বুজতলে লইয়া আসিবেন। হিন্দু-মুসলমান প্রবন্ধে লিখেছেন, এই দুই সম্প্রদায়ের বিরোধের প্রধান কারণ মোল্লা-পুরুতের দেওয়া শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা হিন্দুত্ব মুসলমানত্ব দুই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্ব দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা দুটোই মারামারি বাধায়। টিকিত্ব হিন্দুত্ব নয়, ওটা হয়ত পণ্ডিতত্ব! তেমনি দাড়িও ইসলামত্ব নয়, ওটা মোল্লাত্ব!দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে একবারই নয়, নজরুল বারবার হিন্দু-মুসলমানের মিলন এবং ভ্রাতৃত্বের কথা বলেছেন। মনে করিয়ে দিয়েছেন মোরা একটি বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান। কখনো বলেছেন হিন্দু-মুসলমান দেশমাতার দুই আঁখি-তারার মতো। ভুল বোঝাবুঝি থেকে তাদের মনোমালিন্য হতে পারে, মারামারিও অসম্ভব নয়। কিন্তু তারা একই মায়ের দু সন্তান। তারা একই ভাষায় মাকে ডাকেন। বস্তুত, সংক্ষেপে বলা যায়, তিনি যেভাবে বারংবার হিন্দু-মুসলমানের মিলনের চেষ্টা করেছেন, বাংলা সাহিত্যে অন্য কেউ তা করেননি। অন্তরের অনুভূতি দিয়ে তো নয়ই, এমন কি, সামাজিক দায়িত্ব হিশেবেও নয়। আরও একটি জিনিশ বিশেষ করে লক্ষ্য করার মতোতিনিই প্রথম হিন্দু এবং মুসলিম ঐতিহ্যের অসামান্য মিলন ঘটিয়েছিলেন। কবিতার একই চরণে তিনি দেবতা এবং ফেরেশতা, অবতার এবং পয়গম্বরের কথা বলতে পারতেন। তিনিই বাংলা সাহিত্যের একমাত্র কবি, যিনি একই সঙ্গে হিন্দু এবং মুসলমানী ধর্মীয় সঙ্গীত রচনা করেছেন। কেবল তাই নয়, একই সঙ্গে রচনা করেছেন কীর্তন এবং শ্যামাসঙ্গীত তার শ্যামাসঙ্গীতে তিনি আবার শ্যামামায়ের সঙ্গে মিলন ঘটাতে পেরেছেন শ্যামের তার ভক্তির দৃষ্টিতে সব ধর্ম, সব বর্ণ একাকার হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলেন, নজরুলের সাহিত্যে বৈদগ্ধ্যের অভাব ছিলো তার নিজের ভাষায় "সেই চিরকেলে বাণী ছিলো না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার আগে অথবা পরে কেউই সব্যসাচীর মতো হিন্দু-মুসলিম ঐহিত্যের এমন সমন্বয় ঘটাতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথও নন। সাহিত্যের মান বিচার করলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের কোনো তুলনা চলে না, কিন্তু ঐতিহ্য সমন্বয়ের প্রশ্ন উঠলে স্বীকার করতেই হবে যে, নজরুল যেমন করে হিন্দু-মুসলিম ঐহিত্যের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তা আদৌ করতে পারেননি। করার চেষ্টাও করেননি। বস্তুত, বাড়ির কাছের পড়শিদের প্রাঙ্গণের ধারে গেলেও তিনি তাদের বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করেননি। অপর পক্ষে, নজরুল তা কেবল করেননি, সার্থকভাবে করেছিলেন তিনি যেভাবে তৎসম-তদ্ভব শব্দের সঙ্গে আরবি-ফারসি শব্দের মিলন ঘটিয়েছিলেন, তাও একমাত্র তারই রচনায় দেখা যায়। এবং তিনি এটা করেছিলেন, আধুনিক বাংলা ভাষার জন্মদাতা এবং পালক রবীন্দ্রনাথ যখন খুনশব্দের ব্যবহারে বিরক্ত হয়েছেন, সেই প্রতিকূল সময়ে।
হিন্দু-মুসলমানের মিলনের প্রয়াসে তিনি যে-ভূমিকা রেখেছিলেন, নজরুল নিজেই তার মূল্যায়ন করেছেন: 'আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ড শেক করাবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আজও হিন্দু-মুসলমান এক হতে পারেননি। স্বাধীনতা লাভের পরে শিক্ষা এবং অর্থনীতির উন্নতির ফলে তাদের পারপরিক রক্তপাত এবং হানাহানি বন্ধ হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু তা হয়নি। বরং পশ্চিমবঙ্গে গৈরিক পতাকা এখন পতপত করে উড়তে শুরু করেছে। আর বাংলাদেশে হিন্দু খেদানোর সহিংস প্রক্রিয়া আরও জোরদার হয়েছে। বাংলাদেশে ইদানীং দাঙা হলে, হিন্দু খুন করে পুণ্য অর্জনের চেষ্টা না-করে ধর্মান্ধরা হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করে আর বাড়িতে আগুন লাগায়। তাদের লক্ষ্য; ভয়ভীতি দেখিয়ে হিন্দুদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের সম্পত্তি আত্মসাৎ করা। এমন কি, তথাকথিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পরেও হিন্দুদের ওপর নেমে আসে অত্যাচারের খড়গ কৃপাণ তাদের অপরাধ: সম্ভবত তারা অসাম্প্রদায়িক প্রার্থীদের ভোট দিয়েছেন। মোট কথা, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও, হিন্দু-মুসলমানের প্রেম কিছু বৃদ্ধি পায়নি। নজরুলের প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। আশি বছর আগে চিত্তরঞ্জন সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, হিন্দু-মুসলমানের পরানে তুমিই বাধিলে সেতু! কথা সমান সত্য তার সম্পর্কেও। কিন্তু মর্মান্তিক সত্য হলো: চিত্তরঞ্জন এবং নজরুল প্রেমের আহবান জানালেও, দুজনার ললিত বাণীই হাওয়ায় ভেসে গেছে। নজরুলের অসাম্প্রদায়িকতা আমরা যে কেবল সাহিত্যের মধ্যেই লক্ষ্য করি, তাই নয়। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি আনুষ্ঠানিক ধর্মের উর্ধ্বে উঠতে পেরেছিলেন। তার বন্ধুত্ব কোনো ধর্মীয় গভীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না। এমন কি, বিয়েও তিনি করেছিলেন নিজের ধর্মের সীমানা অতিক্রম করে। এসব ক্ষেত্রে মুসলমানরা স্ত্রীকে ধর্মান্তরিত করেন। অপর পক্ষে, নজরুলের সেই সৎসাহস ছিলো যে, প্রমীলার ধর্মবিশ্বাসের ওপর প্রভাব না-খাটিয়েই তাকে বিয়ে করতে পেরেছিলেন। যে পরিবারে তিনি বিয়ে করেছিলেন, সেই পরিবারের সদস্যরা তাকে ভালোবাসতেন। কিন্তু তাদের বাড়ির কন্যাকে মুসলমানের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্যে তৈরি ছিলেন না। এই পরিবারের বিরজাসুন্দরী দেবীকে নজরুল নিজের মায়ের শূন্য আসনে বসিয়েছিলেন, কিন্তু তিনিও বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। হিন্দু সমাজের অনেক রক্ষণশীল সদস্যরাও নয়। কারণ, একে তারা বিবেচনা করেছিলেন তাদের জাত মারার একটি চোখ-ধাধানো দৃষ্টান্ত হিশেবে সন্তানদের নামকরণ এবং শিক্ষায়ও এই অসাম্প্রদায়িকতার প্রমাণ দিয়েছিলেন নজরুল। তার প্রথম সন্তানের নাম তিনি দিয়েছিলেন কৃষ্ণ মহাম্মদ। মুসলমানদের মধ্যে এখন বাংলায় নাম রাখেন অনেকেই। কিন্তু কৃষ্ণ এবং মহাম্মদের মিলন ঘটিয়ে নয়। দ্বিতীয় পুত্রের নাম দিয়েছিলেন অরিন্দম খালেদ তৃতীয় এবং চতুর্থ পুত্রের নাম দিয়েছিলেন যথাক্রমে সব্যসাচী আর অনিরুদ্ধ। অরিন্দম, সব্যসাচী এবং অনিরুদ্ধতিনটি নামেরই ধর্মনিরপেক্ষ অর্থ থাকলেও, তাদের ধর্মীয় অনুষঙ্গই প্রধান মুসলমানরা এতে তার প্রতি প্রসন্ন হতে পারেননি। কিন্তু নজরুল সে সমালোচনা অগ্রাহ্য করতে পেরেছিলেন। কারণ, আনুষ্ঠানিক ধর্মের চেয়েও মানবিক এবং ভাষিক পরিচয় তার কাছে বড়ো ছিলো। সন্তানদের তিনি কোনো ধর্মীয় শিক্ষাও দেননি। নিজেও ব্যক্তিগত জীবনে কোনো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতেন না। দ্বিতীয় পুত্র মারা যাওয়ার পর তিনি যখন শোকে প্রায় উন্মাদ হয়ে যান, তখন অবশ্য বরদাচরণ মজুমদারের প্রভাবে পড়ে তিনি কালী পূজো করতে আরম্ভ করেছিলেন বলে কেউ কেউ লিখেছেন

অদৃষ্টের পরিহাস এই যে, যে-নজরুল ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার গান গেয়েছেন, মুসলমানরা, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা সেই নজরুলের নাম ব্যবহার করেই মুসলিম জাতীয়তাবাদের নিশান উড়িয়েছেন। তারা নজরুলের নাম ভাঙিয়েছেন নিজেদের সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্যে। রবীন্দ্রনাথ থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে রাখার জন্যে পাকিস্তানীরা নজরুলকে খাড়া করেন মুসলমান-রবীন্দ্রনাথ হিশেবে তার কবিতার ভাষা সংস্কার করে তারা নজরুলের ভগবান'কে 'রহমানে পরিণত করেন। মহাশ্মশানকে বদলে করেন গোরস্থান সামগ্রিক নজরুলকে নয়, তারা খাড়া করলেন এক খণ্ডিত নজরুলকে নজরুলের ইসলামী গান বাজানো হলো বেতারে, টিভিতে। নজরুল যে শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন এবং অন্যান্য ভক্তিবাদী গানও লিখেছিলেন, তার কথা কেউ জানলোও না। পাঠ্যবইতে তিনি যে-প্রাধান্য পেলেন তা তার অবদানকে ছাড়িয়ে গেলো। এমন কি, অনেক সময়ে রবীন্দ্রনাথ স্নান হয়ে গেলেন নজরুলের ছায়ায় যে-কালে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করাকে সরকার ভালো চোখে দেখতো না, এই কালে নজরুল-জয়ন্তী পালনে সরকারের উদার পৃষ্ঠপোষণ মিললো। এমন কি, যে-নজরুলকে ১৯২০-এর দশকে মুসলমানরা নমরুদ, ফেরাউন, শয়তানের অবতার এবং কাফের বলে গাল দিয়েছিলেন, সেই নজরুল পঞ্চাশের দশকে সংস্কার-সাপেক্ষে মুসলমান হয়ে উঠলেন, আর শতাব্দীর শেষে এসে নব্যসাম্প্রদায়িকতায়-উন্মত্ত লোকেদের কাছে তিনি পাক্কা মুসলমানে পরিণত হলেন নজরুল একদিনে মরেননি তিনি নির্বাক হয়ে বেঁচেছিলেন পয়তিরিশ বছর। তারপর কেটে গেছে আরও তিরিশ বছর এই প্রায় পয়ষট্টি বছরের মধ্যে তিনি কয়েকবার মারা যান। তার গানের চরম অনাদর থেকে মনে হয়, তিনি প্রথম বার মারা যান পশ্চিমবাংলায়, দেশবিভাগের ঠিক পরে। মনে হয়, তার পেছনেও ছিলো সাম্প্রদায়িকতা। দ্বিতীয় বার তিনি মারা যান পূর্ব পাকিস্তানে, তাকে খণ্ড খণ্ড করে হাজির করায়। তৃতীয়বার মারা যান বাংলাদেশে, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করায়। চতুর্থবারও মারা যান বাংলাদেশে মৌলবাদীদের হাতে এবারে কেবল ব্যক্তি নজরুল নন, তার আদর্শও ভূত অর্থাৎ অতীত হয়ে যায়। নজরুল মরেও মুসলিম জাতীয়তাবাদের হাত থেকে রেহাই পাননি। পরিজনের মতামত ছাড়াই তাকে যে ঢাকায় সমাধিস্থ করা হয়, সেও ইসলামের প্রতীক হিশেবে তার নাম ব্যবহার করার জাতীয়তাবাদী উদ্দেশ্য থেকেই অথচ ধমীয় জাতীয়তাবাদের প্রভাবে উভয় বাংলাতেই বাঙালিত্ব যখন বিপন্ন, এমন কি, বিপন্ন যখন মনুষ্যত্ব, তখন নজরুলের বেঁচে থাকাটাই খুবই দরকার ছিলো। বস্তুত, একজন নজরুল নয়, খুবই দরকার ছিলো ঘরে ঘরে নজরুলের।

2 comments:

 
back to top