রসুলাল্লাহর সকল সুন্নার সার-সংক্ষেপ কি? ইহা মাওলা আলী (আ.) কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হইলে নিম্নলিখিত হাদিসটি রসুলাল্লাহ কর্তৃক বর্ণিত হয়। মিশরের মোহাম্মদ হোসেন হাইকল-এর লিখিত Life of Muhammad নামক পুস্তক হইতে উদ্ধৃত করা হইল: ১. মারেফাত আমার মূলধন। Wisdom is my capital. ২. যুক্তি আমার ধর্মের শক্তি। Reason the force of my religion. ৩. প্রেম আমার ভিত্তি। Love my foundation. ৪. আকাঙ্খা আমার বাহন। Longing is vehicle. ৫. আল্লাহর জিকির আমার স্থায়ী আনন্দ। The remembrance of Allah (Zikrillah) my
constant pleasure. ৬. একিন আমার ধনভাণ্ডার। Trust
(Eqin) my treasure. ৭. জ্ঞান আমার হাতিয়ার। Knowledge (Alem) my arm. ৮. ধৈর্য আমার অলঙ্কার। Patience my robe (Zinat)
৯. সন্তোষ আমার জেহাদলব্ধ সম্পদ। Contentment
my booty. ১০. নিঃস্বতা আমার গৌরব। Poverty
my pride. ১১. সন্ন্যাস আমার পেশা। Asceticism
(রোহবানিয়াত) my profession. ১২. সঠিক সিদ্ধান্ত আমার শক্তি। Conviction my Strength. ১৩. সত্যবাদিতা আমার মধ্যস্থতাকারী। Truthfulness my intercessor. ১৪. বাধ্যতা আমার যুক্তিপ্রণালী। Obedience my argument. ১৫. জেহাদ আমার নীতিবিজ্ঞান। Zehad my ethics. ১৬. সালাত (বা ধ্যান) আমার পরম আনন্দ। Mediation my supreme pleasure. ১৭. দুঃখের বিলাপ আমার চিরসাথী। Mourning my companion.
হাদিসটির ব্যাখ্যা উপরে উল্লিখিত হাদিসটি রসুলাল্লাহর সকল হাদিস এবং সুন্নার সংক্ষিপ্ত সারকথা। ইহাতে ১৭টি কথার উল্লেখ আছে। প্রথম কথা হইল:
১. মারেফাত আমার মূলধন। ‘মারেফাত’ অর্থ দর্শন বা জ্ঞান। ইহার অপর নাম সালাত। সপ্ত ইন্দ্রিয় দ্বারের মাধ্যমে যাহা কিছু আমাদের অস্তিত্বের মধ্যে প্রবেশ করে তাহা এক এক করিয়া দর্শন করিলে অর্থাৎ দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ ইত্যাদি সঠিক দর্শন করিলে উহা হইতে যে মারেফাত বা জ্ঞান উৎপন্ন হয় উহাই মানুষের মূলধন। যে যতটুকু সালাতের গভীরে যাইতে পারে তাহার মূলধন তত বেশী।
২. ‘যুক্তি আমার ধর্মের শক্তি’। ধর্মসমূহকে গ্রহণ ও বর্জন বিষয়ে মানুষ স্বভাবত অত্যন্ত দূর্বল। যুক্তিযুক্তভাবে ধর্মসমূহকে গ্রহণ ও বর্জন করিতে না শিখিলে ধর্মগুলি সংস্কাররুপে মানুষকে বন্দি করিয়া দুর্বল করিয়া ফেলে। যুক্তির সহিত যথাযথভাবে ধর্মরাশির মোকাবেলা করিলে ইহা হইতে আত্মিক মহাশক্তি অর্জন করা যায়। এই যুক্তি সম্যক গুরুর নিকট হইতে শিক্ষণীয়।
৩. ‘প্রেম আমার ভিত্তি’। বিশ্বসৃষ্টির মূলভিত্তি প্রেম। সুতরাং আল্লাহ-রসুলের সকল কর্মকাণ্ড প্রেমকে কেন্দ্র করিয়াই চলিতেছে। প্রেমহীন জীবন পশুর জীবন হইতেও হীন। আল্লাহ ও তাঁহার রসুলগণ মানুষকে তাঁহাদের প্রতি আকৃষ্ট করিয়া তাঁহাদিগকে প্রেম করিতে শিক্ষা দেন, যে প্রেম মানুষকে ক্রমশ উন্নত করিয়া আল্লাহর নৈকট্য দান করিয়া থাকে। ঊর্ধমুখী প্রেম ইনসানকে পরম উন্নতি দান করে আর নিম্নমুখী প্রেম স্নেহরূপে প্রকাশিত হইয়া নিম্ন পর্যায়ের লোকদিগকে উন্নতির দিকে ধাবিত করে। প্রেমহীন জগৎ মনুষ্য বাসের যোগ্য নহে। সুতরাং প্রেম মহানবীর ভিত্তি।
৪. আকাঙ্খা আমার বাহন। জীবজগতে যে যাহা একান্তভাবে আকাঙ্খা করে সে তাহাই পায়। চাহিদার এই ভিত্তির উপরই জীবজগতের আবর্তন ও বিবর্তন চলিতেছে, এই কথা কোরানে বহুরূপে বহুবার উল্লিখিত আছে। সুতরাং আমাদের জন্য রসুলের শিক্ষা হইল আকাঙ্খাকে বাহন করিয়াই পরম উন্নতির দিকে অগ্রসর হইতে হইবে। ইহা অতি মুল্যবান একটি সুন্নাত।
৫. উল্লিখিত আকাঙ্খাকে সার্থকরূপে কার্যকর করিতে চাহিলে আল্লাহর স্মরণ ও সংযোগক্রিয়া আনন্দের সহিত পালন করিতে হইবে। যাহারা সদা সর্বদা জিকিরের আনন্দে অর্থাৎ আল্লাহর স্মরণ ও সংযোগের আনন্দে থাকেন তাহারাই মুক্তির পথে কামিয়াব হইয়া থাকেন।
৬. একিন অর্থ আত্মপ্রত্যয়, আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস না থাকিলে কোনও কাজেই মানুষ সফলতা অর্জন করিতে পারে না। একিন তিন পর্যায়ভুক্ত : প্রথমত এলমুল একিন, তারপর আইনাল একিন, পরিশেষে হাককুল একিন।
৭. এখানে Knowledge বা Awareness অর্থাৎ জ্ঞান বা সজাগতা বা জানা বলা হয়েছে হাতিয়ার বা বাহুবল। এখানে রসুলাল্লাহ আরবি শব্দ কি ব্যবহার করিয়াছেন তাহা জানা নাই বিধায় হাতিয়ার এবং বাহুবল উভয় অর্থে প্রকাশ করিলাম। সেই সকল ধর্মরাশি বা বিষয়বস্তু অবিরামভাবে আমাদের ইন্দ্রিয় দ্বার দিয়া প্রবেশ করিতেছে সেইগুলির প্রত্যেকটি সম্বন্ধে অবগত বা জাগ্রত থাকিলে উহা হইতে মানসিক শক্তি উৎপন্ন হয়। এই দর্শনক্রিয়া একটি মৌলিক অস্ত্র যাহা দ্বারা সকল মিথ্যা ও শেরেক অতিক্রম করিয়া শুদ্ধি লাভের পথ প্রতিষ্ঠিত করা যায়। রসুলের সুন্নার ইহা একটি ব্যাপক ও বিরাট বিষয়, যদিও ইহা সমাজে প্রচ্ছন্ন বা অস্পষ্ট রহিয়াছে।
৮. ‘ধৈর্য আমার অলঙ্কার (বা পোশাক)’। এইখানে তিনি পোশাক বলিয়াছেন না অলঙ্কার বলিয়াছেন তাহা নির্ণয় করিতে পারিলাম না। অবশ্য উভয়প্রকার রূপই সম্যকভাবে প্রযোজ্য। ধৈর্য ব্যতিত মহত্ব অর্জন করা সম্ভব নহে। ধৈর্যগুণ মহাগুণ। ইহার সাহায্যে অসম্ভবও সম্ভবপর হইয়া উঠে। ধৈর্য ব্যতিত ধর্মের সঠিক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না।
৯. অল্পে তুষ্ট হওয়া বিষয়টি মনের জন্য সহজসাধ্য বিষয় নহে। মনের এই সন্তোষ অর্জন করিতে হয় ‘জেহাদে আকবর’-এর সাহায্যে। সন্তোষ মনের বিশ্রামপ্রাপ্ত শান্ত অবস্থা। বস্তুমোহের শিরিক মাখানো অবস্থাসমূহ হইতে মানসিক জেহাদের মাধ্যমে মন বিষয় হইতে বিষয়ান্তরে ছুটাছুটি করা ত্যাগ করে এবং মহাস্থির শান্ত অবস্থা অর্জন করে। এইরূপ স্থিরতা জেহাদলব্ধ মহাসম্পদ। শিরিকহীন এই অবস্থা জন্মচক্র হইতে মুক্ত।
১০. ‘নিঃস্বতা আমার গৌরব’। নিঃস্বতা অর্থ মনের মহাশূন্যতা সম্পূর্ণভাবে শিরিকহীন অবস্থা। ধর্ম নিরপেক্ষ অবস্থা। সংস্কার সমূদ্রের উপরে ভাসমান থাকিয়া মনকে বিষয়বস্তুর ঊর্ধে শিরিকমুক্ত রাখিবার গৌরব রহিয়াছে। ইতা ছাড়া গৌরবলাভের দ্বিতীয় আর কোনও বিকল্প নাই। বস্তুজগতে বাস করিয়াও বস্তুমোহ হইতে মন-মস্তিস্ককে একেবারে নিঃস্ব করিয়া তুলিবার মধ্যে সকল গৌরব। মানুষের জন্য এই গৌরব মহানবীর সুন্নতের সকল দিক-নির্দেশনা।
১১. ‘সন্ন্যাস আমার পেশা’। আরবি শব্দটি হইল ‘রোহবানিয়াত’। কোনও একটি পেশা অবলম্বন করিয়া মানুষ যেমন বাঁচিয়া থাকে, তেমনই সন্ন্যাসভাব সিদ্ধপুরুষের একটি পেশা। বস্তুজগতে থাকিয়াও বস্তুমোহ ত্যাগের এই পেশা অবলম্বন ব্যতিত বিষয়বস্তুর শিরিক হইতে মুক্ত হওয়া যায় না। পেশা হইতে জগৎবাসী যেমন জীবিকা অর্জন করিয়া থাকে তদ্রুপ সাধক-জীবনের জীবিকা সন্ন্যাস হইতে অর্জিত হয়।
১২. শিরিক হইতে মহাশূন্যভাবে থাকিলে তাহা হইতে যে সিদ্ধান্ত আসে তাহা হয় নির্ভুল এবং শক্তিশালী। আত্মিক শক্তি আসল শক্তি। ইহা মুক্তিপথের দিশারী। শিরিকহীন মন হইতে সঠিক সিদ্ধান্ত বা দৃঢ় বিশ্বাস উদয় হইয়া থাকে। ইহাই মানুষের মৌলিক শক্তি।
১৩. ‘সত্যবাদিতা আমার মধ্যস্থতাকারী’, অর্থাৎ সাহায্যকারী। শিরিকের মধ্যে সত্যবাদিতা নাই। বস্তুবাদী মানুষ শিরিকের মধ্যে বস্তুগত সাহায্য খুঁজিয়া পায়। প্রকৃতপক্ষে উহা অর্থাৎ বস্তুগত সাহায্য সত্তায় মুক্তির সহায়ক নহে। বরং সত্যবাদিতা রহিয়াছে লা-শরিক অবস্থায়। অর্থাৎ মহাশূন্যবাভের মধ্যেই সত্য রহিয়াছে এবং উহাই মুক্তিপথের সহায়ক।
১৪. রক্তমাংসের সত্তা হইয়াও বৈষয়িক বিষয়ে মহাপুরুষের নিজস্ব কোনও যুক্তি নাই। যাহা আছে তাহার সকল যুক্তিই উচ্চতম কর্তার প্রতি আনুগত্য হইতে হইয়া থাকে। রসুলাল্লাহ মহাপুরুষদের প্রতিনিধি হিসাবে এই কথাই প্রকাশ করিতেছেন।
Though with flesh and blood I have no argument of my own in this humdrum world.
All my arguments come from my obedience to Highest Authority.
১৫. ‘জেহাদ করিতে থাক’ ইহাই রাসুলের মূলনীতি। এই জেহাদ প্রধানত মানসিক জেহাদ। সামাজিক প্রয়োজনে ইহা সম্যক নেতার নির্দেশমত অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের শক্তি প্রয়োগ। সুতরাং জেহাদ সর্বদাই কল্যাণমুখী, কোনও অবস্থাতেই হিংসাত্মক নহে।
১৬. সালাতের মাধ্যমেই সাধক সিদ্ধিলাভ করে। তাই সালাত বিষয়টি তার নিত্যানন্দের বিষয়। বস্তুর মোহে সংযুক্ত আনন্দ ক্ষণস্থায়ী বা অনিত্য। সালাত সাধককে শিরিকমুক্ত করিয়া অনিত্যতা হইতে নিত্যতায় পৌঁছাইয়া দেয়। সালাত সার্বক্ষণিক, ইহা সর্ব অবস্থায় এবং সর্ব কর্মে প্রযোজ্য, ধ্যানভিত্তিক সাধনা। সার্বক্ষণিক সালাত যে করে তাঁহাকে মুসুল্লি বলে। মুসুল্লি শেরেকমুক্ত অবস্থায় থাকিবার কারণে নিত্যানন্দ উপভোগ করে।
১৭. চরম পরম মোহাম্মদরূপে অর্থাৎ নূর মোহাম্মদরূপে তিনি প্রতিটি ব্যক্তিসত্তার মধ্যে বিদ্যমান আছেন। ব্যক্তির শিরিকযুক্ত কর্মকাণ্ডের কারণে তিনি আচ্ছাদনে পড়িয়া আছেন, জাগ্রত হইতে পারিতেছেন না। ইহাই তাঁহার দুঃখের বিলাপস্বরূপ ব্যক্ত হইয়াছে। আসলে দুঃখটা ব্যক্তিসত্তার। ব্যক্তিসত্তার এই দুঃখের সহিত তিনি চিরসাথীরূপে বর্তমান। জাগ্রত সত্তারূপে রসুলাল্লাহ জিন ও ইনসানের পক্ষ হইয়া এই বিলাপ প্রকাশ করিতেছেন।
উল্লেখিত হাদিসগুলোর ব্যাখ্যাকারী 'মাওলা সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী'র নাম উল্লেখ করা হয়নি। ধন্যবাদ।
ReplyDelete