১.
ইয়েমেনে আল-কায়দার মতো কিছু উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বহু বছর ধরে তৎপর ছিল। এদেরকে দমনের নামে মার্কিন সরকার সেখানে প্রায়ই ড্রোন হামলা চালাত বলে মাঝে মধ্যেই খবর আসত। কিন্তু এখন সেসব হামলা বন্ধ হয়ে গেছে। অতীতেও এমন অভিযোগ ছিল যে, মার্কিন ড্রোন আসলে আল-কায়দার ওপর হামলা না করে ইয়েমেনের দেশপ্রেমিক বিপ্লবী শক্তিগুলোর ওপর হামলা চালাত। আসলে আল-কায়দার মতো সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাই নিজ হাতে গড়ে তুলেছে দেশে দেশে হামলা চালানোর অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করার জন্য।
২.
ইয়েমেনে আনসারুল্লাহ নামের ইসলামী প্রতিরোধ ও জাগরণ গোষ্ঠীর সদস্যরা তথা হুথি যোদ্ধারা এখন আলকায়দা ও তাদের সমমনা উগ্র ওয়াহাবি-তাকফিরি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।
৩.
হুথি যোদ্ধারা শিয়া মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তাদের এ কাজকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে দেশটির সশস্ত্র বাহিনীসহ শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে আপামর জনগণ। হুথিরা একের পর এক নানা শহর ও প্রদেশ দখল করতে পেরেছে আপামর ইয়েমেনি জনগণের সমর্থনের কারণেই। সশস্ত্র বাহিনী ছাড়াও জনগণের একটা অংশ স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী হয়ে হুথিদের ও আনসারুল্লাহকে সহায়তা দিচ্ছে আল-কায়দা এবং আইএসআইএল-এর বিরুদ্ধে।
৪.
ইয়েমেনে সৌদি আরবের আগ্রাসন ও প্রচণ্ড বিমান হামলা শুরু হওয়ার পরও আনসারুল্লাহ, সশস্ত্র বাহিনী ও গণবাহিনী দেশটির নানা অঞ্চলকে আলকায়দা ও তার সমমনা গোষ্ঠীগুলোর হাত থেকে উদ্ধারের অভিযান সাফল্যের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছে।
৫.
আলকায়দা ও তার সমমনা গোষ্ঠীগুলোর সন্ত্রাসী তৎপরতায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল ইয়েমেনের জনগণ। কিন্তু হুথি ও আনসারুল্লাহ বাহিনী ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর কারণ তারা নানা অঞ্চল জয় করার পর সেইসব অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের শান্তিপূর্ণ ও গঠনমূলক আচরণ দেখেই জনগণ তাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং তাদেরকে ত্রাণকর্তা বলেই মনে করছে।
হিজবুল্লাহ, হামাস ও ইরানের মতোই ইয়েমেনের আনসারুল্লাহও ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরোধী। তাই বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ও তাদের সেবাদাস-চক্র বিপ্লবী এই শক্তির বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে শত্রুতা করবে- এটাই স্বাভাবিক।
৬.
ইয়েমেনে উত্তরাঞ্চলে শিয়া মুসলমানদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। এইসব অঞ্চলে শিয়া মুসলমানদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চলে তাদের সংখ্যা আরও কম। প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। অথচ সৌদি নেতৃত্বাধীন আরব দেশগুলোর বিমান বাহিনী ইয়েমেনের নানা অঞ্চলের ওপর এমন নির্বিচার বোমা বর্ষণ করছে যে তাতে শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে দেশটির সব সম্প্রদায়ের বেসামরিক নাগরিক নিহত হচ্ছে। যাদের মধ্যে বহু সংখ্যক নারী ও শিশুও রয়েছে।
৭.
এক সময় আলকায়দা ও তালেবানের মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে মার্কিন সরকার সন্ত্রাসী বলে ঘোষণা দিয়ে আফগানিস্তান ও ইরাকে হামলা চালিয়েছিল। আর এইসব হামলায়, বিশেষ করে সাদ্দামের ইরাকি বাহিনীর ওপর হামলায় সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছিল সৌদি সরকার। আর এখন এইসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা তাদেরই নতুন সংস্করণ ইয়েমেনে, সিরিয়ায় ও ইরাকে আমেরিকা এবং তার সেবাদাস আরব রাজ-সরকারগুলোর জন্য খুবই মহৎ ও অতি আপন শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
৮.
এক সময় ইরানের বিরুদ্ধে সাদ্দামকে হাজার হাজার কোটি ডলার দিয়ে সহায়তা করেছিল সৌদি সরকারসহ আরব রাজা-বাদশাহরা। কিন্তু কুয়েতে ইরাকি হামলার পর তারা সবাই সাদ্দামের শত্রু হয়ে পড়ে। আর এই আরব রাজা-বাদশাহদের ভূমি ব্যবহার করে ও তাদের অর্থ ব্যবহার করে মার্কিন বিমানগুলো ইরাককে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে এবং অবশেষে সাদ্দামকেও নির্মূল করে। কথিত সুন্নি সাদ্দামকে নির্মূলে সৌদি সরকারের ভূমিকাকে সাদ্দামপন্থী সুন্নিরা কি কখনও ভুলতে পারবেন?
৯.
সিরিয়ায় তৎপর সন্ত্রাসী ওয়াহাবি-তাকফিরি গোষ্ঠীগুলোকে মদদ দেয়ার জন্য সৌদি সরকার হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করেছে। সিরিয়ার লাখ লাখ নিরীহ বেসামরিক মানুষের রক্তে সৌদি সরকারের হাত রঞ্জিত। একইভাবে কাতার, আরব-আমিরাত ও তুর্কি সরকারও সিরিয় জনগণের রক্তের বন্যা বইয়ে দিতে সহকারী জল্লাদের ভূমিকা পালন করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে।
১০.
সিরিয়ার আসাদ সরকার প্রচণ্ড ইসরাইল বিরোধী। মূলত: মধ্যপ্রাচ্যে দখলদার ইসরাইল-বিরোধী আরব শক্তিগুলোর মাথাই হলো আসাদ। আর তাই ইসরাইল ও আমেরিকা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে তাকফিরি ওয়াহাবি সন্ত্রাসীদের দিয়ে আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চেয়েছে। কিন্তু ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকায় পঙ্গপালের মতো সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়েও তারা আসাদকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। আসাদ সরকারের সেনারা নিরীহ জনগণের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করেছিল বলে পাশ্চাত্য বেশ জোরে-শোরে প্রচারণা চালিয়েছিল। কিন্তু জাতিসংঘের তদন্ত দল তা প্রমাণ করতে পারেনি। বরং উল্টো প্রমাণিত হয়েছে যে পশ্চিমাদের মদদ-পুষ্ট সন্ত্রাসীরাই বার বার সিরিয়ার বেসামরিক জনগণের ওপর রাসায়নিক হামলা চালিয়েছে। ওবামা, ক্যামেরন ও রাজা-বাদশাহরা কেনো এখন এ বিষয়ে মুখ বন্ধ করে রেখেছেন?
১১.
সৌদি আরব এখন নিজেকে ইসলামের ত্রাণকর্তা বলে প্রচার করছে। কিন্তু সৌদি সরকারসহ আরব রাজা-বাদশাহগুলো সব সময়ই ইসরাইলের সেবাতেই নিয়োজিত থেকেছে। তারা ইসরাইলের দিকে একটি গুলিও কখনও ছুঁড়েনি। মজলুম ফিলিস্তিনিদের জন্য, বিশেষ করে হামাস ও ইসলামী জিহাদের মতো জিহাদি ফিলিস্তিনি দলগুলোর জন্য তারা তেমন কোনো অর্থ সহায়তাও কখনও দেয়নি।
১২.
পবিত্র কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী মুসলমানদের সঙ্গে শত্রুতার ক্ষেত্রে ইহুদিরাই হচ্ছে সবচেয়ে কঠোর। অথচ সেই ইহুদিদেরই প্রধান সেবক শক্তি মার্কিন সরকারসহ পাশ্চাত্যের সরকারগুলোর সেবাদাসত্ব করে যাচ্ছে আরব রাজা-বাদশাহরা। আরব ভূখণ্ডে তুর্কি খেলাফতের আওতাধীন অঞ্চলে সৌদিদেরকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল ইংরেজরা এই শর্তে যে ফিলিস্তিনে ইহুদিবাদীদের জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি করবে না ওয়াহাবি সৌদ বংশ! আর এরই প্রতিদান হিসেবে এখন ইয়েমেনে সৌদি বিমান হামলায় শরিক হচ্ছে ইসরাইলি জঙ্গি বিমান!!!
১৩.
ইয়েমেনে বর্তমান বিপ্লবী সরকার নাকি আরব রাজা-বাদশাহদের ওপর হুমকি হয়ে উঠেছিল। এই দেশটি নাকি ইরানের প্রভাবিত হয়ে পড়েছে! ইয়েমেনিরা ভবিষ্যতে মক্কা-মদীনা দখল করে নিতে পারে!–এইসব গুজব প্রচার করা হচ্ছে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে। অথচ ইয়েমেনের নানা রাজনৈতিক শক্তির দ্বন্দ্বে রিয়াদই সব সময় হস্তক্ষেপ করে এসেছে, ইরান নয়। ইয়েমেনের তেল-সমৃদ্ধ বেশ কিছু অঞ্চল সৌদি সরকারের দখলে থাকা সত্ত্বেও ইয়েমেন কখনও সৌদি আরবে হামলা চালায়নি। বরং সৌদি সরকারই বার বার ইয়েমেনে হামলা চালিয়েছে।
১৪.
ইয়েমেন আরব বিশ্বের অত্যন্ত দরিদ্র একটি দেশ। তার অস্ত্র ও অর্থ শক্তি সৌদি সরকারের তুলনায় খুবই তুচ্ছ। তাই এই ইয়েমেন হঠাৎ করে কেনো আরব রাজা-বাদশাহ শাসিত সরকারগুলোর জন্য হুমকি হবে?!
১৫.
সৌদি সরকার নিজেকে সুন্নি ইসলামী দলগুলোর সমর্থক বলে জাহির করছে। তাহলে এই সরকার কেনো মিশরে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী বৈধ মুরসি সরকারকে উৎখাতে দেশটির সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করলো? কেনো সিসি সরকারকে শত শত কোটি ডলার অর্থ সাহায্য দিয়েছেন সৌদি রাজা? কেনো ফিলিস্তিনের সুন্নি মুসলমানদের রক্ষার জন্য সৌদি সরকার কখনও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
১৬.
ইয়েমেনের জনগণ আরব বসন্তের জোয়ারে কিংবা ইসলামী গণ-জাগরণের জোয়ারে প্রায় তিন দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা সালেহ সরকারকে উৎখাত করেছিল। এরপর এক প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে পাশ্চাত্য ও সৌদিপন্থী মানসুরকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল। কিন্তু নিজের অযোগ্যতার কথা স্বীকার করে এই মানসুর নিজেই পদত্যাগ করেন। এখন সৌদি সরকারসহ এ অঞ্চলে আমেরিকার সেবাদাস সরকারগুলো আবারও তাকে ক্ষমতায় বসাতে চাচ্ছে ইয়েমেনি জনগণের ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে। এরা পারলে এখন আবারও মুবারককে মিশরের ক্ষমতায় বসাক এবং বেন আলিকে তিউনিসিয়ার ক্ষমতায় বসাক। কেবল পালিয়ে যাওয়া মানসুরকেই কেনো ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে?
১৭.
আনসারুল্লাহর নেতারা বা শিয়া হুথিরা ইয়েমেনের ক্ষমতায় বসতে চায় না বলে বার বার ঘোষণা করে এসেছে। তারা ইয়েমেনের জনপ্রতিনিধিত্বশীল সবগুলো দলের সঙ্গে সংলাপে বসতে এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। একমাত্র ইয়েমেনের জনগণই ইয়েমেনের ভাগ্য নির্ধারণ করার অধিকার রাখে বলে তারা মনে করে। বিজাতীয় শক্তিগুলোর নির্দেশের কাছে তারা মাথা নত করছে না বলেই বিপ্লবী এই আন্দোলনের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং তাদের স্থানীয় সেবাদাস সরকারগুলো। কিন্তু আফগানিস্তান, সিরিয়া ও ইরাকের মতো এখানেও তারা ব্যর্থ হবে।
১৮.
উল্লেখ্য, সৌদি আরবের সশস্ত্র বাহিনীর অন্তত ত্রিশ শতাংশই হচ্ছে ইয়েমেনি বংশোদ্ভূত। তাই ইয়েমেনে স্থল হামলার আগে সৌদি সরকারকে একশ বার এ বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে। ইয়েমেনের লড়াকু জনগণের কাছে বিলাসিতায় অভ্যস্ত সৌদি সেনারা কলা গাছ বলেই বিবেচিত হবে।
১৯.
বাব আল মান্দাব নামের প্রণালীটি এডেনের খুব কাছেই অবস্থিত। এইসব অঞ্চলই এখন জনপ্রিয় আনসারুল্লাহর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই প্রণালী দিয়ে বিশ্বের তেল-সম্পদের প্রায় ৪০ শতাংশ পরিবহন করা হয়। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রণালী একটি বিপ্লবী ও স্বাধীনচেতা গণ-ভিত্তিক সরকারের কর্তৃত্বাধীনে থাকবে তা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ও তাদের সেবাদাসদের জন্য অসহনীয় এক বিষয়। ঠিক যেভাবে তারা হরমুজ প্রণালীর ওপর ইরানের আধিপত্যকেও ভয় করছে!
২০.
যেসব সরকারের জনপ্রিয়তা ও গণভিত্তি নেই সেসব সরকারসহ সারা বিশ্বের বলদর্পী সব শক্তি মিলেও গণ-প্রতিনিধিত্বশীল কোনো আন্দোলন এবং কোনো সরকারকে কখনও পরাজিত করতে পারে না। ইরানের ইসলামী বিপ্লবই হলো এর বড় প্রমাণ। বিপ্লবী ইরানের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল দীর্ঘ ৮ বছরের যুদ্ধ। বিশ্বের সবগুলো পরাশক্তিসহ বিশ্বের ২৬ টি দেশ সে সময় ইরানের বিরুদ্ধে সারিবদ্ধ হয়ে সাদ্দামকে সহায়তা দিয়েছে। কিন্তু ইরানের এক ইঞ্চি মাটিও দখলে রাখতে পারেনি সাদ্দাম। অবশেষে আগ্রাসনের দায় স্বীকার করে সাদ্দাম ইরানের কাছে নতজানু হতে এবং ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছিল। জাতিসংঘের ৫০৮ নম্বর প্রস্তাবে ইরাককে আগ্রাসী হিসেবে অভিহিত করা হয় এবং ইরাক আগ্রাসনের জন্য ইরানকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য বলে উল্লেখ করা হয়।
২১.
সৌদি সরকারসহ আরব রাজা-বাদশাহরা অতীত ও নিকট ইতিহাস থেকে যদি শিক্ষা নিতেন তবে তা তাদের জন্যই ভালো হত। কিন্তু দেশের ষোলো-আনা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমেরিকা, ইউরোপ ও ইসরাইলের ওপর নির্ভরশীল এইসব রাজা-বাদশাহরা কি কখনও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবেন? পাশ্চাত্য ও মার্কিন সরকার জনসমর্থনহীন এইসব সরকারকে নিজ স্বার্থে ব্যবহারের পর ঠিকই ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলতে দ্বিধা বোধ করবে না।
No comments:
Post a Comment