প্রথম ৩ খলিফার ২৫ বছর সময়ের শাসনকালে,গনঅভ্যুথ্যানের ফলে উসমানের ক্ষমতাচ্যুতি ও হত্যাকান্ডের পুর্ব পর্যন্ত,মহানবী(সাঃ)এর সাহাবীগন ও ইসলামের অন্যান্য প্রজন্ম চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবনপাত করছিল।অতঃপর জনগন ইমাম আলী(আঃ)এর প্রতি ফিরে আসে এবং তাঁকে তাদের পরবর্তি খলিফা নিযুক্ত করে(“আল-হাদিছ-ই-উম্মুল মু’মেনিন আয়শা” অধ্যায়-আলা আহদ আল সাহরাইন/১১৫)
ইমাম আলী(আঃ) এমন সময়ে খেলাফতে অধিষ্টিত হলেন যখন মুসলমানেরা পুর্ববর্তি খলিফাদের আমলের ২৫ বছরে তাদের নিজেদের স্টাইলে জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল।ঐ সময়ে বিরাজিত পরিবেশ সম্পর্কে ইমাম আলী(আঃ)নিজে যে বর্ননা দিয়েছেন তা হলো নিম্নরুপ(মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকুব কুলাইনীর গ্রন্থ “রাওজাতুল কাফী”৮/৬১-৬৩তে বিস্তারিত দেখা যেতে পারে)ঃ
“আমার পুর্ববর্তি খলিফাগন এমন কাজ করেছিলেন যাতে তারা সচেতনভাবেই রাসুলুল্লাহর(সাঃ) নির্দেশের বিপরীতে চলে গিয়েছিলেন।তাঁর প্রতি করা আনুগত্যের শপথ তারা ভঙ্গ করেছিল এবং তাঁর সুন্নতের পরিবর্তন করেছিল।এখন আমি যদি ঐ সকল বিষয়গুলোকে পরিত্যাগ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করি এবং রাসুল(সাঃ)এর সময় যা ছিল সেইভাবে ঐ বিষয়গুলোকে পুর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনি,তাহলে আমার বাহিনীর লোকেরা আমাকে নিঃসঙ্গ অসহায় অবস্থায় ফেলে আমা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।খুব বেশী হলে এক ক্ষুদ্র সংখ্যক অনুসারী আমার পক্ষে থাকবে;যারা আল-কুরান ও সুন্নাহর ভিত্তিতে আমার ইমামতকে স্বীকার করে”।
“আমি যদি নিম্ন বর্নিত ব্যাবস্থাগুলো গ্রহন করি তার ফলাফল কি হবে তা কি তোমরা ভাবতে পারো?ঃ
১/রাসুল(সাঃ) যেখানে মাকামে ইব্রাহিমকে স্থাপন করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন যদি আমি তা সেখানে পুনঃস্থাপন করি।
২/নবী কন্যা ফাতেমা(আঃ)এর সন্তানদেরকে আমি আমি যদি ফিদাকের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেই।
৩/মহানবী(সাঃ)এর সময় ওজন ও পরিমাপ যেমন প্রতিস্টিত ছিল,যদি সেই অবস্থায় তা প্রতিস্টিত করি।
৪/যেসব ভুমি মহানবী(সাঃ)যাদেরকে দিয়ে গিয়েছিলেন যদি সেগুলো তাদের কাছে ফিরিয়ে দেই।
৫/যদি খলিফাদের জারীকৃ্ত নিষ্টুর আইন বাতিল করি।
৬/যদি যাকাত ব্যাবস্থাকে তার প্রকৃ্ত ভিত্তির উপর পুনর্বিন্যাস্ত করি।
৭/যদি অজু গোসল ও নামাযের নিয়ম-নীতি সংশোধন করি।
৮/যে সকল মহিলাদের অন্যায়ভাবে তাদের স্বামীদের থেকে পৃ্থক করে অন্যদের নিকট দেওয়া হয়েছে,যদি তাদেরকে তাদের আসল স্বামীদের নিকট ফিরিয়ে দেই।
৯/বায়তুলমালের অর্থ যেভাবে ধনিকদের প্রদান করতঃশুধুমাত্র তাদের হাতে উহা পুঞ্জিভুত না করে মহানবী(সাঃ)এর সময়কালে যেমন ছিল তেমনিভাবে উহা পাওয়ার উপযুক্ত ব্যাক্তিদের মাঝে সমভাবে বন্টন করি(হযরত উমর রাষ্টিয় কোষাগার হতে অর্থ বন্টনের ক্ষেত্রে সমাজে শ্রেনী বিভাজন চালু করেছিল।সেই সময়ে একটি তালিকা করা হয়েছিল এবং এই অনুযায়ি একদল পাচ্ছিল প্রতি বছর ৫০০০ দিরহাম,অন্য একদল ৪০০০ দিরহাম এবং অন্যান্যরা ৩০০০,২০০০,১০০০ এবং ৫০০ শত থেকে ২০০শত দিরহাম।এইভাবে সমাজে ধনী ও দরিদ্র শ্রেনী সৃষ্টি করা হয়)।
১০/যদি ভুমি কর বাতিল করি(হযরত উমর ইরাকের ভুমি কর আরোপ করেছিল ইরানের সাসানিদ রাজন্যদের ভুমি রাজস্ব আইন অনুসারে এবং মিশরে রোমান রাজন্যদের ভুমি রাজস্ব আইন অনুসারে)।
১১/যদি দাম্পত্য সম্পর্ক সংক্রান্ত ব্যাপারে সকল মুসলমানকে সমান ঘোষনা করি(হযরত উমর আরবীয় কন্যাদের সাথে অনারবদের বিবাহ নিষিদ্ব করেছিলেন)।
১২/যদি আল্লাহর আইন অনুসারে খুমস(সম্পদের এক পঞ্চমাংশ) আদায় করি(সুরা আনফাল-৪১)(৩ খলিফা মহানবী(সাঃ) ওফাতের পর খুমস হতে আহলে বায়াতের প্রাপ্য অংশ বাদ দিয়ে দিয়েছিল)।
১৩/যদি মসজিদে নববীকে এর সুচনালগ্নের কাঠামোতে,যে কাঠামোতে রাসুল(সা)এর সময়কালে প্রতিষ্টিত ছিল,পুনঃপ্রতিষ্টিত করি।মহানবী(সাঃ)ওফাতের পর মসজিদের যে প্রবেশ পথ গুলো বন্দ্ব করে দেয়া হয়েছিল তা আবার খুলে দেই,এবং তাঁর ওফাতের পর যে প্রবেশ পথগুলো খোলা হয়েছিল তা আবার বন্দ্ব করে দেই।
১৪/যদি ওজুতে চামড়ার মোজার উপর মাসেহ করা নিষিধ্ব করি(‘খুফ’ হচ্ছে পশুর চামড়ার তৈরী মোজা।সুন্নী মুসলমানগন,তাদের পুর্ববর্তীদের মত,ওজুর জন্য নগ্ন পা ধোয়া বাধ্যতামুলক মনে করে,কিন্তু ‘খুফ’ দ্বারা পা আবৃত থাকলে উহা মাসেহ করা যথেষ্ট মনে করে(এব্যাপারে বুখারি শরিফে মিথ্যা হাদিস রয়েছে)।
১৫/ “নাবিয” এবং খেজুরের মদপানের উপর দন্ড এবং বিশেষ শাস্তির বিধান চালু করি(নাবিয হচ্ছে একধরনের হাল্কা মদ,যা সাধারনত বিয়ার জাতীয় যব/বার্লি হতে তৈ্রি করা হয়)।
১৬/যদি নারী এবং হজ্বের ক্ষেত্রে মহানবী(সাঃ)এর সময়কালে যেমন ছিল,সেই মোতাবেক মু’তার বিধান আইনসিদ্ব করি(খলিফা উমর ২ ধরনের মুতাকে অবৈ্ধ ঘোষনা করেন।হজ্বের মুতা(হজ্বে তামাত্তু) ও নারীর মুতা।একইভাবে নিদিষ্ট কন্যাদের বিবাহ,কুরানের ঘোষনা ও সুন্নী পন্ডিতগনের বননা অনুযায়ী যা সুস্পষ্টভাবেই ইসলামি বিধানের অন্তর্ভুক্ত)।
১৭/যদি মৃত ব্যাক্তির জানাযার নামাযে ৫বার তাকবির বলি(আবু হোরায়রার সুত্রে সুন্নীগন মৃতের জানাজা নামাযে ৪বার তাকবির পড়ে থাকে,সুত্রঃইবনে রুশদ আন্দালুসীর “বিদায়া ওয়াল মুজতাহিদ”১//২৪০)।
১৮/যদি নামাযের শুরুর সময় শব্দ করে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ তেলাওয়াত করা বাধ্যতামুলক করি(সুন্নিদের একটি গ্রুপ তেলাওয়াতের সময় সুরা ফাতিহা ও অন্য সুরা হতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বাদ দেয়।স্পষ্টতই তারা এই ব্যাপারে মুয়াবিয়াকে অনুসরন করে থাকে,সুত্রঃআল-ফাতিহার তাফসীর, ‘তাফদীরে আল-কাশশাফ’১/২৪-২৫)।
১৯/যদি মহানবী(সাঃ)এর সময়কালে তালাকের যে রীতি প্রচলিত ছিল,সেই রীতি কঠোরভাবে অনুসরনের নির্দেশ দেই(তালাক ২ বার……..সুরা বাকারাহঃ২২৯,সুন্নিদের মতে তালাক দেওয়ার জন্য এক বৈঠকে ৩ তালাক উচ্চারন করলে তা বৈ্ধ,এবং এর যথাযথ সাক্ষী না থাকলে তা দ্রুত অনুসমর্থন করাতে হবে,সুত্রঃ’বিদায়াহ ওয়াল মুজতাহিদ ১/৮০-৮৪)।
২০/যদি বিভিন্ন জাতির যুধ্ববন্দীদের প্রতি আচরনের ব্যাপারে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল(সাঃ)এর নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরনের নির্দেশ দেই।
“ এক কথায় আমি যদি লোকদেরকে আল্লাহতায়ালা এবং রাসুল(সাঃ)এর নির্দেশ অনুসরন করানোর জন্য প্রচেষ্টা গ্রহন করি,তাহলে তারা আমায় ত্যাগ করবে এবং এদিক-সেদিক চলে যাবে”।
“আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি,যখন রমযানের মাসে ওয়াযিব(ফরয) নামায ছাড়া অন্য কোন নামায জামাতের সাথে না আদায় করার জন্য আমি লোকদেরকে নির্দেশ দিলাম এবং বুঝিয়ে বললাম যে মুস্তাহাব নামায জামাতের সাথে আদায় করা বিদায়াত,আমার সেনাবাহিনীর একটি দল,যারা আমার পক্ষে একদা যুধ্ব করেছিল,হৈচৈ শুরু করে দিল,বলেঃ’আহ!উমরের সুন্নাত’।‘হে মুসলমানেরা।আলী উমরের সুন্নাত পালটে দিতে চায় ও রমযান মাসে মুস্তাহাব নামায বন্ধ করে দেওয়ার বাসনা করে।তারা এমন গোলমাল শুরু করে দিল যে আমি ভীত হলাম-তারা কিনা বিদ্রোহ করে বসে”।
“হায়!”,ইমাম আলী(আঃ) বলতে থাকেন, “আহ এমন যন্ত্রনা আমি এই লোকদের হাতে ভোগ করলাম,যারা অত্যন্ত প্রবল ভাবে আমার বিরোধিতা করে;যারা তাদেরকে কেবলমাত্র জাহান্নামের দিকেই চালিত করেছিল তারা তাদের সেই ভ্রান্ত নেতাদের আনুগত্য করে”।
রাসুল(সাঃ) ঘোষিত ১ম ইমাম আলী(আঃ) ১ম ৩ খলিফাদের রীতি-পদ্বতির বিপরীতে বিশেষ করে হাদিস সংক্রান্ত বিষয়ে মহানবী(সাঃ)এর পথ অনুসরন করে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার জন্য একটি কার্যক্রম গ্রহন করেছিলেন।তিনি ১ম ৩ খলিফা কত্বৃক চালুকৃ্ত বিদয়াত ( নতুন রীতি পদ্বতি)ধ্বংশ করার জন্য
এক বিরামহীন যুদ্ব শুরু করেছিলেন(তিনি সকল কাহিনী কথকদের উপর,যারা উমর ও উসমানের নির্দেশ মোতাবেক জুময়ার দিনে মসজিদসমুহে খোতবা দিত,নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন।তিনি নবীজীর হাদিস মুক্তভাবে কোন লুকানো ছাড়াই বর্ননার রীতি চালু করলেন।তাঁর পক্ষে যতটুকু সম্ভব তিনি খলিফাদের আবিস্কারসমুহের মুলোতপাটন করলেন।বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুনঃ “ মিন তারিখ আল-হাদিস”)।
" হযরত আলী (আঃ) এর " বেলায়েত " কে অস্বীকার
এবং হারেস বিন নোমান ফেহরীর ঘটনা "
গাদীরের ঘটনা যে কতটুকু গুরুত্বপূর্ন তা পাঠকদের বুঝার জন্য একটি ঘটনা প্রমান স্বরুপ উল্লেখ করছি । এই ঘটনাটি এমন এক ব্যক্তির শাস্তি সম্পর্কিত যে হযরত আলীর (আঃ) বেলায়েত বা ইমামতকে অস্বীকার করেছিলো । নবীজী (সাঃ) হযরত আলী (আঃ) কে ওনার স্থলাভিষিক্ত ঘোষনা করে দিয়েছেন এবং নবীজী (সাঃ) বলেছেন , যারা এখানে উপস্থিত রয়েছে তাদের কাজ হচ্ছে , অনুপস্থিত লোকদের কাছে এ ঘোষনাটি অবশ্যই পৌছে দেবে । হারেস বিন নোমান ( নবীজীর অনুসারী ) যখন এ সুসংবাদটি জানতে পারলো , তখন তার কাছে বিষয়টি ভালো লাগেনি । সে নিজের উটের পিঠ থেকে নেমে সোজা নবীজীর (সাঃ) খেদমতে হাজির হয়ে বললো , আপনার নির্দেশ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই , আপনি আল্লাহর প্রেরিত রাসুল , পাচ ওয়াক্ত নামাজ ,রমজান মাসের রোযা , হজ্ব , যাকাত , ফেৎরাসহ সকল কিছুই আপনার কথামতো মেনে নিয়ে সাধ্য মতো পালন করি । এতো কিছু মেনে নেওয়ার পরও আপনি সন্তষ্ট হলেন না । জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আপনি আপনার ভাই হযরত আলীকে আমাদের উপর আপনার তরফ থেকে অভিভাবক হিসাবে নিয়োগ দিয়ে দিলেন ! এবং বললেন যে , আমি যাদের যাদের মাওলা এই আলীও তাদের তাদের মাওলা । ( যেমন আপনার হুকুম মানা যেমন বাধ্যতামূলক তেমনি আলীর হুকুমও মানা বাধ্যতামূলক ) এই আদেশ কি আপনার নিজের পক্ষ থেকে বলেছেন , নাকি আল্লাহর তরফ থেকে ? এ রকম চরম বেয়াদবীমূলক কথার পরেও নবীজী (সাঃ) বললেন , এক আল্লাহর কসম , একথা আল্লাহর তরফ থেকে বলেছি , আমার নিজের থেকে নয় । "----- আর তিনি (রাসুল) কোন মনগড়া কথা বলেন না , বরং তা ওহী যা তার প্রতি প্রেরন করা হয় -------- " সুরা নাজম/৩,৪ । হারেস প্রকাশ্যে সকলের সামনে দাড়িয়ে বললো , " হে আল্লাহ মোহাম্মাদ (সাঃ) যা বললেন , তা যদি সত্য হয় , তাহলে আকাশ থেকে আমার উপর আজাব স্বরুপ পাথর বষন করো "। বর্নণাকারী বলেন যে , হারেস তখনো নিজের উটের কাছে পৌছুতে পারেনি , আকাশ থেকে ছোট এক টুকরো পাথর তীব্রগতিতে হারেসের মাথায় পতিত হয়ে তার নিন্মদেশ দিয়ে বেরিয়ে গেলো । ফলে সে সেই সময়ই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো
। তারপরই এই আয়াতটি নাজিল হলো ,
"----- এক প্রশ্নকারী
জিজ্ঞেস করে সেই আযাব সম্বন্ধে , যা আপতিত হবে ---- " সুরা মায়ারেজ/১ ।
সূত্র- তাফসীরে কুরতুবি ,খন্ড-১০, পৃ-৬৭৫৭ । তাফসীরে সালবী ,খন্ড-২৯,পৃ- ৫২ সহ প্রায় ১৮ টি বিখ্যাত কিতাবে এই ঘটনার বিবরন রয়েছে । প্রয়োজনে
খন্ড ও পৃষ্ঠার নাঃ দেয়া যাবে ।
যাহোক , সুপ্রিয় পাঠক , এবার এই ঘটনার সাথে আপনার অবস্থান আপনি নিজেই দয়া করে যাচাই করে নিন ।
যাহোক , সুপ্রিয় পাঠক , এবার এই ঘটনার সাথে আপনার অবস্থান আপনি নিজেই দয়া করে যাচাই করে নিন ।
আহ!
ReplyDeleteসত্য আর মিথ্যার কি সপষ্ট বিভাজন...... আমাদের অন্ধদের চোখে আর আলোর আশা কিভাবে করতে পারি... ওই নিকট সময়েই যা ছিল মোহাচ্ছন্ন !!!!