আমি কেন শিবির ছাড়লাম :
১৯৭৯- ঢাকায় একটা কনভেনশনের মাধ্যমে “জামায়াতে ইসলামী
বাংলাদেশ” গঠিত হয়। গোপনে গোলাম আজমকে আমীর করে আব্বাস আলী
খানকে ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৮০- প্রথমবারের মত বায়তুল মোকারমের সামনে জামাতের সভা হয়। প্রকাশ্যে এটাই
তাদের প্রথম সম্মেলন। ১৯৮১- জামাতের ভারপ্রাপ্ত
আমীর আব্বাস আলী খান এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন “একাত্ততে আমরা যা করেছি ঠিকই করেছি। একাত্তরে
বাংলাদেশ কনসেপ্ট ঠিক ছিলোনা” ১৯৮২- রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ যায়গা গুলোতে জামাত দ্রুত প্রবেশ করতে থাকে। কাদের মোল্লা ঢাকা সাংবাদিক
ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়। ১৯৮৩- দলের রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে ব্যাস্ত থাকে দলটি। ১৯৮৪- জামাতের সাবেক আমির মাওলানা আবদুর রহিম জামাত ছেড়ে ইসলামী ঐক্য (জোট) নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন
করেন। ১৯৮৫- এরশাদ সরকারের সাথে দলটার সখ্যতা গড়ে উঠে। কাদের মোল্লা ঢাকা মহানগর আমির নির্বাচিত হয়। ১৯৮৬- এরশাদ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহন করে ১০ টা আসন পায়। ১৯৮৭- সাংঘঠনিক কার্যক্রম বাড়ানোর দিকে মনযোগ দেয়। ১৯৮৮- অনেকদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর জামাতের ছাত্র সংঘঠন শিবির নিজেদের শক্তি প্রদর্শনে
মরিয়া হয়ে উঠে। চট্টগ্রাম রাজশাহী
সহ বিভিন্ন জেলায় তাদের ট্রেডমার্ক রগ কাটার রাজনীতি শুরু করে। ১৯৮৯- তৎপর হয়ে উঠে জামাত। সাংঘঠনিক কার্যক্রম বাড়াতে থাকে। ১৯৯০- এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। টিভিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিভিন্ন রাজনৈতিক
দলের নেতা নেতৃরা বক্তৃতা বিবৃতি দেন । জামাতের নেতারাও গণতান্ত্রিক
আন্দোলনের নেতা হিসেবে টিভিতে আসেন! সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। ১৯৯১- নির্বাচনে রেকর্ড ১৮ টি আসনে জিতে নেয় ! কুলুষিত হয় মহান জাতীয় সংসদ । বিএনপি সরকারের সাথে আপোষে এত আসন পায়। নাগরিকত্বহীন গোলাম আজমকে আনুষ্ঠানিক ভাবে জামাত আমির ঘোষনা করে। ১৯৯২- বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনা জামাতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে। বিজেপি বিরোধী আন্দোলন করে গণহারে রাস্তায় নেমে আসে। সাধারণ মানুষের কাছে পৌচাতে চেষ্টা করে। একই বছর জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি গঠিত হয়। গোলাম আজমকে মৃত্যুদন্ডযোগ্য ঘোষনা করা হয়। ১৯৯৩- গণাদালতের কারনে কিছুটা কোনঠাসা হয়ে পড়ে দলটি। নিজামী কাদেরমোল্লা সাইদী কামরুজ্জামান আব্দুল আলীম সহ আট জনকে মৃত্যুদন্ডযোগ্য
ঘোষনা করে। ১৯৯৪- সালে উচ্চ আদালতের এক রায়ে গোলাম আজম জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব ফিরে পান । ১৯৯৫- ঢিলেঢালা ভাবে পালিত হলেও এবছর জামাত প্রথমবারের মত একদিন হরতাল দেয়। ১৯৯৬- সালে জামাত এবং আওয়ামীলীগ তত্ববধাক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। একসাথে আন্দোলন করেছেন, তবে রাজনৈতিক জোট হিসেবে নয়। নির্বাচনে জামাত একাই লড়েছিল। ১৯৯৭- রাজনীতিতে জামাত শিকড় গেড়ে ফেলেছে। শিবির বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দখল, সাইদী ব্যাপক ভাবে ওয়াজ নসিহত শুরু করেন। ১৯৯৮- বিএনপির সাথে মতৈক্যে আসে দলটি। ১৯৯৯- বিএনপির সাথে ৪ দলীয় জোট গঠন করে । পায়ের নিচে শক্ত মাটি পায়। দেশের মানুষ চুড়ান্ত হতাশ হয়। ২০০০- জামায়াত রাজনৈতিক হাইওয়েতে উঠে যাওয়ায় নিশ্চিন্তে রাজনীতি থেকে অবসর নেন গোলাম আজম। দলের নতুন আমীর হন মতিউর রহমান নিজামী। ২০০১- নির্বাচনে ১৮ টি আসন লাভ করে। এরপর ঘটে জাতিরইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক ঘটনা। দলের শীর্ষ দুই নেতা নিজামী এবং মুজাহীদ মন্ত্রিত্ব লাভ করে! গাড়িতে উড়ায় জাতীয় পতাকা !! ২০০২- শিকড় বাকড় ছড়াতে থাকে একেবারে ক্ষমতায় থেকে। নেতারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও
বক্তৃতা বিবৃতি দেন !! ২০০৩- সাইদী ওয়াজ নসিহত চলতে থাকে । ২০০৪- শুরু করে জঙ্গী তৎপরতা।জঙ্গী দলগুলোর সাথে গড়ে তোলে সুসম্পর্ক । জামাতের আমন্ত্রনে পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর শীর্যস্থানীয় নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশে আসেন। তারা শিরিরের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে অংশ নেন। ২০০৫- নির্বাচনের জন্য ব্যাপকপ্রস্তুতি নিতে থাকে। শুধুমাত্র ভারতীয় কোম্পানী বলে টাটার ২.৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী নিজামী (উইকিলিকস) ২০০৬- জামাতের তান্ডবময় একটা বছর। ২০০৭- নতুন প্রজন্ম জমাতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে থাকে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার জামাতকে নির্বাচন করতে দেওয়ারবিপক্ষে ছিলেন। ২৫ অক্টোবর মিডিয়ায় কাদের মোল্লা বলেন মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে গিয়েছেন নারী এবং সম্পত্তির লোভে ! দেশ
ক্ষোবে ফেটে পড়ে। ২০০৮- নির্বাচনে জামতের লেজেগোবরে অবস্থা। শুধুমাত্র যুদ্ধপরাধীদের বিচার হবে এজন্য তরুন প্রজন্মের ভোটে আওয়ামীলীগের বিপুল ব্যাবধানে জয়লাভ। ২০০৯- মহান জাতীয় সংসদে একজন সংসদ সদস্য যুদ্ধপরাধীদের বিচারের
প্রস্তাব পেশ করলে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ২০১০- আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল গঠিত হয়। গ্রেপ্তার হতে থাকে অভিযুক্ত
ব্যাক্তিরা। জনগন আশাবাদী হয়। ২০১১- দেশ বিদেশে ট্রাইবুনালের নামে অপপ্রচার চালাতে থাকে। একই সাথে প্রচুর টাকা পয়সা খরচ করে চলতে থাকে আন্তর্জাতিক লবিং । ২০১২- দেশপ্রেমকে পুঁজি করে সীমিত সামর্থ নিয়ে চলতে থাকে বিচার কার্যক্রম। চলতে থাকে দুই পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ। ২০১৩- অবশেষে বাচ্চু রাজাকারের রায় দেওয়ার মাধ্যমে ৪২ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটে। লেখার শুরুতেই বলছিলাম এই লেখায় মওদূদীর ৩ টা ফতোয়া ব্যাবহার করবো। দুইটা শুরুতেই দিয়েছিলাম। অন্যটা শেষে দিচ্ছি-
“সময়ে সময়ে মিথ্যা বলা শুধু জায়েজই
নয় বরং অবশ্য কর্তব্য” – আবুল
আলা মওদূদী, তরজমানুল কোরআন,
মে ১৯৫৮
আন্দোলনের নেতা হিসেবে টিভিতে আসেন! সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। ১৯৯১- নির্বাচনে রেকর্ড ১৮ টি আসনে জিতে নেয় ! কুলুষিত হয় মহান জাতীয় সংসদ । বিএনপি সরকারের সাথে আপোষে এত আসন পায়। নাগরিকত্বহীন গোলাম আজমকে আনুষ্ঠানিক ভাবে জামাত আমির ঘোষনা করে। ১৯৯২- বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনা জামাতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে। বিজেপি বিরোধী আন্দোলন করে গণহারে রাস্তায় নেমে আসে। সাধারণ মানুষের কাছে পৌচাতে চেষ্টা করে। একই বছর জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি গঠিত হয়। গোলাম আজমকে মৃত্যুদন্ডযোগ্য ঘোষনা করা হয়। ১৯৯৩- গণাদালতের কারনে কিছুটা কোনঠাসা হয়ে পড়ে দলটি। নিজামী কাদেরমোল্লা সাইদী কামরুজ্জামান আব্দুল আলীম সহ আট জনকে মৃত্যুদন্ডযোগ্য
ঘোষনা করে। ১৯৯৪- সালে উচ্চ আদালতের এক রায়ে গোলাম আজম জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব ফিরে পান । ১৯৯৫- ঢিলেঢালা ভাবে পালিত হলেও এবছর জামাত প্রথমবারের মত একদিন হরতাল দেয়। ১৯৯৬- সালে জামাত এবং আওয়ামীলীগ তত্ববধাক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। একসাথে আন্দোলন করেছেন, তবে রাজনৈতিক জোট হিসেবে নয়। নির্বাচনে জামাত একাই লড়েছিল। ১৯৯৭- রাজনীতিতে জামাত শিকড় গেড়ে ফেলেছে। শিবির বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দখল, সাইদী ব্যাপক ভাবে ওয়াজ নসিহত শুরু করেন। ১৯৯৮- বিএনপির সাথে মতৈক্যে আসে দলটি। ১৯৯৯- বিএনপির সাথে ৪ দলীয় জোট গঠন করে । পায়ের নিচে শক্ত মাটি পায়। দেশের মানুষ চুড়ান্ত হতাশ হয়। ২০০০- জামায়াত রাজনৈতিক হাইওয়েতে উঠে যাওয়ায় নিশ্চিন্তে রাজনীতি থেকে অবসর নেন গোলাম আজম। দলের নতুন আমীর হন মতিউর রহমান নিজামী। ২০০১- নির্বাচনে ১৮ টি আসন লাভ করে। এরপর ঘটে জাতিরইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক ঘটনা। দলের শীর্ষ দুই নেতা নিজামী এবং মুজাহীদ মন্ত্রিত্ব লাভ করে! গাড়িতে উড়ায় জাতীয় পতাকা !! ২০০২- শিকড় বাকড় ছড়াতে থাকে একেবারে ক্ষমতায় থেকে। নেতারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও
বক্তৃতা বিবৃতি দেন !! ২০০৩- সাইদী ওয়াজ নসিহত চলতে থাকে । ২০০৪- শুরু করে জঙ্গী তৎপরতা।জঙ্গী দলগুলোর সাথে গড়ে তোলে সুসম্পর্ক । জামাতের আমন্ত্রনে পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর শীর্যস্থানীয় নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশে আসেন। তারা শিরিরের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে অংশ নেন। ২০০৫- নির্বাচনের জন্য ব্যাপকপ্রস্তুতি নিতে থাকে। শুধুমাত্র ভারতীয় কোম্পানী বলে টাটার ২.৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী নিজামী (উইকিলিকস) ২০০৬- জামাতের তান্ডবময় একটা বছর। ২০০৭- নতুন প্রজন্ম জমাতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে থাকে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার জামাতকে নির্বাচন করতে দেওয়ারবিপক্ষে ছিলেন। ২৫ অক্টোবর মিডিয়ায় কাদের মোল্লা বলেন মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে গিয়েছেন নারী এবং সম্পত্তির লোভে ! দেশ
ক্ষোবে ফেটে পড়ে। ২০০৮- নির্বাচনে জামতের লেজেগোবরে অবস্থা। শুধুমাত্র যুদ্ধপরাধীদের বিচার হবে এজন্য তরুন প্রজন্মের ভোটে আওয়ামীলীগের বিপুল ব্যাবধানে জয়লাভ। ২০০৯- মহান জাতীয় সংসদে একজন সংসদ সদস্য যুদ্ধপরাধীদের বিচারের
প্রস্তাব পেশ করলে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ২০১০- আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল গঠিত হয়। গ্রেপ্তার হতে থাকে অভিযুক্ত
ব্যাক্তিরা। জনগন আশাবাদী হয়। ২০১১- দেশ বিদেশে ট্রাইবুনালের নামে অপপ্রচার চালাতে থাকে। একই সাথে প্রচুর টাকা পয়সা খরচ করে চলতে থাকে আন্তর্জাতিক লবিং । ২০১২- দেশপ্রেমকে পুঁজি করে সীমিত সামর্থ নিয়ে চলতে থাকে বিচার কার্যক্রম। চলতে থাকে দুই পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ। ২০১৩- অবশেষে বাচ্চু রাজাকারের রায় দেওয়ার মাধ্যমে ৪২ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটে। লেখার শুরুতেই বলছিলাম এই লেখায় মওদূদীর ৩ টা ফতোয়া ব্যাবহার করবো। দুইটা শুরুতেই দিয়েছিলাম। অন্যটা শেষে দিচ্ছি-
“সময়ে সময়ে মিথ্যা বলা শুধু জায়েজই
নয় বরং অবশ্য কর্তব্য” – আবুল
আলা মওদূদী, তরজমানুল কোরআন,
মে ১৯৫৮
============================================
আমার চৌদ্দগোষ্ঠীর মাঝেও একটা দ্বাদশ শ্রেনী পার করা মানুষ নেই।
তবে বেশ কয়েকখান আলেম আছে। একজন আলোকিত মানুষ খুজে পাওয়া না গেলেও ডজন খানেক
ধর্মান্ধ ব্যক্তি আর মাথা মোটা ফতোয়াবাজ পাওয়া খুবই সহজ। আমার বাবা মাদ্রাসা পড়ুয়া
না হলেও মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ এবং একজন ইসলামের পেয়ারী (!)। পেশায়
তিনি একজন ব্যবসায়ী। যুবক থাকা অবস্থায় নতুন নতুন অডিও প্লেয়ার কেনা ছিল ওনার শখ।
আমি মোটামুটি চালাক হওয়ার পর থেকেই বুঝতে পারলাম আমার বাবা একজন সাঈদী ভক্ত। কারণ, আমার বাবা রাতে সাঈদীর ওয়াজ
শুনতে শুনতে ঘুমাতেন এবং ভোরে ফজরের নামাজের পরেই ওয়াজের ক্যাসেট আবার লাগিয়ে
দিতেন। বাবার কল্যাণে আমাদেরও ওয়াজ শুনার সৌভাগ্য(!) হতো। তবে সবচেয়ে দূরাবস্থা
হতো আমার মা'র। প্রায়শঃই আবেগাপ্লুত হয়ে কান্না শুরু করতেন । বাবাতো সাঈদীর
ওয়াজ শুনাকে বাধ্যতা মূলক করে অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগলেও
দরাজ গলা আর গুছিয়ে কথা বলার কারণে একপর্যায়ে আমিও সাঈদীর মাঝারী আকারের ভক্ত হয়ে
যাই। এবং একপর্যায়ে অন্ধকারকে নিকাহ করি। তখন আমি ৭ম শেনীর ছাত্র। সাঈদীর মুখে
ছাত্রশিবিরের প্রশংসা শুনে নিজেই খুজে বের করলাম আমাদের ইউনিয়নের শিবির সভাপতিকে।
ভদ্রলোক খুবই সুদর্শন। আমিতো ভাবলাম নূরের ঝলকানিতে আক্তারুজ্জামান ভাইয়ের মুখ
অতিশয় উজ্জ্বল দেখাচ্ছিলো। দেরি না করে সমর্থক ফরম পূরণ করলাম এবং ইসলামের
সৈনিক(!) হয়ে গেলাম। আমার ঘরে এলো "এসো আলোর পথে",
"আমরা
কি চাই? কেন চাই? কিভাবে চাই?" "নামাজের হাকীকত" "কোরআনের হাকীকত"
"ইসলামের হাকীকত" এবং অন্যান্য নামের অসংখ্য বই। মাসিক রিপোর্ট করার
জন্য একটা রিপোর্ট বই। কয়েক দিন পর এলো "কিশোর কন্ঠ" "কারেন্ট
নিউজ" সহ আরও কিছু বই। পরম উৎসাহে সব বই খেতে লাগলাম। আমার মস্তিষ্কেতো ভীষণ
জ্ঞানের জ্যাম পড়ে গেল। নিজেকে খুবই জ্ঞানী ভাবতাম তখন।
আমি আরও ভীষণ উৎসাহিত হলাম
যখন, কয়েকটি সভায় জিহাদী বক্তব্য রেখে পুরস্কৃত হলাম। শিবিরের
নের্তৃপর্যায়ে আমাকে নিয়ে তখন দারুন আলোচনা হতো এবং আমাকে ভবিষ্যত নেতা হিসেবে
টার্গেট করে আমার মগজ ধোলাইয়ে তারা দারুন ব্যস্ত ছিলো। আমার শিবির বিষয়ক
কর্মকান্ডে সবচে' বেশি খুশি হয়েছিলেন আমার বাবা। তিনি থখন আমার দৈনিক খরচের টাকাও
বাড়িয়ে ছিলেন। আমাদের পরিবারে আমার বড়বোনের সাথে আমার সবচে' বেশী সখ্যতা ছিল। একপর্যায়ে
আমি আর আমার বোনের প্রচেষ্টায় আমাদের পুরো বাড়ির লোকজনকেই আমরা জামাত মনোভাবপন্ন
করে ফেলি। যেহেতু আমি শিবিরকে একটি আদর্শ সংগঠন ভেবে অতি সৎ জীবন যাপন শুরু করলাম, সেহেতু এলাকার সবাই আমাকে খুব
ভাল জানতো। আসলে আমি তখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যতটা ভাবতাম না যতটা না ভাবতাম '৪৭ এর দেশ বিভাগ নিয়ে।
মুক্তযুদ্ধকে একটি ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনা হিসেবে আমার সামনে উপস্থাপন করা হয়েছিলো।
আমাকে শিখিয়ে দেয়া হয়েছিলো যে, কেউ যদি মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত
ইসলামের ভূমিকা নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলে তবে যেন বলি, "জামায়াত পক্ষেও ছিলোনা আবার
বিপক্ষেও ছিলোনা" সাথে একটা সংযুক্তির কথা বলতো এভাবে,
" গোলাম
আজম তখন লন্ডনে ছিলো, লন্ডনে থেকেই তিনি পাকিস্তান সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন এই
মর্মে যে, বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে পাকিস্তান ভুল করতেছে, বাংলার জনগন যদি ক্ষেপে ওঠে
তবে পাকিস্তান দ্বিখন্ডিত হবে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভীষণ মার খাবে। আমি যেন
মানুষকে আরও বলি যে, গোলাম আজম তথা জামায়াতে ইসলাম ছিলো শান্তিপ্রিয়। এবং অবশেষে আমি
যেন একটি প্রশ্ন রাখি এই বলে, এখন কি পাকিস্তান উন্নত? নাকি বাংলাদেশ উন্নত?"
সত্যিকার
অর্থে আমিও নজরুলকে ভুলে আল্লামা ইকবালের ভক্ত হলাম এবং এও মানা শুরু করলাম যে, রবীন্দ্রনাথ কবি হিসেবে খুবই
নিম্নমানের। আমাকে জানানো হল, বাংলা একটি মিশ্রিত ভাষা অথচ
উর্দু হলো মৌলিক ভাষা। আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে এই সকল অযৌক্তিক যুক্তি
গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলাম। আসলে শিবির এমন একটি পক্রিয়ায় কাজ করে, যা সত্যিই বেশ আকর্ষনীয়, বিশেষ করে মগজ ধোলাইয়ের জন্য।
আমার মগজ ধোলাইয়ের কর্মটি সাঈদীই সেরে ফেলেছিলেন, যার কারনে পরবর্তীতে আমাকে
নিয়ে কাজ করতে শিবিরের যথেষ্ট সুবিধা হয়েছিলো। অতি অল্প সময়ের মধ্যে আমার
মস্তিষ্কে তারা মওদূদী'র তত্ব ঢুকিয়ে দিয়েছিলো পরম যত্ন সহকারে। আমার পড়ালেখার রুটিনে
মওদূদীর বাণী সম্বলিত বিভিন্ন হ্যান্ডনোট যুক্ত ছিল আমার দশম শ্রেণী সময়কালে। অতপর
মওদূদীর লেখা তাহফীমূল কোরআন-এর ১ম খন্ড আমাকে দেওয়া হলো। আসলে আরবী থেকে উর্দু
এবং উর্দু থেকে বাংলা রূপান্তর করে এই গ্রন্থখানির অনেক সংস্কার করা সত্বেও এর অনুবাদ
যে একপেশে তা আমার স্বল্প জ্ঞানেও ধরা পড়েছিলো। কিন্তু যেহেতু আমি তখন শিবিরের
প্রেমে মগ্ন ছিলাম, সেহেতু এই ধরা পড়াটা আমারই ভুল মনে করতাম। আমি তখন জিহাদ আর
বেহেশতের স্বপ্নে মশগুল ছিলাম। আমি আয়নায় নিজের চেহারা দেখতাম এবং ভাবতাম, আমার চেহারায় নূরের ঝিলিক এলো
কিনা? আমার এসএসসি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত আমি শিবিরের কর্মীপদে পদোন্নতি
লাভ করি। দশম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায়ই আমাকে সাথী হওয়ার জন্য খুব চাপ দেয়া হতো।
বিভিন্ন অজুহাতে সে বিষয়টি আমি এড়িয়ে যেতাম। কারণ আমি গঠন তন্ত্রে দেখেছি সাথী হতে
হলে কোরআন পড়া জানতে হবে। কিন্তু আমি কোরআন পড়তে পারতাম না। বিষয়টি প্রকাশ করাটা
আমার কাছে লজ্জাজনক ছিল বলে আমি চুপ করে থাকতাম। যদিও পরে বুঝেছি যে, শিবির করার জন্য পুরো কোরআনের
দরকার নেই, শুধুমাত্র হাঙ্গামা বিষয়ক আয়াত গুলোই জানা দরকার। ভাগ্যিস, আমি এই বিষয়টি তখন বুঝিনি, যদি বুঝতাম তাহলে মহব্বতের
কারণে, তখন দোষ ধরা না পড়ে উেল্টা আমিই সাথী হয়ে যেতাম। যা আমার জন্য আরও
ধ্বংসাত্মক হতো।
২০০১ এর নির্বাচনের আগে, শেখ হাছিনা ক্ষমতা ছাড়ার
প্রায় দু'মাস পূর্বে ঢাকার মুক্তাঙ্গনে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ছাত্র সমাজ, ইসলামী ছাত্র শক্তি সহ কয়েকটি
ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত তৎকালীন ছাত্র ঐক্য'র মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
যদিও তা পল্টন ময়দানে হওয়ার কথা।যার উদ্যেশ্য ছিল শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং সংসদ
ভেঙ্গে দেওয়া। আমি তখন নোয়াখালী কলেজের একাদশ শ্রেনীর ছাত্র। জেলা শহরের একটি মেসে
আমি থাকতাম। মহাসম্মেলনের ৩দিন আগে ছাত্রশিবিরের তৎকালীন জেলা সভাপতি মোশাররফ
হোসেন আমাকে জানালেন সম্মেলনের দিন ভোরে ভোরে আমাকে ঢাকা যেতে হবে এবং আমি যেন
একাদশ শ্রেনী থেকে নূন্যতম ৩০জন ছাত্রকে সাথে নিই। আমার সাথে তখন প্রায় সবদলের
সমর্থকদের সাথেই ভালো সম্পর্ক ছিল। সেই সুবাদে আমি মোট ৩৩জন ছাত্রকে যোগাড় করলাম।
আমার এই সক্রিয় ভুমিকা দেখে কলেজ শাখার সভাপতি জাকির হোসেন সবুজ আমাকে জানালেন, ভবিষ্যত নেতৃত্ব নেয়ার জন্য
প্রস্তুত থাকতে। কথাটিতে অত্যন্ত খুশি হয়ে সেদিন আমি ৪ রাকায়াত নফল নামাজ আদায়
করেছিলাম। যথারীতি নির্দিষ্ট তারিখের রাত ১২টায় আমরা সবাই জেলা জামে মসজিদ মোড়ের
শিবির অফিসে অবস্থান নিই। আমরা যারা সাংগঠনিক ছাত্র, তাদের সবাইকে ১০০টাকা করে
চাঁদা দিতে হয়েছিল। ক্ষেত্র বিশেষে আরও বেশি দিতে হয়েছে। আমি দিয়েছিলাম ৫০০টাকা।
মোট ৩টি বাস ভাড়া করা হয়েছিলো আমাদের জন্য। রাত ২টায় মোট ২০জন ছাত্র'র উপস্থিতিতে আমাদের একটি
বৈঠক হয়। যেখানে জানতে পারলাম প্রতিটি বাসে পাথরের টুকরো ভুর্তি ২টি করে বস্তা, এবং সাইজ করা ৩০টি করে লাঠি
থাকবে। পথিমধ্যে যদি কোন সমস্যার সৃষ্টি হয় তবে এগুলো ব্যবহার করতে হবে। রাত সাড়ে
৩টায় আমাদের বাসগুলো ছেড়ে দেয়। এখন মনে হলে ভয়ে আতকে ওঠি এই ভেবে যে, কতো মায়ের সন্তান সেদিন
বিপদের মুখে পা বাড়িয়েছিল খুব সাবলীল ভাবে। আমার এবং আমাদের অনেকের মনেই তখন শহীদ
হওয়ার অন্তিম ইচ্ছা, তাই আমরা মনে প্রানে ছেয়েছিলাম পথে যেন গন্ডগোল হয়। কিন্তু
কোনপ্রকার গন্ডগোল ছাড়াই সকাল ৮টার দিকে আমরা বায়তুল মোকাররম অফিসের সামনে পৌঁছি
এবং সেখানে অবস্থান নিই। সকালে আমরা ছিড়া আর কলা খাই। দফায় দফায় আমাদের মিটিং
হচ্ছে। এরই মাঝে জানতে পারলাম পল্টন ময়দানে সম্মেলন করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হল।
পরে সিদ্ধান্ত হলো মুক্তাঙ্গনেই সমাবেশ হবে। যোহরের নামাজ বায়তুল মোকাররমেই আদায়
করলাম। নামাজের পর প্রত্যেকের জন্য ৩পিস পাউরুটি এবং ১পিস কলার ব্যবস্থা করা
হয়েছিলো। যদিও চিহ্নিত কিছুলোক বিরিয়ানি খেয়েছিলো। আমাকেও সেই দলে ডেকেছিলো, কিন্তু আমি যাইনি। কারণ আমার
সাথে আসা ৩৩জন ছাত্রতো আর বিরিয়ানি খেতে পারবে না। ৩টার দিকে শিবিরের কেন্দ্রীয়
অফিসে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি নুরুল ইসলাম বুলবুলের সাথে প্রত্যেক জেলা সভাপতি
নেতৃত্বাধীন জেলা কমিটির সাথে ৩০ মিনিটের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে পরে
সবাই মিছিল সহকারে মুক্তাঙ্গনের দিকে রওয়ানা দিবে। আমাদের জেলা সভাপতি, সাধারন সম্পাদক এবং কলেজ
সভাপতির সাথে আমারও যাওয়া হয়েছিলো। রুমে ঢোকার আগেই ৪জন শক্তিশালী যুবক আমাদেরকে
চেকিং করলো। তারপর আমরা রুমে ঢুকলাম। কেন্দ্রীয় সভাপতি আমাদেরকে জানালেন যে, সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশকে
কঠোর হওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং আমরা সবাই যেন প্রস্তুত থাকি। আমাদের
নোয়াখালী টিমের বিশেষ কিছু ব্যক্তির নাম লিস্ট থেকে পড়ে বললেন যে তারা যেন মিছিলের
দু সাইডে থাকে। কে জানে হয়তো তাদের কাছে ভারী কোন অস্ত্র ছিলো। সমাবেশ স্থলে
শিবিরের সবাই যেন মাথায় শিবিরের প্লেকার্ড বেঁধে সমাবেশের চারপাশে অবস্থান নেয়।
মিটিং শেষে আমরা একাংশ নোয়াখালী কলেজের এবং অপর অংশ জেলার পরিচয়বাহী ব্যানার
সহকারে মিছিল করতে করতে রওয়ানা দিলাম। আমি শহীদ হওয়ার আশায় মিছিলের সামনে কাতারে
ছিলাম। এবং সবাই মিলে পথে পথে পুলিশকে উদ্দেশ্য করে উস্কানীমূলক শ্লোগান দিতে
থাকি। কিন্তু পুলিশের ভূমিকা ছিলো নিরব। সমাবেশ স্থলে পৌঁছেই আমি অনেক কষ্টে
মঞ্চের ঠিক সামনে অবস্থান নিই। তাও শহীদ হওয়ার খায়েশে। একের পর এক বক্তব্য শুনেই
যাচ্ছিলাম। একপর্যায়ে ইসলামী ছাত্র শক্তির কেনদ্রীয় সভাপতি বললেন উনি শেখ হাসিনার
কাপড় খুলে ফেলবেন, আমরা উনার সাথে থাকবো কিনা? শুনেতো আমি থ। মনেপ্রানে আশা
করেছিলাম, আমাদের কেন্দ্রীয় সভাপতি এইটার নিন্দা জানাবেন। কিন্তু সমাবেশের
সভাপতির বক্তৃতা দিতে এসে উনি সেই বক্তাকেই বেশী সাধুবাদ জানালেন। আমার অবুঝ মন
ভাবলো এক্ষেত্রে বোধহয় সাধুবাদ জানাতে হয়। অবশেষে শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাবেশ সেরে
দুপুরের পর উপোস থেকে রাত ১টায় নোয়াখালী পৌঁছি।
আমি যে মেসে থাকতাম (২০০১-২০০২)
তার মালিক ছিলেন এক ভদ্র মহিলা। নাম নার্গিস আক্তার। তার নামানুসারে বাসাটির নাম
নার্গিস কটেজ। নার্গিস খালা প্রচুর টাকার মালিক। খালা আবার জামাত শিবিরকে প্রচুর
চাঁদা দিতেন। শিবিরের ডোনার তালিকায় উনার নাম ছিলো অনেকের আগে। মেসে আবার আমিই
একমাত্র শিবির করতাম। সেই সুবাধে খালার খুব প্রিয় ছিলাম আমি। আমার তৎপরতায় মেসে
শিবির সমর্থকের সংখ্যা বাড়তে থাকলো। এবার আমি আরও ভালো করে শিবির নেতাদের নজরে
আসলাম। তখন দেশে সরকার বিরোধী তুমুল আন্দোলন। প্রতিদিনই মিছিল মিটিং লেগেই ছিল।
একদিন শহরের মসজিদ মোড়ে আমাদের (ছাত্র ঐক্যের) সমাবেশ ছিল। সেই দিন আবার ছাত্রলীগও
মিছিলের ডাক দিয়েছিল। আমাদের ৬জন কর্মী মিছিল সহকারে রিকশাযোগে আসার পথে ছাত্রলীগ
কর্মীদের হাতে প্রহৃত হয়। এঘটনা জানার পর আমরা ভীষণ ক্ষেপে যাই। সাথে সাথে আমরা
মিছিল বের করে শহরের টাউনহল মোড়ে আওয়ামীলীগ অফিসের দিকে অগ্রসর হই। আওয়ামীলীগ
নেতারা তখন মিছিল পূর্ব মিটিংয়ে ব্যস্ত। দোতলা অফিস পুরোটাতেই তখন জেলা পর্যায়ের
নেতায় ভরপুর। ভবনটির নিচে বেশ কয়েকটি মটর সাইকেল রাখা ছিলো। পুরাতন ক্যাম্পাস
শাখার সাবেক সভাপতি সোহেল, আমি এবং কয়েকজন মিলে ৪টি মটর সাইকেলে আগুন ধরিয়ে দিই। এবং রাখা সড়ক
ও জনপথ বিভাগ কতৃক ফুটপাতের কাজের জন্য স্তুপ করে ইটের টুকরো দিয়ে ছুড়ে মেরে
অফিসটির প্রায় সব ক'টি জানালা ভেঙ্গে ফেলি। ধীরে
ধীরে ছাত্রলীগের কর্মীরাও জড়ো হতে থাকে। কিন্তু আমরা তখন বেপোরোয়া। পুলিশ দু'দিক মুখ করে অবস্থান নিয়েছিল।
একপর্যায়ে আমরা পুলিশকে আক্রমন করে বসি। এবং দোতলায় ওঠে জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি
বেলায়েত হোসেন, সাধারন সম্পাদক, অধ্যাপক মোঃ হানিপ, পিন্টু, ছাত্রলীগ নেতা তালেবান, রেদোয়ান, ভুলু সহ অনেককেই মারধর শুরু
করি। একপর্যায়ে পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করে। কিন্তু কে শোনে কার কথা
আমাদেরকে কি আর রুখা যায়!! অফিসের পুরো আসবাবপত্র ভেঙ্গে চুরে একাকার করে তবেই
অফিস কক্ষ ত্যাগ করি। ততক্ষণে প্রায় ১৫জন আওয়ামী নেতা এবং পুলিশকে হাসপাতালে
পাঠানো হয়েছিল। বেশিরভাগ ছাত্রলীগ নেতা পালিয়ে গিয়েছিল। অত্যধিক সাহসী যারা ছিল
তাদেরকে ধাওয়া করে সরকারি আবাসিক এলাকার দিকে নিয়ে যাই এবং বেদম মারধর করি। ঐদিন
প্রায় শতাধিক ছাত্রলীগ কর্মী এবং পুলিশ মারাক্তক আহত হয়। পরিস্থিতি শান্ত হবার পর
আমাদের যারা রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়েছিল এবং যারা সামান্য আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিল
তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় অভিযোগ
ছিল, আমাদের কর্মীদেরকে মেরে টাকাপয়সা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে ছাত্রলীগ
কর্মীরা। যদিও অভিযোগটি পুরোপুরি মিথ্যা। অথচ শুধূ আমার হাতেই আওয়ামী নেতাদের
প্রায় ৪ লক্ষ টাকার সম্পদ নষ্ট হয়। যদিও তার জন্য আমাকে কোন মামলায় পড়তে হয়নি।
কলেজে আমাদের সিনিয়রদের
ফাইনাল পরীক্ষা ঘনিয়ে এলে আমাকে বলা হলো তাড়াতাড়ি যেন সাথী প্রার্থী হই। আমি এক
কথায় না করে দিলাম। কারণ ক্যাম্পাসে আমি তখন প্রকাশ্যে সিগেরেট খেতাম এবং মাঠের
কোনায় বসে মেয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতাম, যা শিবিরের বর্ণিত আদর্শের
পরিপন্থী। যদিও বিষয়টি শিবির নেতাদের নজরে ছিল না। শিবিরকে ভালবাসতাম বলেই আমি
চাইনি সাথী হতে। কিন্তু আমার উপর চাপ বাড়তে লাগলো। কারণ আমাদের ব্যাচে যে ক'জন সাথী ছিলো, তাদের সবারই কোন না কোন
সমস্যা ছিল। কেউ পড়ে লেখায় খারাপ ছিলো, কেউ মানা সই ছিল না, কারও আবার কথার দোষ ছিলো।
সবমিলিয়ে আমার উপরই তীরন্দাজের টার্গেট ছিলো। কোন ভাবেই যখন ওদেরকে মানাতে পারলাম
না, তখন বললাম যে, ঠিক আছে আমি গোপনে সাংগঠিন
কাজ করে যাব। তবে প্রকাশ্যে কাউকে দ্বায়িত্ব নিতে হবে। তারা রাজি হলো। এভাবে বেশ
কয়েক দিন চলেছিলো। কলেজের পাশেই (পুরাতন ক্যাম্পাস) শান্তি নগর গ্রাম, কলেজ থেকে দৃষ্টি দূরত্বে
একটি মসজিদ অবস্থিত। সেখানে আমাদের মিটিংগুলো হতো। আমার শিবির বিষয়ক কর্মকান্ড
সম্পর্কে আমার কলেজ বন্ধুরা তেমন একটা জানতো না।
তখনও শেখ হাসিনার সরকার(২০০১)
ক্ষমতা ছাড়েনি। সারাদেশে বিরোধী দলের তুমুল আন্দোলন। একদিন বিকেলে খবর পেলাম
আমাদের পাশ্ববর্তী জেলা লক্ষীপুরে এক শিবির কর্মীকে পিটিয়ে গাছের সাথে বেঁধে
রেখেছে। আমরা তখন কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমার ভেতরটা কেঁদে উঠলো। কারন
কর্মীটি একেবারেই বালক। ১০ শ্রেনীর ছাত্র। আমি ঘটনাস্থলে যাবার জন্য পীড়াপিড়ী
করছিলাম। খবর নিয়ে জানতে পারলাম গডফাদার আবু তাহেরের অনুসারীরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে।
দিঘলী বাজার নামক স্থানে অনেক গুলো স্কুল ছাত্রদের নিয়ে শিবির নেতারা গিয়েছিলো
ছাত্রলীগের অফিস ভাঙতে। কারণ, তারা শিবিরকে ব্যঙ্গ করে
পোস্টারিং করেছে। মাত্র ৫০জন কর্মী মিলে ছাত্রলীগের মতো একটি সুসংগঠিত ছাত্র
সংগঠনের অফিস ভাঙতে যাওয়াটা নেহাৎ বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। ছাত্রলীগ নেতারা তখন
অফিসের ভেতর আড্ড মারছিলো। ঐদিন এক ছাত্রলীগ নেতার বোনের বিয়ে ছিলো। যেখানে তার
বন্ধু বান্ধব সহ অনেক নেতা কর্মী উপস্থিত হয়েছিলো। ঐ নেতার বাড়ি অফিস থেকে
৫মিনিটের দূরত্বে। খবর পেয়ে সবাই এসে হাজির । শিবিরকে দেখে যেখানে ৮০বছরের
বৃদ্ধেরও দাঁত কিমিয়ে ওঠে, সেখানে এতোগুলো জওয়ানের রক্তে যে, কি পরিমান ঝড় ওঠেছিলো তা
আন্দাজ করা মোটেও কঠিন নয়। প্রচন্ড মারামারির মাঝে অনেক স্কুল ছাত্র ধরা পড়ে যায়।
"তাদের মাঝে একটি ছাত্র শহীদ হওয়ার কথা বললে ছাত্রলীগ নেতারা তাকে গাছের সাথে
বেঁধে রাখে, এবং বলে-এইবার শহীদ হ। তোর খানাপিনা সব বন্ধ।" আমরা
মাইজদী(নোয়াখালী জেলা শহর) থেকে প্রায় ৪০জনের একটি দল পিক আপ যোগে রওয়ানা দিলাম।
লক্ষীপুর থানার সাথে যোগাযোগ করে, ছাত্রলীগ নেতাদের সাথে আলোচনা
করে ঐ ছাত্রকে ছাড়িয়ে নিই। রাতে ঘুমোনোর আগে অনেক ভাবলাম। এই কোমলমতি স্কুল
ছাত্রদের কেন এইসকল হাঙ্গামায় নেয়া হয়? আমিও তখন অতটা বড় নয়।
সবেমাত্র একাদশ শ্রেনীর ছাত্র। কিন্তু নিজেকে খুব বড় মনে করতাম। সারা রাত আমার ঘুম
হয়নি। এক বালকের অসহায়ত্ব আমাকে কাঁদিয়েছে সারারাত। সেই দিন প্রথম আমার মাঝে এক
ধরনের প্রশ্নের জন্ম নেয়। সেই প্রশ্নের জের ধরেই আমার শিবির থেকে বেরিয়ে আসা। ছোট
ছিলাম বলে শিবিরের ভেতরের খবর অনেকটা জানতাম না। পরে ধীরে ধীরে এমন কিছু জানলাম, যা গা শিউরে ওঠার মতো। এর ক'দিন পরেই শহরের মাইজদী বাজার
নামক স্থানে বিশিষ্ট উপন্যাসিক এবং নাট্যকার প্রনব ভট্ট দাদাদের ফার্মেসি ভট্ট
মেডিকেল হল থেকে ওষধ কিনতে এসে স্থানীয় আল-আমিন মাদ্রাসার এক ছাত্র'র সাথে কথাকাটি হয়। প্রনব
ভট্রের দুই ভাই মিথুন ভট্ট আর ইমন ভট্ট জেলা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতা ছিলেন। ঘটনাটি
আমাদের সাবেক ইন্টার শাখার সভাপতি সোহেল নিজচোখে দেখেন। তিনি গেলেন সোজা আমার মেসে।
মাদ্রাসায় আমার পরিচিত কেউ আছে কিনা জানতে চাইলে আমি বললাম, আল-আমিন মসজিদের ইমাম এবং
মাদ্রাসার শিক্ষক এক মুফতি'র কথা। আমাকে নিয়ে মাদ্রাসায় গেলেন এবং মুফতিকে কিছু কথা বললেন। যা
বললেন তা ছিলো বেশ উস্কানি মূলক। তারপরেই ঝাঁকে ঝাঁকে মাদ্রাসার ছাত্র লাঠি সোটা
নিয়ে মাইজদী বাজারে ভট্ট মেডিকেল হলে আক্রমন করে বসে। সেই সাথে সোনালী ব্যাংক ভবন, স্যাভোরী ফাস্ট ফুড, ইয়ং ভিডিও সেন্টার সহ বেশ
কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করা হয়। আমরা তখন মেসে। প্রায় আধঘন্টা পর ঘটনাস্থলে এসে
যা দেখলাম, তাতে ৭১'র একটা স্বরূপ পেয়ে গেলাম। এই ধরনের দাঙ্গা সৃষ্টি করে দেওয়া কি
ঠিক হলো? এই প্রশ্নটি সোহেলকে করা হলে সে জানায়,
"এ
ধরনের ভাঙচুরের দরকার আছে, কিন্তু শিবির যদি ঘটনাটি ঘটাতো তাহলে নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে।
তাই উপস্থিত বুদ্ধিতে কাজটি করিয়ে দিলাম।" এবং সেই সাথে এ বিষয়গুলো(হাঙ্গামা
বাধিয়ে দেয়ার কারিশমা) থেকে শিক্ষা গ্রহন করার পরামর্শ দিলেন।
৯০এর স্বৈরাচার পতনের পর আমার
দেখা সবচে' কঠিন হরতাল ছিলো ২০০১এ শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ডাকা চারদলীয়
জোটের হরতাল গুলো। ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় ঘনিয়ে এসেছিলো। কিন্তু চারদলীয় জোট
চেয়েছিলো অন্তত ১ দিন আগে হলেও সরকারের পতন ঘটানো। যদিও তা সম্ভব হয়নি। সে সময়ের
ডাকা হরতাল ছিল একেবারেই কঠোর। নোয়াখালীতে সাইকেল পর্যন্ত চলতে দেয়া হতো না। এরকম
এক হরতালে আমি আরও কয়েকজন ছাত্রদল এবং শিবির কর্মীকে সাথে নিয়ে সকাল থেকে দুপুর
পর্যন্ত প্রায় ৮/১০টি সাইকেলের টায়ার খুলে রাস্তায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম। এবং
আরোহীকে উত্তম মধ্যম দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলাম। শহরের অবস্থা খারাপ শুনে দুপুরে মেসের
মালিকের টিএন্ডটি নাম্বারে বাবা ফোন করেন বাড়ি যাওয়ার জন্য। মেসে গিয়ে শুনে বাড়ির
উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সম্বল টিউশনির টাকায় কেনা একটি ফনিক্স সাইকেল। সাইকেল নিয়ে
বাইপাস রোডে এগুতে লাগলাম। যেহেতু আমি শহরে শিবিরের একটি মোটামুটি পরিচিত মুখ, সেহেতু শহর এবং এর কাছাকাছি
স্থানে যে আমার কোন সমস্যা হবে না সেরকম একটি ধারনা আমার ছিল। কিন্তু আমার সে
ধারণা ভুল প্রমানিত হল যখন আমি কাশেম বাজার নামক স্থানে প্রিয় সাইকেলটি হারিয়ে
ফেললাম। এবং তা শিবির কর্মীদের হাতেই। আমার পরিচয় দেয়ার সুযোগ পর্যন্ত পাইনি। তার
আগেই হকস্টিকের আঘাতে আমার সাইকেল কাত হয়ে গেল। পিঠের উপর হকিস্টিকের হিট খুব
জোরেই লেগেছিলো। সব হারানোর পর পরিচয় না দিয়েই হন্টন যোগে বাড়ীর পথ ধরলাম। বিবেকের
তাড়নায় কথাটি উপরের মহলেও জানাইনি। আমার হাতেওতো অনেক সাইকেল সকাল থেকে প্রান
হারিয়েছিলো। সেবারের সেই হকিস্টিকের আঘাত আমার মেরুদন্ডে সমস্যার সৃষ্টি করেছিলো।
প্রায় ১০হাজার টাকা খরচ হয়েছিল হাড় বিশেষজ্ঞ'র চেম্বারের দৌড়াদৌড়ি আর ওষধ
খরচ দিয়ে। প্রায় ২ মাস আমি বিছানায় পড়েছিলাম। আজও শীত এলে আমার সে হকিস্টিকের
আঘাতের জের গুনে গুনে বুঝে নিতে হয়। পরিচিত জনেরা অনেক চাপাচাপি করলেও ঘটনা বলিনি
কাউকেই। যদি তাতে আবার শিবিরের কোন ক্ষতি হয়। অবশ্য আঘাতকারীরা কিভাবে আমার পিতৃ
পরিচয় পেয়ে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছিলো। দু'মাস পরে সুস্থ হয়ে আবার শহরে উঠলাম।
তার পরের দিন আমার এক গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে রিকশা করে কলেজের প্রায় ১৫ কিঃ মিঃ
পশ্চিমে রাজগঞ্জ বাজারের দিকে ঘুরতে যাই। তখন দুপুর ২টার মতো। পথঘাট প্রায় ফাঁকা।
তখনো আমরা রাজগঞ্জ পৌঁচতে পারিনি, তার আগেই একটা বাজারের শেষ
প্রান্তে কয়েকজন ছেলে আমাদের গতিরোধ করে। এবং জিজ্ঞাসা করে আমরা কোথা থেকে এসেছি।
সব বলার পর বলে, "এটা শিবির নিয়ন্ত্রিত এলাকা, এখানে প্রকাশ্যে পিরিত চলে
না"। আরও অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছিল সেদিন। যদিও প্রায় সবাই আমার সঙ্গীর দেহে
চোখ দিয়ে অনেক কিছু আবিষ্কারে ব্যস্ত ছিল। এবং ২০মিনিট সময়ে তাদের চোখের হক সুদে
আসলে মিটিয়ে নিয়েছিলো। অবশেষে নিজের পরিচয় না দিয়েই চলে আসি। আমার শিবির পরিচয় অত
বিস্তৃত ছিল না বলেই এই সকল সমস্যা হতো।
শিবিরের সাথে আমার সংসার খুব
ভালো ভাবেই চলছিলো। আমি সারাদিন খুব ব্যস্ত থাকতাম সংসার (শিবির) নিয়ে আর রাতের
অর্ধেকটা কেটে যেত জামায়াতকে ক্ষমতাসীন দেখার স্বপ্ন দেখে দেখে। আমার যাবতীয় সুখ
আর দুঃখ তখন শিবিরকে ঘিরেই। তাই রমনীর প্রেম ঐ বয়সে আমাকে আর স্পর্শ করতে পারেনি।
কিন্তু এতো সুখ আর সইলো না। আমার সতী আদর্শের সংসারে পশুসম পতি সতীনের আমদানি
করলো। এই সতীন যদিও শিবিরের ঘরে জন্মলগ্ন থেকেই ছিলো, কিন্তু আমার নজরে আসে সংসারে
অনেকগুলো ছেলেপুলে আসার পর। তখন আমার আগে পিছে পঞ্চাশোর্ধ সদস্যের এক বিশাল ছাত্র
বাহিনী। আমার হাতে প্রায় ৫০জন ছাত্র শিবিরের সমর্থক হয়। যা নিয়ে আমি গর্ভে
মোটামুটি গর্ভবতী ছিলাম। অথচ সপ্তমাসী গর্ভের গর্ভপাত করাতে হলো অনেকটা দুঃখ পেয়ে।
আজও সেই দুঃখের রেশ ধরে কোন শিবির কর্মী দেখলেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়,
"আহারে
! আমার মায়ের কি সুন্দর কপি ক্ষেত শুয়োরের দল মাড়িয়ে দিল"।
নোয়াখালী-৫ আসনে ২০০১এর
নির্বাচনটা শিবিরের ক্ষেত্রে খুবই শান্তিপূর্ণ ভাবে হলো। যদিও আমাদের আসনে সতন্ত্র
প্রার্থী এক সময়ের আবাহনী ক্লাবের কোষাদ্যক্ষ একরামুল করিম চৌধুরীর অনুসারীরা
নির্বাচনের আগে ও পরে ব্যাপক তান্ডব চালায়। এবং অনেক শিবির কর্মী তখন টাকার লোভে
একরাম চৌধুরীর দলে যোগ দেয়। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে খুব দ্রুত বেগে শিবির তার
কার্যক্রম চালাতে থাকে। আমাদের এলাকাটা (গ্রামের) তখন শিবিরের খুব শক্ত একটা ঘাটি।
আমাদের গ্রামের শতাব্দী প্রাচীন স্কুলেই তখন প্রায় ৪০জন শিবির সমর্থক এবং ২৮জন
কর্মী ছিলো। স্বাভাবিক ভাবেই আমি তাদের বড়ভাই ছিলাম।
আমার মাধ্যমে যারা শিবিরে পা
রাখে, তারা মূলত আমার দেখানো পথেই চলতো। আমি কখনওই তাদেরকে শিবিরের কোন
প্রোগ্রামে নিতাম না। কারণ তার স্কুল ছাত্র। তবে প্রতি বৃহস্পতিবার আমাদের গ্রামের
মসজিদে তাদেরকে নিয়ে সাপ্তাহিক সভার আয়োজন করতাম। এবং তাদেরকে জিহাদের কথা কম
বলতাম। কারণ কোমলমতি ছাত্রদের মনে যদি যুদ্ধ বিগ্রহের আগ্রহ চলে আসে, তবে সহিংসতা ছাড়া তারা সমাজকে
আর কিছুই দিতে পারবেনা। বিশেষ করে লক্ষীপুরের ঐ ছাত্রের কথা আর হরতালের সময় আমার
সাইকেল হারানোর ঘটনার পর জিহাদ নামক শব্দটির প্রতি আমার ভীষণ অনীহার জন্ম নেয়।
একদিন আমাদের মসজিদে শিবিরের
থানা সভাপতির উপস্থিতিতে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে প্রথমে বক্তব্য রাখতে গিয়ে
আমি জিহাদ সম্পর্কে অনেক কথা বলেছিলাম, যা শিবিরের বিপক্ষে চলে যায়।
গম্ভীর মুখ নিয়ে সভাপতি হেলাল উদ্দিন সভা শেষ করলেন। এর দু'দিন পরে লোক পাঠিয়ে আমাকে তার
সাথে দেখা করার কথা বললেন। দেখা করতে গেলে উনি আমাকে সাথী হওয়ার জন্য বলেন এবং
শিবিরের সংবিধানটি আমার হাতে তুলে দেন। আমি সংবিধান নিয়ে চলে আসার সময় বললেন, এমন কিছু করবেন না যাতে
শিবিরের ক্ষতি হয়। কোন উত্তর না করে আমি চলে আসি। কারণ ততক্ষণে আমি নিশ্চিত হলাম
শিবিরের আদর্শের সাথে আমার আদর্শ মিলবে না।
এর কিছুদিন পরেই চট্টগ্রাম
জেলা সভাপতি মঞ্জু আমাদের সদ্য গঠিত কবিরহাট উপজেলার কবিরহাট বাজারে একটি কিন্ডার
গার্টেনে (শিবিরের নিজস্ব) আয়োজিত কর্মী সম্মেলনে আসেন। ঐ দিনকে কেন্দ্র করে আমাদর
ব্যাপক প্রস্তুতি ছিলো। আমাকে ২০ জনের একটি টার্গেট দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সবাইকে
আশ্চর্য করে আমি কোন ছাত্রকে না নিয়েই সম্মেলনে উপস্থিত হই, যা শিবিরের নেতৃত্ব পর্যায়ে
ভীষণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। এর জন্য আমাকে শোকজও করতে হয়েছিল। ভেতরে ভেতরে জ্বললেও
স্বাভাবিক জবাব দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে আমাকে নিয়ে একটি বৈঠক হয় এবং অপার দেয়া হয় যে, আমি যদি সাথী হয়ে আগের মতো
সাংগঠনিক কাজকর্ম করি তবে আমকে থানা সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন করা হবে। খুব
সচেতনভাবেই আমি প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করি। প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে আমি
পারিবারিক সমস্যার কথা উল্লেখ করেছিলাম।
আমি চেয়েছিলাম ইসলামের আদর্শে
বড় হতে। কিন্তু শিবির আমাকে যে ইসলামের সন্ধান দিলো, তাতে আমি কোন শান্তিই খুজে
পেলাম না। বরং যা পেয়েছি, তা যদি আমি মানি, তবে আমার জন্মটাই প্রশ্নবোধক
হয়ে যাবে। একজন মানুষ হিসেবে অবশ্যই কেউ না কেউ আমাকে সৃষ্টি করেছেন। সেই সৃষ্টি
কর্তা নিশ্চয় তার সৃষ্টিকে অনাসৃষ্টি করার আদেশ দিবেন না। কারণ তাতে স্রষ্টারই
সৃজনী ক্ষয় হবে।
তখনও আমি মাসে ১০০টাকা হারে
এয়ানত দিতাম। এমন কত টাকা যে, শিবিরকে দিয়েছিলাম!! সবই
বাবার ভান্ড থেকে চুরি করা। যে ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হয়ে বাপের দোকানের ক্যাশের ১০০
টাকা গচ্ছা দিতাম, সে ভালোবাসা বড্ড তেতো হয়ে যাচ্ছিলো। সর্বাত্মক চেষ্টা করতাম
শিবিরকে এড়িয়ে চলতে। অবশ্য বেশিদিন ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাদা দিতে হয়নি। শিবিরের প্রতি
আগ্রহ হারিয়ে ফেলার পর মোট ৩মাস চাঁদা দিয়েছিলাম। আমার অনাগ্রহের বিষয়টি শিবির
নেতাদের নজরে আসে। এ বিষয়ে ভেতরে ভেতরে অনেক কানাঘুষা হতো। তারা প্রাসঙ্গিক ভাবে
আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করতো, "আল্লাহর দুনিয়ায় যারা ইসলামী শাসনের বিরোধী তাদের বিরুদ্ধে
জিহাদ করা দোষের কিছু নয় এবয় অবশ্যই তা ফরজ।" বেহেশতের লোভ দেখানো এমন ভাবে
মনে হতো, বেহেশতটা আশুলিয়ার ফ্যান্টাসি কিংডম; বাসে করে গেলাম, টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম। আর
বিষয়টি এমন যে, শিবির নেতাদের টিকিট সবসময় বেহেশতের প্রহরীর কাছে জমা থাকতো, যেন কষ্ট করে বহন করা না
লাগে।
আমি তখন ভীষণ চিন্তিত ছিলাম
এই ভেবে যে, যারা আমার হাত ধরে শিবিরের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছিলো তাদেরকে কি
জবাব দিব? আবার ভাবতাম যেহেতু তারায় আমার মন্ত্রে মুগ্ধ হয়ে শিবিরের পতাকাতলে
এসেছে, নিশ্চয় আবার বেরিয়েও যাবে। ভয়টা খুব বেড়ে যেত যখন ভাবতাম, যদি তারা আমাকে সাড়া না দিয়ে
শিবিরকে আঁকড়ে ধরে রাখে!! তবে চোখের সামনে অনেক গুলো ছাত্রের জীবন ধ্বংসের
কুন্ডলীতে আটকা পড়বে এবং এর জন্য নির্দিষ্টভাবে আমিই দায়ী থাকবো।
জামাত শিবিরের জঙ্গী কানেকশন :
২০০৩ এর মাঝামাঝি সময়ে আমি
আমার এক বন্ধুর সাথে ঢাকা গিয়েছিলাম। ঐ বন্ধুর এক ভাই তখন পুরানা পল্টনে একটি
মাসিক পত্রিকা অফিসে চাকরী করতো। পত্রিকাটি বর্তমানে বিলুপ্ত। অফিস ছিলো হোটেল
গ্র্যান্ড আজাদের পাশেই। বন্ধুর ভাই'র সাথে দেখা করতে গেলে জানতে
পারলাম সম্পাদকের বাসায় জরুরী মিটিং হচ্ছে। আমরা সেখানে গেলাম। ওয়েটিং রুমে
বসেছিলাম অনেকক্ষন। পরে বন্ধুর মুখ থেকে যখন শুনলো আমি শিবিরের একজন সক্রিয় কর্মীয়, তখন আমাকে ভেতরে যাওয়ার
অনুমতি দেয়া হয়। আমি ৫জন বয়স্ক ব্যক্তিকে দেখতে পেয়েছিলাম। পরিচয়ের এক পর্যায়ে
জানতে পারলাম সম্পাদক সাহেব বর্তমানে(২০০৩) রমনা থানা জামায়াতে ইসলামীর একজন
দ্বায়িত্বশীল। পরে বন্ধুর ভাইয়ের কাছ থেকে জানলাম মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোরগঞ্জের
আলবদর কমান্ডার ছিলেন। বাঁকি ৪জনের মধ্যে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি, ভারতের আহমেদাবাদ, কাশ্মীর এবং তামিলনাড়ুর
নাগরিক ছিলেন। তাদের আলোচনার কিছু অংশ আমি শুনেছি। পুরোটাই উর্দু বা হিন্দিতে। তখন
আমি অতটা পরিপক্ক ছিলাম না। বিষয়টিকে অত বেশি গুরুত্ব দেইনি। তবু যতটুকু বুজেছি তা
হলো- যারা বাংলাদেশে ধর্মান্ধতা বিষয়ে জনগনকে সচেতন করছে- তাদেরকে টার্গেট করতে
হবে।
শিবিরের জঙ্গী প্রশিক্ষণ :
বাংলাদেশের পাহাড়ী অঞ্চলে শিবিরের
জঙ্গী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিলো। যেখানে তাদের সাথে আঁতাত ছিলো পাহাড়ী জঙ্গীদের।
প্রশিক্ষণ চালাতে গিয়ে তাদেরকে মুছলেকা দিতে হতো। পরবর্তীতে পাহাড়ে জঙ্গলের পরিমান
কমে যাওয়া এবং পাহাড়ী জঙ্গীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে প্রশিক্ষণে সমস্যা দেখা দেয়। তার
বাহিরে দেশের প্রতিটি থানায় কয়েকটি করে মার্শাল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। অস্ত্র
প্রশিক্ষণের বিষয়ে তৃণমূল পর্যায়ে কোন প্রশিক্ষণ শিবির আছে কি না, সে বিষয়ে আমার কাছে কোন তথ্য
নেই। এবং জঙ্গী তৎপরতা নিয়ে যে সকল তথ্য দিয়েছি তার মুখোমুখি আমি হইনি। ঐ সকল
প্রশিক্ষন নেয়ার উপযুক্ততা অর্জনের আগেই আমি শিবির ছেড়েছি। কিন্তু শিবিরের সাথে
দীর্ঘদিন জড়িত থাকার সুবাধে শিবির নেতাদের আলোচনা এবং অন্যান্য কর্মকান্ডে আমি এই
সকল ক্লু বের করতে সক্ষম হই।
শিবিরের অর্থনৈতিক সাপোর্ট :
শিবিরের সবচেয়ে বেশি অর্থ
কালেকশন হয় নেতা কর্মীদের থেকে চাঁদা উঠিয়ে। তারপরে আছে সৌদি আরব থেকে প্রাপ্ত
অনুদান। উল্লেখ্য আমার দেখা সর্বশেষ ২০০২/০৩ এর সময়কার সভাপতি নুরুল ইসলাম বুলবুল
সৌদি সরকারের অর্থ ব্যয়ে হ্জ্জকালীন সৌদী সফর করেন। তার আগে মতিউর রহমান মল্লিক
থেকে শুরু হয় এই সৌদি সফর। অর্থের দিক দিয়ে আরও বড়সড়
একটা অংক আসে দেশীয় শুভাকাঙ্খীদের থেকে প্রাপ্ত অনুদানে। তবে কানাঘুষা আছে, নিরব চাঁদাবাজি থেকেই নাকি
সবচেয়ে বেশি অর্থ সংগৃহিত হয়।
আমি কেন শিবির করতাম :
আমি মূলত সাঈদীর ওয়াজ শুনে
একটি বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিলাম যে, জিহাদ আমাদের জন্য ফরজ এবং তা
না করলে বেহেশত অনিশ্চিত। আর ইসলামী দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিবিরকে বেচে নেয়ার
কারণ হলো- সাঈদীর ওয়াজে একটি হাদিস শুনেছিলাম, মুহম্মদকে জিজ্ঞাসা করা
হয়েছিলো- শেষ জামানায়তো ইসলামী জনগোষ্ঠী অনেক ভাগে বিভক্ত হবে, তখন মুসলিমরা কোন দলকে বেছে
নেবে? জবাবে মুহম্মদ বলেছিলেন, যে দলের উপর নির্যাতন বেশী হবে
তাকেই বেছে নেবে। ভেবে চিন্তে দেখলাম শিবিরই সবচেয়ে বেশি লাথি উষ্ঠা খায়। তাই চোখ
বুঁজে শিবিরকেই বেছে নিয়েছিলাম।
আমি কেন শিবির ছাড়লাম :
**শিবির আমাদের স্বাধীনতার
বিষয়ে নাক সিঁটকায়।
**রাজাকারদের গুরু মেনে ছাত্র
রাজনীতি করে।
**বাংলা ভাষা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য
করে।
**জাতীয় সঙ্গীত�
আপনার আরেকটু পড়াশোনা করে লেখা উচিত ছিল । গল্পটা যারা মূর্খ তাদেরকে খাওয়ায় দিয়েন । আমি কখনো শিবিরে ছিলাম না কিন্তু এতোটুকু বুঝতে পারি যে আপনার জ্ঞানের অজ্ঞতা রয়েছে ইসলাম সম্পর্কে ।
ReplyDeleteএটা কি কোন আওয়ামী ল্যাস্পেন্সার এর লিখা? একটা দল্কে ডুবানোর জন্য আর কতটা নিচে নামতে হবে? যাই লিখেন তার জন্য কারো ক্ষতি হলে তার দায় আপ্নাকেই নিতে হবে।
Delete