Sunday, 14 June 2015

আমি রোজা থাকি না, 'না খেয়ে থাকি'

2 Comments
শিয়াদের মতে, সুন্নিদের রোজা একেবারেই হয় না। কারণ সুন্নিগণ সন্ধ্যায় এফতার করে। অল্পক্ষণের জন্য রোজা নষ্ট করিয়া ফেলে। অপরপক্ষে সুন্নিদের মতে, শিয়াদের রোজা মাকরূহ হইয়া যায়, যেহেতু প্রায় পনর মিনিট পরে তাহারা এফতার করে।যেহেতু এফতার শীঘ্রই করার তাগিদ কয়েকটি হাদিসেই দেখিতে পাওয়া যায় বলিয়া সূন্নি আলেমগণ মনে করেন, যেইহেতু সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের মতে এফতার করিতে হইবে, নতুবা এফতার বিষয়ে তাড়াহুড়া করার আদেশ লঙ্ঘনের জন্য উহা মকরুহ অর্থাৎ অবাঞ্চিত বা ত্রুটিপূর্ণ হইয়া যায়। শিয়া আলেমগণ মনে করেন যেহেতু কোরানে বলিতেছেন (২:১৮৭)"সিয়াম পূর্ণ কর রাত্রের দিকে " অতএব সন্ধ্যাকে রাত্রিরূপে গ্রহণ করা যায় না। কারণ, সন্ধ্যা রাত্রিও নয়, দিনও নয়। সূর্যাস্তের পর কিছুটা অন্ধকার হইলে তখন উহাকে রাত্রি বলা হয়।আসলে উভয় দল এ বিষয়ে ভুল মত প্রকাশ করিয়া থাকে। সিয়াম সাধনার হাকীকত বুঝিতে পারিলে দেখা যাইবে যে, উভয় দল এবিষয়ে ভ্রান্তির মধ্যে রহিয়াছে। এফতার সন্ধ্যায় হোক বা পনর মিনিট পরে হোক তাহাতে কিছুই যায় আসেনা। তথাপি সমাজ জীবনে সকলের জন্য সম্মিলিত একটি মত গ্রহণ করিয়া চলাই ভাল। ইহাতে শৃঙ্খলা বজায় থাকে।সূরা মরিয়মের ২৬নং বাক্যে হযরত মরিয়ম কর্তৃক একটি সিয়াম পালন করার কথা এইরূপে উল্লেখিত আছে :"নিশ্চয় আমি আররহমানের জন্য মানত করিয়াছি একটি সওম সুতরাং আমি এই সময় কোন মানুষের সঙ্গে কথা বলি না "দৈহিক অপবিত্রতার কারণে শরীয়তের বিধান মতে সদ্য সিয়াম পালন করা নিষিদ্ধ আছে। ইহাতে শিশুর খাদ্যাভাব হইতে পারে। এমতাবস্তায় হযরত মরিয়ম আল্লাহর নির্দেশে সিয়ামের মানত করেন কেমন করিয়া?যেহেতু দিনের বেলা খাদ্য ত্যাগের মধ্যে সিয়াম আবদ্ধ নয়, সেইহেতু মরিয়ম সেই নাজুক অবস্থায় সিয়াম পালন করিয়াছিলেন। ইহাতে প্রমাণ হয় সিয়াম সম্পূর্ণরূপে মনের ব্যাপার। খাদ্যের সময় নিয়ন্ত্রণ উহার একটি সাধারণ আনুষ্ঠানিক বিষয় মাত্র। সিয়াম সম্পূর্ণ মনের ব্যাপার। কথা বলিতে গেলে সিয়াম হইতে মনের যতটুকু বিচ্যুতি ঘটিয়া থাকে এবং তাহাতে সিয়াম ভাব যে পরিমাণে ব্যাহত হয় ২৪ ঘন্টার মধ্যকার আহারে সময় নির্ধারিত না করিয়া প্রয়োজন মত যখন ইচ্ছা পানাহার গ্রহণে তাহা হয় না।


হাদীসে সিয়াম
                                                                           
হযরত আবু হোরায়রা হইতে বর্ণিত আছে যে, রসুলাল্লাহ আ. বলিয়াছেন :যখন রমজান প্রবেশ করে আকাশের দরজা খুলিয়া যায় (অন্য একটি উক্তিতে আছে জান্নাতের দরজা খুলিয়া যায়), জাহান্নামের দরজা বন্ধ হইয়া যায় এবং শয়তান সমূহ শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয় (এবং অন্য উক্তিতে আছে রহমতের দরজা খুলিয়া যায়)। (ঐক্যসম্মত)ব্যাখ্যা :"রমজান যখন প্রবেশ করে " এর অর্থ যাহার মধ্যে রমজানের সাধনা প্রবেশ করে অর্থাৎ দানা বাঁধে, তাহার রহস্য জগতের রুদ্ধদ্বার খুলিয়া যায়। এর কারণ নফসের কুপ্রবৃত্তির সমস্ত দরজা সে বন্ধ করিয়া ফেলিয়াছে। সুতরাং তাহার নফসের মধ্যে পাপ প্রবেশের সকল দ্বার বন্ধ হইয়া গিয়াছে। নফসের কু-প্রবৃত্তিগুলোর সকল দ্বার অর্থাৎ নরকের দ্বার বন্ধ করিলে রহমতের দ্বার তথা জান্নাতের দ্বার খুলিয়া যায়। সদ্ভাব সৎচিন্তা অন্তরে প্রবেশ লাভ করিতে থাকে এবং তাহার "পার্থিব জান্নাত " রচনা আরম্ভ হইয়া যায়।যাহার রমজানের সিয়াম সাধনার মশগুল হয় না তাহাদের জীবনে এবং তাহাদের মনের জগতে এই পরিবর্তন আসিতে পারে না। এইজন্য "রমজান প্রবেশ করিলে " কথা বলা হইয়াছে, "রমজান মাস আসিলে " কথা বলেন নাই। এই কারণে দেখা যায় রমজানের সিয়ামের ভাব সাধকের অন্তরে প্রবেশ করাইতে চাহিলে আরও দুইমাস আগে হইতে রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করার কথা হাদীসে উল্লেখ আছে।ইবলিশ মানব অন্তরে প্রবেশাধিকার লাভ করার কারণে আমাদের প্রবৃত্তির সঙ্গে শয়তান মিশিয়া গিয়াছে। শয়তান শুধু বাহিরের জীব নয়। যদি শয়তান শুধুমাত্র বাহিরের জীব হইত এবং রমজান মাসে তাহাদিগকে বন্ধ করিয়া রাখা হইত তাহা হইলে সমস্ত জগতে কোথাও এতটুকু পাপ রমজান মাসে থাকিতে পারিত না।
                                                     

সালমা ইবনে মোহাব্বাক হইতে বর্নিত হইয়াছে যে, রসুলাল্লাহ আ. বলিয়াছেন :যাহার জন্য একটি বাহন রহিয়াছে, (যে বাহন) তাহাকে একটি সন্তুষ্টির বিষয়ের দিকে লইয়া যায় তবে সে রমজানের সিয়াম করুক যেখানেই তাহাকে জানাইয়া দেয় (অর্থাৎ যখনই যেখান হইতে বিষয়টি তাহার অবগতির মধ্যে আসে)। (আবু দাউদ)ব্যাখ্যা :সাধক সত্তা হইতে তাহার জীবদ্দশায় দেহমনের বিচ্ছেদ কে সিয়াম বলে। এখানে বাহন অর্থে মানব দেহকে বুঝাইয়াছে। শুধু দেহই নয়, যাহা কিছুর উপরে মন হামেল হয় বা আশ্রয় গ্রহণ করে তাহাকও বাহন বলা হইয়াছে। এই বাহন তাহাকে কোনো একটি বিষয়ের উপর যদি সন্তুষ্টির নির্ভরের দিকে লইয়া যায় তবে উহা হইতে ছুটিয়া যাইবার জন্য রমজানের সিয়াম করিবার নির্দেশ তাহাকে দেওয়া হইতেছে। সিয়াম সাধনা ব্যতীত মানব মন বিষয় হইতে বিষয়ান্তরে ভ্রমণ করে এবং কোনো বিষয়কে তৃপ্তির আশ্রয়রূপে গ্রহণ করে। সাধক সৃষ্টিতে বন্দী হইয়া থাকিবার জন্য নয়। কোনো সাধক আমানু যখন জ্ঞানময় হালতের মাধ্যমে অবগত হইতে পারে যে, এই দেহ বা অন্য কোনো বাহন তাহাকে আর একটি দেহের আশ্রয়ের দিকে লইয়া যাইতেছে তথা পুনর্জন্মে ফেলিয়া দিতেছে তাহা হইলে তখনই সেখানেই সে যেন সিয়াম করে যাহাতে আর দেহ কারাগারে আশ্রয় লইতে না হয়। সাধক ব্যতীত সর্বসাধারণের এই উপলব্ধি বা জ্ঞানময় হাল আসে না, যে যতবড় পণ্ডিতই হোক না কেন। একমাত্র সালাতের প্রক্রিয়ার মধ্যেই এই উপলব্ধি নিহিত আছে। 
                                                                        


আবু হোরায়রা হইতে বর্নিত আছে যে, রসুলাল্লাহ আ. বলিয়াছেন :প্রত্যেক বিষয়বস্তুর একটা যাকাত (অর্থাৎ শুদ্ধিক্রিয়া) আছে এবং দেহের জাকাত হইল সিয়াম। (ইবনে মাজা)।।ব্যাখ্যা :দেহ আমাদের সত্তার জন্য কারাগার বা বন্দীশালা। ইহাতে আবদ্ধ হইয়া আমরা নানারূপ কলঙ্কে পতিত হই। সুতরাং ইহাকে ভালবাসা ভাল নয়। ইহার কারণেই আমাদের মনমানসিকতার মধ্যে কলুষ-কালিমা জন্ম লাভ করে এবং ইহার বন্ধন হইতে মুক্তি লাভ করা কঠিন হইয়া পড়ে। সিয়াম দেহের প্রতি আকর্ষণকে কমাইয়া দেয় এবং ইহার কলুষ-কালিমা দূর করিয়া ইহাকে শুদ্ধ ও পবিত্র করিয়া তুলে।দেহের জাকাত হইল সিয়াম। অর্থাৎ দেহের বন্ধনকে তথা দেহকে আপন অস্তিত্ব হইতে ত্যাগ করিতে পারিলে উহা পবিত্র হইয়া যায়। দেহের মোহ যে একান্ত পরিত্যাজ্য তাহা কোরানে বিভিন্ন রূপে পরিব্যক্ত আছে, যথা--- ''এবং যে ব্যক্তি তাহার রবের ঘরকে ভয় পায় তাহার জন্য দুইটি জান্নাত (৫৫ :৪৬)"আয়াতটির ব্যাখ্যা :মানব দেহেই রবের আত্মবিকাশ হইয়া থাকে। কারণ এখানেই তিনি জাগ্রত হইয়া উঠার জন্য সুপ্ত অবস্থায় বিরাজ করেন। এইজন্য মানব দেহকে কোরানে রবের ঘর বলা হইয়াছে। দেহ দুঃখময়। সুতরাং যে ব্যক্তি দেহ হইতে মুক্তি লাভের জ্ঞান অর্জন করিয়াছে সে দেহকে বন্দিশালা বা কারাগাররূপে ভয় পায়। অর্থাৎ জন্মচক্রে আর আবদ্ধ হইতে চায় না। এমন ব্যক্তির জন্য মাত্র দুইটি জান্নাত অতিক্রম করা বাকি থাকে। মুক্তপুরুষে পরিণত হইয়া জন্মচক্র জয় করিতে আর মাত্র দুইটি স্তর অতিক্রম করা তাহার জন্য প্রয়োজন হয়। জন্মচক্র অতিক্রান্ত ব্যক্তিগণই কেবলমাত্র প্রকৃতি জয় করিয়া পুরুষ হইতে পারিয়াছেন। এইজন্য কোরানে আলে রাসূল এবং আলে মোহাম্মদগণের দেহের সর্বনামে পুংলিংঙ্গ ব্যবহার করা হইয়াছে।
                                                 


আবু হোরায়রা হইতে বর্ণিত আছে যে, রসুলাল্লাহ আ. বলিয়াছেন :প্রত্যেক বস্তুর জাকাত আছে এবং দেহের জাকাত হইল সিয়াম। (ইবনে মাজা)।ব্যাখ্যা :জাক্কা অর্থাৎ "পবিত্র করা " কথা হইতে জাকাত শব্দ আসিয়াছে। জাকাত মানুষের মনের ব্যাপার। জাকাত অর্থ মনের স্বকীয়তা উতসর্গ। মনের উৎসর্গ দ্বারাই আল্লাহর সকাল দানের ভোগসমূহ পবিত্র হইয়া থাকে। কৃপণের মতো আমিত্ব দ্বারা সকল বস্তু মনের মধ্যে আকড়াইয়া রাখিলে তাহা মনের জন্য অপবিত্র হইয়া যায়। মনের লালসা হইতে উহাকে ত্যাগ করিয়া উপভোগ করিতে হয়। ইহাই জাকাতের সংক্ষিপ্ত হাকীকত। দেহের জাকাত হইল সিয়াম, যেমন মনের জাকাত তাহার আমিত্বের উৎসর্গ (যাহা কোরানে সর্বত্র লিখিত আছে) এবং ধনসম্পদের জাকাত শতকরা আড়াই ভাগ ত্যাগ করা নির্দিষ্ট করা আটটি খাতে ব্যয় হওয়ার জন্য।এখানে আমাদের বক্তব্য হইল "দেহের জাকাত "। দেহের কোন ভোগই পবিত্র বলিয়া গণ্য হইতে পারেনা যদি সিয়াম করা না হয়। অর্থাৎ সিয়াম ব্যতীত দেহের সকল চাহিদা অপবিত্র। দেহের অবাধ ভোগই অধর্ম, ইহার উপর সংযম ও নিয়মের বাধন প্রতিষ্ঠা করিয়া ইহাকে পবিত্র করিতে হয়। যাহাতে আর না আসিতে হয় দেহের বন্ধনে। "দেহের জাকাত হইল সিয়াম " অর্থাৎ দেহকেই চিরতরে বিসর্জন দেওয়া বা ত্যাগ করিয়া ফেলা। দেহ মানব জীবনের সকল শিরিকের ভাণ্ডার। বিগত সকল জীবনের বিষয়বস্তুর চাহিদা সমূহের ফলশ্রুতি হইল এই দেহ। দেহকে চিরতরে ত্যাগ করার সাধনার অপর নাম সিয়াম। সিয়াম অর্থ Rejection, বিসর্জন, ত্যাগ বা পরিহার। (সিয়াম দর্শন :সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী)

2 comments:

 
back to top