Monday, 27 April 2015

নওগাঁ জেলা ও গাঁজা

0 Comments
নওগাঁ জেলা ও গাঁজা  

নওগাঁ জেলার অর্থনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এই জেলার নওগাঁ সদর, মহাদেবপুর ও বদলগাছী থানায় বৃটিশ আমলে গাঁজা চাষ হত। গাঁজা চাষের জন্য এই এলাকার মাটি উপযোগী হওয়ায় প্রায় ৯,০০০ হেক্টর গাঁজা চাষের আওতাভূক্ত করা হয়। প্রায় একশ বছর ধরে নওগাঁ থানার তিলকপুর, বোয়ালিয়া, বক্তারপুর, কীর্তিপুর, নওগাঁ , হাঁপানিয়া, বর্ষাইল, দুবলহাটি, বদলগাছী থানার বালুভরা, মহাদেবপুর থানার ধনজইল ও ভীমপুর এলাকায় গাঁজা চাষ হত। এই তিন থানা পৃথক জেলার অধীনে থাকায় ১২০ বছর পূর্বে গাঁজা চাষের সুবিধার্থে এই তিন থানাসহ অন্যান্য থানার সমন্বয়ে রাজশাহী জেলার অধীনে নওগাঁ মহকুমা গঠিতত হয়। তৎকালীন রাজশাহী জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পদাধিকারবলে গাঁজা সোসাইটির চেয়ারম্যান, মহকুমা প্রশাসক ভাইস চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করতেন। বৃটিশ সরকার গাঁজার দাম নির্ধারণ করে দিলেও গাঁজা চাষীরা লাভ হতে বঞ্চিত হত না । গাঁজার মত আর কোন ফসল এত লাভও হত না। তাই নওগাঁ গাঁজা মহালের চাষীরা তৎকালীন বৃটিশ ইন্ডিয়ার সব থেকে স্বচ্ছল চাষী বলে গণ্য হতেন। গাঁজা সোসাইটির অফিস ভবন ও স্টাফ কোয়ার্টার ছিল নওগাঁ শহরের প্রথম দিককার সহাপনা। ভবনগুলোকে কেন্দ্র করে নওগাঁ শহরের গোড়াপত্তন হয়। গাঁজা সোসাইটির অবদানকে বাদ দিলে নওগাঁর অর্থনৈতিক ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায় ।বৃটিশ সরকার নওগাঁর গাঁজা উৎপাদকদের কাছ থেকে বৎসরে ৬৬ লক্ষ টাকা রাজস্ব পেত। যা সরকারের রাজস্বের প্রধানতম উৎস বলে পরিগনিত হত। গাঁজা চাষীদের প্রতিষ্ঠান দি নওগাঁ গাঁজা গ্রোয়ার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃসংক্ষেপে গাঁজা সোসাইটি এই অর্থকারী  ফসল  শিক্ষা, স্বাসহ্য, পশুকল্যাণ, যোগাযোগ ব্যবসহার উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা রাখত। নওগাঁ শহরের গুরুত্বপূর্ণ  এই সোসাইটির সম্পত্তিগুলোর সুষ্ঠু ব্যবসহাপনা করা হলো সোসাইটি তাঁর সস্যদের আর্থ সামাজিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন করতে সক্ষম হবে।
ভিন্ন ভিন্ন নামে বিভিন্ন দেশে এর বিস্তার। গাঁজা গাছের শীর্ষ পাতা এবং ডাল যা এই উপমহাদেশে গাঁজা নামে পরিচিত একই জিনিস পশ্চিমা দেশ গুলোতে মারিজুয়ানা বা মারিহুয়ানা নামে পরিচিত। গাছের পাতা বা ডালের আঠালো কষ দিয়ে তৈরী এ অঞ্চলের নামের জিনিসটিই পশ্চিমা দেশের হাশিশ। ভাং, সিদ্ধি, পাট্টি, সব্জি, গ্রাস, মাজুন নানা নামে ডাকা হয় এই বিষাক্ত বস্তুটিকে।
এই মাদকটি গ্রহনে দৃষ্টিভ্রম, বাচালতা, মাংশপেশীর অনিয়ন্ত্রিত ও অপ্রয়োজনীয় সংকোচন, দিকভ্রান্ত হওয়া, মাথা ঘুরা, ক্ষুধা লাগা, গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে যাওয়া,সময়জ্ঞান হারানো থেকে শুরু করে প্রলাপ বকা, বিকার আসা এমনকি মানুষকে হত্যাকরার ইচ্ছাও জাগ্রত হতে পারে। মাত্রা বেশী হয়ে গেলে অনেক সময় হাত পা এর নড়াচড়ার নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলা, হাতে পায়ে ঝি ঝি ধরা এবং অবশ হয়ে যাওয়া, কথা জড়িয়ে যাওয়া, মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে যাওয়া থেকে শ্বাস কষ্ট হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।নিয়মিত এবং বেশী মাত্রায় গাঁজা জাতীয় দ্রব্য সেবনে গাঁজা সাইকোসিস (Ganja-psychosis) নামে একধরনের লক্ষন হয়। এতে চোখে রক্তজমে চোখ লাল হয়ে যায়, ক্ষুধামন্দা, নির্জিবতা, শরীরের মাংস-পেশী শুকিয়ে যাওয়া, অত্যাধিক দুর্বলতা, হাত-পা অনবরত কাপতে থাকা, পুরুষত্বহীনতা থেকে শুরু করে পুরোপুরি মানসিক রোগী হয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। রানিং এমোক নামক আরেক ধরনের মানসিক বিপর্যয় ও গাঁজা সেবিদের পরিণতি হয়ে আসতে পারে। অবিরত গাঁজা সেবনের কারনে অনেক সময় এদের দৃষ্টিভ্রম (Hallucination), নির্যাতিত-বঞ্চিত হবার কল্পনা থেকে এরা হিংসাত্মক, আগ্রাসি সন্ত্রাসীর ভূমিকায় অবতীর্ন হতে পারে। রানিং এমক হলে লোকটি চোখের সামনে যাকে পায় তাকে তার কল্পিত শত্রু মনে করে অস্ত্র নিয়ে হত্যা করতে পারে এবং এই মানসিক অবস্থা কেটে যাবার আগ পর্যন্ত যাকে সামনে পায় ক্রমান্বয়ে তাকেই হত্যা করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। এই আবেশ কেটে গেলে একসময় সে আত্মহত্যা করতে যেতে পারে অথবা আত্মসমর্পনও করতে পারে।
গাঁজা শরীরের বিষ-ব্যথা সারায়। এ কথার বর্ণনা রয়েছে ভারতবর্ষের প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে। তবে এ কথাও সুবিদিত যে, গাঁজা, ভাং ও মারিজুয়ানা গ্রহণ মানুষের স্মরণশক্তি হ্রাস করে এবং দীর্ঘ মেয়াদে মনোবৈকল্য ঘটায়। যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা এখন গাঁজা, ভাং ও মারিজুয়ানার ওপর গবেষণা করে জেনেছেন, এ সব মাদকদ্রব্য থেকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন ব্যথানাশক ওষুধ প্রস্তুত করা সম্ভব, যা মানুষের কোনো ক্ষতি করবে না। গবেষণাটি করেছে ফ্রান্সের বায়োমেডিকেল ইনস্টিটিউটএর নেতৃত্ব দিয়েছে আইএনএসইআরএম। ফ্রান্সের গবেষকরা জানান, 'তারা ইঁদুরের মস্তিষ্কের যে অংশের কোষের নিউরনে গাঁজা বা মারিজুয়ানার মাদক ক্রিয়া করে তা ওষুধ প্রয়োগ করে নিষ্ক্রিয় করেন প্রথম। এর পর ওই ইঁদুরের শরীরে এসব মাদক প্রবেশ করিয়ে দেখা গেছে, তাতে ইঁদুরটি বেহুশ হয় না। বরং ওটির প্রাণচাঞ্চল্য ঠিকই থাকে। এ অভিজ্ঞতা থেকে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ব্যথানাশক হিসেবে গাঁজা বা মারিজুয়ানার ভালো গুণ মানুষের বিভিন্ন রোগের ওষুধ এবং অস্ত্রোপচারের জন্য চেতনানাশক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। শিগগিরই গাঁজা ও মারিজুয়ানার নির্যাস থেকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন এ ওষুধ প্রস্তুত হবে। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ও আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এক গবেষণায় দেখেছেন, ভাং ও গঞ্জিকা সেবনে ফুসফুসের ক্ষতি তামাক পাতায় প্রস্তুত সিগারেট পানের চেয়ে কম।

গাঁজা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন কৃষিজাত দ্রব্যের মধ্যে অন্যতম। জনশ্রুতি আছে ১৭২২ সাল নাগাদ এই এলাকায় প্রথম গাঁজার চাষ শুরু হয় নওগাঁ সদর উপজেলার মুরাদপুর গ্রামে। আবার অনেকেই বলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে গাঁজা চাষ শুরু হয়। যাই হোক, অধিক লাভজনক হওয়ায় ১৮৭৭ সাল নাগাদ এই অঞ্চলে গাঁজাচাষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
১৮৭৬ সালে ব্রিটিশ সরকার গাঁজা উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য লাইসেন্স প্রথা চালু করে। অর্থাৎ লাইসেন্সে নির্ধারিত জমি ছাড়া অন্য জমিতে গাঁজা চাষ করা যাবে না।
গাঁজা উৎপাদনকে কেন্দ্র করে ১৯১৭ সালে ‘নওগাঁ গাঁজা কাল্টিভেটরস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি.’ নামে একটি সমবায় সমিতি গঠিত হয় এবং সে বছরই সমিতিটি সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধনপ্রাপ্ত হয়। এভাবে ভিত্তি রচিত হয় উপমহাদেশের বৃহত্তম সমবায় সমিতির। জন্মলগ্নে সোসাইটির সদস্য সংখ্যা ছিল ১৮ জন। অবাক করা ব্যাপার পরে এর সদস্য সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৭ হাজারে।
সংরক্ষিত পরিবেশে গাঁজা চাষ করা হতো। বছরের জুন-জুলাই ছিল চারা তৈরির মাস। উঁচু মজবুত বাঁশ বা কাঠের বেড়া দিয়ে বীজতলা তৈরি করা হতো। বেড়ার চারপাশে চৌকি নির্মাণ করে পাহাড়া দিত সশস্ত্র পুলিশ। একইসঙ্গে বীজতলার অভ্যন্তরে বাঁশের টং তৈরি করে পাহাড়া দিত খোদ চাষীরা। বীজতলায় প্রবেশ ও বাহির উভয় ক্ষেত্রে পুলিশ চাষীদের দেহ তল্লাশি করত, যাতে তারা নিজেরাও চারা বাইরে পাচার করতে না পারে। চারা উপযুক্ত হলে রোপণ করা হতো। নিয়ম হলো, ৮ ইঞ্চি পরপর সারিবদ্ধভাবে চারা রোপণ করা। উল্লেখ্য, গাঁজা উৎপাদন হয় পুরুষ গাছ থেকে। দেখতে খানিকটা গাঁদা ফুলের মতো কিন্তু ছোট এক ধরনের জটা। স্ত্রী গাছ ক্ষেতের প্রধান শত্রু। কারণ তার স্পর্শে পুরুষ গাছে জটা ধরে না, ধরে কেবল বীজের থোকা। সুতরাং স্ত্রী গাছ অপসারণের প্রয়োজন হতো। স্ত্রী গাছ চিহ্নিতকরণের জন্য নিয়োজিত থাকতো অভিজ্ঞ লোক। তাদের ‘পরখদার’ বা ‘পোদ্দার’ বলা হতো।
সাত-আট মাস পর ফেব্রুয়ারিতে জটা পরিপক্ক হলে চাষীরা গাছের গোড়া কেটে সরকার কতৃক নির্ধারিত ঘেরাও করা স্থানে প্রতিটি গাছ হিসেব করে শুকাতে দিত। নির্দিষ্ট সময় শুকানোর পর একটির পর একটি গাছ সাজিয়ে ২-৩ দিনের জন্য ভারি ইট বা পাথর চাপা দিয়ে রাখা হতো। এরপর গাছগুলো পুনরায় রোদে শুকিয়ে সেখান থেকে জটা আলাদা করে চাপ দিতে হতো। ফলে অবশিষ্ট রসগুলো বের হয়ে যেত। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর সেগুলো সাবধানে বস্তায় ভরে সশস্ত্র পুলিশ পাহাড়ায় শহরের গাঁজাগোলা বা গুদামঘরে পাঠানো হতো। সেখানে কাঠের তৈরি বাক্সে সাজিয়ে রাখার মাধ্যমে এই কাজ শেষ হতো।
গাঁজা চাষের মৌসুমে পুরো কাজ ম্যাজিস্ট্রেটসহ মাদক বিভাগের কর্মকর্তাদের কড়া নজরে পরিচালিত হতো। পুরো এলাকায় থাকতো পুলিশ-আনসারদের পাহাড়া। অনেক সময় রাতে হ্যাজাক জ্বালিয়ে উৎপাদিত গাঁজা বিক্রি হতো সোসাইটির মাধ্যমে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির আগে উপমহাদেশে এত বড় দ্বিতীয় কোনো সমবায় সমিতি ছিল না। ১৯৮৭ সালে গাঁজা চাষ বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত সোসাইটির সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় সাত হাজার। সে সময় বাংলা, আসাম, উড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশ, চেন্নাই, বার্মা, নেপাল এবং সুদূর ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের একাধিক দেশে নওগাঁর গাঁজা রপ্তানী হতো। ১৯১৮ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫৫ হাজার মণ গাঁজা উৎপাদন হতো। ১৯৭৪ সালে জেনেভা কনভেনশনে মাদকদ্রব্যবিরোধী চুক্তিতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে। চুক্তিতে ১৯৯০ সালের মধ্যে গাঁজা চাষ বন্ধের শর্ত ছিল। শর্ত মোতাবেক তিন বছর আগেই ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশে গাঁজা চাষ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
গাঁজা সোসাইটির প্রধান কার্যালয় কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ের আদলে গড়া। এই কার্যালয়ের সাজসজ্জার জন্য কাঠ আনা হয়েছিল নেপাল থেকে। ভবনের প্রস্তরফলক থেকে জানা যায়, ১৯২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এর উদ্বোধন করেন তৎকালীণ মন্ত্রী খান বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। বর্তমানে নওগাঁ শহরের প্রায় সবগুলো প্রাচীন ভবনই সোসাইটির সম্পত্তি। সোসাইটির নিজস্ব সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে ৪০ একর জমি, ১০০টি ভবন, ৭টি দিঘি, ১টি লেক, ১১টি উচ্চ বিদ্যালয়, ৩টি মসজিদ, ১টি মন্দীর, ৪টি গুদাম ঘর, ১টি সরাইখানা এবং কো-অপারেটিভ ক্লাব। এ ছাড়াও ১টি লাইব্রেরি, ৩টি হাসপাতাল, ৩টি দাতব্য চিকিৎসালয়, ১টি পশুচিকিৎসালয়, ১টি হিমাগারসহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু সম্পত্তি। এমনও শোনা যায় আসাম, কলকাতা এবং ঢাকাতেও সোসাইটির সম্পত্তি রয়েছে। শুধু তাই নয়, শাখা কার্যালয় খোলার জন্য লন্ডন শহরেও জমি কেনা হয়েছিল।
সোসাইটির স্টাফদের বসবাসের জন্য ৪০টি বাসভবন নিয়ে ব্যারাক নির্মাণ করা হয়েছিল। এগুলোর মাঝে চলাচলের জন্য ইউরোপীয় আদলে পথে বিছানো ছিল কালো পাথর। নওগাঁয় বর্তমানে সরকারি অফিস-আদালতের প্রায় সবই স্থাপিত হয়েছে সোসাইটির ভবনগুলোতে। গাঁজা চাষ বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু সোসাইটির কার্যক্রম আজও চলমান। যদিও সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি কাজের মাঝেই এর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। আজকে এই সময়ে এসে গাঁজাচাষকে কেন্দ্র করে একটি শিল্প গড়ে উঠতে পারে, তা ভাবতেই অবিশ্বাস্য মনে হয়। গাঁজা গোডাউনের প্রবেশদ্বার পেরিয়ে বেশ কয়েকটি ভবন। লাল রং করা ভবনগুলোর কোনোটি কার্যালয়, কোনোটি গুদামঘর ইত্যাদি। সেখান থেকে যমুনা নদীর পাড়ে একটি স্থাপনা কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্থাপনাটি দেখে মনে হয় ঠিক যেন উপুর করে রাখা গাঁজা সেবন করার কলকে। উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। আসলে এটি একটি চুল্লি। নষ্ট ও মানসম্পন্ন নয় এমন গাঁজা এই চুল্লিতে পুড়িয়ে ফেলা হতো।

বর্তমানে নেপালে উৎপাদিত গাঁজা বিশ্ববিখ্যাত। কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ দক্ষ চাষীর অভাব রয়েছে। নওগাঁ থেকে অনেক লোক সেখানে গিয়ে শ্রম ও জ্ঞান দিয়ে থাকেন। কলকাতার রাইটার্স ভবনের আদলে তৈরি গাঁজা সোসাইটির লাল রং করা চমৎকার ভবন। দেখে বোঝা যায়, বহুদিন সংস্কার হয়নি। সম্মুখভাগের ফাঁকা জায়গাটায় নির্মাণ করা হয়েছে দুইতলা মার্কেট। ফলে চলার পথ বা সড়ক থেকে ভবনটি চোখের আড়ালে থেকে যায়। যেমন আড়ালে পড়ে গেছে এক সময় নওগাঁয় গাঁজাচাষের সেইসব ইতিহাস।


সিফফিনের যুদ্ধ বা জঙ্গে সিফফিন

0 Comments
সিফফিনের যুদ্ধ বা জঙ্গে সিফফিন
হিজরি ৩৭ সালে মওলা আলী (আঃ) আর সিরিয়ার গভর্নর আবু সুফিয়ান ইবনে মুয়াবিয়ার মধ্যে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। খলিফা উসমানের হত্যার তথাকথিত প্রতিশোধের কারণ দেখিয়ে মুয়াবিয়া এ যুদ্ধের সুত্রপাত ঘটায়। বস্তুত এ যুদ্ধ ছিল মুয়াবিয়ার কতিৃত্ব বজায় রাখার জন্য। মুয়াবিয়া খলিফা উমারের সময় থেকে সিরিয়ার গভর্নর নিয়াজিত থেকে সেখানে স্বশাসন চালিয়ে আসছিলো। উসমানের সময় তার ক্ষমতা যথেচ্ছ প্রয়োগ করে সিরিয়াকে করতলগত করে নিয়েছিলো। মওলা আলী (আঃ) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর মুয়াবিয়া তাঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করেনি কারণ সে মনে করত মওলা আলি(আঃ) হাতে বায়াত গ্রহণ করলে তাঁর কতিৃত্ব থাকবে না। ফলে উসমান হত্যাকে একটা ইস্যু হিসাবে ব্যাবহার করেছিলো। তার পরবর্তী কার্যাবলী থেকে এটা সুস্পষ্ট বুঝা যায়। সে ক্ষমতা দখলের পর কোনদিন ভুলেও উসমান হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের বিষয়টি মুখে আনেনি বা হত্যাকারীর বিষয়ে কোন শব্দ করে নি।
যদিও প্রথম দিন থেকেই মউলা আলি(আঃ) বুঝতে পেরেছিলেন যে যুদ্ধ অবশ্যই হবে তবু ওজর নিঃশেষ করার প্রয়োজনে জামালের যুদ্ধ শেষে কুফায় ফিরে এসে ৩৬ হিজরি ১২ রজব সোমবার তিনি জারির ইবনে আব্দিল্লাহ আল-বাজালিকে একটা পত্রসহ মুয়াবিয়ার কাছে সিরিয়া প্রেরণ করেছিলেন। পত্রে তিনি লিখেছিলেন যে, মুজাহির ও আনসার তাঁর বায়াত গ্রহণ করেছে এবং মুয়াবিয়া যেন বায়াত গ্রহণ করে উসমান হত্যার মামলা পেশ করে, যাতে তিনি কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী রায় প্রদান করতে পারেন। কিন্তু মুয়াবিয়া নানা তালবাহানা করে জারিরকে দেরী করাতে লাগলো। অপর দিকে আমর ইবনে আল-আসের বুদ্ধিতে উসমান হত্যার কারণ দেখিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণার ব্যবস্থা করলো। সে সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ বাক্তিদের মাধ্যমে অজ্ঞ জনগণকে বুঝিয়েছিল যে, উসমান হত্যার জন্য আলী দায়ী। তার আচরণ দ্বারা অবরোধকারীদের উৎসাহ ও প্রশ্রয় দিয়েছেন। ইতিমধ্যে মুয়াবিয়া উসমানের রক্তমাখা জামা ও তার স্ত্রীর নায়লাহ বিনতে ফারাফিসার কাটা আঙ্গুল দামস্কের কেন্দ্রীয় মসজিদে ঝুলিয়ে রেখেছিল এবং তার চারদিকে সত্তর হাজার সিরিয়ান কান্নারত ছিল এবং তারা উসমানের রক্তের প্রতিশোধ নেয়ার শপত গ্রহণ করেছিলো। এভাবে মুয়াবিয়া সিরিয়দের অনুভূতি এমন এক অবস্থায় নিয়ে গেল যে, তারা উসমানের রক্তের বদলা নেয়ার জন্য নিজেদের জীবন বিসর্জন দিতেও দৃঢ় সংকল্প হলো। তখন মুয়াবিয়া “উসমান হত্যার প্রতিশোধ” ইস্যুর অপর তাদের বায়াত গ্রহণ করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলো। মুয়াবিয়া জারিরকে সিরিয়দের অনুভূতি ও মনোভাব দেখিয়ে দিয়ে অপমান করে ফেরত পাঠিয়ে দিল।  
জারির কাছে বিস্তারিত জানতে পেরে মওলা আলী (আঃ) খুব দুঃখ পেয়েছিলেন এবং মালিক ইবনে হাবিব আল- ইয়ারবুইকে নুখায়লাহ উপত্যকায় সৈন্য সমাবেশ করার আদেশ দিলেন। ফলে কুফার উপকণ্ঠে প্রায় আশি হাজার লোক জড়ো হয়েছিলো। প্রথমে মওলা আলী (আঃ) জিয়াদ ইবনে নদর আল-হারিছির নেতৃত্বে আট হাজারের একটা শক্তিশালী রক্ষীবাহিনী এবং সুরায়হ ইবনে আল- হারিছির নেতৃত্বে অন্য একটা চার হাজারের শক্তিশালী বাহিনী সিরিয়া আভিমুখে প্রেরণ করলেন। অবশিষ্ট সৈনবাহিনির নেতৃত্ব নিজে গ্রহণ করে ৫ শাওয়াল বুধবার মওলা আলি(আঃ) সিরিয়া অভিমুখে যাত্রা করলেন। কুফার সীমান্ত অতিক্রম করে তিনি যোহর সালাত আদায় করলেন এবং তারপর দায়র আবু মুসা, নাহর, নারস, কুব্বাত কুব্বিন, বাবিল, দায়র কাব, কারবালা, সাবাত, বাহুরা সিনি, আল-আনবার ও আর জাযিরাহ স্থানে বিশ্রাম গ্রহণ করে আর-রিক্কায় উপনীত হলেন। এখানকার জনগণ উসমানের পক্ষে ছিল এবং এখনেই ইবনে মাখতামাহ আল আসাদি তার আটশত লোকসহ তাঁবু খাটিয়েছিল। এসব লোক মওলা আলী (আঃ) পক্ষ ত্যাগ করে মুয়াবিয়ার সাথে যোগ দেয়ার জন্য কুফা থেকে বেরিয়ে এসেছিল। যখন তারা মওলা আলী (আঃ) এর বাহিনী দেখতে পেল তখন তারা ফরাত নদীর ওপরের সেতু খুলে ফেললো যাতে তিনি নদী পার হতে না পারেন। কিন্তু মালিক ইবনে হারিছ আল- আশতারের ধমকে তারা ভীত হয়ে গেল এবং উভয়ের মধ্যে আলাপ আলোচনার পর সেতু জোড়া লাগিয়ে দিল এবং মউলা আলী (আঃ) তাঁর সৈনবাহিনি নিয়ে নদী পার হয়ে গেলেন। নদীর অপর পারে যেয়ে দেখতে পেলেন জিয়াদ ও সুরায়হ সেখানে অপেক্ষা করছে। তারা মওলা আলী (আঃ) কে তারা জানালো ফরাত অভিমুখে মুয়াবিয়ার এক বিশাল বাহিনী আসছে, আমাদের দ্বারা তাদের গতিরোধ করা সম্ভব হবে না এই কারনে আমরা মউলা আলী (আঃ) এর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তাদের থেমে থাকার ওজর মউলা আলী (আঃ)  গ্রহণ করলেন এবং অগ্রবর্তী হওয়ার আদেশ দিলেন। যখন তারা সুর-আর-রুম নামক স্থানে গিয়ে দেখতে পেল, আবু আল-আওয়ার আস-সুলামি সেখানে সৈন্য সহ অবস্থান করছে। মওলা আলী (আঃ) মালিক ইবনে হারিছ আল-আশতার কে সেনাপতি করে সেখানে পাঠালেন এবং নির্দেশ দিলেন যে, যত দূর সম্ভব যুদ্ধ এড়িয়ে তাদেরকে যেন প্রকৃত আবস্থা বুঝিয়ে বলা হয় এবং উপদেশের মাধ্যমে মনোভাব পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। মালিক ইবনে হারিছ আল-আশতার তাদের কাছ থেকে অল্প দূরে ক্যাম্প করলেন। কিন্তু তিনি যুদ্ধের কোন ভাব দেখালেন না। অপর দিকের অবস্থা থমথমে ছিল, যে কোন সময় যুদ্ধ শুরু করার তারা উন্মুক্ত অসি হাতে অপেক্ষা করছিলো। আবু আল-আওয়াল হঠাৎ করে রাতের বেলা আক্রমণ করে বসলো এবং সামান্য যুদ্ধের পর পালিয়ে গেল। পরদিন মওলা আলী (আঃ) সসৈন্যে সেখাপৌছে সিফফিন অভিমুখে যাত্রা করলেন। মুয়াবিয়া পূর্বেই সিফফিন পৌছে ছাউনি পেতেছিল এবং ফরাত কূল অবরোধ করে সৈন্য মোতায়েন করেছিলো। মওলা আলী (আঃ) সেখানে পৌঁছে মুয়াবিয়াকে অনুরোধ করে পাঠালেন যেন সে ফরাত কূল থেকে সৈন্য সরিয়ে পানি নেয়ার ব্যবস্থা অবরোধমুক্ত করে। মুয়াবিয়া প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে মওলা আলী (আঃ) এর সৈন্যগন সাহসিকতার সাথে আক্রমণ করে ফরাত কূল দখল করে। তারপর মওলা আলী (আঃ) মুয়াবিয়ার কাছে বশীর ইবনে আমর আল-আনসারি, সাইদ ইবনে কায়েস আল-হামদানি ও শাবাছ ইবনে আত-তামিমীকে প্রেরণ করলেন এ জন্য যে, তারা যেন যুদ্ধের ভয়াবহতা তাকে বুঝিয়ে বলে এবং সে যেন বায়াত গ্রহণ করে একটা মীমাংসায় আসতে রাজি হয়। এ প্রস্তাবে মুয়াবিয়া সরাসরি বলে দিল যে, উসমানের রক্তের প্রতি সে উদাসীন থাকতে পরে না; কাজেই তরবারিই একমাত্র মীমাংসা- এর কোন বিকল্প নেই। ফলে ৩৬ হিজরি সালের জিলহজ মাসে উভয় পক্ষের যোদ্ধারা একে অপরের মোকাবেলা করার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে পড়লো। মওলা আলী (আঃ) এর পক্ষে যারা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করেছিলেন তারা হলো হুজব আদি আল-কিন্দি, সাবাছ ইবনে রিবি আত-তামিমি, খালিদ ইবনে মুয়াম্মার, জিয়াদ ইবনে নদর আল-হারিছি, জিয়াদ ইবনে খাসাফাহ আত-তায়মি, সাইদ ইবনে কায়েস আল-হামদানি, কয়েস ইবনে সাদ আল আনসারী ও মালিক ইবনে হারিছ আল-আসতার। আর মুয়াবিয়ার পক্ষে আবদার রহমান ইবনে খালিদ বিন ওয়ালিদ, আবু আল-আওয়ার আস-সুলামি, হাবিব ইবনে মাসলামাহ আল-ফিহরি, আবদুল্লাহ ইবনে জিলকালা, উবায়দুল্লাহ ইবনে উমার ইবনে আল-খাত্তাব,সুরাহবিল ইবনে সিমত আল-কিন্দি ও হামজাহ ইবনে মালিক আল-হামদানি। জিলহজ মাসের শেষে যুদ্ধ বন্ধ করা হল মুহরামের জন্য যুদ্ধ ১ মাস বন্ধ থাকার পর ১ সফর আবার যুদ্ধ শুরু হল। মওলা আলী (আঃ) পক্ষ থেকে কুফি অশ্বারোহীগণের সেনাপতি হলেন মালিক আশতার ও কুফি পদাতিক বাহিনির সেনাপতি হলেন আম্মার ইবনে ইয়াসির এবং মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে অশ্বারোহীগণের সেনাপতি হলেন সহল হুনায়েক ও পদাতিকের সেনাপতি হলেন কায়েস ইবনে সাদ। মওলা আলী (আঃ) ঝাণ্ডা বহনকারী ছিল হাসিম ইবনে উতবাহ। মুয়াবিয়ার সেনাদলের দক্ষিণ বাহুর সেনাপতি ছিল ইবনে জিলকালা ও বাম বাহুর সেনাপতি ছিল হাবিব ইবনে মাসালামাহ।
প্রথম দিন মালিক ইবনে আশতার যুদ্ধের ময়দানে তার লোকজন নিয়ে এবং হাবিব ইবনে মাসলামাহ তার লোকজন নিয়ে মালিকের মোকাবেলা করলো। সারাদিন তরবারি ও বর্শার যুদ্ধ চলেছিল।
পরদিন হাসিম ইবনে উতবাহ মওলা আলী (আঃ) এর সৈন্য নিয়ে ময়দানে নামলো এবং আবু আল-আওয়াল তার মোকাবেলা করলো। অশ্বারোহী অশ্বারোহীর উপর পদাতিক পদাতিকের উপর ঝাপিয়ে পড়লো এবং ভয়ানক যুদ্ধে দৃপ্তপদে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেছিলো।
তৃতীয় দিন আম্মার ইবনে ইয়াসির অশ্বারোহী ও জিয়াদ ইবনে নদর পদাতিক বাহিনী নিয়ে ময়দানে নামলো। আমর ইবনে আস বিশাল বাহিনী নিয়ে তাদের মোকাবেলা করলো। মালিক ও জিয়াদের প্রবল আক্রমণে শত্রুপক্ষ পরাজয়ের মুখামুখি ও আক্রমণ রোধে ব্যর্থ হয়ে সেনা নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে যায়।
চতুর্থ দিনে মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। উবায়দুল্লাহ ইবনে উমার তার মোকাবেলায় এসেছিল মুহাম্মাদ বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে মুয়াবিয়া সেনেদলের প্রভূত ক্ষতি করে।
পঞ্চম দিনে আবাদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ময়দানে গেল এবং তার মোকাবেলা করার জন্য ওয়ালিদ ইবনে উকবা এসেছিল। কিন্তু আবাদুল্লাহ বীরবিক্রমে এমন প্রচণ্ড আক্রমণ করলো যে, ওয়ালিদের সেনা পিছু হটে গেল।
ছষ্ঠ দিনে কায়েস ইবনে সা’দ আল-আনসারী ময়দানে নামলো তার বিপরীতে ইবনে জিলকালা এসেছিল। উভয় পক্ষে এমন লড়াই হয়েছিল যে, প্রতি পদক্ষেপে মৃতদেহ দেখা গিয়েছিল এবং রক্তের স্রোতধারা বয়ে গিয়েছিল। অবশেষে রাত নামলে উভয় বাহিনী আলাদা হয়ে যায়।
সপ্তম দিনে মালিক আশতার ময়দানে নামলে হাবিব ইবনে মাসলামাহ তার মোকাবেলায় এসে যোহরের নামাজের পূর্বেই ময়দান ছেড়ে পিছিয়ে গেল।
অষ্টম দিনে মওলা আলি(আঃ) নিজেই ময়দানে গেলেন এবং এমন প্রচণ্ড বেগে আক্রমণ করলেন যে যুদ্ধক্ষেত্র কম্পিত হয়ে উঠেছিল। বর্শা ও তীরবৃষ্টি উপেক্ষা করে ব্যূহের পর ব্যূহ ভেদ করে শত্রুর উভয় লাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং মুয়াবিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে বললেন, “অযথা লোক ক্ষয় করে লাভ কি? তুমি আমার মোকাবেলা কর। তাতে একজন নিহত হলে অপরজন শাসক হবে”। এ সময় ইবনে আস মুয়াবিয়াকে বললো, আলী ঠিক বলেছে। একটু সাহস করে তার মোকাবেলা কর। মুয়াবিয়া বললো, “ তোমাদের প্ররোচনায় আমি আমার প্রান হারাতে প্রস্তুত নই”। এ বলে সে পিছনের দিকে চলে গেল। মুয়াবিয়াকে পিছনে হটতে দেখে মওলা আলী (আঃ) মুচকি হেসে ফিরে এলেন। যে সাহসিকতার সাথে মওলা আলী (আঃ) সিফফিনে আক্রমণ রচনা করেছিলেন তা নিঃসন্দেহে অলৌকিক। যখনই যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতেন তখন শত্রু ব্যূহ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত এবং দুঃসাহসী যোদ্ধারাও তাঁর মুখামুখি হতো না। এ কারনে তিনি কয়েক বার পোশাক বদল করে যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছিলেন। একবার আরার ইবনে আদ’হামের মোকাবেলায় আব্বস ইবনে রাবি ইবনে হারিস ইবনে আবদাল মুত্তালিব গিয়েছিল। আব্বাস অনেকক্ষণ লড়াই করেও আরারকে পরাজিত করতে পারছিল না। হঠাৎ সে দেখতে পেল আরারের বর্মের একটা আংটা খুলে আছে। আব্বস কাল বিলম্ব না করে তরবারি দিয়ে আরও ক’টি আংটা কেটে দিয়ে চোখের নিমিষে আরারের বুকে তরবারি ঢুকিয়ে দিল। আরারের পতন দেখে মুয়াবিয়া বিচলিত হয়ে গেল এবং আব্বাসকে হত্যা করতে পারে এমন কেউ আছে কিনা বলে চিৎকার করতে লাগলো। এতে গোত্রের  লাখম গোত্রের কয়েকজন এগিয়ে এসে আব্বাসকে চ্যালেঞ্জ করলে সে বললো যে, সে তার প্রধানের অনুমতি নিয়ে আসবে। আব্বাস মওলা আলী (আঃ) কাছে গেলে তিনি তাকে রেখে তার পোশাক পরে ও তার ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন, আব্বাস মনে করে লাখম গোত্রের লোকেরা বললো, “তাহলে তুমি তোমার প্রধানের অনুমতি নিয়েছ”। তার উত্তরে মওলা আলী (আঃ) বলেনঃ
“যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ নিশ্চয় তাদের সাহায্য করতে সক্ষম”। (কুরআন- ২২:৩৯)
তখন লাখাম গোত্রের একজন লোক হাতির মত গর্জন করতে করতে মওলা আলী (আঃ) এর উপর আঘাত করলো। তিনি সে আঘাত প্রতিহত করে এমন জোরে আঘাত করলেন যে, লোকটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে ঘোড়ার দুদিকে দুখণ্ড পরে গেল। তারপর সে গোত্রের অন্য একজন এসেছিল। সেও চোখের নিমিষে শেষ হয়ে গেল। আসি চালনা ও আঘাতের ধরণ দেখে লোকেরা বুঝতে পারল যে আব্বাসের ছদ্মবেশে আল্লাহ্‌র সিংহ ময়দানে যুদ্ধ করছেন। তখন আর সাহস করে তাঁর সামনে আসে নি।
আম্মার ইবনে ইয়াসির ইবনে আমির, ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় যে কজন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। তিনি প্রথম মুসলিম যিনি নিজের ঘরে মসজিদ নির্মাণ করে আল্লাহ্‌র ইবাদত করতেন।
তাঁর পিতা ইয়াসির ও মাতা সুমাইয়ার সাথে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ও মাতা উভয়ে ইসলামের প্রথম শহীদ।
আম্মার রাসুল (সাঃ) সময় থেকে বদর থেকে শুরু করে মহানবী (সাঃ) এর সাথে সকল যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। ইসলামের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রান। তাঁর ধার্মিকতা, বিশিষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট ও সৎকর্মের জন্য রাসুল (সাঃ) অনেক হাদিস আছে। আয়েশা (রাঃ) ও বেশ কয়েক জন সাহাবীর বর্ণনায় আছে,
*রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “আম্মারের আপাদমস্তক ইমানে ভরপুর”।
*রাসুল (সাঃ) আরও বলেন, “আম্মার সত্যের সাথে সত্য আম্মারের সাথে। সত্য যেদিকে আম্মার সেদিকে। চোখ নাকের যতটা কাছে আম্মার আমার ততটা কাছের, কিন্তু হায়, হায়! একটা বিদ্রোহী দল তাকে হত্যা করবে”।
*রাসুল (সাঃ) আরও বলেন, “হায়, হায়! সত্য ত্যাগী একদল বিদ্রোহী আম্মারকে হত্যা করবে, আম্মার তাদেরকে জান্নাতের দিকে ডাকবে এবং ওরা আম্মারকে জাহান্নামের দিকে ডাকবে। তাঁর হত্যাকারী এবং যারা তাঁর অস্ত্র ও পরিচ্ছদ খুলে ফেলবে তারা জাহান্নামের অধিবাসী”।
*রাসুল (সাঃ) তিরোধনের পর, রাসুল (সাঃ) ঘোষিত ১ম ইমাম মওলা আলী (আঃ) কে অস্বীকার করে অগনতান্ত্রিক ভাবে ক্ষমতায় বসে আবু বক্কর (রাঃ)। এসময় আম্মার মওলা আলী (আঃ) এর বিশেষ সমর্থক ও অনুচর ছিলেন। উসমান (রাঃ) খেলাফত (আমিরুল মোমেনিন) কালে বায়তুল মাল বণ্টনে দূর্ণীতিমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যখন জনগণ সেচ্চার হয়ে উঠল তখন এক জনসমাবেশে আমিরুল মোমেনিন বলেন “বায়তুল মাল পবিত্র এবং তা আল্লাহ্‌র সম্পদ। রাসুলের উত্তরসূরি হিসাবে আমার ইচ্ছা মত তা বণ্টন করার অধিকার আছে। যারা আমার কথা ও কাজের সমালোচনা করে তারা অভিশপ্ত এবং তাদেরকে কঠোর ও কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে”। তখন আম্মার জোর গলায় বলেছিলেন “আমিরুল মোমেনিন জনসাধারণের স্বার্থ উপেক্ষা করে রাসুল (সাঃ) কর্তৃক নিষিদ্ধ গোত্র-স্বার্থ উপেক্ষা করে স্বজন প্রীতির প্রবর্তন করেছে”। এতে উসমান (রাঃ) রাগান্বিত হয়ে আম্মার কে পিটিয়ে চ্যাপ্টা করে দেয়ার জন্য তার লোকজন কে আদেশ দিলেন। ফলে কয়েক জন বনি-উমাইয়া আম্মারের উপর ঝাপিয়ে পড়ে তাকে বেদম প্রহার করেছিল। এমন কি আমিরুল মোমেনিন নিজেই জুতা পরিহিত পায়ে তার মুখে পদাঘাত করেছিলেন। এতে আম্মার অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং উম্মে সালমার পরিচর্যায় তিন দিন পর জ্ঞান ফিরে পান।
মওলা আলী (আঃ) ক্ষমতায় আশার পর আম্মার তাঁর একজন একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। তিনি এসময় সকল প্রকার সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা মূলক কাজে অংশ গ্রহণ করেছিলন। বিশেষ করে জামালের ও সিফফিনের যুদ্ধে।
আম্মার শত্রু সনৈব্যূহের মধ্যে প্রবেশ করে একের পর এক আক্রমন রচনা করে তাদের নাস্তানবুদ করে দিচ্ছিলো। এ সময় নিচ প্রকৃতির মুয়াবিয়ার কিছু সৈন তাঁকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং আবু আল- যুহরী নামক এক পিশাচ তাঁকে এমন আঘত করেছিল যে যা সহ্য করতে না পেরে সাউনি তে ফিরে গেলেন। সাউনিতে ফিরে তিনি পানি চাইলেন। লোকেরা তাঁকে এক বাটি দুধ দিয়েছিল। দুধ দেখে আম্মার বলেছিলেন, “আল্লাহ্‌র রাসুল ঠিক কথাই বলেছেন”। লোকেরা এই কথার অর্থ জানতে চাইলে তিনি বললেন, “আল্লাহ্‌র রাসুল আমাকে একদিন বলেছিলেন এ পৃথিবীতে আমার শেষ খাদ্য হবে দুধ”। এই দুধ পান করার পর নিজে কে আল্লাহ্‌র কাছে নিজেকে সপে দিলেন। মওলা আলী (আঃ) তাঁর মাথা কোলে তুলে নিয়ে বললেন, নিশ্চয়, “যদি কোন মুসলিম আম্মারের মৃত্যুতে মানসিক ভাবে আহত না হয়ে থাকে তবে তাকে যর্থাথ ঈমানদার বলা যাবে না।
মওলা আলী (আঃ) অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, রাসুল (সাঃ) বলেছিলেন “আম্মার সত্যের সাথে সত্য আম্মারের সাথে”।
আম্মার ইবনে ইয়াসির ইবনে আমির ৩৭ হিজরি সনের ৯ সফর সিফফিন যুদ্ধে মারা যান।
এদিকে আম্মারের মৃত্যুতে মুয়াবিয়ার সৈনদের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাদের মনে ধারণা দেয়া হয়েছিল যে, তারা ন্যায়ের জন্য মওলা আলী (আঃ) এর বিরুধে লড়ছে। আম্মারের সম্পর্কে রাসুল (সাঃ) এর ঐ বানী অনেকেই জানত, আম্মারের মৃত্যুতে তাদের ভুল ভেঙ্গে গেল। তারা বুঝতে পারল যে তারা অন্যায় যুদ্ধে লিপ্ত এবং মওলা আলী (আঃ) ন্যায়ের পথে রয়েছেন। এ চিন্তা অফিসার হতে শুরু করে সাধারন সৈনিক সবার মনে আলোড়ন তৈরি করেছিলো। অবস্থা বেগতিক দেখে মুয়াবিয়া তার চিরাচরিত মিথ্যা, ছলনা ও কুট চালের আশ্রয় গ্রহণ করলো, “আম্মারের মৃত্যুর জন্য আমরা দায়ী নই। আলিই তো তাকে যুদ্ধে নিয়ে এসেছে। কাজেই তার মৃত্যুর জন্য আলী দায়ী। মুয়াবিয়ার এমন ছলনা পূর্ণ উক্তি যখন মওলা আলী (আঃ) কে জানানো হলে মওলা আলী (আঃ) বললেন, “মুয়াবিয়া বুঝাতে চায় হামজার মৃত্যুর জন্য রাসুল (সাঃ) দায়ী, কারণ তিনি তাকে ওহুদের যুদ্ধে এনেছিলেন”।
এছাড়াও রাসুলের(সাঃ) অনেক সাহাবী ও আনসারী এ যুদ্ধে শহীদ হন। যেমন, খুজায়মাহ ইবনে ছাবিত আল- আনসারী। রাসুল (সাঃ) তাঁর সাক্ষ্যকে দুজন লোকের সাক্ষ্যের সমতুল্য সত্য বলে মনে করতেন, একারণে তাঁর উপাধি ছিল যূশ-শাহাদাতাইন। সিফফিনের যুদ্ধে ময়দানে তাঁর কাছাকাছি কোন মওলা আলী (আঃ) এর সৈন্য এলে তিনি চিৎকার করে বলতেন, আমি যূশ-শাহাদাতাইন খুজায়মাহ ইবনে ছাবিত আল-আনসারী আমি রাসুল (সাঃ) কে বলতে শুনেছি “যুদ্ধ কর, যুদ্ধ কর, আলীর পক্ষে যুদ্ধ কর”।
নবম দিনে দক্ষিণ বাহুর দায়িত্ব দেয়া হল আবদুল্লাহ ইবনে বুদায়ল কে ও বাম বাহুর দায়িত্বে ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস মওলা আলী (আঃ) মধ্যভাগে ছিলেন। মুয়াবিয়ার সৈন্যদের নেতৃতে ছিল হাবিব ইবনে মাস্লামাহ। উভয় লাইন মুখামুখি হলে একে অপরের উপর সিংহের মত ঝাপিয়ে পড়েছিল এবং চারদিক থেকে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। মওলা আলী (আঃ) এর পতাকা বনি হামাদানের হাতে ঘুরছিল। একজন শহীদ হলে আরেকজন তুলে ধরে। প্রথমে শুরায়রের হাতে ছিল তার পতনে শুরাহবিল ইবনে শুরায়রের হাতে গেল, তারপর ইয়ারিম ইবনে শুরায়রের, এরপর হুবায়রাহ ইবনে শুরায়র এরপর মারসাদ ইবনে শুরায়র- এই ছয় ভ্রাতা শহীদ হবার পর পতাকা গ্রহণ করল সুফিয়ান, এরপর আবাদ, এরপর কুরায়ব- জায়েদের তিন পুত্র । তারা শহীদ হবার পর পতাকা ধারন করলো বসিরের দুপুত্র- উমায়র ও হারিস। তারা শহীদ হবার পর পতাকা ধারন করল ওহাব ইবনে কুরায়ব। এদিনের যুদ্ধে শত্রুর বেশী লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ বাম বাহুর দিকে। সেদিকে এত তীব্র বেগে আক্রমণ করেছিল যে, আবদুল্লাহ ইবনে বুদায়লের সাথে মাত্র তিনশত সৈন্য ছাড়া সকলেই যুদ্ধক্ষেত্র পিছিয়ে গিয়েছিল। এ অবস্থা দেখে মওলা আলী (আঃ) আশতারকে বললেন, “ওদের ফিরিয়ে আন। ওদের জীবন যদি ফুরিয়ে আসে থাকে তাহলে পালিয়ে গিয়ে মৃত্যু কে এড়ানো যাবে না। দক্ষিণ বাহুর পরাজয় বাম বাহু কে প্রভাবিত করবে ভেবে মওলা আলী (আঃ) বাম বাহুর দিকে এগিয়ে গেলেন। এসময় উমাইয়াদের এক ক্রীতদাস (আহমার) বলল, “তোমাকে কতল করতে না পারলে আল্লাহ্‌ আমার মৃত্যু দেন” এ কথা শুনে মওলা আলী (আঃ) এর এক ক্রীতদাস ফায়সান তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। সে শহীদ হলে মওলা আলী (আঃ) আহমারকে এমন আছাড় দিলেন যে তার শরীরের সব জোড়া খুলে গিয়েছিল। তখন ইমাম হাসান ও মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া তাকে জাহান্নামে পাঠায়ে দিল। এদিকে মালিক আসতারের আহব্বানে দক্ষিণ বাহুর পালাতক লোকজন ফিরে আসে তীব্র আক্রমণ করে শত্রুকে পূর্বস্থানে ঠেলে নিয়ে গেল- এখানে আবদুল্লাহ ইবনে বুদায়েল শত্রু কর্তৃক ঘেরাও হয়ে ছিলেন। নিজের লোকজন দেখে সাহস ফিরে এলো। সে মুয়াবিয়ার তাঁবুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। মুয়াবিয়া আবদুল্লাহ ইবনে বুদায়েল কে দেখে ভয় পেয়ে তার দেহরক্ষীদের পাথর মারতে বলল। এতে তিনি শহীদ হন। মালিক বনি হামদান ও বনি মুযহিদ- এর যোদ্ধা নিয়ে মুয়াবিয়ার উপর আক্রমণ চালাবার জন্য এগিয়ে গেল এবং দেহরক্ষীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাগলো। দেহরক্ষীদের পাঁচটি চক্রের মধ্যে একটি বাকী থাকলে মুয়াবিয়া পালাতে চাইলে, এমন সময় কে একজন সাহস দেয়ায় সে ফিরে দাঁড়াল। অপর দিকে আম্মারের তরবারি প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আম্মার যেদিকে যেত রাসুল (সাঃ) এর সকল সাহাবী তাঁকে অনুসরণ করত। এইদিনে আম্মার শহীদ হন।
এসব অকুতোভয় যোদ্ধাগনের মৃত্যুতে মওলা আলী (আঃ) দুঃখিত হৃদয়ে হামদান ও রাবিয়াহ গোত্রদ্বয়ের লোকদের বললেন, “আমার কাছে তোমরা বর্ম ও বর্শা সমতুল্য। উঠে দাঁড়াও- এসব বিদ্রোহীকে উচিত শিক্ষা দাও”। ফলে হামদান ও রাবিয়াহ গোত্রদ্বয়ের বার হাজার সৈন্য তরবারি হাতে দাঁড়িয়ে গেল।তাদের পতাকা ছিল হুদায়ন ইবনে মুনযিরের হাতে। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করলো এবং ব্যূহ একের পর এক ভেদ করে রক্তের স্রোত বইয়ে দিল এবং লাশ স্তূপীকৃত হয়ে রইল। রাতের গাঢ় অন্ধকার না নামা পর্যন্ত তরবারি থামলো না। এটাই সেই ভয়ঙ্কর রাত যা ইতিহাসে “আল- হারিরের রাত্রি” বলে খ্যাত। এ রাতে অস্ত্রের ঝনঝনানি, ঘোড়ার খুরের শব্দ ও মুয়াবিয়ার সৈন্যদের আর্তনাদে আকাশ প্রকম্পিত হয়েছিল। আর মওলা আলী (আঃ) এর দিক থাকে “অন্যায় ও বিভ্রান্তি নিপাত যাক”- শ্লোগানে তাঁর সৈন্যগণের সাহস বৃদ্ধি করছিল এবং মুয়াবিয়ার হ্রদয় শুকিয়ে দিয়েছিল। সকাল বেলায় দেখা গেল ত্রিশ হাজার উর্ধে লোক নিহত হয়েছে।
দশম দিনে মওলা আলি (আঃ) এর সৈন্যগন একই মনোবল নিয়ে যুদ্ধে গেল। দক্ষিণ বাম বাহুর দলনেতা ছিলেন মালিক আল-আসতার এবং বাম বাহুর নেতা আব্বাস। তারা এমন তীব্র বেগে আক্রমণ রচনা করেছিলেন যে, মুয়াবিয়ার সৈন্যরা পালাতে শুরু করল। পরাজয় নিশ্চিত দেখে মুয়াবিয়া আবার ছল করল, পাঁচশত কুরআন বর্শার মাথায় বেঁধে তুলে ধরল, তারা বলছিল যুদ্ধ নয়, কুরআনের আলোয় সিদ্ধান্ত হবে, এতে মওলা আলী (আঃ) এর ক্লান্ত সৈন্যরা তলোয়ার চালনা বন্ধ করল- ছলনা কৃতকার্য হলো। অন্যায়ের পথ পরিষ্কার হয়ে গেল।

এই যুদ্ধ নিয়ে বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম লিখলেনঃ
“এই ধূত ও ভোগীরাই তলোয়ারে বেঁধে কোরআন,
‘আলীর’ সেনারে করেছে সদাই বিব্রত পেরেশান!
এই এজিদের সেনাদল শয়তানের প্ররোচনায়
হাসান হোসেনে গালি দিতে যেত মক্কা ও মদিনায়।
এরই আত্ম প্রতিষ্ঠা- লোভে মসজিদে মসজিদে
বক্তৃতা দিয়ে জাগাত ঈর্ষা হায় স্বজাতির হৃদে”।                       
*এই আর্টিকেল লিখতে অনেক হাদিস ও ইসলামিক ইতিহাসের সাহায্য নেয়া হয়েছে, যেমনঃ নাহাজ আল- বালঘা- আবু তালিব ইবনে আলী (আঃ) খোৎবা- ১২১,১৮১। সাহি আল- বুখারি, মওলার অভিষেক ও ইসলাম ধর্মে মতভেদের কারণ- সদর উদ্দিন চিশতী। আরও অনেক, যদি কেউ আরও ভালো ভাবে জানতে চান তাহলে উপরোক্ত কিতাব গুলি পড়ার জন্য অনুরোধ করা হল।  


    


Sunday, 26 April 2015

ইহুদী বংশোদ্ভূত সউদী সরকার ১৯২৫ সালে ক্ষমতায় বসার পর মক্কা ও মদীনা শরীফে কি কি ইসলামী ঐতিহ্য ধ্বংস করেছে:

0 Comments
মসজিদ:
১) সাইয়্যিদুশ শুহাদা হযরত হামজা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু'র ঐতিহাসিক মসজিদ ও মাজার শরীফ।
২) হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা রদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহা ঐতিহাসিক মসজিদ।
৩) আল মানরাতাইন মসজিদ।
৪) নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিত বংশধর হযরত জাফর ইবনে ছদ্বিক রহমতুল্লাহি'র পুত্র হযরত আলী আল উরাইদি রহমতুল্লাহি মসজিদ এবং মাজার শরীফের গম্বুজ। ২০০২ সালের ১৩ আগস্ট তা ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করা হয়।
৫) খন্দকের ময়দানে ৪টি ঐতিহাসিক মসজিদ।
৬) আবু রাশিদ মসজিদ
৭) হযরত সালমান ফারসী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মসজিদমদীনা শরীফ।
৮) রাজত আল শামস মসজিদমদীনা শরীফ।
মাজার শরীফ:
১) জান্নাতুল বাক্বিমদীনা শরীফ। যেখানে প্রায় ৭ হাজার সাহাবীর মাজার শরীফ বিদ্যামান ছিলো। ১৯২৫ সালের ৮ই শাওয়াল সউদ ইহুদীরা জান্নাতুল বাকিতে হামলা ও লুটপাট চালায়। তারা নবীজির পবিত্র বংশধর এবং সম্মানিত সাহাবীগণের পবিত্র মাজার শরীফগুলো সাথে জঘণ্যধরনের বেয়াদবি করে। (নাউযুবিল্লাহ)।
২) জান্নাতুল মুয়াল্লামক্কা শরীফ। সেখানে নবীজির পারিবারিক অতি ঘনিষ্টজনদেরযেমন: নবীজির সম্মানিত পূর্বপুরুষ এবং উম্মুল মু'মীনিন হযরত খাদিজাতুল কুবরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা'র পবিত্র মাজার শরীফ ছিলো। ১৯২৫ সালে এ পবিত্রস্থান ধ্বংস করে সউদী ইহুদীরা।
৩) নবীজি সম্মানিত আব্বাজানের পবিত্র মাজার শরীফ ধ্বংস করা হয়।
৪) নবীজির সম্মানিত আম্মাজানের পবিত্র মাজার শরীফ ধ্বংস করা হয় ১৯৯৮ সালে।
৫) নবীজির সম্মানিত বংশধর হযরত মুসা কাজিম রহমতুল্লাহির সম্মানিত আম্মাজান এবং হযরত জাফর ছাদিক রহমতুল্লাহি'র সম্মানিত স্ত্রী'র পবিত্র মাজার শরীফ ধ্বংস করা হয়।
৬) উহুদের ময়দানে শহীদান সাহাবীগণের পবিত্র মাজার শরীফ ধ্বংস করা হয়।
৭) ১৯৭৫ সালে জেদ্দায় সকল মানুষের মাতা হযরত হাওয়া আলাইহাস সালামের সম্মানিত রওজা শরীফ ধ্বংস এবং সিলগালা করে দেয়া হয়।
ঐতিহাসিক সম্মানিত স্থান সমূহ:
১) নবীজি যে পবিত্র ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
২) হযরত খাদিজাতুল কুবরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহার উনার পবিত্র ঘর। যেখনে জন্ম গ্রহণ করেন সম্মানিত নবী কন্যা হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা এবং সম্মানিত নবী পুত্র হযরত কাসিম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।
৩) হিজরতের পরে নবীজি মদীনা শরীফে যে ঘরে গিয়ে অবস্থান করেছিলেন।
৪) দ্বার-ই-আরকামইসলামের প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র।
৫) সম্মানিত নবীপূত্র হযরত ইব্রাহীম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু'র পবিত্র জন্মস্থান।
৬) নবীজির সম্মানিত বংশধর হযরত জাফর ছাদিক রহমতুল্লাহির পবিত্র ঘর।
৭) হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু'র পবিত্র ঘরযেখানে হযরত ইমাম হাসান রদ্বিয়াল্লাহু এবং হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু জন্মগ্রহণ করেন।
উল্লেখ্যপ্রায় ১৩০০ বছর ইসলাম একভাবে চলে আসছিলো। কিন্তু ১৯২৫ সালে ব্রিটিশ সহযোগীতায় সউদী ইহুদীরা ক্ষমতায় বসার পর তাদের ফতওয়া বিভাগ থেকে অপব্যাখ্যামূলক ফতওয়া দিতে থাকে এবং এ জঘন্য অপকর্মে লিপ্ত হয়। এই জঘন্য কর্মের মাধ্যমে তারা একদিক থেকে সম্মানিত ব্যক্তিদের সাথে বেয়াদবি করে,অন্যদিকে মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্যশূণ্য করে ফেলে।
বলাবাহুল্য মুসলমানদের কেন্দ্রস্থালে আসন গেড়ে ফেলা এ ইহুদীদের বিরুদ্ধে অনেক আগেই জিহাদ করা ফরজ ছিলো। কিন্তু আফসুস মুসলমানদের জন্যযারা জ্ঞানের অভাবে এখনও গাফেল রয়েছে।

আলে সৌধ বা বর্তমান সৌদি আরবের রাজাদের গল্প

0 Comments
৮ ই শাওয়াল (শুক্রবার) ইসলামের ইতিহাসের এক শোকাবহ দিন। ৮৮ বছর আগে এই দিনে ওয়াহাবি ধর্মদ্রোহীরা পবিত্র মক্কা ও মদিনায় ক্ষমার অযোগ্য কিছু পাপাচার ও বর্বরতায় লিপ্ত হয়েছিল। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা যখন পবিত্র জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র দ্বিতীয়চতুর্থপঞ্চম ও ষষ্ঠ নিষ্পাপ উত্তরসূরির পবিত্র মাজার জিয়ারত করছিলেন তখন ওয়াহাবি দুর্বৃত্তরা সেখানে ভাঙ্গচুর ও লুটপাট অভিযান চালায় এবং ওই নিষ্পাপ ইমামদের পবিত্র মাজারের সুদৃশ্য স্থাপনা ও গম্বুজগুলো মাটির সঙ্গে গুড়িয়ে দেয়।

এরপর বর্বর ও ধর্মান্ধ ওয়াহাবিরা আরো কিছু পবিত্র মাজারের অবমাননা করে এবং এইসব মাজারের গম্বুজ ও  স্থাপনাগুলো ভেঙ্গে-চুরে ইসলাম অবমাননার ন্যক্কারজনক তাণ্ডব চালায়। এইসব মাজার ছিল বিশ্বনবী (সা.)'র  ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন,সাহাবি,স্ত্রীবংশধর ও খ্যাতনামা আলেমদের।
জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে এসে বিশ্বনবী (সা.) বলতেন তোমাদের ওপর সালাম! হে বিশ্বাসীদের আবাসস্থল! আল্লাহ চাইলে আমরাও শিগগিরই তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব। হে আল্লাহআল-বাকির (জান্নাতুল বাকি কবরস্থানের) অধিবাসীদের ক্ষমা করুন।

সুন্নি ও শিয়া সূত্রে বর্ণিত হাদিস অনুযায়ী বিশ্বনবী  হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর সাহাবায়ে কেরাম ও আত্মীয়-স্বজনদের কবরে সালাম দিতেন।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) গোটা সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত (রাহমাতুললিল আলামিন) হিসেবে তাঁর যুগের  ও অন্য সব অনাগত যুগের মুসলমানদের জন্য সত বা মহত লোকদের কবর জিয়ারতের ব্যাপারে নিজের সুন্নাত ও কর্মপন্থা শিখিয়ে গেছেন।

মহান আল্লাহর ইচ্ছায় নেককার কবরবাসী সালাম ও দোয়া শুনতে পান। বিশ্বনবী (সা.) নিশ্চয়ই জানতেন যেমুসলমান নামধারী এক শ্রেণীর মানুষ সুদূর ভবিষ্যতে তাঁর এইসব সুন্নাত পদদলিত করবে এবং মক্কা ও  মদিনায় মুসলমানদের রক্ত ঝরাবে এবং বেদাআত বা কুপ্রথা প্রতিরোধের নামে তাঁর পবিত্র আহলে বাইত বা নিষ্পাপ ইমামদের পবিত্র মাজারগুলোসহ  তাঁর  ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনস্ত্রীসাহাবি,  বংশধর ও খ্যাতনামা আলেমদের মাজারগুলো গুড়িয়ে দেবে।

বিশ্বনবী (সা.) কবর জিয়ারতের সুন্নাতকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করেছিলেন। সম্ভবত এর অন্যতম কারণ এটাও ছিল যে এর মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের মধ্যে বিভেদকামী এই ওয়াহাবি-সালাফি গোষ্ঠীর মুনাফেকি বা কপট চরিত্র উন্মোচন করবেন। এই সুন্নাতের মাধ্যমে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এটা স্পষ্ট করেন যেএকটি গতিশীল ইসলামী সমাজ সবসময় তার মৃত ব্যক্তিদের স্মরণ করে যেই মৃত ব্যক্তিরা মৃত্যুর পরেও খোদায়ী রহমত পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। অন্যদিকে শহীদদের অবস্থা আরো উন্নত। স্বয়ং মহান আল্লাহ বলেছেন,
 যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছে তাদের তোমরা মৃত ভেবো নাবরং তারা জীবিত এবং তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে জীবিকা-প্রাপ্ত। (সুরা আলে ইমরান-১৬৯)
অন্য একটি আয়াত হতে জানা যায় এই বিশেষ জীবন (বারজাখের জীবন) শুধু শহীদদের জন্যই নয়বরং আল্লাহর সকল অনুগত ও সৎকর্মশীল বান্দার জন্য নির্ধারিত।
মহান আল্লাহ্ বলেছেন :
 যারা আল্লাহ্ ও তাঁর প্রেরিত পুরুষের আনুগত্য করবে তারা সেই সব ব্যক্তির সঙ্গে থাকবে নবীগণসত্যবাদিগণশহীদগণ ও সৎকর্মশীলদের মধ্য হতে যাদের তিনি নিয়ামত দিয়েছেন। তারা কতই না উত্তম সঙ্গী! (সুরা নিসা-৬৯)
যদি শহীদগণ আল্লাহর কাছে জীবিত থাকেন ও জীবিকা লাভ করেন তবে যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের অনুগত হবেসেও শহীদদের সাথে থাকবে, (যেহেতু রাসূল নিজেও তাঁর আনীত নির্দেশের আনুগত্যকারীসেহেতু তিনিও এই সুবিধার অন্তর্ভুক্ত)। কারণ এ আয়াতে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যকারীরা শহীদদের সঙ্গে থাকবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদি শহীদরা মৃত্যুর পর আল্লাহর কাছে জীবিত থাকেন তবে তারাও অর্থাত আল্লাহ ও নবী-রাসূলদের আনুগত্যকারীরাও আল্লাহর কাছে জীবিত রয়েছেন ও বারজাখী জীবনের অধিকারী।

বিশ্বনবী (সা.)র জন্য এটা কতই না হৃদয় বিদারক যে তাঁর প্রিয় আহলে বাইতসাহাবি ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের মাজারগুলো গুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে! জান্নাতুল বাকি কোনো সাধারণ কবরস্থান নয়। এখানে রয়েছে অন্তত সাত হাজার সাহাবির কবর। এখানে রয়েছে বিশ্বনবী (সা.)র ফুপি বা পিতার বোন হযরত সাফিয়া ও আতিকার কবর। এখানেই রয়েছে বিশ্বনবী (সা.)র শিশু পুত্র হযরত ইব্রাহিম (তাঁর ওপর অশেষ শান্তি বর্ষিত হোক)-এর কবর। এই পুত্রের মৃত্যুর সময় বিশ্বনবী (সা.) অশ্রু-সজল চোখে বলেছিলেনচোখগুলো থেকে পানি ঝরছে এবং হৃদয় শোকাহতকিন্তু আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্রেককারী কথা ছাড়া অন্য কিছুই বলব না। আমরা তোমার জন্য শোকাহত হে ইব্রাহিম!

জান্নাতুল বাকি হচ্ছে সে স্থান যেখানে সমাহিত হয়েছেন বিশ্বনবী (সা.)র চাচা হযরত আবু তালিব (রা.)র স্ত্রী ফাতিমা বিনতে আসাদ (সালামুল্লাহি আলাইহা)। এই মহীয়সী নারী বিশ্বনবী (সা.)-কে লালন করেছিলেন নিজ সন্তানের মত স্নেহ দিয়ে এবং তাঁকে কবরে রাখার আগে বিশ্বনবী (সা.) এই মহান নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য নিজেই ওই কবরে কিছুক্ষণ শুয়েছিলেন। রাসূল (সা.) তার জন্য তালকিন উচ্চারণ করেছিলেন শোকার্ত কণ্ঠে।  

জান্নাতুল বাকি হচ্ছে সেই কবরস্থান যেখানে বেহেশতী নারীদের সর্দার তথা খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা (সা.) বিশ্বনবী (সা.)র ইন্তিকালের পর যে ৯০ দিন নিজে বেঁচে ছিলেন প্রায়ই সেখানে গিয়েই শোক প্রকাশ করতেন। যেখানে বসে তিনি শোক প্রকাশ করতেন সেই স্থানটিকে বল হল বাইতুল হুজন বা শোক প্রকাশের ঘর। একই স্থানে কারবালার শোকাবহ ঘটনার পর  বিশ্বনবী (সা.)র নাতি শহীদদের নেতা ইমাম হুসাইন (আ.) ও নিজের পুত্র হযরত আবুল ফজল আব্বাস (রা.) র জন্য শোক প্রকাশ করতেন মুমিনদের নেতা হযরত আলী (আ.)র স্ত্রী উম্মুল বানিন (সা. আ.)। এখানেই মদিনাবাসী যোগ দিতেন শোক-অনুষ্ঠানে। এখানে প্রায়ই শোক প্রকাশের জন্য আসতেন ইমাম হুসাইন (আ.)র স্ত্রী হযরত রাবাব (সা. আ.)। বিশ্বনবী (সা.)র নাতনী ও ইমাম হুসাইন (আ.)র বোন হযরত জয়নাব (সা. আ.) ও উম্মে কুলসুম (সা.আ.) নিয়মিত শোক প্রকাশের জন্য এখানেই আসতেন।

৮৮ বছর আগেও জান্নাতুল বাকিতে টিকে ছিল বিশ্বনবী (সা.)র ১২ জন নিষ্পাপ উত্তরসূরির মধ্য থেকে তাঁর নাতি হযরত ইমাম হাসান (আ.)অন্য নাতি ইমাম হুসাইন (আ.)'র পুত্র ইমাম জয়নুল আবেদিন (আ.)তাঁর পুত্র ইমাম মুহাম্মাদ বাকির (আ.) ও বাকির (আ.)'র পুত্র ইমাম জাফর সাদিক (আ.)র সুদৃশ্য মাজার। কিন্তু বর্তমানে এ এলাকায় টিকে রয়েছে একমাত্র বিশ্বনবী (সা.)র মাজার। ওয়াহাবিরা বিশ্বনবী (সা.)র পবিত্র মাজার ভাঙ্গার জন্য বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেয়ার পরও মুসলমানদের প্রতিরোধের মুখে ও ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার ভয়েই তা বাস্তবায়নের সাহস করেনি।

ব্রিটিশ ও কাফিরদের সহযোগী ইহুদিবাদী চরিত্রের অধিকারী ওয়াহাবিরা কেবল মদিনায় নয় পবিত্র মক্কায়ও ইসলামের অনেক নিদর্শন ও পবিত্র মাজার ধ্বংস করেছে। এইসব মাজারের মধ্যে রয়েছে মক্কায় জান্নাতুল মোয়াল্লা নামক কবরস্থানে অবস্থিত বিশ্বনবী (সা.)র স্ত্রী ও  প্রথম মুসলমান  উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা (সা. আ.)র পবিত্র মাজার এবং বিশ্বনবী (সা.)  পুত্র হজরত কাসেম (আ.)চাচা হযরত আবু তালিব (রা.) ও দাদা হযরত আবদুল মুত্তালিব (আ.)সহ অন্যান্য পারিবারিক সদস্যদের মাজার।

ওয়াহাবিরা মদীনায় ওহুদ যুদ্ধের ঐতিহাসিক ময়দানে বিশ্বনবী (সা.)র চাচা শহীদদের নেতা হযরত হামজা (সা.)র মাজারসহ অন্যান্য শহীদ সাহাবিদের মাজারও ধ্বংস করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াহাবিরা সিরিয়ায় বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত সাহাবির মাজারে হামলা চালিয়ে সেইসব মাজারের অবমাননা করেছে। তারা বিখ্যাত সাহাবি হজর ইবনে ওদাই (রা.) মাজার ধ্বংস করে তার লাশ চুরি করে নিয়ে গেছে। এ ছাড়াও তারা কয়েকবার হামলা করেছে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)র বোন হযরত জয়নাব (সা. আ.)র মাজারে।

ওয়াহাবিরা এভাবে ইসলামের ইতিহাসের নিদর্শনগুলো ধ্বংস করছে ঠিক যেভাবে বায়তুল মোকাদ্দাস শহরে মুসলমানদের পবিত্র প্রথম কেবলা এবং এর আশপাশের  ইসলামী নিদর্শনগুলো ধ্বংসের চেষ্টা করছে দখলদার ইহুদিবাদীরা। ফিলিস্তিনের অনেক ইসলামী নিদর্শন ধ্বংস করেছে ইহুদিবাদীরা। অনেকেই মনে করেন ওয়াহাবিদের পৃষ্ঠপোষক সৌদি রাজবংশ (যারা তুর্কি খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ইংরেজদের সহায়তা করেছে এবং পুরস্কার হিসেবে হিজাজে বংশীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে) ছিল একটি ইহুদিবাদী ইহুদি গোত্রেরই বংশধর। এরা মুখে মুখে মুসলমান বলে দাবি করলেও সব সময়ই ইসলামের শত্রুদের সহযোগী।

কেউ কেউ বলে থাকেন যে সৌদি রাজ-পরিবার আসলে দোমনেহ নামের বিভ্রান্ত ইহুদিবাদী গোষ্ঠীর বংশধর। এই গোষ্ঠী ভণ্ড  ইহুদিবাদী নবী শাব্বিটি জিভির অনুসারী। তারা প্রকাশ্যে ইসলামের অনুসারী বলে দাবি করত। কিন্তু তারা বাস্তবেমদ্যপ ও নির্বিচার যৌনাচার বা যৌন অনাচারসহ নানা ঘৃণ্য কাজে অভ্যস্ত ছিল।

আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগে ওয়াহাবি মতবাদের প্রবক্তা আবদুল ওয়াহহাব নজদি সৌদ বংশের সহায়তা নিয়ে ইবনে তাইমিয়ার বিভ্রান্ত চিন্তাধারা প্রচার করতে থাকে। তার ভুল দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নজদি অলি-আওলিয়ার উসিলা দিয়ে দোয়া করা,তাদের মাজারে মানত করা ও শ্রদ্ধা জানানোসহ অলি-আওলিয়ার মাজার ও কবর জিয়ারতের মত ইসলামের মৌলিক কিছু ইবাদত এবং আচার-অনুষ্ঠানকে হারাম ও শির্ক বলে ঘোষণা করেছিল।  ফলে ওয়াহাবিরা মাজার ও পবিত্র স্থানগুলো ধ্বংস করে আসছে। শুধু তাই নয় নজদি তার চিন্তাধারার বিরোধীদেরকে কাফির ও তাদেরকে হত্যা করা ওয়াজিব বলে উল্লেখ করত।

অথচ বিশ্বনবী (সা.) নিজে কবর জিয়ারত করতেন এবং বিশেষ করে তাঁর মাতা হযরত আমিনা (সালামুল্লাহি আলাইহা)র কবর জিয়ারত করতে ছুটে যেতেন। তিনি নিজের মায়ের কবরের পাশে কাঁদতেন। (আল মুস্তাদরাকখণ্ড-১পৃ.৩৫৭মদিনার ইতিহাস,ইবনে শাব্বাহখণ্ড-১পৃ.১১৮) আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত হয়েছে যেমহানবী (সা.) বলেছেনতোমরা কবর জিয়ারত কর। এই জিয়ারত তোমাদেরকে পরকালের স্মরণে মগ্ন করবে।


ওয়াহাবিরা আলে সৌদের বাহিনী নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণের ওপর নৃশংসভাবে গণহত্যা চালিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করত এবং জনগণকে ওয়াহাবি মতবাদ মেনে নিতে বাধ্য করত। প্রাথমিক পর্যায়ে যখন তাদের কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না সে সময় ওয়াহাবিরা লুটপাট ও ডাকাতির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। শহরগুলোতে লুটপাটের পর সেইসব অঞ্চলের ওপর দখলদারিত্ব ধরে রাখার ক্ষমতা তখনও তাদের ছিল না। ওয়াহাবিরা বিশ্বনবী (সা.)র পবিত্র মাজারে এবং কারবালায় হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) মাজারে হামলা চালিয়ে মূল্যবান অনেক সম্পদউপহার ও নিদর্শন লুট করেছিল।

ইসলামের পবিত্র ও ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো ধ্বংস করে ওয়াহাবিরা শুধু মুসলিম উম্মাহর হৃদয়কেই ক্ষত-বিক্ষত করেনি,একইসঙ্গে মানব সভ্যতার অবমাননার মত জঘন্য কলঙ্কও সৃষ্টি করেছে। কারণপ্রত্যেক জাতি ও সভ্যতাই নিজের পুরনো ঐতিহাসিক চিহ্ন ও নিদর্শনগুলোকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সংরক্ষণ করে। এ জন্য বিপুল অংকের অর্থ খরচ করে থাকে জাতিগুলো। অথচ ওয়াহাবিরা ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনগুলোও ধ্বংস করে দিচ্ছে যাতে ভবিষ্যত প্রজন্মগুলো এইসব নিদর্শন সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে। এটা ইসলাম ও মানব সভ্যতার জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।

ওয়াহাবিরা  অতীতেও জান্নাতুল বাকিতে হামলা চালিয়ে নিষ্পাপ ইমামদের মাজার ধ্বংস করেছিল। প্রথমবার তারা হামলা চালিয়েছিল হিজরি ১২২১ সালে (১৮০০ খ্রিস্টাব্দে)। (এ সময় হিজাজে সৌদি ওয়াহাবিদের গঠিত প্রথম বিদ্রোহী ও অবৈধ সরকারটি নির্মূল হয়েছিল তুরস্কের ওসমানিয় খেলাফতের মাধ্যমে। ) সে সময়  ওয়াহাবিরা দেড় বছর ধরে মদীনাকে অবরুদ্ধ করে শহরটি দখল করতে সক্ষম হয় এবং বিশ্বনবী (সা.) পবিত্র মাজারের দামী পাথর ও সোনা-রূপাসহ মূল্যবান জিনিষগুলো লুট করে এবং জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে ধ্বংসযজ্ঞ ও লুটপাট চালায়। তারা হামলা পবিত্র মক্কায়ও হামলা চালিয়েছিল।  

তারা ওই একই বছর কেবল বিশ্বনবী (সা.)র মাজার ছাড়া মক্কা ও মদীনায় সব মাজার ধ্বংস করে। শ্রদ্ধার জন্য নয়বরং জনগণের ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে ও ভয়াবহ পরিণামের ভয়ে বিশ্বনবী (সা.)র মাজার ধ্বংস করার সাহস তারা করেনি। ওয়াহাবিরা মক্কা ও মদিনার কাজি বা বিচারকদের অপসারণ করে সেখানে নিজেদের কাজি নিয়োগ করে। নবনিযুক্ত ওয়াহাবি কাজি বিশ্বনবী (সা.)র মাজার বা কবর জিয়ারত থেকে জনগণকে বিরত রাখার চেষ্টা করতেন। মক্কা ও মদিনার জনগণকে জোর করে ওয়াহাবি মতবাদ মেনে নিতে বাধ্য করেছিল ওয়াহাবিরা।

ধর্মপ্রাণ সুন্নি ও শিয়া মুসলমানরা অর্থ ব্যয় করে আবারও জান্নাতুল বাকির মাজারগুলো পুনর্নির্মাণ করেন। কিন্তু ওয়াহাবিরা দ্বিতীয়বার মক্কা দখলের পর পর ১৩৪৪ বা ১৩৪৫ হিজরিতে তথা ১৯২৫ সালে মদীনা অবরোধ করে এবং প্রতিরোধাকামীদের পরাজিত করে এই পবিত্র শহর দখল করে।  ওসমানিয় পুলিশদের শহরের বাইরে হটিয়ে  দিয়ে এবারও তারা জান্নাতুল বাকিতে অবস্থিত নবী (সা.)- পরিবারের নিষ্পাপ ইমামদের মাজারসহ সব মাজার ধ্বংস করে এবং লুটপাট চালায়। মুসলমানরা এই দিনটিকে ইয়াওমুল আলহাদাম বা ধ্বংসের দিন বলে অভিহিত করেছেন।
 
back to top