Wednesday, 5 October 2016

যে বিভ্রান্তির শেষ নাই

0 Comments
হিজরী ৬০ সালের কথা। কয়েক দিন মাত্র অতিক্রান্ত হয়েছে, ইয়াজিদ তার পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজসিংহাসন ঘিরে চলছে আনন্দ ফুর্তি এবং উত্স্বের সমারোহ কিন্তু ইয়াজিদের চোখে মুখে চিন্তার ছায়া, দৃষ্টির গভীরে লুকিয়ে থাকা উদ্বেগের নিশানা মাঝে মধ্যেই মেঘাচ্ছন্ন আকাশের প্রচ্ছন্ন চাঁদের মত প্রকাশিত হচ্ছে। প্রয়াত বাবার সতর্কবাণী ঘন ঘন তাকে আঘাত করে চলেছে।
মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে আমিরে মুয়াবিয়া ইয়াজিদকে চারজন ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে সতর্ক করে বলেছিলেন, এদের মধ্যে তিনজনকে তুমি ছলচাতুরী, লোভ কিংবা হুমকি দিয়ে বাগে আনতে সক্ষম হলেও হোসাইন বিন আলীকে তুমি তা পারবে না কারণ হোসাইন প্রতিপালিত হয়েছে এক পবিত্র পরিবেশে, স্বয়ং বিশ্বনবীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে।
অপরদিকে মদিনা শরীফের প্রশাসক ওলিদ তার খাস কামরায় বসে নানা চিন্তায় মশগুল ছিল। এমন সময় কাসেদ এসে ইয়াজিদের একখানি পত্র ওলিদের কাছে হস্তান্তর করল। তাতে লিখা ছিল, ‘ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে মদিনার প্রশাসক ওলিদ ইবনে ওতবার প্রতি......... আপনাকে অবহিত করা হচ্ছে যে, আমিরে মুয়াবিয়া ইহধাম ত্যাগ করেছেন এবং মৃত্যুর পূর্বে তিনি আমাকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করেছেন। আপনার প্রথম কাজ হচ্ছে প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করে হলেও মদিনার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিশেষ করে হোসাইন বিনআলীর আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি আদায় করতে হবে।
নির্দেশ পাবার পর মদীনার শাসক ওলীদ ইবনে ওতবা ইমামকে তার গৃহে দাওয়াত করে যখন মুয়াবিয়ার মৃত্যুর খবর এবং ইয়াজিদের চিঠির প্রসঙ্গ টেনে বলল তার আনুগত্য স্বীকার করে নিতে,তখন ইমাম বলেছিলেন যে 'তুমি তো নিশ্চয়ই চাও যে আমি গোপনে নয় বরং সর্বসমক্ষে তার বাইয়াত গ্রহণ করি ?' ওলিদ বেশ আনন্দের সাথে বলেছিল-'হ্যাঁ, ঠিক তাই' ইমাম হোসাইন (.) তখন বলেছিলেন, 'তাহলে কাল আমি লোকজন নিয়ে তোমার কাছে আসি।' একথা শুনে নবী পরিবারের প্রকাশ্য শত্রু মারওয়ান ইবনে হাকাম হাঁক মেরে বলল 'হে ওলীদ ! হোসাইনকে যেতে দিও না। তাহলে তার আর নাগাল পাবে না। এখানেই তার শিরোচ্ছেদ করো।' হোসাইন () বললেন, 'কাকে তুমি ভয় দেখাচ্ছ। নবী পরিবারের কেউই কোনোদিনইয়াজিদের মতো একজন ফাসেকের বাইয়াত গ্রহণ করতে পারে না। একথাটাই কাল সকালে জনগণের সামনে পুনরাবৃত্তি করতে চাই আমি।' এই বলে শান্ত চিত্তে তিনি ওলীদের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সুনসান নিরব নিস্তব্ধ রাতে ইমাম হোসাইন () গেলেন পূত-পবিত্র একটি জায়গায়। জায়গাটি আর কিছু নয়, তাঁরই প্রিয় নানা রাসূলে খোদা (সা) এর মাযার। বিনীত শ্রদ্ধাময় প্রশান্ত অনুভূতি নিয়ে তিনি বিড়বিড় করে বলছিলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল (সা)! আমি তোমার প্রিয়তম কন্যা ফাতেমা (সা.) সন্তান হোসাইন। একজন অত্যাচারী বর্তমানে চাচ্ছে আমি যেন তার বাইয়াত গ্রহণ করি। কিন্তু কাজ আমি কক্ষনোই করব না......... কারণ কাজ তোমার সম্মান মর্যাদার সম্পূর্ণ বিরোধী।'

ইমাম হোসাইন () হজের রীতি অনেকটা অসমাপ্ত রেখেই আল্লাহর বিধান পালনের উদ্দেশ্যে নিজেকে প্রস্তুত করলেন। যেন এক ভিন্নরূপী সকাল, তুফানের আগে ভয়াল নিস্তব্ধতা। কুফার পথে ইমাম স্থানে স্থানে মানুষকে উদ্দেশ্য করে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিতে থাকেন। তার এসব বক্তব্যের মর্মকথা হলো , হে লোক সকল; নবী করিম (.) বলেছেন, যে অত্যাচারী শাসক হারামকে হালাল মনে করে, রাসুলের সুন্নাতের পরিপন্থি কাজ করে এবং নিরপরাধ মানুষকে উত্যক্ত করে, তাকে চিনবার পরও যদি মুসলমানরা প্রতিবাদী না হয় এবং এর বিরুদ্ধে সোচ্চার না হয় তাহলে জেনে রাখো অত্যন্ত কঠোর পরিণতি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
জোহাইর বিন কিস্ ইমামকে উদ্দেশ্যে করে বলে উঠলেন, হে নবীজির বংশধর, আপনার সহযাত্রীরা তাদের নিজের জীবনের চেয়ে আপনার সান্নিধ্যকে প্রাধান্য দেয়। সময় দূর থেকে অশ্বারোহী একটি দলকে আসতে দেখা যায়। অশ্বারোহী দলটি ইমামের কাছে এসে সালাম নিবেদন করল। ইমাম কুফার অবস্থা জানতে চাইলেন। আগন্তক কাফেলা ইমামকে জনালেন, কুফার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অর্থ-সম্পদের বিনিময়ে ইয়াজিদের পক্ষে চলে গেছে। তারা এখন আপনার বিরুদ্ধে তত্পের হয়েছে। আগন্তকদের আরেকজন বলে উঠল, সাধারণ মানুষ মন থেকে আপনাকে ভালোবাসলেও আগামীকাল তারাই আপনার বিরুদ্ধে তরবারী চালনা করবে।
ইমাম হোসাইন তখন তার প্রতিনিধি কেইসের সম্পর্কে জানতে চান। আগন্তক কাফেলা ইমামকে জানাল, কুফার শাসনকর্তা ইবনে যিয়াদের লোকেরা কেইসকে গ্রেফতার করে ,এরপর ইবনে যিয়াদ কেইসকে আপনার আমিরুল মুমেনীন হযরত আলীর প্রতি অভিসম্পাত করার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু ঈমানের আলোয় দীপ্তমান কেইস আহলে বাইতের প্রশংসা করতে শুরু করে। এই অপরাধে নরাধম ইবনে যিয়াদের নির্দেশে কেইসকে প্রাসাদের ছাদ থেকে নিক্ষেপ করা হয়। ফলে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
পথিমধ্যে কুফার মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা এবং সেখানকার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানবার পর ইমাম হোসাইন (:) এর সঙ্গীদের অনেকেই আর অগ্রসর না হয়ে, ইমামকে ফিরে যাবার জন্য পরামর্শ দেন। তারা ইমামকে বলেন, এটা এখন নিশ্চিত যে কুফার মানুষ আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। কিন্তু আগন্তক কাফেলার কাছ থেকে সবকিছু জানার পর ইমাম যেন আরো প্রত্যয়ী হয়ে উঠলেন। তিনি তার প্রতিনিধি এবং দূতদের অবস্থান সুস্পষ্ট করার জন্য সুরায়ে আহযাবের ২৩ নম্বর আয়াত তেলাওয়াত করলেন। "ঈমানদার বিশ্বাসীদের মধ্যে অনেকে আল্লাহর সাথে তাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে। ওদের কেউ কেউ শাহাদাত বরণ করেছে এবং অনেকে প্রতীক্ষায় রয়েছে। তারা তাদের লক্ষ্য পরিবর্তন করেনি।"

ইমাম তার সঙ্গীদেরকে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিলেন, ইসলামের এই ক্রান্তিকালে মহা আদর্শ স্থাপন করা ইমাম ছাড়া আর কার পক্ষে সম্ভব ছিল? তাই ইমাম সত্য মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের জন্যে, বিভ্রান্তি বিচ্যুতির বেড়াজাল থেকে মুহাম্মাদী ইসলাম রক্ষার উদ্দেশ্যে নিজ করণীয় সাব্যস্ত করে ফেললেন। ইমামের নির্দেশ পেয়ে তার সহযাত্রী দল, ঘোড়া গুলোকে পানি পান করালেন এবং কারবালা প্রান্তরের উদ্দেশ্যে যাত্রার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। ইমাম হোসাইন (.) তার সঙ্গীদের কাফেলা উষর মরু প্রান্তর দিয়ে এগিয়ে চলেছে। কোথাও কোন শব্দ নেই; হঠাৎ, কাফেলার মধ্য থেকে আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে সকলের মনোযোগ আকৃষ্ট হলো। একজন বলে উঠলেন, হে ইমাম, দূরে খেঁজুরের বাগান দেখা যাচ্ছে। এখানে এর আগে কখনো তো খেঁজুরের বাগান ছিল না!
কাফেলার অন্যরাও তখন মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করার চেষ্টা করল। না, কোন খেঁজুরের বাগান নয়, দেখে মনে হচ্ছে বর্ম সজ্জিত একদল ঘোড়সাওয়ার বাহিনী আমাদের দিকে ছুটে আসছে। আস্তে আস্তে অশ্বারোহী সেনাদলটি ইমামের কাফেলার সামনে এসে উপস্থিত হলো। দলপতি নিজেদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য পানি প্রার্থনা করলে ইমাম তাদেরকে পর্যাপ্ত পানি দেয়ার জন্য তার সঙ্গীদেরকে নির্দেশ দিলেন। এরপর ইমামের এক সঙ্গী আগন্তক দলপতিকে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে , তিনি নিজেকে হুর ইবনে ইয়াজিদ রিয়াহী বলে পরিচয় দেন।
ইমাম হুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি আমাদের পক্ষে না বিপক্ষে? জবাবে হুর বললেন, আমি আপনার যাত্রায় বাধা দেয়ার জন্য আদিষ্ট হয়ে এখানে এসেছি। ইমাম হুরের বাহিনীর প্রতি ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝতে পারলেন এরা কুফার অধিবাসী। তাই তাদেরকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, তোমরাই না আমাকে হাজার হাজার চিঠি দিয়ে আমাকে কুফায় আসার জন্য আমন্ত্রন জানিয়েছিলে?
এরই মধ্যে ইমামের একজন সঙ্গী নামাজের জন্য আযান দেন। দুপক্ষই ইমামের ইমামতিতে নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষ হওয়ার পর ইমাম পুনরায় হুরকে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। হুর পুনরায় একই উত্তর প্রদান করে। ইমাম হোসাইন (:) পুনরায় হুর এবং তার বাহিনীকে লক্ষ্য করে বলেন, তোমরাই না আমাকে সাহায্যের জন্য বার বার অনুরোধ করেছিলে, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে এখানে এসেছি আর তোমরা উল্টো এখন আল্লাহর নবীর বংশধরদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছ?
আমরা অপমান অমর্যাদাকে কখনই মেনে নেব না। আল্লাহ তার রাসুলের এটাই শিক্ষা। মুমেন মুসলমানরা সব সময় সম্মান রক্ষার জন্য মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করবে। হুরের বাহিনী ইমামের কাফেলার পাশাপাশি অগ্রসর হতে থাকে। এক পর্যায়ে ইমামের বিভিন্ন ভাষণ হুরের অন্তরে ঝড়ের সৃষ্টি করে। দলপতি হুরের অন্তরে আমূল পরিবর্তনের আভাস স্পষ্ট হতে শুরু করে।
মরুর বুকে ঘোড়াগুলো দৌড়াচ্ছে। আকাশজুড়ে কালোমেঘের আনাগোনা। কারবালার বুকে এতো জনসমাগম বোধ হয় আর কখনো হয় নি। দিনের প্রতিটি প্রহরেই নতুন নতুন সেনা এসে জড়ো হচ্ছে। উমন ইবনে সাদ আবি ওক্কাসের নেতৃত্বে চার হাজার সৈন্য কারবালায় প্রবেশ করে হোসাইন (.) কে বাইয়াত গ্রহণ করতে বলে। এর কয়েক ঘণ্টা পর শিমার ইবনে জিলজুশান মুরাদির নেতৃত্বে আরো বহু নতুন সৈন্য এসে তার সাথে যোগ দেয়। লৌহবর্ম পরিহিত অবস্থায় শিমার ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলো। তার চোখেমুখে নির্দয়-নির্মমতার ছাপ। অহঙ্কারের সাথে সে কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে যেয়াদের একটি চিঠি ওমরের হাতে দেয়। চিঠিতে লেখা ছিলঃ 'হে সাআদের পুত্র! হোসাইনের সাথে নম্র ব্যবহার করার জন্যে তোমাকে পাঠাই নি। হোসাইন যদি আত্মসমর্পন না করে , তার ওপর এবং তার সঙ্গী- সাথীদের ওপর হামলা করবে। সবাইকে হত্যা করে তাদের লাশের ওপর দিয়ে ঘোড়া চালাবে। কাজের জন্যে তুমি আমার কাছ থেকে উত্তম পুরস্কার পাবে। আর যদি তুমি দায়িত্ব পালন করতে না পারো, তাহলে সেনাপতির দায়িত্ব শিমারকে দেবে।'
চিঠি পড়ে ওমর সাআদ শিমারের দিকে তাকিয়ে বলল: 'তোর ওপরে খোদার লা'নত। তুই একটা প্রতারক।' বলতে না বলতেই শিমার হুঙ্কার মেরে বলল যে ইয়াযিদের আদেশ পালন না করা পর্যন্ত সে শান্ত হবে না। অবশেষে মুহররমের ষষ্ঠ দিনে বিশ সহস্রাধিক সশস্ত্র সৈন্যকে রাসূলে খোদা (সা.) এর সন্তানের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে কারবালায় প্রেরণ করা হলো।
কারবালা দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেল। একদিকে কেবল তাঁবু আর তাঁবু, অস্ত্র-শস্ত্র আর ঘোড়া। অপরদিকে ছোট ছোট কয়েকটি তাঁবু। যেগুলোর মাঝে সবুজ রঙের বড়ো চাদর দেখতে পাওয়া যায়। একদিকে দুনিয়াপুজারী বলদর্পী সেনাদের আনন্দ-উল্লাস, অপরদিকে নবীজীর সন্তানের প্রতিরক্ষায় সত্যপূজারী একদল খোদাপ্রেমিক মানুষের দোয়া-দরুদের গুঞ্জরণ। সেনাপতিরা একের পর এক কুফার গভর্নরের কাছ থেকে চিঠি পাচ্ছে। চিঠির ভাষ্য হলো-'হোসাইন ইবনে আলীকে বলো,তাকে এবং তার সঙ্গী-সাথীদেরকে অবশ্যই ইয়াযিদের বাইয়াত গ্রহণ করতে হবে, অন্যথায় তার গর্দান নেবে।' আরেকটি পত্রে বলা হয়েছে, ‘হোসাইনের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করবে। এমনকি তার সাথীদেরকে এক ফোঁটা জলও নিতে দেবে না '
ইমাম হোসাইন (.) এর নূরানী চেহারায় সত্যের প্রতি ভালোবাসার ছাপ সুস্পষ্ট। কিন্তু কুফাবাসীর গোমরাহী তাঁর অন্তরমনকে আহত করেছে। তিনি তাঁর প্রতিপক্ষের সেনাদের উদ্দেশ্যে বললেনঃ 'দুনিয়াপূজারী মানুষ যখন আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকে, ধর্ম তখন তাদের কাছে খেলনা বস্তু বলে মনে হয়, অর্থাৎ তখন তারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে। তবে যখন তারা কোনো কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তখন খুব কম লোককেই সত্য দ্বীনের ওপর অটল থাকতে দেখা যায়।'
রাতের বেলা মরুভূমিতে নেমে এলো রহস্যময় নীরবতা। হঠাৎ শত্রুসেনাদের মাঝ থেকে একটা আনন্দধ্বনি ভেসে উঠল। ইমামের সঙ্গীরা তাঁদের তাঁবুগুলোকে কাছাকাছি নিয়ে এলো এবং পরিখা খনন করে শত্রুদের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করল। নামায শেষে ইমাম তাঁর সাথীদের মাঝে গেলেন গভীর দৃষ্টি দিয়ে তাদের দিকে তাকালেন। তারপর তাঁর কণ্ঠধ্বনি রাতের নিরবতা ভেদ করল। 'আমি তোমাদের মতো বন্ধু এবং নিজের পরিবারের মতো পরিবার আর দেখি নি। আমার সাথে তোমরা যে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছো, আমি সেই বন্ধন তুলে নিলাম এবং তোমরা যে আমার হাতে বাইয়াত হয়েছ তার দায় থেকেও আমি তোমাদের মুক্ত করে দিলাম। এখন তোমাদের সবাইকে আমি অনুমতি দিচ্ছি তোমরা যে পথ দিয়ে এসেছ , সেপথে পুনরায় চলে যেতে পারো রাতের আঁধারে তোমরা চলে যাও। যেসব সৈন্য এখানে এসেছে , তারা কেবল আমাকেই চায় তোমাদরকে নয়।'
বীরত্ব সাহসিকতার অনন্য পরাকাষ্ঠা ইমাম হোসাইন (.) এর ভাই আব্বাস সবার আগে এগিয়ে এসে বললেন, 'আমরা তোমাকে একা রেখে নিজ নিজ শহরে ফিরে যাব- এরকম কোনো দিন যেন না আসে।' এরপর মুসলিম ইবনে আওসাজা উঠে বললেন , 'হে নবীর সন্তান! চারদিক দিক থেকে যখন শত্রুরা তোমাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে, তখন আমরা তোমাকে ছেড়ে চলে যাব? আল্লাহর দরবারে আমরা এর কি জবাব দেব? আমরা শহীদ না হওয়া পর্যন্ত তোমার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করে যাব এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়ে যাব।' সাআদ ইবনে আব্দুল্লাহ হানাফি বললেন , হে নবীর সন্তান! আমরা তোমাকে একা ছেড়ে যাব না। আমরা আল্লাহর দরবারে বার্তা পৌঁছাতে চাই যে, প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর পর তোমার সহযোগিতায় থেকে প্রকারান্তরে তাঁকেই আমরা সাহায্য করেছি '
যাহির ইবনে কায়েন বললেন, 'খোদার শপথ, ইচ্ছে করে একবার মরে আবার জীবিত হই, আবার মরে আবার জীবিত হই-এভাবে হাজারবার মরে বেঁচেও চাই নবীজীর খান্দান এবং এই যুবকদের জীবন সকল প্রকার বালা-মুসিবত্থেকে রক্ষা পাক ' কাসেম নামের তেরো বছরের একটি শিশু ইমামের পাশে চিৎকার করে বলল, চাচাজান! আমিও কি এই যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাব? ইমাম তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মৃত্যুকে তুমি কীভাবে চিন্তা করো? কাসেম বলল, 'চাচাজান! আল্লাহর দ্বীনের সহযোগিতা করতে গিয়ে এবং জুলুম-অত্যাচার দূর করতে গিয়ে যেই মৃত্যু তাকে আমি মধুর চেয়ে মিষ্টি বলে মনে করি।'
ইমাম এবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, ভাতিজা আমার,তুমিও শহীদ হবে।একথা শুনে এই কিশোর অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হবার জন্যে গেল। আর ইমাম হোসাইন (.) চাঁদের রূপালি জ্যোত্স্নায় তাঁর সঙ্গী-সাথীদের জন্যে দোয়া করলেন। অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিতে তিনি শত্রুদের শিবিরগুলোর দিকে তাকিয়ে পবিত্র কুরআনের সূরা আল-ইমরানের ১৭৮ এবং ১৭৯ নম্বর আয়াতদুটি তিলাওয়াত করলেনঃ কাফেররা যেন এই চিন্তা না করে যে, তাদের আমরা যে অবকাশ দিয়েছি তা তাদের মঙ্গলের জন্যে। আমরা তাদেরকে অবকাশ দেই এইজন্যে যে, যাতে তারা তাদের গুনাহের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে তোলে,তাদের জন্যে রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি। এটা সম্ভব নয় যে, আল্লাহ মুমিনদেরকে তাদের অবস্থার মধ্যে ফেলে রাখবেন, তবে যে পর্যন্ত না ভালো থেকে মন্দ আলাদা হয়।
কারবালায় গড়ে ওঠা পৃথক দুটি শিবিরের কথা আমরা বলেছি। একটিতে আনন্দ-উল্লাস আর অপরটিতে ইবাদাত-বন্দেগিপূর্ণ এক আধ্যাত্মিক পরিবেশ। এভাবে দিন যাচ্ছে আর ইমামের শত্রু শিবিরে বিভিন্নরকম ঘটনা ঘটছে। ইবনে সাআদের দল যেন অপেক্ষা করতে পারছে না। তারা যতো দ্রুত সম্ভব ঘটনা ঘটিয়ে পুরস্কার গ্রহণের চিন্তায় ব্যস্ত। কিন্তু শত্রুপক্ষীয় মহাবীর হুর ইবনে ইয়াযিদ রিয়াহি হঠাৎ অদ্ভুত এক আচরণ শুরু করে দেয়। সে অবিশ্বাস্যরকমভাবে একবার এদিকে আবার ওদিকে তাকাতে থাকে। ভীষণ এক অস্থিরতা তাকে পেয়ে বসেছে। যেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ভাবছে সে কিংবা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে
হ্যাঁ, একধরনের সন্দেহের দোলাচলে দুলছে সে। একদিকে ইমাম হোসাইন (.) জনগণকে মানবিক মূল্যবোধ রক্ষায় সত্য-ন্যায়ের পতাকাতলে হাতছানি দিয়ে ডাকছে , অপরদিকে তাঁকে হত্যা করার মধ্যে রয়েছে পার্থিব স্বার্থ সিদ্ধির সুবর্ণ সুযোগ। কি করবে না করবে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে ভুগতে হঠাৎ সে চলে যায় কুফার সেনাপতি ওমর ইবনে সাআদের কাছে। হুর তাকে জিজ্ঞেস করে-হে ওমর! তুমি কি সত্যিই হোসাইনের সাথে যুদ্ধ করবে? ওমর জবাব দেয়-হ্যাঁ, খোদার কসম নৃশংসতম যুদ্ধ করব। হুর শিহরিত হলো। তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তার পাশের একজন বলে উঠলো-এই হুর!তোর কী হয়েছে? তোকে কখনো এমন পেরেশান হতে দেখি নি! তোকে তো আমি সবসময় বীর-মহাবীর হিসেবেই দেখেছি। হুর বলল- দোযখ এবং বেহেশতের মধ্য থেকে কোনো একটিকে নির্বাচন করা উচিত। সেই নির্বাচনের মোক্ষম সময় এখন এই বলেই চিত্কার করে উঠল সে-খোদার শপথ! আমাকে টুকরো টুকরো করে ফেললেও বেহেশত ছাড়া অন্য কিছুই আমি বেছে নেব না
কিছুক্ষণ পর কুফার এই মহাবীর কাঁপতে কাঁপতে ধীরে ধীরে ইমাম হোসাইন (.) এর শিবিরের দিকে যায়। অশ্রুসজল চোখে নম্রকণ্ঠে বলে-হে খোদা! তোমার পথে ফিরে এসেছি। আশা করি তুমি আমার তওবা কবুল করবে। হে খোদা! তোমার বন্ধু এবং রাসূলের সন্তানের অন্তরকে আমি সন্ত্রস্ত করেছি, আমার এই মহাপাপ তুমি ক্ষমা করে দিও। এরপর ইমামের সামনে গিয়ে বলল-'হে রাসূলে খোদার সন্তান! তোমার জন্যে আমার জীবন উত্সার্গ হোক। আমি হুর, আমি সেই হুর যে তোমার পথে বাধা সৃষ্টি করেছিল! খোদার কসম, বিশ্বাস করতে পারি নি তোমার সাথে এরকম আচরণ করা হবে। আমি এখন আমার কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত। সেইসাথে আমি এখন তোমার পথে আমার জীবন উত্সির্গ করার জন্যে প্রস্তুত। আল্লাহ কি আমার তওবা কবুল করবেন?
ইমাম অত্যন্ত দয়ার্দ্র কণ্ঠে বললেন, 'হ্যাঁ, আল্লাহ তওবা গ্রহণকারী। আল্লাহর রহমত তোমার ওপর বর্ষিত হোক।
হুর বলল, যুদ্ধের ময়দানে সর্বপ্রথম আমাকে যাবার অনুমতি দিন।
ইমাম তাকে তার ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিলেন। ওমর ইবনে সাআদ ইমামের শিবির লক্ষ্য করে প্রথম তীর নিক্ষেপ করে। তার একাজের সাক্ষীও সে রেখে দেয়। হুর বীরবিক্রমে ইয়াযিদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে থাকেন। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়ে অবশেষে হুর শাহাদাত লাভ করেন।
কারবালায় এরকম আরো 'টি চিত্র আমরা লক্ষ্য করব। যেমন আবেস ইবনে শাবিব শাকেরী। তিনি ইমামের কাছে এসে বলেন, বর্তমান পৃথিবীতে তুমিই আমার কাছে সবচে প্রিয়তম ব্যক্তি। হে পুন্যকারীদের সন্তান! তুমি স্বাক্ষী থাকো, আমি তোমার এবং তোমার নানা মহানবী (সা.) এর পথে আন্তরিকতার সাথে আপন প্রাণ উত্সর্গ করলাম। এই বলে অনুমতি নিয়ে তিনি যুদ্ধে যা। আবেসকে চিনতে পেরে ওমর ইবনে সাআদের পক্ষের একজন বলে উঠলো-আমি যুদ্ধের ময়দানে আবেসের যুদ্ধ কৌশল দেখেছি। সে অত্যন্ত সাহসী এক বীরযোদ্ধা। একথা শুনে ওমর ইবনে সাদ অসংখ্য সেনাকে তার সাথে লড়বার আদেশ দেয়। অবশেষে একাকী সবার সাথে লড়ে শেষ পর্যন্ত তিনিও শাহাদাতবরণ করেন।
ওমর ইবনে সাআদের চাচাতো ভাই হাশেম ইবনে উতবা ইমামের খেদমতে এসে বললেন, আমি আপনার সহযোগিতায় আমার প্রাণ বাজি রেখে এসেছি। ইমাম তাঁর জন্যে দোয়া করলেন। হাশেম যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে হাঁক ছাড়ল- আমি আমার চাচাতো ভাই ওমর ইবনে সাআদ ছাড়া অন্য কারো সাথে লড়তে আসি নি। হে ওমর! তুই কীভাবে দ্বীনের ইমামকে হত্যা করার জন্যে কোমর বেঁধে লেগেছিস? ইমাম নবীজীর সন্তান। কী অদ্ভুত কথা, ফোরাতের পানি রাসূলে খোদার খান্দান ব্যতীত সবার জন্যে উন্মুক্ত করেছিস!
ওমর ইবনে সাআদ চাচাতো ভাই হাশেমের সাথে লড়তে পারবে না জেনে কৌশলে তার মুখোমুখি হওয়া থেকে নিজে বিরত থেকে তার সেনাদেরকে সামনে ঠেলে দেয়। সেনারা চারদিক থেকে হাশেমকে ঘিরে ফেলে নির্মমভাবে হত্যা করে।
ওহাব ইবনে আব্দুল্লাহ তাঁর মা এবং স্ত্রীকে নিয়ে কারবালায় আসে। তার মা তাকে যুদ্ধে যাবার জন্যে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে বল্লেন-বাবা! কিসের অপেক্ষায় আছো। ওঠো, রাসূলে খোদার পরিবারের সমর্থনে এগিয়ে যাও। ওহাব যুদ্ধ করতে করতে দু'হাত হারায়। মা তা দেখে বলে উঠে দাঁড়াও! রাসূলে খোদার হেরেম রক্ষা করো।
ইমাম হোসাইন (.) কাছে এসে বললেন-হে মা! তোমার তাঁবুতে ফিরে যাও। আল্লাহ তোমাকে পুরস্কৃত করবেন এভাবে ইসলাম রক্ষার্থে, নবীজীর সম্মান মর্যাদা রক্ষার্থে, সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধের দায়িত্ব পালনে নির্মমভাবে শাহাদাত্ব রণ করেন ইমাম হোসাইন (.) সহ তাঁর সঙ্গী-সাথীগণ। তাঁদের এই ঐতিহাসিক আত্মদানের মধ্য দিয়ে রচিত হয় ইতিহাসের সবচে নির্মমতম বেদনাঘন মহান আদর্শ। যে মহা আদর্শের নায়ক হলেন নবীজীর প্রিয় সন্তান ইমাম হোসাইন (.) আর প্রতিপক্ষে ছিল ইসলামের ইতিহাসের
সর্বনিকৃষ্ট চরিত্র কাপুরুষ ইয়াযিদ।
এটি এমন একটি অভিশপ্ত নাম যে নামটির উচ্চারণে মুসলমানমাত্রই দ্বিধাগ্রস্ত। পক্ষান্তরে ইমাম হোসাইনের নামের সাথে মিল রেখে মুসলমানরা তাদের সন্তানদের নাম রাখছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত থাকবে। এখানেই সুস্পষ্ট হয়ে যায় সত্য-মিথ্যা। এখানেই সূচিত হয় মুহররম বিপ্লবের বিজয়।
পবিত্র তাসূয়া বা নয়ই মহররম হচ্ছে শহীদগণের নেতা হযরত ইমাম হুসাইন (.)' শাহাদাত লাভের আগের দিবসের বার্ষিকী ইসলাম ধর্মকে ভেতর থেকে নিষ্প্রাণ বিকৃত করার যে প্রক্রিয়া উমাইয়া শাসকরা শুরু করেছিল ইসলামী খেলাফতের আসনে ইয়াজিদের আরোহন ছিল এই বিকৃতিকে পাকাপোক্ত করার চূড়ান্ত ব্যবস্থা। আর সময়ই ইসলামকে চিরতরে বিকৃত করার প্রচেষ্টা নস্যাতের জন্যে এগিয়ে আসেন বিশ্বনবী (সা.)' সুযোগ্য দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (.) একদিকে ইয়াজিদের নেতৃত্ব মেনে নেবার জন্যে প্রবল চাপ অন্যদিকে মুসলমানদের ইমাম হিসেবে তাঁর প্রতি কুফা নগরীর জনগণের ব্যাপক সমর্থন ঘোষণার প্রেক্ষাপটে তিনি জনগণকেইয়াজিদের তাগুতি শাসনের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ করার প্রয়াস পান এবং কুফার দিকে অগ্রসর হন।
কিন্তু ইমাম হোসাইন (.) পথিমধ্যে ইয়াজিদের সশস্ত্র বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বার বার বাধাপ্রাপ্ত হন। অবশেষে কারবালার প্রান্তরে উমর বিন সাদের নেতৃত্বে ইয়াজিদের চার হাজার সেনা ৭২ জন সঙ্গীসহ ইমাম হোসাইন (.) তাঁর পরিবার পরিজনকে হয় ইয়াজিদের আনুগত্য স্বীকার নতুবা যুদ্ধ দুইয়ের যে কোনো একটি পথ বেছে নেয়ার আহ্বান জানায়। ইমাম হোসাইন (.) চূড়ান্ত যুদ্ধের আগে মহান আল্লাহর দরবারে নিবিষ্টচিত্তে শেষবারের মতো নৈশ এবাদতে মশগুল হবার জন্যে একটি দিন সময় চেয়ে নেন। এরপরের ঘটনা সবারই কম-বেশী জানা আছে দশই মহররম তারিখে ইমাম হুসাইন (.) তাঁর ৭২ জন সঙ্গী-সাথী শাহাদত লাভের কথা নিশ্চিত জেনেও বীর বিক্রমে ইয়াজিদের তাগুতী সেনাদের সাথে লড়াই করে শহীদ হন। তাঁদের আত্মত্যাগ ইসলাম মানবতার মর্যাদা রক্ষা করতে সমর্থ হয় এবং তাঁরা ইতিহাসে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাগরণের চিরন্তন প্রতীক ইসলাম ধর্মের প্রকৃত চেতনার রক্ষক হিসেবে অমরত্ব লাভ করেন।
ইমাম হুসাইন (.) তাঁর সঙ্গীদের বীরত্ব পবিত্র খুন ইসলামের চিরসবুজ বৃক্ষে পুণরায় প্রাণের সঞ্চার করে। তাইতো আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বলেছেন,
আঁজলা ভরে আনলো কি প্রাণ
কারবালাতে বীর শহীদান?
হ্যাঁ, ইসলামকে ভেতর থেকে নিষ্প্রাণ করার ষড়যন্ত্র রুখে দেয়া ছাড়াও ইমাম হুসাইন তাঁর সঙ্গীরা প্রাণের অফুরন্ত জোয়ার সৃষ্টি করে গেছেন মুক্তিকামী মানুষের প্রাণপ্রবাহে। ইমাম হুসাইন (.)' বিপ্লব যুগে যুগে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনগুলোর জন্যে আধ্যাত্মিক দিশারী হিসেবে কাজ করছে। ইরানে সংঘটিত ইসলামী বিপ্লবসহ বর্তমান যুগের বিশ্ব-ইসলামী জাগরণও এর ব্যতিক্রম নয়। একইসাথে কারবালার শহীদানদের আত্মত্যাগ শাহাদতের সংস্কৃতিকে দিয়েছে সর্বোচ্চ মহিমা সাফল্যের প্রাণস্পর্শ
এছাড়াও কারবালার বীরত্ব গাঁথার প্রতিটি পরতে খুঁজে পাওয়া যায় পবিত্র কুরআনের আলোকোজ্জ্বল শিক্ষার প্রাণবন্ত ছোঁয়া। আলোকোজ্জ্বল্যে চিরভাস্বর সেইসব কিছু দিক আমরা এখন তুলে ধরার চেষ্টা করব। পবিত্র কুরআন মানুষকে সৌভাগ্য মর্যাদা পবিত্রতার দিকে আহ্বান করে আর এজন্যেই কুরআন মানুষকে আহ্বান জানায় অন্যায় দূর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। ইমাম হুসাইন (.) পবিত্র কুরআনের শিক্ষার আলোকেই এটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে মানুষ যেন কোনো অবস্থাতেই জালেম দূর্নীতিবাজ শাসকদেরকে মানুষের স্বাধীনতা, সম্মান মর্যাদা ক্ষুন্ন করার অনুমতি না দেয়। ইমাম হোসাইন (.) কারবালার বিপ্লবের মাধ্যমে মানুষের হারিয়ে যাওয়া সম্মান মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিলেন এবং তাতে সফল হয়েছিলেন বলেই তাঁর বিপ্লব যুগ স্থানের গন্ডী পেরিয়ে কালোত্তীর্ণ চিরন্তন মর্যাদা লাভ করেছে।
ঠিক কারণেই পবিত্র মদীনা শহরে ইয়াজিদের প্রতিনিধি যখন ইমাম হুসাইন (.)কে ইয়াজিদের আনুগত্য স্বীকারের আহ্বান জানায় তখন তিনি পবিত্র কুরআনের সুরা আহযাবের ৩৩ নম্বর আয়াত তেলাওয়াত করে শুনিয়ে দেন যাতে খেলাফতের ওপর নবী বংশের অধিকার এবং বনি উমাইয়াদের শাসনের আইনগত ভিত্তিহীনতা ফুটে উঠে আয়াতে বলা হয়েছে, হে নবী পরিবার বা রাসূলের আহলে বাইত, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তো চাচ্ছেন তোমাদের হতে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণ পবিত্র রাখতে
সত্যের পথে নির্ভিক থাকা একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করা পবিত্র কুরআনের আরেকটি শিক্ষা। ইমাম হুসাইন (.) এমন সময় ইয়াজিদের তাগুতি শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়য়েছিলেন যখন তত্কা লীন সমাজের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ইয়াজিদের ভয়ে সন্ত্রস্ত ছিলেন। এমনকি তারা ইয়াজিদের মোকাবেলা না করতে সংগ্রামে নেমে বেঘোরে প্রাণ না দিতে ইমাম হুসাইন (.)কে পরামর্শও দিয়েছিলেন। কিন্তু ইমাম তাঁর লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল পুরোপুরি আস্থাশীল। তিনি তথাকথিত শান্তিকামীদের উদ্দেশ্যে পবিত্র কুরআনের সুরা হুদের বাণী উচ্চারণ করেছিলেন, আমি আমার সাধ্যমত সংস্কার করতে চাই, আমার কার্যসাধন আল্লাহরই সাহায্যে, আমি তাঁরই উপর নির্ভর করি এবং আমি তাঁরই অভিমুখী
ইমাম হুসাইন ইয়াজিদের স্বৈর তাগুতি শাসন মেনে নিতে অস্বীকার করে যখন বিপ্লবী উদ্দেশ্য নিয়ে মদীনা ত্যাগ করেন তখন তাঁর অবস্থা ছিল অনেকটা সূরা কাসাসে বর্ণিত ২১ নম্বর আয়াতের মতো। আয়াতে বলা হয়েছে,  ‘মূসা বলল, হে আমার প্রতিপালক তুমি জালেম সম্প্রদায়ের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করো। '
পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে সম্মান মর্যাদা শুধু ঈমানদারদেরই প্রাপ্য এবং সসম্মানে মৃত্যুবরণ করা অমরত্বেরই নামান্তর। অন্যদিকে কুরআন অবমাননা লাঞ্ছনার কাছে নতি স্বীকার করাকে পর্যায়ক্রমিক মৃত্যু বলে মনে করে। আর এজন্যেই পবিত্র কুরআনের নীতির ভিত্তিতেই ইমাম হুসাইন (.) বলেছিলেন, অপমান আমাদের স্পর্শ করতে পারে না। সূরা মুনাফিকুনের অষ্টম আয়াতেও বলা হয়েছে, সম্মান একমাত্র আল্লাহ, তাঁর রাসূল (সা.) বিশ্বাসী বা মুমিনদের জন্যে নির্ধারিত।
যে কোনো সমাজে শান্তি সমৃদ্ধির প্রধান শর্ত হলো দূর্নীতি অন্যায়ের প্রতিরোধ এবং সৎ কাজের বিস্তার। পবিত্র কুরআনের সমাজে দৃষ্টিতে সৎ কাজের উত্সা অসৎ কাজের নির্দেশ না থাকলে তা দূর্নীতি এবং ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়
ইমাম হোসাইন (.) কারণেই কারবালার মহাজাগরণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ইয়াজিদের বাহিনীকে অপবিত্রতার দৃষ্টান্ত বলে মনে করতেন এবং নিজ কন্যার কাছে ইয়াজিদী শক্তির পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে সুরা মুজাদিলার ১৯ নম্বর আয়াত তেলাওয়াত করেছেন। আয়াতে বলা হয়েছে, শয়তান তাদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে এবং শয়তান তাদের মন থেকে আল্লাহর স্মরণ ভুলিয়ে দিয়েছে।
ইমাম হোসাইন (.)' বিপ্লবের আরো একটি বড় দিক হলো ধর্মের পুণরুজ্জীবন, নামাজ আধ্যাত্মিক মূল্যবোধগুলোর বিকাশ বা বিস্তৃতি। ইমাম হোসাইন (.)' অনুসারীরা জিহাদের পাশাপাশি প্রার্থনা, নামাজ মহান আল্লাহর ওপর ভরসার ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। ইমাম হুসাইন (.) তাঁর সঙ্গীরা সব সময়ই, এমনকি আশুরার দিনে তুমুল সংঘাতের সময়ও জামাতে নামাজ আদায় করেছেন। আশুরার রাত থেকে সূর্য্য উদয় পর্যন্ত তাঁরা নামাজ, দোয়া, তওবা পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতে মশগুল ছিলেন।
যারা আল্লাহর পথে নির্ভিক হাসিমুখে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে জীবন বিলিয়ে দেয়, পবিত্র কোরান তাঁদেরকে বেহেশতে সুসংবাদ দেয় এবং তাঁদেরকে আল্লাহর মনোনীত বিশেষ বান্দা বলে ঘোষণা করেছে। ইমাম হুসাইন (.) তাঁর সঙ্গীদরকে বেহেশতের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন এবং তাঁদেরকে শ্রেষ্ঠ সঙ্গী বলে অভিহিত করেছিলেন।
শাহাদতের অমিয় সুধা পানের জন্যে ব্যাকুল ইমাম তাঁর সঙ্গী এমনকি তাঁর কিশোর পুত্র এবং ভাতিজার কাছেও আল্লাহর পথে শাহাদত ছিল মধুর চেয়েও মিষ্টি। আর কারণেই বলা যায়, কারবালার বিপ্লব মুসলিম সমাজের শিরায় শিরায় যুগে যুগে সঞ্চারিত করেছে হাজারো শক্তির প্রাণময় প্রবাহ যা অফুরন্ত চিরপ্রবর্ধমান।

No comments:

Post a Comment

 
back to top