Thursday, 23 June 2016

ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের পটভূমি ও বিস্তারিত বর্ণনা

0 Comments
ইসলামের স্মরণীয় যুদ্ধগুলোর মধ্যে বদর অন্যতম। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবিরা মুসলমানদের কাছে পরবর্তীকালে বিশেষ মর্যাদা পেয়েছিলেন। এ কারণেই যে কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় সাক্ষী উপস্থাপনের ক্ষেত্রে পক্ষগুলো নিজ নিজ দাবির যথার্থতা বুঝাতে কতজন বদরী সাহাবী তাদের সঙ্গে রয়েছেন তার উল্লেখ করত। রাসূল (সা.)-এর জীবনীতে বদরে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের ‘ বদরী’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
পটভূমি:
দ্বিতীয় হিজরীর জমাদিউল আউয়াল মাসের মাঝামাঝি মদীনায় খবর পৌঁছায় আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মক্কা থেকে সিরিয়ায় বাণিজ্য কাফেলা যাত্রা করেছে। মহানবী (সা.) এ কাফেলাকে ধরার জন্য জাতুল উশাইরা পর্যন্ত গমন করেন ও পরবর্তী মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করেন। কিন্তু ঐ কাফেলার সন্ধান পান নি। কাফেলাটি প্রত্যাবর্তনের সময় শরতের প্রথম দিক নির্দিষ্ট ছিল। কারণ সাধারণত এ সময়েই সিরিয়া থেকে মক্কায় কাফেলাসমূহ ফিরে আসে। যে কোন যুদ্ধে তথ্য হলো জয়ের প্রথম পদক্ষেপ। যদি যুদ্ধের সেনাপতি শত্রুর ক্ষমতা,অবস্থান ও মানসিক অবস্থা সম্পর্কে সঠিকভাবে না জানে তবে যুদ্ধের প্রথমেই পরাস্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
ইসলামের নবীর যুদ্ধকৌশলের প্রশংসিত ও লক্ষণীয় একটি দিক হলো- যার প্রমাণ প্রতিটি যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ থেকে আমরা পাই- শত্রুর অবস্থান ও প্রস্তুতি সম্পর্কে অগ্রিম তথ্য সংগ্রহ। তথ্য সংগ্রহের বিষয়টি বৃহৎ ও ক্ষুদ্র সকল যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ।
আল্লামা মাজলিসীর৪৫১ বর্ণনা মতে রাসূল (সা.) আদী নামের এক সাহাবীকে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করেন।‘হায়াতে মুহাম্মদ’ এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ অনুযায়ী মহানবী কুরাইশ কাফেলার যাত্রাপথ, প্রহরীর সংখ্যা ও আনীত পণ্যের ধরন সম্পর্কে জানার জন্য তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ্ ও সাঈদ ইবনে যাইদকে প্রেরণ করেছিলেন। তাঁদের আনীত তথ্য নিম্নরূপ ছিল :
১. কাফেলাটি বেশ বড় এবং মক্কার সব গোত্রের লোকই তাতে রয়েছে।
২. কাফেলার নেতৃত্বে রয়েছে আবু সুফিয়ান এবং ৪০ জন প্রহরী ও রক্ষী তাদের সঙ্গে রয়েছে।
৩. এক হাজার উট মাল বহন করে নিয়ে আসছে যার মূল্য পঞ্চাশ হাজার দিনারের সমপরিমাণ।
যেহেতু মদীনার মুহাজির মুসলমানদের বিপুল সম্পদ মক্কার কুরাইশদের হাতে অবরুদ্ধ (ক্রোক) হয়েছিল সেহেতু মুসলমানদের জন্য কুরাইশদের বাণিজ্য পণ্য অবরোধের প্রয়োজন ছিল। যদি কুরাইশরা মুসলমানদের সম্পদ অবরোধ অব্যাহত রাখে তবে মুসলমানরাও স্বাভাবিকভাবে কুরাইশদের বাণিজ্য পণ্য অবরোধ করে গনীমত হিসাবে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেবে। এ লক্ষ্য নিয়েই রাসূল (সা.) সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেন,
هذا غير قريش فيها أموالهم فاخرجوا إليها لعل الله يغنمكموها
“ হে লোকসকল! কুরাইশ কাফেলা নিকটেই। তাদের সম্পদ হাতে পেতে মদীনা থেকে বেরিয়ে যাও। এতে তোমাদের অর্থনৈতিক অসুবিধা দূর হবে।”
মহানবী (সা.) আবদুল্লাহ্ ইবনে উম্মে মাকতুমকে মদীনার মসজিদে ইমামতির এবং আবু লাবাবাকে মদীনার সার্বিক দায়িত্ব দান করে দ্বিতীয় হিজরীর রমজান মাসের ৮ তারিখে তিনশ’ তের জন সঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে কুরাইশদের সম্পদ আটক করার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে বের হলেন।
যাফরান নামক স্থানের দিকে মহানবীর যাত্রা
সংবাদদাতাদের প্রেরিত বার্তা পেয়ে মহানবী (সা.) হিজরী বর্ষের দ্বিতীয় সালের রমজান মাসের আট তারিখ সোমবার কুরাইশ কাফেলার উদ্দেশ্যে যাফরানের দিকে যাত্রা করেন। তিনি আলী ইবনে আবি তালিব ও মুসআবের হাতে পৃথক দু’ টি পতাকা প্রদান করেন। প্রেরিত সেনাদলে বিরাশি জন মুহাজির, খাজরাজ গোত্রের একশ’ সতের জন এবং একষট্টি জন আওস গোত্রের লোক ছিলেন। সেনাদলে মাত্র তিনটি ঘোড়া ও সত্তরটি উট ছিল।
ইসলামের সে যুগে মুসলিম সমাজে আত্মত্যাগ ও শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা এতটা তীব্র ছিল যে, অনেক অপ্রাপ্তবয়স্ক বালকও সে যুদ্ধে অংশগ্রহণের আগ্রহ ব্যক্ত করেছিল; কিন্তু রাসূল (সা.) তাদেরকে মদীনায় ফিরিয়ে দেন।
মহানবী (সা.)-এর কথা হতে আগেই বোঝা গিয়েছিল, এ অভিযান মুসলমানদের জীবনে কিছুটা স্বস্তি ও অর্থনৈতিক মুক্তির সুযোগ এনে দেবে। কুরাইশরা যেসব সম্পদ মক্কায় বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল তা-ই মুসলমানদের আশার উপকরণ ছিল। মুসলমানরা তা কব্জা করার উদ্দেশ্যেই মদীনা থেকে বের হয়েছিল। এ কাজের বৈধতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, কুরাইশরা মক্কায় মুসলমানদের সমগ্র সম্পদ ক্রোক করেছিল এবং তাদের মক্কায় যাতায়াতের পথরোধ করেছিল। ফলে তারা তাদের জীবন নির্বাহের উপকরণ হতে বঞ্চিত ছিল। স্পষ্ট যে, যে কোন জ্ঞানসম্পন্ন মানুষই বলবেন শত্রুর সঙ্গে সেরূপ আচরণই করা উচিত যেরূপ আচরণ সে তার প্রতিপক্ষের সঙ্গে করেছে।
প্রকৃতপক্ষে কুরাইশদের কাফেলাগুলোর ওপর মুসলমানদের আক্রমণের কারণ মুসলমানদের প্রতি তাদের নির্যাতনমূলক আচরণ যা কোরআনও উল্লেখ করেছে এবং মুসলমানদের এ আক্রমণের অনুমতি দিয়ে বলেছে :
 أذن للّذين يُقاتلون بأنّهم ظُلموا و أنّ الله على نصرهم لقدير
“ যাদের প্রতি আক্রমণ করা হয়েছে তাদের প্রতিরোধের অনুমতি দেয়া হলো। কারণ তারা নির্যাতিত হয়েছে এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাদের সাহায্য করতে পূর্ণ ক্ষমতাবান।”
আবু সুফিয়ান সিরিয়ার দিকে যাত্রার পূর্বেই জেনেছিল যে,মহানবী (সা.) তাদের কাফেলাকে পশ্চাদ্ধাবন করতে পারেন। এ কারণেই সে প্রত্যাবর্তনের পথে সতর্কতা অবলম্বনের লক্ষ্যে যে কাফেলারই মুখোমুখি হতো প্রশ্ন করত মুহাম্মদ (সা.) কাফেলার পথ রুদ্ধ করে রেখেছেন কি না? যখন তার কাছে বার্তা পৌঁছল মহানবী (সা.) সঙ্গীদের সঙ্গে নিয়ে মদীনা হতে বেরিয়ে এসেছেন ও কুরাইশ কাফেলার পশ্চাদ্ধাবনের মনোবৃত্তিতে বদর প্রান্তরের নিকটবর্তী যাফরানে ছাউনী ফেলেছেন তখন সে কাফেলা নিয়ে অগ্রসর হতে নিবৃত্ত হয়ে কুরাইশদের এ বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করাকে অধিকতর যুক্তিযুক্ত মনে করল। সে দামদাম (জামজাম) ইবনে আমর গিফারী নামক এক দ্রুতগামী উটচালককে ভাড়া করে নির্দেশ দিল মক্কায় পৌঁছে মক্কার সাহসী কুরাইশ বীরদের ও কাফেলার সঙ্গে যাদের সম্পর্ক রয়েছে তাদের জানাও তারা যেন মুসলমানদের হাত থেকে কুরাইশ কাফেলাকে বাঁচাতে মক্কা থেকে এখানে এসে পৌঁছায়।
দামদাম দ্রুত মক্কায় পৌঁছে আবু সুফিয়ানের নির্দেশ অনুযায়ী নিজ উষ্ট্রের কান কেটে ও নাক ছিদ্র করে, তার পিঠে বসবার স্থানটি বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে অগ্র ও পশ্চাৎ ছিন্ন করে বলল,“ হে মক্কার অধিবাসিগণ! তোমাদের বাণিজ্য পণ্য বহনকারী উটগুলো আক্রান্ত হয়েছে। মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীরা তোমাদের পণ্য লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছে। তোমাদের পণ্য তোমাদের হাতে পৌঁছবে বলে মনে হয় না, দ্রুত কুরাইশ কাফেলার সাহায্যে এগিয়ে এস।”
উষ্ট্রের কান ও নাক হতে অঝোরে রক্ত ঝরছিল। উটের এ করুণ অবস্থাদৃষ্টে এবং দামদামের মর্মস্পর্শী বক্তব্য ও সাহায্যের আহ্বানে মক্কার অধিবাসীদের রক্ত উষ্ণ হয়ে উঠল। সকল যোদ্ধা ও সাহসী পুরুষ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে মক্কা থেকে বের হলো। মক্কার প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে শুধু আবু লাহাব এ দলটির সঙ্গে আসেনি, তবে সে আস ইবনে হিশাম নামে এক ব্যক্তিকে তার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য চার হাজার দিরহাম দিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য রাজী করায়।
কুরাইশ গোত্রপতিদের মধ্যে উমাইয়্যা ইবনে খালাফ বিশেষ কারণে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাচ্ছিল না। কারণ সে শুনেছিল মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, সে মুসলমানদের হাতে নিহত হবে। কুরাইশ গোত্রপ্রধানরা দেখল এরূপ ব্যক্তিত্ব যদি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে তবে নিশ্চিতভাবে তাতে কুরাইশদের ক্ষতি ও মর্যাদাহানি হবে। উমাইয়্যা ইবনে খালাফকে যুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে কুরাইশরা দু’ ব্যক্তিকে (যারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে বের হচ্ছিল) উমাইয়্যার কাছে পাঠায়। সে যখন কুরাইশদের কাছে বসেছিল তখন এ দু’ ব্যক্তি একটি ট্রেতে সুরমাদানি নিয়ে তার কাছে উপস্থিত হয়ে বলে,“ হে উমাইয়্যা! যখন তুমি নিজ গোত্র ও ভূমির সম্ভ্রম রক্ষা ও বাণিজ্য পণ্য উদ্ধারের কাজ হতে বিরত থেকে নারীদের মত ঘরের কোণে বসে যুদ্ধ এড়িয়ে চলার নীতি গ্রহণ করেছ তখন নারীদের মত এ সুরমা চোখে দিয়ে তাদের সঙ্গেই বসে থাক, কুরাইশ বীর যোদ্ধাদের তালিকা হতে নিজের নাম উঠিয়ে নাও।”
এরূপ আক্রমণাত্মক কথা উমাইয়্যাকে এতটা উত্তেজিত করল যে, সে অবচেতনভাবেই যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়ে কুরাইশ কাফেলার সঙ্গে বাণিজ্য পণ্য উদ্ধারের লক্ষ্যে রওয়ানা হলো।
কুরাইশ যে সমস্যার মুখোমুখি হলো
যাত্রার সময় নির্ধারিত হলো। কুরাইশ গোত্রপ্রধানরা বুঝতে পারল মুসলমানদের পূর্বেই বনি বকর গোত্রের মতো কঠিন শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং পশ্চাৎ দিক থেকে তাদের আক্রমণের শিকার হতে পারে। কারণ বনি বকরের সঙ্গে কুরাইশদের রক্তের শত্রুতা ছিল। এ ঘটনাটি ইবনে হিশাম তাঁর সিরাত গ্রন্থে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। বনি বকর গোত্রের প্রসিদ্ধ ব্যক্তি সুরাকা ইবনে মালিক এ সময় তাদের কাছে এসে নিশ্চয়তা দান করল যে, এমন কিছু ঘটার কোন সম্ভাবনা নেই এবং কুরাইশরা নিশ্চিত মনে মক্কা হতে বেরিয়ে যেতে পারবে।
মহানবী (সা.) কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলাকে অবরোধ করার লক্ষ্যে মদীনা থেকে বের হয়েছিলেন এবং যাফরান নামক স্থানে অবস্থান নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বাণিজ্য কাফেলার আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন। এ সময় হঠাৎ করে নতুন খবর এসে পৌঁছাল যা ইসলামের সৈনিকদের চিন্তা-চেতনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাল এবং তাদের জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। মহানবীর কাছে সংবাদ পৌঁছেছিল যে, মক্কাবাসীরা তাদের বাণিজ্য কাফেলাকে রক্ষার উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে বের হয়েছে এবং আশেপাশেই অবস্থান গ্রহণ করেছে। মক্কার সব গোত্রই এ সৈন্যদলে অংশগ্রহণ করেছে। মুসলমানদের মহান নেতা দু’ পথের মাঝে নিজেকে লক্ষ্য করলেন। একদিকে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা বাণিজ্যপণ্য অবরোধের উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে বের হয়েছিলেন এবং এ কারণে মক্কা থেকে আগত বড় একটি সেনাদলের মুখোমুখি হওয়ার উপযুক্ত প্রস্তুতি তাঁদের ছিল না; লোকবল এবং যুদ্ধাস্ত্র উভয় ক্ষেত্রেই তাঁদের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। অন্যদিকে যে পথে তাঁরা মদীনা থেকে বের হয়েছিলেন সে পথেই যদি পুনরায় মদীনায় ফিরে যেতেন তবে এতদিন পরিচালিত বিভিন্ন সামরিক মহড়াগুলোর ফলে অর্জিত মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হতো। হয়তো এর ফলে শত্রুরা দুঃসাহস দেখিয়ে আরো অগ্রসর হয়ে ইসলামের কেন্দ্র মদীনাতেও আক্রমণ করে বসত। তাই মহানবী (সা.) পশ্চাদপসরণকে উপযুক্ত মনে করলেন না, বরং যেটুকু শক্তি রয়েছে তা নিয়েই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিরোধ করাই সমীচীন মনে করলেন।
অন্য যে বিষয়টি এখানে লক্ষণীয় ছিল তা হলো মদীনা থেকে আগত সেনাদলের অধিকাংশই ছিলেন আনসার যুবক। তাঁদের মধ্যে শুধু ৭৪ জন মুহাজির ছিলেন। তদুপরি মহানবী (সা.) আকাবায় আনসারদের সঙ্গে যে চুক্তি করেছিলেন তা ছিল প্রতিরক্ষামূলক- আক্রমণাত্মক নয়। তাই তাঁরা মদীনার বাইরে তাঁর শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন এমন কোন প্রতিশ্রুতি সেখানে ছিল না। এমন মুহূর্তে মুসলিম সেনাদলের সর্বাধিনায়ক কি করলেন? তিনি সামরিক পরামর্শ সভার আহবান ছাড়া আর কোন পথ খুঁজে পেলেন না। এভাবে তিনি মতামত জানার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চিন্তা করলেন।
সামরিক পরামর্শ সভা
তিনি দাঁড়িয়ে সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন,“ এ বিষয়ে তোমাদের মত কি?” সর্বপ্রথম (প্রথম খলিফা) আবু বকর দাঁড়িয়ে বললেন,“কুরাইশদের সম্ভ্রান্ত সাহসী ব্যক্তিরা মক্কা থেকে আগত সেনাদলে অংশগ্রহণ করছে। কুরাইশ কখনই অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ করেনি এবং তাদের সম্মানিত স্থান থেকে নিচে নেমে অপমানকে গ্রহণ করেনি। অন্যদিকে আমরা মদীনা থেকে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে আসি নি।” --(অর্থাৎ যুদ্ধ না করার মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে এবং মদীনায় ফিরে যাওয়াই উত্তম।) রাসূল (সা.) তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন,“ বসুন।” এরপর (দ্বিতীয় খলিফা) হযরত উমর দাঁড়িয়ে হযরত আবু বকরের কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। রাসূল তাঁকেও বসার নির্দেশ দিলেন। তখন হযরত মিকদাদ (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন,“ হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের অন্তর আপনার সঙ্গে। আল্লাহ্ আপনাকে যা নির্দেশ দিয়েছেন আপনি তারই অনুসরণ করুন। মহান আল্লাহর শপথ,কখনই আমরা আপনাকে সেরূপ কথা বলব না যেরূপ কথা বনি ইসরাইল হযরত মূসাকে বলেছিলেন। যখন হযরত মূসা (আ.) বনি ইসরাইলকে জিহাদের আহবান জানিয়েছিলেন তখন তারা হযরত মূসাকে বলেছিল : হে মূসা! তুমি ও তোমার প্রভু তাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর এবং আমরা এখানেই বসে থাকব। কিন্তু আমরা এর বিপরীতে আপনাকে বলব : আপনি আপনার প্রতিপালকের অনুগ্রহের ছায়ায় জিহাদ করুন এবং আমরাও আপনার অনুগত হয়ে আপনার অধীনে যুদ্ধ করব।”  ০মহানবী (সা.) মিকদাদের এ কথায় অত্যন্ত খুশী হলেন এবং তাঁর জন্য মহান আল্লাহর নিকট বিশেষভাবে দোয়া করলেন।
ইবনে হিশাম, মাকরিযী এবং তাবারী তাঁদের ইতিহাস গ্রন্থসমূহে মহানবীর সামরিক পরামর্শ সভার ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন।
তাবারী হযরত আবদুল্লহ্ ইবনে মাসউদের নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন,“ বদরের দিন আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল মিকদাদের অবস্থানে যদি আমি অবস্থান নিতে পারতাম। কারণ তিনি বিরূপ এক পরিবেশে বলেছিলেন : আমরা কখনই বনি ইসরাইল জাতির মতো আপনাকে (মহানবীকে) বলব না যে,আপনি ও আপনার প্রভু গিয়ে যুদ্ধ করুন এবং আমরা এখানে বসে রইলাম। যখন মহানবীর চেহারা ক্রোধে রক্তিম হয়ে গিয়েছিল তখন হযরত মিকদাদ এমন কথা বলেছিলেন যাতে মহানবীর চেহারা আনন্দে উদ্ভাসিত হয়েছিল। তাই আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল ঐ ইপ্সিত অবস্থানটি যদি আমি অর্জন করতে পারতাম!”  তাই বোঝা যায়, মিকদাদের পূর্বে শায়খাইন আতঙ্ক ও হতাশার বাণী শুনিয়েছিলেন ও মদীনায় ফিরে যাওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছিলেন।
এটি ছিল একটি পরামর্শ সভা। তাই সভায় উপস্থিত প্রত্যেকেরই নিজস্ব মত প্রকাশের অধিকার ছিল।
পরামর্শ সভার সিদ্ধান্ত ও আনসার দলপতির মত
যে মতগুলো এতক্ষণ উপস্থাপিত হয়েছে তা ব্যক্তিগত মত হিসাবেই প্রণিধানযোগ্য। মূলত পরামর্শ সভার লক্ষ্য ছিল আনসারদের মত জানা। যতক্ষণ আনসাররা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিবে ততক্ষণ ছোট কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণও সম্ভব ছিল না। এতক্ষণ মতামত দানকারী ব্যক্তিবর্গের সকলেই ছিলেন মুহাজির। এ কারণেই মহানবী (সা.) আনসারদের মত নেয়ার জন্য তাঁর কথার পুনরাবৃত্তি করে বললেন,“ তোমরা তোমাদের মত প্রদান কর।”
সা’ দ ইবনে মায়ায আনসারী দাঁড়িয়ে বললেন,“ আপনি কি আমাদের মত চাচ্ছেন?” রাসূল বললেন,“ হ্যাঁ।” মায়ায বললেন,“ হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনার ওপর ঈমান এনেছি। আমরা সাক্ষ্য দিয়েছি আপনার আনীত ধর্ম সত্য। এ বিষয়ে আমরা আপনার সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধও হয়েছি। তাই আপনি যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, আমরা তারই অনুসরণ করব। সেই আল্লাহর শপথ ,যিনি আপনাকে নবী হিসাবে প্রেরণ করেছেন। যদি আপনি সমুদ্রেও প্রবেশ করেন (লোহিত সাগরের দিকে ইশারা করে) তবে আমরাও আপনার পশ্চাতে তাতে প্রবেশ করব। আমাদের এক ব্যক্তিও আপনার অবাধ্য হবে না। আমরা শত্রুর মুখোমুখি হতে কুণ্ঠিত নই। আত্মত্যাগের ক্ষেত্রে আমরা এতটা প্রমাণ করব যে, এতে আপনার চক্ষু উজ্জ্বল হবে। আপনি আল্লাহর নির্দেশে আমাদের যেখানেই যেতে বলবেন, আমরা যেতে প্রস্তুত।”
সা’ দের এ বক্তব্য মহানবীর অন্তরে প্রফুল্লতা বয়ে আনল এবং তাঁর সত্য ও লক্ষ্যের পথে দৃঢ়তা এবং জীবনসঞ্চারক আশার বাণী হতাশা ও শঙ্কার কালো ছায়াকে দূরীভূত করল।
সত্যের এ সাহসী সৈনিকের বক্তব্য এতটা উদ্দীপক ছিল যে, মহানবী (সা.) সাথে সাথে যাত্রার নির্দেশ দিয়ে বললেন,
“ যাত্রা শুরু কর। তোমাদের জন্য সুসংবাদ, হয় তোমরা কাফেলার মুখোমুখি হবে ও তাদের সম্পদ ক্রোক করবে, নতুবা কাফেলার সাহায্যে এগিয়ে আসা দলের মুখোমুখি হয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। আমি কুরাইশদের নিহত হওয়ার স্থানটি দেখতে পাচ্ছি,তাদের ভয়ঙ্কর ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।”
মুসলিম সেনাদল নবীর পশ্চাতে যাত্রা শুরু করল এবং বদরের প্রান্তরে পানির আধারের কাছে ছাউনী ফেলল।
শত্রুর সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ
যদিও বর্তমানে সামরিক নীতি ও যুদ্ধকৌশলের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে ও পূর্ববর্তী সময় থেকে তার পার্থক্য স্পষ্ট তদুপরি এখনও শত্রুর অবস্থা, যুদ্ধকৌশল, সামরিক শক্তি ও অন্যান্য গোপন তথ্য সম্পর্কে অবগত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা পূর্বের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধে জয়লাভের জন্য এ সকল তথ্য এখনও মৌলিক বলে বিবেচিত। অবশ্য বর্তমানে তথ্য সংগ্রহের এ জ্ঞানটি সামরিক শিক্ষাদানের অন্যতম পাঠ্যের রূপ নিয়েছে এবং গোয়েন্দাবৃত্তির জন্য বিশেষ ক্লাস ও পাঠ্যসূচী প্রণীত হয়েছে। বর্তমানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ব্লকের দেশগুলোর সামরিক অবস্থান তাদের গোয়েন্দা সংস্থার বিস্তৃতির ওপর নির্ভরশীল মনে করে। কারণ গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমেই তারা শত্রুর সম্ভাব্য শক্তি ও যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে পূর্বে অবহিত হয়ে তাদের পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হবে বলে বিশ্বাস করে।
এ কারণেই মুসলিম সেনাবাহিনী এমন এক স্থানে অবস্থান নিল যাতে করে এ মৌলনীতি সংরক্ষিত হয় এবং কোনরূপেই যেন গোপন তথ্যসমূহ প্রকাশিত না হয়। অন্যদিকে একদল সংবাদ বাহককে কুরাইশ সেনাদল ও বাণিজ্য কাফেলা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য নিয়োগ করা হলো। প্রেরিত সংবাদ বাহকরা তথ্যসমূহ নিম্নরূপ পদ্ধতিতে হস্তগত করেছিল :
১. প্রথম দলে স্বয়ং নবী (সা.) ছিলেন। তিনি একজন সেনাকে সঙ্গে নিয়ে কিছু পথ অগ্রসর হয়ে একজন গোত্রপ্রধানের সাক্ষাৎ পেলেন এবং তাকে প্রশ্ন করলেন,“ কুরাইশ এবং মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীদের সম্পর্কে আপনি কোন তথ্য জানেন কি?”
সে বলল,“ আমার নিকট খবর পৌঁছেছে যে, মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীরা অমুক দিন মদীনা থেকে বের হয়েছে। যদি এ খবরটি সত্য হয়,তবে তারা অমুক স্থানে অবস্থান নিয়েছে (সে এমন স্থানের নাম বলল রাসূল ও তাঁর সঙ্গীরা ঠিক সেখানে অবস্থান নিয়েছিলেন)। কুরাইশরাও অমুক দিন মক্কা থেকে যাত্রা করেছে বলে আমরা খবর পেয়েছি। যদি এ খবরটিও সঠিক হয় তবে কুরাইশ অমুক স্থানে অবস্থান নিয়েছে (এ ক্ষেত্রে সে কুরাইশদের অবস্থান নেয়া স্থানের নামই উল্লেখ করল।)
২. যুবাইর ইবনে আওয়াম, সা’ দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ও আরো কিছু সঙ্গী হযরত আলীর নেতৃত্বে বদরের কূপের কাছাকাছি স্থানে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রেরিত হয়েছিল। এ স্থানটি তথ্য সংগ্রহের জন্য আনাগোনার স্থান হিসাবে সংবাদ বাহকদের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। প্রেরিত দলটি কূপের কাছে কুরাইশদের দু’ জন দাসের সাক্ষাৎ লাভ করল। তাঁরা তাদের বন্দী করে রাসূল (সা.)-এর কাছে আনেন। এ দুই দাস কুরাইশের দু’ গোত্র বনি হাজ্জাজ ও বনি আ’সের পক্ষ থেকে কুরাইশদের জন্য পানি নেয়ার উদ্দেশ্যে কূপের কাছে এসেছিল।
রাসূল (সা.) তাদেরকে কুরাইশদের অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তারা জানায় পর্বতের পশ্চাতের সমতল ভূমিতে তারা অবস্থান নিয়েছে। তাদের সংখ্যা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তাদের সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে তারা অবগত নয় বলে জানাল। মহানবী (সা.) প্রশ্ন করলেন,“ প্রতিদিন তারা খাদ্যের জন্য কতটি উট জবাই করে।” তারা বলল,“ কোন দিন দশটি, কোন দিন নয়টি।” মহানবী ধারণা করলেন তাদের সংখ্যা নয়শ’ থেকে এক হাজার। এরপর তাদের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কারা এসেছে প্রশ্ন করলে জানায়, উতবা ইবনে রাবীয়া, শাইবা ইবনে রাবীয়া, আবুল বাখতারি ইবনে হিশাম, আবু জাহল ইবনে হিশাম, হাকিম ইবনে হাজাম,উমাইয়্যা ইবনে খালাফ প্রমুখ তাদের মধ্যে রয়েছে। এ সময় রাসূল (সা.) সাহাবীদের উদ্দেশে বললেন,
هذه مكّة قد القت اليكم افلاذ كبدها
“ মক্কা শহর তার কলিজার টুকরোগুলোকে বের করে দিয়েছে।”
এরপর তিনি এ দু’ ব্যক্তিকে বন্দী রাখার নির্দেশ দিয়ে তথ্য সংগ্রহ অভিযান অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিলেন।
৩. দু’ ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেয়া হলো বদর প্রান্তে গিয়ে কুরাইশ কাফেলা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়ার। তাঁরা একটি কূপের কাছাকাছি স্থানে অবতরণ করে পানি পানের উদ্দেশ্যে এসেছেন এমন ভান করে কূপের কাছে পৌঁছলেন। সেখানে দু’ নারীর সাক্ষাৎ লাভ করলেন যারা পরস্পর কথা বলছিল। তাদের একজন আরেক জনকে বলছিল,“ আমার প্রয়োজন আছে জেনেও কেন আমার ধার পরিশোধ করছ না?” অন্যজন বলল,“ কাল অথবা পরশু বাণিজ্য কাফেলা এসে পৌঁছবে। আমি কাফেলার জন্য শ্রম দিয়ে তোমার অর্থ পরিশোধ করব।” মাজদি ইবনে আমর নামক এক ব্যক্তি এ দু’ নারীর নিকট দাঁড়িয়েছিল। সেও ঋণগ্রস্ত মহিলার কথাকে সমর্থন করে বলল,“ কাফেলা দু’ এক দিনের মধ্যেই এসে পৌঁছবে।”
সংবাদ বাহক দু’ ব্যক্তি এ কথা শুনে আনন্দিত হলেন, তবে সাবধানতা ও গোপনীয়তা বজায় রেখে ফিরে এলেন এবং রাসূল (সা.)-কে তথ্যটি অবহিত করলেন। যখন মহানবী কুরাইশদের অবস্থান ও বাণিজ্যিক কাফেলার আগমন সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য পেলেন তখন প্রয়োজনীয় প্রাথমিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন।
আবু সুফিয়ানের পলায়ন
কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলাপ্রধান আবু সুফিয়ান কাফেলা নিয়ে সিরিয়া গমনের সময় একদল মুসলমান কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছিল। তাই সে ভালোভাবে জানত যে,ফিরে আসার সময় অবশ্যই মুসলমানদের দ্বারা আক্রান্ত হবে। এ কারণেই সে মুসলমানদের আয়ত্তাধীন এলাকায় প্রবেশের পরপরই তার কাফেলাকে এক স্থানে বিশ্রাম নিতে বলে স্বয়ং তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বদর এলাকায় প্রবেশ করে। সেখানে সে মাজদি ইবনে আমরের সাক্ষাৎ পেল। তাকে সে প্রশ্ন করল,“ অত্র এলাকায় সন্দেহভাজন কোন ব্যক্তিকে দেখেছ কি?” সে বলল,“ সন্দেহ হতে পারে এমন কিছু দেখি নি দুই উষ্ট্রারোহীকে কূপের নিকট অবতরণ করে পানি পান করে চলে যেতে দেখেছি।” আবু সুফিয়ান কূপের নিকট এসে উষ্ট্রের বসার স্থানটিতে উষ্ট্রের মল পড়ে থাকতে দেখল। সে মলগুলোকে আঘাত করে ভেঙে দেখল তাতে খেজুরের বীজ রয়েছে। সে বুঝতে পারল উটগুলো মদীনা থেকে এসেছে। সে দ্রুত কাফেলার নিকট ফিরে এসে কাফেলাকে মুসলমানদের আয়ত্তাধীন এলাকা থেকে দ্রুত বেরিয়ে যাবার নির্দেশ দিল এবং কাফেলার পথকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিল। অতঃপর সে কুরাইশদের কাছে বার্তা পাঠাল যে, কাফেলা মুসলমানদের অধীন এলাকা থেকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে গেছে এবং কুরাইশ সেনাদল যেন যে পথে এসেছে সে পথে মক্কায় ফিরে যায়। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে উপযুক্ত শিক্ষাদানের দায়িত্বটি যেন আরবদের ওপর ছেড়ে দেয়।
কুরাইশ কাফেলার পরিত্রাণ লাভের ঘটনা সম্পর্কে মুসলমানদের তথ্য লাভ
কুরাইশ কাফেলার পলায়নের ঘটনাটি মুসলমানদের কাছে পৌঁছলে যেসব ব্যক্তি বাণিজ্য পণ্য লাভের নেশায় বুঁদ হয়েছিল তারা বেশ অসন্তুষ্ট হলো। তখন মহান আল্লাহ্ তাদের অন্তরকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করলেন :
 و إذا يعدكم الله إحدى الطائفتين أنّها لكم و توّدون أنّ غير ذات الشوكة تكون لكم و يريد الله أن يحقّ الحقّ بكلماته و يقطع دابر الكافرين
“ স্মরণ কর ঐ মুহূর্তকে যখন আল্লাহ্ দু’ টি দলের একটিকে মুখোমুখি হওয়ার সুসংবাদ তোমাদের দিলেন এবং তোমরা অমর্যাদার দলটির (বাণিজ্য কাফেলা) মুখোমুখি হওয়ার আশা করছিলে; অন্যদিকে আল্লাহ্ চেয়েছেন সত্যকে পৃথিবীর ওপর সুদৃঢ় করতে এবং কাফির দলের মূলোৎপাটন করতে।”
কুরাইশদের মতদ্বৈততা
যখন আবু সুফিয়ানের প্রেরিত ব্যক্তি কুরাইশ সেনাদলের কাছে তার বার্তা নিয়ে পৌঁছল তখন এ নিয়ে কুরাইশদের মধ্যে ব্যাপক মতদ্বৈততা সৃষ্টি হলো। বনি যোহরা ও আখনাস ইবনে শারীক তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ পক্ষসগুলোকে নিয়ে প্রাঙ্গন ত্যাগ করল। কারণ তাদের ভাষ্য ছিল : আমরা বনি যোহরা গোত্রের বাণিজ্য পণ্যগুলো রক্ষার উদ্দেশ্যে এখানে এসেছিলাম। সে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। হযরত আবু তালিবের পুত্র তালিব, যিনি বাধ্য হয়ে কুরাইশদের সঙ্গে এসেছিলেন তিনিও কুরাইশদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার পর মক্কায় ফিরে গেলেন।
আবু জাহল আবু সুফিয়ানের মতের বিপরীতে নাছোড়বান্দা হয়ে বলল,“ আমরা বদর প্রান্তে তিন দিনের জন্য অবস্থান নেব। সেখানে উট জবাই করে, শরাব পান করে ও গায়িকাদের গান শুনে কাটাব। সে সাথে আমাদের শক্তির মহড়া প্রদর্শন করব যাতে করে সকল আরব আমাদের শক্তি সম্পর্কে অবহিত হয় এবং চিরকাল তা স্মরণ রাখে।”
আবু জাহলের মনভোলানো কথায় প্ররোচিত হযে কুরাইশরা বদর প্রান্তরের দিকে ধাবিত হয়ে একটি উঁচু টিলার পশ্চাতে উঁচু সমতল ভূমিতে গিয়ে অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। অবশ্য সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি হওয়ায় কুরাইশদের চলাচলই মুশকিল হয়ে পড়ল ও তারা আরো অগ্রসর হওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে ঐ টিলা থেকে একটু দূরেই অবস্থান নিতে বাধ্য হলো।
অন্যদিকে মহানবী (সা.) বদরের যে প্রান্তে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন সেখানে বৃষ্টির কোন নেতিবাচক প্রভাব ছিল না। এ প্রান্তটি‘ উদওয়াতুদ দুনিয়া’ নামে প্রসিদ্ধ।
বদর অঞ্চলটি একটি বিস্তৃত ভূমি যার দক্ষিণ প্রান্ত উঁচু ও‘ উদওয়াতুল কাছওয়া’ নামে পরিচিত এবং উত্তর প্রান্তটি নিচু ও ঢালু। এ প্রান্তটি‘ উদওয়াতুদ দুনিয়া’ নামে পরিচিত। এ বিস্তৃত ভূমিতে বিভিন্ন ধরনের কূপ থাকার কারণে পর্যাপ্ত পানির সরবরাহ ছিল এবং সব সময় কাফেলাসমূহ এ স্থানে অবতরণ করে বিশ্রাম নিত।
হাব্বাব ইবনে মুনযার নামক এক মুসলিম সেনাপতি রাসূল (সা.)- কে বললেন,“ হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আল্লাহর নির্দেশে এখানে অবস্থান নিয়েছেন নাকি এ স্থানে অবস্থান গ্রহণ যুদ্ধের জন্য উপযোগী মনে করে অবস্থান করছেন?” মহানবী (সা.) বললেন,“ এ বিষয়ে বিশেষ কোন নির্দেশ অবতীর্ণ হয় নি। যদি তোমার মতে অন্য কোন স্থান এটি হতে উপযোগী হয় তা বলতে পার। যদি যুদ্ধের জন্য অধিকতর উপযোগী স্থান পাওয়া যায়,আমরা সেখানে স্থানান্তরিত হব।”
হাব্বাব বললেন,“ আমরা শত্রুর নিকটবর্তী পানির কিনারে অবস্থান নিলে ভালো হবে। সেখানে বড় চৌবাচ্চা তৈরি করলে আমাদের এবং চতুষ্পদ প্রাণীগুলোরও সার্বক্ষণিক পানির ব্যবস্থা হবে।” মহানবী (সা.) তাঁর কথা পছন্দ করলেন এবং সকলকে ঐ স্থানের দিকে যাত্রার নির্দেশ দিলেন। এ ঘটনাটি প্রমাণ করে যে,রাসূল সামাজিক বিষয়ে সব সময় জনমত ও সার্বিক পরামর্শের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।
নেতৃত্ব মঞ্চ
সা’ দ ইবনে মায়ায মহানবী (সা.)-এর নিকট প্রস্তাব করলেন,“ আপনার জন্য উঁচু টিলার ওপর তাঁবু তৈরি করি যেখান থেকে সমগ্র প্রাঙ্গণের ওপর আপনি দৃষ্টি রাখতে পারবেন। তদুপরি আপনার জন্য কয়েকজন রক্ষী নিয়োজিত করি যাতে করে তারা আপনার নিরাপত্তার প্রতি লক্ষ্য রাখতে পারে এবং আপনার নির্দেশসমূহ যুদ্ধে নিয়োজিত সেনাপতিদের নিকট পৌঁছাতে পারে।
সর্বোপরি যদি এ যুদ্ধে মুসলমানগণ জয়ী হন তবে তো কথাই নেই। আর যদি পরাজিত হন ও সকলে নিহত হন,হে নবী! আপনি দ্রুতগামী উটের সাহায্যে মদীনার দিকে রওয়ানা হয়ে যাবেন। আপনার দেহরক্ষী সৈন্যরা কৌশল অবলম্বন করে যুদ্ধের গতিকে শিথিল করে দিয়ে শত্রুর অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করবে এবং এ সুযোগে আপনি মদীনায় পৌঁছে যাবেন। মদীনায় অনেক মুসলমান রয়েছেন যাঁরা আমাদের অবস্থা সম্পর্কে অনবগত। যখন তাঁরা আমাদের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হবে তখন আপনাকে পূর্ণরূপে সহায়তা দেবে এবং আপনার সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করবে।
মহানবী (সা.) সা’ দ ইবনে মায়াযের জন্য দোয়া করলেন এবং নির্দেশ দিলেন তাঁর জন্য টিলার ওপর নিরাপত্তা তাঁবু স্থাপন করার যাতে করে সমগ্র প্রাঙ্গণের অবস্থার ওপর দৃষ্টি রাখতে পারেন। মহানবী (সা.)-এর কথা অনুযায়ী নেতৃত্ব মঞ্চ স্থানান্তরিত করা হলো।
নিরাপদ নেতৃত্ব মঞ্চের ওপর দৃষ্টিপাত
মহানবী (সা.)-এ জন্য নিরাপদ নেতৃত্ব মঞ্চ প্রস্তুত ও সা’ দ ইবনে মায়ায ও অন্যান্য আনসার যুবক কর্তৃক তাঁর প্রহরার বিষয়টি তাবারী ইবনে ইসহাক থেকে বর্ণনা করেছেন এবং অন্যরাও তাঁর অনুসরণে তা তাঁদের ইতিহাস গ্রন্থে এনেছেন। কিন্তু নিম্নোক্ত যুক্তিসমূহের ভিত্তিতে বলা যায় যে,এ বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রথমত এ বিষয়টি সৈন্যদের মনোবলকে নিঃসন্দেহে কমিয়ে দেবে এবং তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যদি কোন সেনানায়ক শুধু নিজের জীবন ও নিরাপত্তার কথাই চিন্তা করেন তাঁর অনুগত সেনাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেন না,সেরূপ সেনানায়ক তাঁর অনুগত সেনাদের প্রভাবিত করতে সক্ষম নন।
দ্বিতীয়ত এ কাজটি মহানবী (সা.) কর্তৃক প্রাপ্ত ঐশী আয়াতে উল্লিখিত সুসংবাদের সঙ্গে মোটেও সামঞ্জস্যশীল নয়। তিনি কুরাইশদের মুখোমুখি হওয়ার পূর্বেই তাঁর সঙ্গীদের সুসংবাদ দিয়ে বলেছিলেন,“ স্মরণ কর যখন আল্লাহ্ তোমাদের নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি দান করলেন যে,দুই দলের (বাণিজ্য কাফেলা ও কুরাইশদের সাহায্যকারী দলের) একদলের মুখোমুখি হওয়ার যাতে তোমাদেরই জয় হবে।”
তাবারীর মতে এরূপ সুসংবাদ পাওয়ার পরও যখন বাণিজ্য কাফেলা হাতছাড়া হয়েছিল ও সাহায্যকারী দলটি সামনে উপস্থিত হয়েছিল তখন মহানবী (সা.)-এর জন্য নিরাপদ নেতৃত্ব মঞ্চ তৈরি হয়েছিল। এ সুসংবাদ মতে মুসলমানরা বিজয়ী হবেন এ কথা আগেই জেনেছিলেন। তাই পরাজিত হওয়ার শঙ্কা তাঁদের ছিল না এবং সে আশংকায় নবী (সা.)-এর জন্য নিরাপত্তা মঞ্চ তৈরি ও দ্রুতগামী উট প্রস্তুত রাখার বিষয়টি অর্থহীন ছিল।
ইবনে সা’ দ তাঁর তাবাকাত গ্রন্থে হযরত উমর ইবনে খাত্তাবের নিকট হতে বর্ণনা করেছেন,“ যখন নিম্নোক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয় এবং একটি দলের পরাজয়ের কথা বলা হয় তখন আমি মনে মনে বললাম : এ আয়াতটিকে কোন্ দলের পরাজয়ের কথা বলা হয়েছে? বদর যুদ্ধের দিন দেখলাম রাসূল (সা.) যুদ্ধের পোশাক পরিধান করেছেন ও জোশের সঙ্গে এ আয়াতটি পড়ছেন। তখন বুঝতে পারলাম আমাদের প্রতিপক্ষ এ দলের পরাজয়ের কথাই এতে বলা হয়েছে।”
ইতিহাসের এ অংশটি লক্ষ্য করেও কি আমরা মহানবী (সা.) ও মুসলমানদের অন্তরে পরাজয়ের শঙ্কা ছিল বলে মনে করব?
তৃতীয়ত হযরত আলী (আ.) যুদ্ধক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর যে রূপ বর্ণনা করেছেন তার সঙ্গে এ কৌশলটি সংগতিশীল নয়। তিনি হযরত মুহাম্মদ সম্পর্কে বলেছেন,“ যুদ্ধক্ষেত্রে যখনই যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ লাভ করত আমরা মহানবীর পশ্চাতে আশ্রয় গ্রহণ করতাম। তখন কোন ব্যক্তিই মহানবী (সা.) হতে শত্রুর নিকটবর্তী থাকত না।” যে ব্যক্তির অবস্থাকে তাঁর প্রথম ছাত্র এভাবে বর্ণনা করেন তাঁর সম্পর্কে কিরূপে আমরা এ সম্ভাবনার কথা বলব যে,তিনি মুসলমানদের প্রথম যুদ্ধে রক্ষণাত্মক ও পলায়নের কৌশল গ্রহণ করেছিলেন।
তাই আমরা ধরে নিতে পারি,নেতৃত্ব মঞ্চটি নিরাপত্তার দৃষ্টিতে নয়,বরং নেতৃত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করেই প্রস্তুত করা হয়েছিল যাতে করে তিনি সমগ্র রণক্ষেত্রের ওপর দৃষ্টি রাখতে পারেন। কারণ যদি সমরনায়ক সমগ্র রণক্ষেত্রের ওপর নজর রাখতে না পারেন তাহলে তাঁর পক্ষে যুদ্ধকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
কুরাইশ গোত্রের কার্যক্রম
দ্বিতীয় হিজরীর রমযান মাসের সতের তারিখের সকালে কুরাইশগণ টিলার ওপর হতে বদরের সমতল প্রান্তরে নেমে আসে। যখন মহানবী (সা.) তাদেরকে টিলার ওপর হতে নিচে নামতে দেখলেন তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন,“ হে আল্লাহ্! আপনি জানেন কুরাইশরা অহংকার ও গর্বের সাথে আপনার দীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছে,তারা আপনার রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। হে প্রভু! আমাকে সাহায্যের যে প্রতিশ্রুতি আপনি দিয়েছেন তা কার্যকরী করুন ও আমার শত্রুদের আজ ধ্বংস করুন।”
কুরাইশদের পরামর্শ সভা
কুরাইশরা বদর এলাকার এক প্রান্তে অবস্থান নিলেও মুসলমানদের সংখ্যা ও শক্তি সম্পর্কে অবহিত ছিল না। তাই মুসলমানদের সৈন্য-সংখ্যা সম্পর্কে অবগত হওয়ার উদ্দেশ্যে কোন সমাবেশের লোকসংখ্যা নির্ণয়ে অভিজ্ঞ উমাইর ইবনে ওয়াহাব নামের এক সাহসী ব্যক্তিকে প্রেরণ করল। সে একটি অশ্বে আরোহণ করে মুসলমানদের সেনা-ছাউনীর চারিদিকে ঘুরে এসে জানাল তাদের সংখ্যা প্রায় তিনশ’ । তবে সে এও বলল,আরো একবার ঘুরে দেখে আসা উত্তম,কেননা হতে পারে পেছনে অন্য কেউ লুকিয়ে আছে অথবা কোন সাহায্যকারী দল অবস্থান নিয়ে থাকতে পারে।
সে সমগ্র বদর প্রান্তরে একবার ভালোভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে আতঙ্কজনক খবর আনয়ন করল। সে বলল,“মুসলমানদের পেছনে কোন আশ্রয়স্থল নেই,কিন্তু তোমাদের জন্য মদীনা হতে আগত মৃত্যুর বার্তা বহনকারী উটসমূহকে আমি দেখেছি।” অতঃপর বলল,“ মুসলমানদের এক দলকে দেখলাম তাদের তরবারি ছাড়া আর কোন আশ্রয়স্থল নেই। তাদের প্রত্যেকে তোমাদের এক ব্যক্তিকে হত্যা না করা পর্যন্ত নিহত হবে না। যদি তারা তোমাদের হতে তাদের সমসংখ্যক ব্যক্তিকে হত্যা করে তবে তোমাদের জীবনের মূল্য কি? চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে ভেবে দেখ।”
ওয়াকেদী ও আল্লামা মাজলিসী তার বক্তব্যে নিম্নোক্ত কথাগুলোও ছিল বলে উল্লেখ করেছেন:“ তোমরা কি লক্ষ্য করেছ তারা নীরব ও কোন কথা বলছে না,কিন্তু তাদের ইচ্ছাশক্তি ও দৃঢ়তা তাদের চেহারায় স্পষ্ট। তারা বিষাক্ত সাপের মতো জিহ্বাকে মুখের চারিদিকে আবর্তন করাচ্ছে ও ছোবল হানার জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে।”
কুরাইশরা দু’ দলে বিভক্ত
এই সাহসী বিচক্ষণ সৈনিকের কথা কুরাইশদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলল। আতঙ্ক ও ত্রাস সমগ্র সেনাদলকে আচ্ছন্ন করল। হাকিম ইবনে হাজাম উতবার নিকট গিয়ে বলল,“ উতবা! তুমি কুরাইশদের নেতা। কুরাইশ তাদের বাণিজ্য-পণ্য রক্ষার জন্য মক্কা থেকে এসেছিল। তাদের বাণিজ্য-পণ্য রক্ষা হয়েছে। তাদের অবস্থানও পূর্ণরূপে সুরক্ষিত। এ অবস্থায় হাদরামীর (হাজরামীর) হত্যা ও রক্তপণ এবং মুসলিমদের মাধ্যমে তার সম্পদ লুণ্ঠন ব্যতীত আর কোন সমস্যা নেই। তাই তোমরা হাদরামীর রক্তপণ নিজেরাই আদায় করে মুহাম্মদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত হও।” হাকিমের বক্তব্য উতবার ওপর আশ্চর্য প্রভাব ফেলল। সে দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশে আকর্ষণীয় বক্তব্যে বলল,“ হে লোকসকল! তোমরা মুহাম্মদের ব্যাপারটি আরবদের ওপর ছেড়ে দাও। যখন আরবরা তার আনীত ধর্মের মূলোৎপাটন করবে ও তার শক্তির ভিতকে উপড়ে ফেলবে তখন আমরাও তার হাত থেকে মুক্তি পাব। আর যদি মুহাম্মদ সফলও হয় সে আমাদের কোন ক্ষতি করবে না। কারণ আমরা আমাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তার সঙ্গে যুদ্ধ না করে ফিরে যাব। উত্তম হলো আমরা যে পথে এসেছি সে পথে ফিরে যাই।”
হাকিম উতবার কথাটি আবু জাহলকে জানাল। সে সময় আবু জাহল যুদ্ধের বর্ম পরিধান করছিল। উতবার কথা শুনে সে খুবই রাগান্বিত হলো। সে এক ব্যক্তিকে হাদরামীর ভ্রাতা আমের হাদরামীর নিকট পাঠিয়ে জানাল,“ যখন তুমি তোমার ভ্রাতার রক্ত ঝরতে দেখছ তখন তোমার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ উতবা জনতাকে তোমার ভাইয়ের রক্তের বদলা নিতে বিরত থাকার আহবান জানাচ্ছে। তাই কুরাইশদেরকে তোমার ভ্রাতার রক্তের বদলা নেয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা স্মরণ করিয়ে দাও ও তোমার ভ্রাতার মৃত্যুর জন্য মর্সিয়া পড়।”
আবু আমের তার মাথাকে অনাবৃত করে সাহায্যের আহবান জানিয়ে আর্তনাদ করে বলল,“ হায় আমের! হায় আমের!”
আবু আমেরের আর্তনাদ ও মর্সিয়া কুরাইশদের ধমনীতে আত্মসম্মানবোধের শোণিতধারা প্রবাহিত করল। তারা যুদ্ধের জন্য সংকল্পবদ্ধ হলো। উতবার আহবান তাদের জোশে স্তিমিত হয়ে গেল। এমনকি গোত্রপ্রীতি ও সম্মানবোধের এ সার্বিক অনুভূতি উতবাকেও প্রভাবিত করল। সেও উজ্জীবিত হয়ে যুদ্ধের পোশাক পরিধান করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো।
কখনো কখনো যে,ভিত্তিহীন উত্তেজনা ও অনুভূতি চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির আলোকে নির্বাপিত করে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশাকে নস্যাৎ করে দেয় এটি তার একটি দৃষ্টান্ত। যে ব্যক্তি কিছুক্ষণ পূর্বেও শান্তি ও সমঝোতাপূর্ণ সহাবস্থানের আহবান জানাচ্ছিল,সেই গোত্রপ্রীতির গোঁড়ামির অনুভূতিতে সাড়া দিয়ে যুদ্ধের ময়দানে অগ্রগামী হলো।
যে ঘটনা যুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলল
আসওয়াদ মাখযুমী একজন রুক্ষ মেজাজের লোক ছিল। তার দৃষ্টি যখন মুসলমানদের নির্মিত হাউজের (চৌবাচ্চা) ওপর পড়ল সে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিল এ হাউজ থেকে পানি পান করার অথবা সেটি নষ্ট করার। এজন্য সে প্রাণ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত ছিল না। তাই মুশরিকদের ছাউনি থেকে বেরিয়ে সে হাউজের নিকটে এল। সে সময় ইসলামের মহান সৈনিক হযরত হামযাহ্ (রা.) সেখানে প্রহরারত ছিলেন। সে পানির নিকট পৌঁছে তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে রত হলে তিনি তরবারির এক আঘাতে তার এক পা বিচ্ছিন্ন করলেন। এ অবস্থায়ই সে তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে পানির দিকে অগ্রসর হলে হযরত হামযাহ্ সেখানে তাকে হত্যা করলেন।
এ ঘটনাটি যুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলল। কারণ কোন দলকে যুদ্ধে উদ্দীপিত করার জন্য হত্যা অপেক্ষা উত্তম কোন ইস্যু থাকতে পারে না। কুরাইশদের যে দলটির অন্তরে বিদ্বেষের আগুন জ্বলছিল ও যুদ্ধের জন্য বাহানা খুঁজছিল এজন্য উত্তম বাহানা হাতে পেল। এরূপ অস্ত্র হাতে পেয়ে তারা যুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলল।
মল্লযুদ্ধের শুরু
আরবের প্রাচীন যুদ্ধরীতি ছিল মল্লযুদ্ধের মাধ্যমে শুরু হওয়া। অতঃপর সম্মিলিত যুদ্ধ শুরু হতো।
আসওয়াদ মাখযুমী নিহত হওয়ার পর কুরাইশের তিন প্রসিদ্ধ বীর সামনে এগিয়ে এসে মুসলমানদের উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল। এরা তিনজন হলো রাবীয়ার পুত্র উতবা ও শাইবা এবং উতবার পুত্র ওয়ালিদ। সুসজ্জিত এ তিন বীর। এরা যুদ্ধের ময়দানের মাঝে অশ্বের পদশব্দ তুলে প্রতিদ্বন্দ্বী আহবান করল। আনসারদের মধ্য হতে তিন সাহসী যুবক আওফ,সাউয ও আবদুল্লাহ্ ইবনে রাওয়াহা মুসলমানদের সৈন্য-ছত্র হতে বেরিয়ে এসে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। কিন্তু উতবা যেহেতু জানত এরা মদীনার আনসার সেহেতু তাদের উদ্দেশে বলল,“ তোমাদের সঙ্গে আমাদের কোন কাজ নেই।”
অতঃপর এক ব্যক্তি চিৎকার করে বলল,“ হে মুহাম্মদ! আমাদের সমমর্যাদার ও সমগোত্রীয় কোন ব্যক্তিকে প্রেরণ কর।” রাসূল (সা.) উবাইদাহ্ ইবনে হারেস ইবনে আবদুল মুত্তালিব,হামযাহ্ এবং আলীকে সামনে এগিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন। এ তিন সাহসী বীর নিজ মুখমণ্ডল আবৃত করে সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং নিজ নিজ পরিচয় দান করলেন। উতবা এ তিন ব্যক্তিকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে গ্রহণ করে বলল,“ তোমরা আমাদের সমকক্ষ।”
কেউ কেউ বলেছেন,এ মল্লযুদ্ধে প্রত্যেকে তাঁর সমবয়সীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। সবচেয়ে তরুণ আলী (আ.) মুয়াবিয়ার মামা ওয়ালিদের সঙ্গে,মধ্যবয়সী হামযাহ্ মুয়াবিয়ার নানা উতবার সঙ্গে এবং বৃদ্ধ উবাইদাহ্ শাইবার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। অবশ্য ইবনে হিশাম শাইবাকে হযরত হামযার এবং উতবাকে হযরত উবাইদার প্রতিদ্বন্দ্বী বলেছেন। এখন আমরা দেখব কোন্ মতটি সঠিক। দু’ টি বিষয়কে বিশ্লেষণ করলে সত্য আমাদের নিকট স্পষ্ট হবে।
প্রথমত ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন,আলী ও হামযাহ্ তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বীকে প্রথম আক্রমণেই পরাস্ত করতে সক্ষম হন। তাঁরা তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যার পরই উবাইদার সাহায্যে এগিয়ে যান ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করেন।
দ্বিতীয়ত আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) মুয়াবিয়ার প্রতি প্রেরিত তাঁর পত্রে বলেছেন,

و عندی السّیف الّذی اعضضته بجدّک و خالک و أخیک فی مقام واحد
“ আমার নিকট সেই তরবারি রয়েছে যার দ্বারা তোমার নানা (হিন্দার পিতা উতবা),মামা (ওয়ালিদ ইবনে উতবা) এবং ভ্রাতাকে (হানযালা ইবনে আবি সুফিয়ান)-কে হত্যা করেছি। আমি এখনও সেই রূপ শক্তির অধিকারী।”
এ পত্র হতে স্পষ্ট যে,হযরত আলী (আ.) মুয়াবিয়ার নানা উতবার হত্যায় অংশগ্রহণ করেছেন। অন্যদিকে আমরা জানি হযরত আলী ও হামযাহ্ তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বীকে কোন প্রতি-আক্রমণের সুযোগ না দিয়েই হত্যা করেছিলেন।
যদি উতবা হযরত হামযার প্রতিদ্বন্দ্বী হতো তবে হযরত আলী বলতেন না,‘ আমি তরবারির আঘাতে তোমার নানাকে হত্যা করেছি’ । সুতরাং স্পষ্ট যে,হযরত হামযার প্রতিদ্বন্দ্বী শাইবা ছিল এবং হযরত উবাইদার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল উতবা। তাই হযরত আলী ও হামযাহ্ স্বীয় প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যার পর উতবাকে হত্যায় অংশ নিয়েছিলেন।
সম্মিলিত আক্রমণ শুরু হলো
কুরাইশদের প্রসিদ্ধ যোদ্ধারা পরাস্ত হলে সম্মিলিত যুদ্ধ শুরু হলো। মহানবী (সা.) তাঁর নেতৃত্বের স্থান হতে নির্দেশ দিলেন মুসলিম যোদ্ধারা যেন সম্মিলিত যুদ্ধ শুরুর পূর্বে মুশরিকদের অগ্রাভিযান প্রতিরোধ করতে শত্রুদের উদ্দেশে তীর নিক্ষেপ করে।
অতঃপর নেতৃত্ব মঞ্চ হতে নিচে নেমে এসে সৈন্যদলকে বিন্যস্ত করলেন। এ সময় সাওয়াদ ইবনে আজিয়া সেনাসারি হতে এগিয়ে এলে মহানবী (সা.) তাঁর ছড়ি দিয়ে তাঁর পেটে মৃদু আঘাত করলেন ও তাঁকে পিছিয়ে যাওয়ার আদেশ দিলেন। সাওয়াদ রাসূলের উদ্দেশে বললেন,“ আপনি অন্যায়ভাবে আমাকে আঘাত করেছেন,আমি এর কিসাস চাই।” মহানবী (সা.) মুহূর্ত বিলম্ব না করে স্বীয় জামা উঠিয়ে প্রতিশোধ নিতে বললেন। সৈন্যদল আশ্চর্য হয়ে মহানবীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। সাওয়াদ তাঁর পবিত্র বুকে চুম্বন করলেন এবং ঘাড়ে হাত রেখে বললেন,“ আমার শেষ জীবন পর্যন্ত আপনার বুকে চুম্বন করতে চাই।”
অতঃপর মহানবী (সা.) তাঁর নেতৃত্ব মঞ্চের স্থানে ফিরে এসে পূর্ণ ঈমানসহ মহান আল্লাহর উদ্দেশে বললেন,“হে প্রভু! যদি এ দলটি আজকে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় তবে পৃথিবীর বুকে আপনার ইবাদাত করার মতো কেউ থাকবে না।”
সম্মিলিত আক্রমণের ঘটনাটি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যসহকারে ইতিহাস গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে। তাতে এ বিষয়টি নিশ্চিত যে,মহানবী (সা.) নেতৃত্ব মঞ্চ হতে অনেক বারই নিচে নেমে এসেছেন এবং মুসলমানদেরকে আল্লাহর পথে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন। একবার তিনি মুসলমানদের উদ্দেশে উচ্চৈঃস্বরে বলেছেন,

و الذی نفس محمّد بیده لا یقاتلهم الیوم رجل فیقتل صابرا محتسبا مقبلا غیر مدبر إلّا ادخله الله الجنة
“ সেই আল্লাহর শপথ,যার হাতে আমার (মুহাম্মদের) প্রাণ নিবদ্ধ,আজকের দিনে যে ব্যক্তি ধৈর্যের সাথে আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করে নিহত হবে,আল্লাহ্ তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন।”
সমরনায়কের এরূপ বক্তব্যে সৈন্যরা কেউ কেউ এতটা অনুপ্রাণিত হলেন যে,দ্রুত শহীদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় স্বীয় বর্ম খুলে রেখে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। উমাইর ইবনে হিমাম রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন,“ আমার নিকট থেকে বেহেশতের দূরত্ব কতটুকু?” রাসূল বললেন,“ কাফিরদের নেতাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পরিমাণ।” তাঁর হাতে কয়েক টুকরা খেজুর ছিল যা তিনি দূরে নিক্ষেপ করলেন এবং যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। অতঃপর মহানবী (সা.) এক মুঠো মাটি নিয়ে কাফিরদের উদ্দেশে নিক্ষেপ করে বললেন,“ তোমাদের মুখমণ্ডলসমূহ বিকৃত হোক!” এরপর সম্মিলিত আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে মুসলমানদের শিবিরে জয়ের আভাস লক্ষ্য করা গেল। শত্রুরা সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হয়ে পালাতে শুরু করল। যেহেতু মুসলিম সেনারা ঈমানের বলে বলীয়ান ছিলেন এবং তাঁরা জানতেন হত্যা করা এবং নিহত হওয়া উভয়ই তাঁদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে তাই কোন কিছুতেই তাঁরা ভীত ছিলেন না এবং কোন কিছুই তাঁদের অগ্রযাত্রাকে রহিত করতে পারছিল না।
অধিকার রক্ষা
দু’ ধরনের ব্যক্তির অধিকার রক্ষার প্রতি দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন ছিল;তাদের একদল হলো সেই সমস্ত ব্যক্তি যারা মক্কায় অবস্থানকালীন সময় মুসলমানদের প্রতি সদাচরণ করেছিল ও পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছিল,যেমন আবুল বাখতারী- যে মুসলমানদের ওপর আরোপিত অবরোধ তুলে নেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। অপর দল হলো সেই সকল ব্যক্তি যারা ইসলাম ও মহানবী (সা.)-এর প্রতি অন্তর হতে ভালোবাসা প্রদর্শন করত এবং তাঁদের শুভাকাঙ্ক্ষী ছিল,কিন্তু কুরাইশদের সাথে রণাঙ্গনে আসতে বাধ্য হয়েছিল। যেমন রাসূলের চাচা আব্বাসের মতো বনি হাশিমের কিছু সংখ্যক ব্যক্তি।
যেহেতু ইসলামের নবী রহমত ও অনুগ্রহের আধার ছিলেন সেহেতু এ দু’ ধরনের ব্যক্তির রক্ত ঝরানো হতে নিবৃত থাকতে বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ
এ যুদ্ধে ১৪ জন মুসলমান ও ৭০ জন কাফির নিহত হয় এবং ৭০ জন মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়। বন্দীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নাদার (নাজার) ইবনে হারেস,উকবা ইবনে আবি মুয়ীত,আবু গাররাহ্,সুহাইল ইবনে আমর,আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব এবং আবুল আস।
বদর যুদ্ধের শহীদদেরকে রণক্ষেত্রের এক প্রান্তে সমাধিস্থ করা হয়েছিল যা এখনও বিদ্যমান। রাসূল (সা.) কুরাইশদের মৃতদেহগুলোকে একস্থানে জমায়েত করে একটি কূপে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দিলেন। যখন ওকবার মৃতদেহ টেনে-হিঁচড়ে কূপের দিকের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন তার পুত্র আবু হুযাইফা তা লক্ষ্য করে বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। মহানবী (সা.) তা বুঝতে পেরে বললেন,“ তোমার মনে কোন প্রকার সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে কি?” তিনি বললেন,“ না,তবে আমি আমার পিতাকে জ্ঞানী, ধৈর্যশীল ও সম্মানার্হ ব্যক্তি হিসাবে জানতাম এবং সব সময় ভাবতাম এ বিষয়গুলো তাকে ইসলামের দিকে পরিচালিত করবে। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি আমার ধারণা ভুল ছিল।”
তোমরা তাদের চেয়ে বেশি শ্রবণকারী নও
বদরের যুদ্ধের অবসান ঘটল এবং কুরাইশরা চরমভাবে পরাস্ত হলো। তাদের মধ্যে ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন বন্দী হয়েছিল,বাকীরা রণক্ষেত্র হতে পালিয়ে গিয়েছিল। তাদের মৃতদেহগুলোকে রাসূলের নির্দেশে একটি বড় কূপে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। যখন তাদের মৃতদেহগুলোকে কূপে নিক্ষেপ করা হলো মহানবী (সা.) একে একে তাদের নাম ধরে ডেকে বললেন,“ হে উতবা,শাইবা,উমাইর,আবু জাহল... তোমরা কি তোমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তাকে সত্য হিসাবে পেয়েছ? (জেনে রাখ) আমি আমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত প্রতিশ্রুতি সত্য হিসাবে পেয়েছি।” এ সময় মুসলমানদের মধ্য থেকে কেউ কেউ রাসূলকে প্রশ্ন করলেন,“ যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদেরকে লক্ষ্য করে কি আপনি কথা বলছেন?” রাসূল (সা.) বললেন,“ তোমরা তাদের থেকে অধিকতর শ্রবণকারী নও, কিন্তু তাদের উত্তর দানের ক্ষমতা নেই।”
ইবনে হিশাম বর্ণনা করেছেন,এ সময় রাসূল (সা.) তাদের (মৃতদের) উদ্দেশে আরো বলেন,“ কত নিকৃষ্ট আত্মীয় (ও প্রতিবেশী) ছিলে তোমরা! তোমরা আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছ,কিন্তু অন্যরা আমাকে সত্য প্রতিপন্ন করেছে। তোমরা আমাকে আমার জন্মভূমি হতে বিতাড়িত করেছ,অন্যরা আমাকে আশ্রয় দিয়েছে। তোমরা আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছ,অন্যরা আমাকে সাহায্য করেছে। তোমরা কি প্রতিপালকের পক্ষ হতে আগত প্রতিশ্রুতিকে সত্য হিসাবে পেয়েছ?”
মদীনায় মহানবী (সা.)-এর সুসংবাদ প্রেরণ
রাসূল (সা.) আবদুল্লাহ্ ইবনে রাওয়াহা ও যায়েদ ইবনে হারেসাকে দূত হিসাবে মদীনায় মুসলমানদের বিজয়ের বার্তা বয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। সে সাথে কাফিরদের পরাজয় এবং উতবা,শাইবা,আবু জাহল,যামআ,উমাইয়্যা,নাবিয়াহ্,মানবা ও আবুল বাখতারীসহ বড় বড় কাফির নেতার নিহত হওয়ার বার্তাও তাঁরা পৌঁছালেন। রাসূলের প্রেরিত দূতরা যখন মদীনায় পৌঁছেন তখন মুসলমানরা রাসূলের কন্যা ও হযরত উসমানের স্ত্রীর দাফনের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ফলে যুদ্ধের বিজয়ের সঙ্গে রাসূলের কন্যা-বিয়োগের ঘটনা মিশ্রিত হয়ে গেল।
যা হোক,বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের ঘটনাটি মক্কার মুশরিক এবং মদীনার ইয়াহুদী ও মুনাফিকদের মনে আতংক ও ভীতির সঞ্চার করল। কারণ তারা কখনই বিশ্বাস করতে পারে নি এরূপ বিজয় মুসলমানদের ভাগ্যে ঘটবে। তাই প্রচার করতে চাইল এ খবর মিথ্যা। কিন্তু মুসলমানদের বিজয়ী দল যখন বন্দীদের সঙ্গে নিয়ে মদীনায় প্রবেশ করল তখন সকল সংশয় ও মিথ্যার অপনোদন ঘটল।
মক্কাবাসীদের কাছে কাফির নেতাদের নিহত হওয়ার সংবাদ
হাইসামানে খাজায়ী প্রথম ব্যক্তি হিসাবে মক্কায় প্রবেশ করে বদরের রক্তক্ষয়ী ঘটনা সম্পর্কে (যাতে তাদের গোত্রপ্রধানরা নিহত হয়েছিল) মক্কাবাসীদের অবহিত করল। আবু রাফে যিনি হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের দাস ছিলেন ও পরবর্তীতে হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও হযরত আলী (আ.)-এর প্রিয়ভাজন হিসাবে পরিণত হয়েছিলেন তিনি বর্ণনা করেছেন,“ সে সময় ইসলামের আলোয় হযরত আব্বাসের গৃহ আলোকিত হয়েছিল। হযরত আব্বাস,তাঁর স্ত্রী উম্মুল ফযল ও আমি ইসলাম গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু ভয়ে আমাদের ঈমানকে গোপন রেখেছিলাম। যখন ইসলামের শত্রুদের মৃত্যুর খবর মক্কায় পৌঁছল আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম। কিন্তু কুরাইশ ও তাদের সমর্থকরা খুবই ব্যথিত হয়েছিল। আবু লাহাব নিজে যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও অন্য এক ব্যক্তিকে তার স্থলে যুদ্ধ করার জন্য ভাড়া করেছিল। ঐ মুহূর্তে সে কাবার নিকটবর্তী জমজম কূপের নিকটে বসেছিল। এ সময় খবর পৌঁছল আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস (হারব) মক্কায় পৌঁছেছে। সে আবু সুফিয়ানকে খবর পাঠাল যত দ্রুত সম্ভব যেন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। সে এসে আবু লাহাবের পাশে বসল এবং বদরের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিল। ঘটনার বিবরণ তার ওপর বজ্রপাতের মতো আপতিত হলো এবং সে ভয়ে শিহরিত হলো। সে দিনই সে জ্বরে আক্রান্ত হলো এবং বিশেষ কষ্টকর রোগে আক্রান্ত হয়ে এক সপ্তাহ পর মৃত্যুবরণ করল।
রাসূল (সা.)-এর চাচা আব্বাসের বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়টি ইতিহাসের একটি জটিল প্রশ্ন। তিনি এ যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়েছিলেন। তিনি এ যুদ্ধে মুশরিকদের সঙ্গে বদরে এসেছিলেন,অন্যদিকে তিনিই সে ব্যক্তি যিনি আকাবার শপথ গ্রহণের দিন মদীনার আনসারদের আহবান জানিয়েছিলেন রাসূলকে সাহায্য করার জন্য। এ প্রশ্নের সমাধান দিয়েছে তাঁর দাস আবু রাফের বক্তব্য। আবু রাফে বলেছেন,“ তিনিও তাঁর ভ্রাতা আবু তালিবের ন্যায় একত্ববাদী ধর্ম ইসলাম ও তার নবীর প্রতি ঈমান এনেছিলেন,কিন্তু সে সময়ের দাবি অনুযায়ী তিনি তাঁর ঈমানকে গোপন রেখেছিলেন এবং এভাবে মহানবীকে সাহায্য করতে প্রয়াস পেয়েছিলেন। তিনি কুরাইশদের গোপন ষড়যন্ত্র সম্পর্কে রাসূলকে অবহিত করতেন। যেমন উহুদের যুদ্ধে কুরাইশদের পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি পূর্বেই রাসূলকে অবহিত করেছিলেন।”
যা হোক কুরাইশদের সত্তর ব্যক্তির মৃত্যুর খবরটি সমগ্র মক্কাবাসীকে শোকাভিভূত করল এবং তাদের সকল সুখ ও আনন্দকে কেড়ে নিল।
ক্রন্দন ও শোকগাথা পাঠ নিষিদ্ধ হলো
আবু সুফিয়ান মক্কাবাসীদের ক্রোধকে উজ্জীবিত রাখা ও তাদের বীরদের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহাকে জাগরিত করার লক্ষ্যে ক্রন্দন ও শোকগাথা পাঠ নিষিদ্ধ ঘোষণা করল ও কবিতা পাঠের আসর হতে নিবৃত হওয়ার নির্দেশ দিল। কারণ ক্রন্দন ও শোকগাথা পাঠ প্রতিশোধ স্পৃহাকে স্তিমিত করে এবং শত্রুর মনোবলকে বাড়িয়ে দেয়। সে মক্কাবাসীদের জন্য ফরমান জারি করল যে,মুসলমানদের কাছ থেকে কুরাইশরা রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ না করা পর্যন্ত যেন স্ত্রীদের সঙ্গে মিলিত না হয়।
বন্দীদের ব্যাপারে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত
বদর যুদ্ধে বন্দীদের ব্যাপারে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে,তাদের মধ্যে যারা শিক্ষিত তাদের প্রত্যেকে মুসলিম শিশুদের ১০ জনকে শিক্ষা দান করবে। যারা অশিক্ষিত তারা তাদের অর্থনৈতিক পদমর্যাদা অনুযায়ী এক হাজার হতে চার হাজার দিরহাম মুক্তিপণ হিসাবে দিবে। যাদের কোন অর্থ-সম্পদ নেই তারা কোন মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি লাভ করবে। এ খবর মক্কাবাসীদের নিকট পৌঁছলে বন্দীদের আত্মীয়স্বজনরা খুব খুশী হলো। তারা তাদের বন্দীদের মুক্ত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অর্থ নিয়ে মদীনার দিকে যাত্রা করল। তারা মুক্তিপণ দানের মাধ্যমে নিজ নিজ আত্মীয়দের মুক্ত করে নিল। যখন সুহাইল ইবনে আমর মুক্তিপণ আদায়ের মাধ্যমে মুক্তিপণ লাভ করল তখন রাসূলের এক সাহাবী তাঁর নিকট অনুমতি চাইলেন সুহাইলের সামনের দাঁতগুলো উপড়ে ফেলার জন্য যাতে করে সে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে না পারে। মহানবী (সা.) অনুমতি দিলেন না,বরং বললেন,“ এরূপ অঙ্গহানি করার অধিকার ইসলাম কাউকে দেয় নি।”
রাসূলের কন্যা যয়নাবের স্বামী আবুল আস একজন ব্যবসায়ী ও মক্কার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ইসলামপূর্ব যুগে রাসূলের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। মহানবীর নবুওয়াত লাভের পর তাঁর স্ত্রী ইসলাম গ্রহণ করলেও তিনি অমুসলিম থেকে যান।
বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তিনি মুসলমানদের হাতে বন্দী হন। সে সময় তাঁর স্ত্রী মক্কায় অবস্থান করছিলেন। স্বামীর বন্দী হওয়ার কথা শুনে তাঁকে মুক্ত করার জন্য স্বীয় গলার হার যা তাঁর মা হযরত খাদীজাহ্ তাঁকে তাঁর বিবাহের রাতে উপহার দিয়েছিলেন তা মদীনায় পাঠালেন। মহানবী হযরত খাদীজার হারটির প্রতি লক্ষ্য করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তিনি তাঁর জীবনের সংকটময় মুহূর্তে হযরত খাদীজার ভূমিকার কথা স্মরণ করে কাঁদছিলেন। কারণ সংকটময় সেই মুহূর্তে হযরত খাদীজাহ্ তাঁর পাশে ছিলেন এবং তাঁর সমস্ত সম্পদ ইসলামের সেবায় বিলিয়ে দিয়েছিলেন।
মহানবী (সা.) মুসলমানদের বায়তুল মাল (সাধারণ সম্পদ) সংরক্ষণে খুব তৎপর ছিলেন। মুসলমানদের অধিকার যেন সংরক্ষিত থাকে এজন্য তিনি তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন,“ এই গলার হারটি তোমাদের সকলের সম্পদ,যদি তোমরা অনুমতি দাও তবে আবুল আসকে কোন মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি দিয়ে এ গলার হারটি যয়নাবকে ফিরিয়ে দেব।” রাসূলের সঙ্গীরা সর্বসম্মতভাবে তাঁর প্রস্তাব মেনে নিলেন। মহানবী আবুল আসকে মুক্ত করে দিয়ে তাঁর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করলেন যে,যয়নাবকে তিনি মুক্ত করে মদীনায় পাঠিয়ে দেবেন। তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক যয়নাবকে মুক্ত করে মদীনায় পাঠিয়ে দিলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন।
[সূত্র: আয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানির লেখা বই ‘চিরভাস্বর মহানবী (সা)’, প্রথম খণ্ড]

Thursday, 16 June 2016

তেলাপোকা একটি পাখি মোয়াবিয়া একজন সাহাবা

2 Comments
কিছু জ্ঞানপাপী আলেম শতশত বছর ধরে অবান্তর হাদিসের ভিত্তিতে দুশ্চরিত্র মুয়াবিয়াকে সাহাবী বানিয়ে রেখেছে৷যদিও কুরআন কারা সাহাবী হিসেবে গণ্য হবে তা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে তারপরও তারা নির্লজ্জের মত ফোর্থ হ্যান্ড হাদীস দেখিয়ে দাঁত কেলাচ্ছে! এবার দেখা যাক কুরআন কি বলছে?' সূরাহ তওবাহ : আয়াত ১০০ وَالسَّابِقُونَ الأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ اللّهُ عَنْهُمْ وَرَضُواْ عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُم جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ আর যারা সর্বপ্রথম হিজরতকারী ও আনছারদের মাঝে পুরাতন, এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ সে সমস্ত লোকদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কানন-কুঞ্জ, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত প্রস্রবণসমূহ। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। এটাই হল মহান কৃতকার্যতা। The vanguard (of Islam)- the first of those who forsook (their homes) and of those who gave them aid, and (also) those who follow them in (all) good deeds,- well- pleased is Allah with them, as are they with Him: for them hath He prepared gardens under which rivers flow, to dwell therein for ever: that is the supreme felicity. সূরাহ হাদীদ : আয়াত ১০ وَمَا لَكُمْ أَلَّا تُنفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلِلَّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَا يَسْتَوِي مِنكُم مَّنْ أَنفَقَ مِن قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ أُوْلَئِكَ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِّنَ الَّذِينَ أَنفَقُوا مِن بَعْدُ وَقَاتَلُوا وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَى وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ তোমাদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে কিসে বাধা দেয়, যখন আল্লাহই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের উত্তরাধিকারী? তোমাদের মধ্যে যে মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও জেহাদ করেছে, সে সমান নয়। এরূপ লোকদের মর্যদা বড় তাদের অপেক্ষা, যার পরে ব্যয় করেছে ও জেহাদ করেছে। যদিও আল্লাহ কল্যাণের ওয়াদা দিয়েছেন তবে তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত। And what cause have ye why ye should not spend in the cause of Allah.- For to Allah belongs the heritage of the heavens and the earth. Not equal among you are those who spent (freely) and fought, before the Victory, (with those who did so later). Those are higher in rank than those who spent (freely) and fought afterwards. But to all has Allah promised a goodly (reward). And Allah is well acquainted with all that ye do. উপরের আয়াত দুটিতে সাহাবি হওয়ার জন্য দুটি যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে- ০১. রাসুল করিম সাঃ এর প্রথম দিকের সঙ্গী হতে হবে ০২.মক্বা বিজয়ের আগে ইসলাম গ্রহনকারী হতে হবে৷ মুয়াবিয়ার উপরোক্ত দুটি যোগ্যতার একটিও নেই৷ যে সকল দুর্বল হাদিস দিয়ে মুয়াবিয়ার গ্রহনযোগ্যতা দেয়া হচ্ছে সেই হাদীস গুলির চেয়ে অনেক বেশী গ্রহনযোগ্য হাদীসে স্বয়ং রাসুল করিম সাঃ এর মুখে মুয়াবিয়ার সমালোচনা আমরা দেখতে পাই৷ # সহিহ মুসলিম ,হাদীস নম্বর - ৬২৯৮ ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত আছে যে, "আমি একদিন ছেলেদের সাথে খেলা করছিলাম, এমন সময় রাসুল করিম সাঃ কে আসতে দেখলাম৷আমি একটি দরজার আড়ালে চলে গেলাম৷৷কিন্তু রাসুল করিম আমার কাঁধ ধরে আমাকে ডেকে আনলেন এবং মুয়াবিয়াকে ডাকতে বললেন৷আমি ডাকতে গিয়ে তাকে ভোজনে ব্যস্ত দেখতে পেলাম এবং ফিরে আসলাম৷রাসুল করিম আবার আমাকে যেতে বললেন ,আমি আবার গেলাম এবং মুয়াবিয়াকে ডাকলাম কিন্তু সে তখনও ভোজনে ব্যাস্ত ছিল৷আমি ফিরে এসে রাসুল করিমকে এটা জানানোর পর তিনি বল্লেন 'আল্লাহ যেন তার পেট কখনও পূর্ণ না করেন' !" **এই হাদীসটি ইমাম আহমাদ ইবনে হানবাল রহ. এবং ইমাম হাকিম রহ. দ্বারা পরিক্ষীত এবং স্বীকৃত৷ # আল তাবারী (৮ম খন্ড) , পৃষ্ঠা নং ১৮৬, দার আল মারিফ পাবলিকেশন, মিশর৷ এই হাদীসটি দুজন সাহাবার দ্বারা বর্ণিত হয়েছে— হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত আছে, "আমি রাসুল করিম সাঃ কে বলতে শুনেছি যে " মুয়াবিয়ার মৃত্যু ইসলামের পথে হবেনা"! হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা.হতে বর্ণিত আছে, " আমি রাসুব করিম সাঃ কে বলতে শুনেছি ' মৃত্যুর সময় মুয়াবিয়া আমার উম্মত হিসেবে গ্রহনযোগ্য হবেনা'!" ** এমন সহীহ হাদীস থাকার পরও তারা কেন চার নাম্বার হাদীস নিয়ে মেতে আছে তা জ্ঞানীজনদের না বোঝার কথা নয়৷ ইসলামের ইতিহাসে প্রথম অন্তঃকোন্দল বা ফিৎনার জনক এই দুশ্চরিত্র মুয়াবিয়া৷ ৬৭৫ হিজরী সালের মে মাসে হযরত আলী কা. সাথে এই যুদ্ধ শুরু হয়৷এখান থেকেই মুয়াবিয়া সুক্ষ কৌশলে মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নী বিভক্তির সূত্রপাত ঘটায়৷আজ মুসলমানরা শতভাগে বিভক্ত হয়ে আছে! মুয়াবিয়া ইসলামী খিলাফতের বিলুপ্তি ঘটিয়ে নিজের কুপুত্র এজিদ কে আরব হেজাজের রাজা মনোয়ন করার মাধ্যমে রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে৷ রাজতন্ত্রের মাধ্যমেই যুগেযুগে অযোগ্য ব্যক্তিদেরকে মুসলমানদের শাসক হবার সুযোগ তৈরী করে দেয়া হয়েছিল৷ এজিদ হতে শুরু করে মক্বার গভর্নর হুসেন শরীফ আর আজকের সৌদ পরিবারের মত অযোগ্য শাসকরা বরাবরই এই রাজতন্ত্রের ছত্রছায়ায় থেকেই লালিত পালিত হয়েছে৷ মুয়াবিয়া নিজেকে লজ্জায় কোনোদিন 'খলিফা' দাবী করতে পারে নাই৷শেষ পর্যন্ত তাকে 'আমীর' উপাধি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে৷ ইসলামের ঘরের অভ্যন্তরের শত্রু হচ্ছে মুয়াবিয়া আর এজিদ গং এবং তাদের পা চাটা কিছু জ্ঞানপাপী আলেম৷এদের নির্মূল করতে পারলে মুসলমানদের ঐক্য ফিরে আসতে পারে৷এরা যতদিন মুসলমানদের অভ্যন্তরে আছে ততদিন মুসলমানরা কখনোই এক হতে পারবেনা৷ মুসলমানদের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক! ______________________________________________________________
"#কাফেরদের অনেক লান্ঞ্ছনারপরেও নবীজি নিজের মাতৃভূমি মক্কা ত্যাগ করতে চাননি|কিন্তু যখন নিজের প্রাননাশেরপরিকল্পনার কথা জানতে পারেনতখন তিনি আল্লাহর অনুমতি নিয়েমদিনাতে হিজরতের সিদ্ধান্ত নেন|রাতেরবেলা হযরত আলীকেনিজের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গোপনে হযরত আবুবকর রা. কে নিয়ে মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা হন| ইতিমধ্যে কাফিররা তা টের পেয়ে যায় এবং নবীজি এবং আবুবকর রা. কে ধরার জন্য একটি অনুসন্ধানী দল পাঠায়|এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন ওয়ালিদ ইবনে উতবাহ (মুয়াবিয়ার মামা), মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান এবং মুয়াবিয়ার আরও দুইআপন বড় ভাই|এই সময় নবীজি এবং হযরত আবুবকর রা . 'ঘার আলথাউর' (cave of bull) নামের গুহায়আত্মোগোপন করে নিজেদের সুরক্ষিত রাখেন| মক্কা বিজয়ে রআগে এইরকম কার্যকলাপ ছিলমুয়াবিয়া, তার পিতা আবু সুফিয়ানএবং মাতা হিন্দার (রাসূলকরিমের চাচা হযরত হামযা রা: এর কলিজা ভক্ষণকারীনি)|মক্কা বিজয়ের পর স্বার্থের কারণে এবং চাপে পরে তারা ইসলাম গ্রহন করে|(*সূত্র: মসনদ_লিখক ইমাম আহ্মদ হাম্বল রহঃ) দেখা যাক *কোরআন কি বলে:#নবীজিকে যারা স্বচক্ষে দেখেছেতারা সকলেই যদি সাহাবী হয়েথাকেন তবে আবু লাহাব /জেহেলও সাহাবী হিসেবে গন্য হওয়ার অধিকার রাখে ! তাহলে মুয়াবিয়া সহ ঐ সময়ের সকল মক্কা এবংমদীনাবাসীও সাহাবী !!কখনোই নয়; এমন ভ্রান্ত একটা ধারণা আমাদের শিখিয়েছে কিছু কুলাঙার আলেম সম্প্রদায়; অথচকারা সাহাবী হিসেবে গন্য হবেনতা কোরআনেই বলা আছে|কেবল মাত্র প্রথম দিকের মুহাজির এবং আনসাররা সাহাবীর মর্যাদা পাবেন, কোরআন বলে~"ওয়াসসা-বিকুনাল আউওয়ালুনা মিনালমুহা-জিরিনা ওয়াল আনস্বা-রি ওয়াল্লাযীনাত্তাবা'ঊহুম বিইহসা নির রাদিওয়াল্লা-হু আনহুম ওয়া-রাদু আনহু" "মুহাজির এবং আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম দিকের,যারা আন্তরিকতার সাথে অনুসরণ করেছে তাদের উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট (রাদিওয়াল্লা) এবং তারাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট" (সূরাহ-তওবা;100)| মূলতঃ নবীজির বহুদিনের পরীক্ষিতসাথিরাই প্রথম দিকে হিজরত করেছিলেন| মদীনাতে তাদের যারা আশ্রয় দিয়েছিল সেসবআনসাররা তাদের সব উতসর্গ করেছিল|সুতরাং তাদের মর্যাদা অনেক বেশি| আর মক্কা বিজয়ের পরে যারা মুসলমান হয়েছে তাদেরমর্যাদা কখনোই এক সমান হতে পারে না,বরং তাদের মর্যাদাঅনেক কম|কোরআন বলে ~"লা ইয়াসতাওয়ী মিনকুম মানআনফাক্বা মিন ক্বাবলিল ফাতহি ওয়া কাতালা;উলা ইকা আজামু দারাজাতাম মিনাল লাযীনা আনফাকু মিম বাদু ওয়া কাতালু" "তোমাদের মধ্যে যে মক্কা বিজয়েরপূর্বে ব্যয় করেছে এবং যুদ্ধ করেছে সেসমান নয় তাদের যারা বিজয়ের পরেব্যয় এবং যুদ্ধ করেছে বরং পদ মর্যাদায়পূর্বের তারা অধিক শ্রেষ্ঠ" (সূরাহ- হাদীদ:10)| মুয়াবিয়া হিজরত করেনি এবং মক্কা বিজয়ের পরে সে মুসলমান হয়েছে অতএব তাকে সাহাবী বলার প্রশ্নই আসেনা|যারা এসব জেনেও মুয়াবিয়াকে সাহাবী মানে তারানির্দ্বিধায় পথভ্রষ্ট||*কিছু দলিল :মুয়াবিয়ার রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ওখেলাফত উচ্ছেদঃ ক্ষমতা মুয়াবিয়ার হস্তগত হলেইসলামী খেলাফত এর অবসান ঘটেএবং রাজতন্ত্রের সুত্রপাত ঘটে।মুয়াবিয়ার বায়াত এর পর সাদ ইবনেআবি ওয়াক্কাস মুয়াবিয়ারউদ্দেশে বলেন- হে রাজা আপনার প্রতি সালাম। (ইবনুল আসির ৩য় খণ্ড) মুয়াবিয়া নিজেও বলেছেন আমি মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম রাজা। (আলবিদায়া ওয়ান নেহায়া ৮ম খণ্ড) হাফেজ ইবনে আসীর বলেন-মুয়াবিয়া কে খলিফা না বলেরাজা বলা সুন্নত। কারন মহানবী সাঃ বলেন আমার পর ত্রিশ বছরখেলাফত থাকবে অতঃপরবাদশাহির আগমন ঘটবে। হিজরি ৪১ সালে ইমাম হোসেন আঃ এরখেলাফত ত্যাগের মাধ্যমে সে মেয়াদ পূর্ণ হয়। ( আল বেদায়াওয়ান নেহায়া ৮ম খণ্ড)" "#মুয়াবিয়াকে ইমাম হাসান এর হত্যাকারী উল্লেখ করে আল্লামা আব্দুর রহমান জামি রাঃ তার বিখ্যাত কিতাব শাওয়াহেদূন নবুয়ত কিতাব এ লিখেন – হযরত ইমাম হাসান আঃ কে মুয়াবিয়ার আদেশেই তার স্ত্রীর মাধ্যমে বিষ দেয়া হয়েছিল। *বিশিষ্ট সাহাবা হাজর ইবনে আদি রাঃ কে জীবিত দাফনঃ মুয়াবিয়ার নির্দেশে ৭০ হাজার এর অধিক মসজিদ এ যখন রাসূলকরিম, মওলা আলী আঃ ও তার পবিত্র বংশধরদের গালিগালাজ ও অভিসম্পত দেয়া হচ্ছিল তখন হযরত হাজর ইবনে আদি কুরআন ও হাদিস থেকে শেরে খোদা মওলা আলীর শানে বর্ণিত তা পাঠ করতে লাগলেন। অতঃপর মুয়াবিয়ার নির্দেশে হাজর বিন আদি রাঃ ও তার সাতজন সঙ্গিকে হত্যা করা হয় অত্যন্ত নির্মমভাবে। মুয়াবিয়ার নির্দেশে তাদের কে জীবিত মাটিতে পুতে মারা হয় যাতে কেহ মুয়াবিয়ার আদেশ অমান্য করার সাহস না পান।( এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরন তাবারী ৪র্থ খন্ড,ইবনুল আসীর ৩য় খণ্ড,আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া ৮ম খন্ড,ইবনে খালদুন ৩য় খণ্ড) এই নির্মম হত্যা কাণ্ডের পর আবুল আওলিয়া হযরত হাসান বসরি রাঃ অভিমত প্রকাশ করেন যে, এ অহেতুক হত্যাকাণ্ডের কারনে মুয়াবিয়ার নিষ্কৃতি নেই। ( ইবনুল আসীর ৩য় খণ্ড, আল বেদায়া ৮ম খণ্ড) এই ঘটনা থেকে বিরত থাকার জন্য হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাঃ আগেই পত্রের মাধ্যমে নিষেধ করেছিলেন কিন্তু মুয়াবিয়া হযরত আয়েশার এই কথা শুনেন নি। পরে হযরত আয়েশা রাঃ মুয়াবিয়ার সাক্ষাতে আসলে বলেন “–হে মুয়াবিয়া তুমি হাজর কে হত্যা করতে গিয়ে আল্লাহকে একটুকুও ভয় করলে না?” (আল ইস্তিয়াব ১ম খণ্ড, তাবারী ৪র্থ খণ্ড) এই সব মুনাফিক হত্যাকারীদের সম্পর্কে আল্লাহ্ কুরআন এ বলেন- “কোন মুসলমান কে যে স্বেচ্ছায় হত্যা করবে তার শাস্তি দোজখে এবং সেথায় সে চিরস্থায়ী হবে, তার উপর আল্লাহর লানত” (সুরা নেছা ৯৩)। *#বায়তুল_মালের_লঙ্ঘন: বায়তুল মাল হচ্ছে খলিফা বা সরকারের নিকট আল্লাহ্ ও জনগনের আমানত। অথচ মুয়াবিয়া রাজা হবার পর বায়তুল মাল কে নিজের মালে পরিনত করেছেন। বায়তুল মালে জনগনের অধিকার বলতে কিছু ছিল না। তিনি তার ইচ্ছা মোতাবেক ভোগ ও বণ্টন করতেন। বায়তুল মালের হিসাব চাওয়ার অধিকার কারো থাকল না।জনগণ কে নির্ভর করতে হত বাদশাহর দান দাক্ষিণ্যর উপর। (ইবনুল আসীর ৪র্থ খণ্ড,আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া ৯ম খণ্ড) নন মুসলিম দের উপর জিজিয়া করঃ ইসলামের বিস্তার এর ফলে মুসলমান বেড়ে যায় ফলে জিজিয়া কর কমে যায়। তাই বায়তুল মালএর আয় হ্রাস পায় যা মুয়াবিয়ার ভোগ বিলাস এ ব্যঘাত সৃষ্টি হয়। তাই মুয়াবিয়া নও মুসলিম দের মধ্যে জিজিয়া কর আরোপ করা হয়। যা সম্পূর্ণ কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী।সাধারন মানুষের ইসলাম গ্রহন এর চাইতে ও মুয়াবিয়ার ধন সম্পদ বৃদ্ধি করাই ছিল তার কাছে অধিকনগুরুত্বপূর্ণ। (ইবনুল আসীর ৪র্থ খণ্ড) মুয়াবিয়া কুরআন এর আদেশ লঙ্ঘন করে গনিমত এর মালের মূল্যবান সোনা চাঁদি নিজেই রেখে দিতেন। (আত তাবারী, আল ইস্তিয়াব ১ম খণ্ড, আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া ৮ম খণ্ড)|||" ____শরীফুল ইসলাম। _______________________________________________________________
"যে মনে মাওলা আলী(আ) এর প্রেম আছে, সে মনে মোয়াবিয়ার প্রেম স্থান নিতে পারেনা।একইভাবে মোয়াবিয়া প্রেমিকের মুখে মাওলার নাম শোভা পায় না।যে মোয়াবিয়া রাসূল(স) কে হত্যা করার জন্য অস্ত্রের মহড়া দিয়েছেন,যে মুয়াবিয়া ইমাম হাসান(আ) কে বিষপ্রয়োগে শহীদ করার মূল হোতা,যে মোয়াবিয়া মাওলা আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন,যে মুয়াবিয়া এবং তার পিতা আবু সুফিয়ান রাসূলের বিরুদ্ধে সকল যুদ্ধের মূল হোতা, যার চক্রান্তে মা আয়েশা(রা) ও মাওলা আলী(আ) এর মধ্যে একাধিক যুদ্ধ বিগ্রহ ঘটে, যে মোয়াবিয়া এজিদি সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা,যার মা একজন বেশ্যা এবং রাসূলের প্রীয় চাচাজানের কলিজা ভক্ষণকারী,যেই পরিবারটাই রাসূলের চীরশত্রু তাদের প্রেম আর রাসূল(স) এর প্রেম,পাক পাঞ্জাতনের প্রেম,আহলে বায়াতের প্রেম,অলি আউলিয়ার প্রেম একসাথে থাকতে পারেনা। রাসূল(স) ও উনার আহলে বায়াত এবং রাসূলের প্রকৃত প্রেমিকদের এমন অসম্মান করার অধিকার কারো নেই।তথাপি অনধিকার চর্চায় রাসূল(স) কে অসম্মান করে,মাওলা আলী(আ) কে অসম্মান করে নিজেকে জান্নাতি হিসেবে প্রচার করা হয় কোন বিবেকে।ফাদকুলিহি ইবাদি ওয়াদ খুলিহি জান্নাতি। আমার বান্দাদের/দাসদের অন্তর্ভূক্ত হও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।আল্লাহর বান্দা/দাস হতে পারলে জান্নাত নগত।দেখুন সসুরা ফাজর এর ২৭ নম্বর আয়াতে।দলের একটা নাম দিয়া বাকির লোভে নগত ছাড়া,এসব দেখি কানার হাটবাজার।পিতা আদম থেকে শুরু করে সকল নবীর আমলেই একজন করে মূল ষড়যন্ত্রকারী ছিল।ইতিহাসে কারো কারো নাম এখনো আছে। আমাদের রাসূলের প্রচারে ঘৃণ্য বাধাদানকারী নরকীটের নাম কি? সেই আবু সুফিয়ান,মুয়াবিয়া আর এজিদ চক্রের লোক বড় গলায় কথা বলে কি করে??আহলে বায়াতের কথা অন্তত তাদের মুখে শোভা পায় না।মোয়াবিয়ার প্রেমিক ছাড়া আর কেই বা শিয়া বলে গালি দিবে আহলে বায়াতের প্রেমিকদের।আহলে বায়াতকে ভালবাসলে তোমরা শিয়া বলে উপহাস কর।আর আবু সুফিয়ান, মুয়াবিয়া, ইয়াজিদকে ভালবেসে কোন মুখে নিজেদের মুসলিম দাবী কর তোমরা??এর চেয়ে নির্লজ্জ প্রয়াস আর কি হতে পারে???আরে বোকারাম,তোমরা কি বড়পীর সাহেবের বইও নকল করে ফেললে??কিন্তু পারনি খাজা গরীবে নেওয়াজ আজমেরী সঞ্জরী(রহ) এর মাজারের গেট টা পরিবর্তন করতে।খাজা বাবা বলেছেন,হোসাইন (আ) হলেন দ্বীনের বাদশা।তিনি আরো বলেন,আমিতো কেবল তারই গোলাম যে হোসাইন (আ) এর গোলাম। তিনি নিজেকে হোসাইন (আ) এর ঘোড়ার খুড়ের ধূলার সাথে তুলনা করতেও দ্বিধা বোধ করেন।তিনি নিজে বলেছেন,তোমরা কি মনে কর হোসাইন(আ) সেদিন পানির তৃষ্ণায় শহীদ হয়েছেন,আমি মইনুদ্দীন চিশতীর লাঠির আঘাতে এখানে পানির নহর বয়ে যাবে।ইমাম হোসাইন(আ) সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য দেখিয়ে গেছেন।এখন হয়ত খাজা বাবাকেও শিয়া বলে গালি দিয়ে আপনারা জান্নাতের টিকেট নিবেন!!!জেনে রাখবেন খাজা বাবা বড়পীর সাহেবের আপন ভাগিনা।বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহ) মাতা ও পিতার দিক দিয়ে আল হাসানী ওয়াল হোসাইনী। জেনে রাখুন বড়পীর সাহেব এবং দুনিয়ার কোন অলি আবু সুফিয়ান,মুয়াবিয়া, এজিদের বংশধর নয়।যুগে যুগে সকল অলিদের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি লানত।সকল আহলে বায়াত প্রেমিকদের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি লানত। সম্রাজ্য দখল করা মুয়াবিয়া ও এজিদের ক্ষমতায় রচিত জাল হাদীসে আর কত রাসূল শত্রুর গুণ গাইবেন???আপনারা জান্নাতি বটে!!!আমরা ভালবাসি রাসূল(স) কে,ভালবাসি পাক পাঞ্জাতনকে,ভালবাসি আহলে বায়াতকে, আমরা মনুষ্য সৃষ্টি সুন্নি শিয়া,আহলে হাদীস,আহলে সুন্নত নামক কোন দলের নই।আমরা আল্লাহ মনোনীত নূহ (আ) কিস্তি স্বরুপ আহলে বায়াতের নৌকার যাত্রী। আপনারা যারা মুয়াবিয়া আর এজিদের প্রেমিক তারা ভাঙ্গা নৌকায় জান্নাতের হুর নিয়া নাচানাচি করে।"

Tuesday, 14 June 2016

নজরুলের ধর্মমত ও অসাম্প্রদায়িকতা

2 Comments
নজরুল ইসলামকে কেউ খুবই ভালোবেসেছেন, কেউ বা অসম্ভব ঘৃণা করেছেন। কিন্তু কেউই তাকে অবহেলা করতে পারেননি। তিনি যখন জনপ্রিয়তার একেবারে তুঙ্গে, তখনো কেবল প্রশংসার জোয়ারে ভাসেননি, বরং তীব্র নিন্দা আকর্ষণ করেছেন অনেকের তরফ থেকে। যেমন, মৌলবীরা (নজরুলের ভাষায় মৌ-লোভীরা) ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, তিনি কাজী হলেও কাফের। আর হিন্দুরা তাকে উপাধি দিয়েছিলেন পাত নেড়েতাঁর ভাষায় পুরুষরা তাঁকে গান দিয়েছেন, মেয়েরা তাকে অভিশাপ দিয়েছেন নারীবিদ্বেষী বলে চরকার গান লিখেছেন বলে তার নিন্দা করেছেন বিপ্লবীরা, আর কংগ্রেসীরা তাকে অবিশ্বাস করেছেন বিপ্লবী ঠাহর করে। তা হলে নজরুল আসলে কী ? আপাতদৃষ্টিতে তার পরস্পরবিরোধী ব্যক্তিত্বের পেছনে আছে তার প্রবল পছন্দ-অপছন্দ। তিনি যা বলেছেন, চীৎকার করে বলেছেন। তিনি যে-পথে চলেছেন, তার মাঝখান দিয়ে চলেছেন। আপোশ করে চলা, পাশ কাটিয়ে চলা তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য নয় আরও একটু খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, তীব্রতাই তার বিশ্বাসের একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়, তার বিশ্বাস অটল, ধ্রুবতারার মতো। কখনো তিনি এলিয়ে পড়েননি, কারণ একটা শক্ত ভিত্তি ছিলো তার বিশ্বাসের। সেই ভিত্তিটা মানবতার। সব মত, সব পথের উর্ধ্বে মানুষকে নিতান্ত মানুষ হিশেবে দেখার ক্ষমতা ছিলো তার। সে শক্তি তিনি সম্ভবত অর্জন করেননি, সেটা ছিলো তার স্বভাবেরই অংশ। তার যে মানবপ্রীতির জন্যে তিনি মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা লাভ করেছিলেন, সেই মানবপ্রীতিই তাকে আবার অনেকের কাছে, অনেক গোষ্ঠীর কাছে অপ্রিয় করে তুলেছিলো। তিনি মানুষে মানুষে সাম্যের কথা বলেছেন, কিন্তু কমিউনিষ্ট হতে পারেননি। এমন কি, তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুললেও, তিনি তাতে যোগ দিতে পারেননি। কারণ, তার মানবপ্রীতিকে কতোগুলো বিধান অথবা একটা কট্টর আদর্শের ছকে ফেলতে পারেননি তিনি। এক সমাজকে মানলে, করবে / আরেক সমাজ নির্বাসন। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, কোনো রাজনৈতিক দল, কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে তিনি একাত্ম হতে পারেননি। তার মানবতার সংজ্ঞার সঙ্গে কারো ষোলো আনা মিল হয়নি নজরুল হয়তো ঠিকই বলেছেনতিনি বর্তমানের কবি, ভবিষ্যতের নবী নন। হয়তো তার সাহিত্য চিরকালীন সাহিত্য নয়। কিন্তু তিনি যে-মানবতার কথা বলেছিলেন, তা চিরকালের তার আগে অথবা পরে কোনো বাঙালি সাহিত্যিক, কোনো দার্শনিক, কোনো ধর্মীয় নেতা, এমন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মানবতার জয় গান করতে পারেননিমানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। সত্য বটে, তার অন্তত দু শতাব্দী আগে চণ্ডীদাস বলেছিলেন, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। কিন্তু চণ্ডীদাসের মানুষ এবং নজরুলের মানুষ এক নন। চণ্ডীদাস মনের মানুষের কথা বলেছিলেন। 
নজরুল বলেছিলেন রক্তমাংসের মানুষের কথা। মানুষের প্রতি এই অকৃত্রিম ভালোবাসার জন্যেই নজরুল বলতে পেরেছিলেন যে, জগতের সব পবিত্র গ্রন্থ এবং ভজনালয়ের চেয়ে একটি মানুষের ক্ষুদ্র দেহ অনেক বেশি পবিত্র। মানুষকে ঘৃণা করে যারা ধর্মগ্রন্থ পড়েন, তিনি তাদের কাছ থেকে ধর্মগ্রন্থ কেড়ে নেওয়ার আহবান জানিয়েছিলেন। মন্দির-মসজিদ ভেঙে ফেলার জন্যে কালাপাহাড় এবং গজনি মামুদকে আহবান জানিয়েছিলেন। সকল সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে তার এই যে-মানবপ্রীতি, তা- তাকে হিন্দু নয়, মুসলমান নয়, খাটি বাঙালিতে পরিণত করেছিলো অথচ নজরুল রীতিমতো মুসলমান হতে পারতেন। তিনি যে-অশিক্ষিত পরিবারে জন্মেছিলেন, সে পরিবারে আনুষ্ঠানিক ইসলাম ধর্মই পালিত হতো। আর, ছেলেবেলা সেই ধর্মের শাস্ত্র পড়েই মাত্র দশ বছর বয়সে মসগিদে নামাজ পড়ানোর চাকরি পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি যেসব ইসলামী গান লিখেছিলেন, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কোরান-হাদিস তিনি ভালোই জানতেন। কিন্তু ছেলেবেলার এই শিক্ষা সত্ত্বেও তিনি মোল্লাহ হলেন না, বরং কয়েক বছরের মধ্যে কাফের কাজীউপাধি লাভ করেন পরিণত নজরুল যে কেবল ইসলাম ধর্মের কতোগুলো বিধানের বিরোধিতা করলেন, তাই নয়; আনুষ্ঠানিক ধর্মেরই তিনি পদচিহ্ন এঁকে দিলেন। কি করে এটা সম্ভব হয়েছিলো, বলা শক্ত। ছাত্রজীবনে এবং সেনাবাহিনীতে থাকার সময় তিনি অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের ঘনিষ্ঠতায় এসেছিলেন-- এই একটি তথ্য দিয়েই ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। হতে পারে বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতিতে যে সমন্বয়বাদী এবং ভক্তিবাদী ধর্ম প্রচলিত ছিলো, নিজের অজ্ঞাতেই সেই ধর্ম দিয়ে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু সেভাবেই হোক তার দৃষ্টিভঙ্গিতেই একটা অসাধারণ মানবতাবাদী ঔদার্য্য ছিলো। সাধনা করে অথবা বৈদগ্ধ্য দিয়ে এটা তিনি আয়ত্ত করেছিলেন বলে মনে হয় না। তার ফলে মাত্র তেইশ বছর বয়সেই তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, কোনো আনুষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস আন্তরিক হলে সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে ওঠা যায় না অথবা মানুষকে সমান চোখে দেখা যায় না সত্যিকারভাবে সাম্প্রদায়িকতার উপরে উঠতে পেরেছিলেন বলেই, জাতিভেদের মানবতা-বিরোধী বিকট চেহারা এবং ভণ্ডামির স্বরূপ তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পেরেছিলেন। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বলতে পারিস বিশ্বপিতা ভগবানের কোন সে জাত ? / কোন ছেলের তার লাগলে ছোওয়া অশুচি হন জগন্নাথ ? তিনি আপসোস করেছেন, মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া তার আগেকার আট শো বছরের বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত লালন ফকিরই জাতের এই মানবতা-বিরোধী চেহারা দেখতে পেয়েছিলেন এবং তিনিও তা দেখতে পেয়েছিলেন ভূমিজ সন্তান ছিলেন বলে। কিন্তু নজরুল জাতের নামে বজ্জাতির কথা লেখার পর যে-আশি বছর চলে গেছে, তার মধ্যে অন্য কেউ-আর এমন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জাতের বিভেদমূলক স্বরূপ তুলে ধরেননি। নজরুল রাজনীতিক ছিলেন না। কিন্তু সমকালের রাজনীতি দিয়ে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়েছিলেন। তার চারদিকে যেসব ঘটনা ঘটছিলো, সে সম্পর্কে তিনি সাহিত্যিক নির্লিপ্ততা অথবা নীরবতা পালন করতে পারেননি।

সে জন্যেই চিত্তরঞ্জন দাশ হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের যে-প্রয়াস দেখিয়েছিলেন, তাকে তিনি যেমন উদাত্ত কণ্ঠে স্বাগত জানিয়েছিলেন, অন্য কেউ তা জানাননি। চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পর তিনি একটি কবিতায় লিখেছিলেন যে, মুহাম্মদের আগে তার জন্ম হলে কোরানেও তার নাম থাকতো এমন সাহসের কথা বোধ হয় পরাধীন ভারতবর্ষেই লেখা সম্ভব ছিলো এখন ধর্মীয় উন্মত্ততার যুগে স্বাধীন ভারত অথবা স্বাধীন বাংলাদেশকোথাও কথা বলার জো নেই। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য অথবা অনৈক্য নজরুলের মনে যে কী প্রবল ভাবাবেগ এবং প্যাশনের জন্ম দিতো, তা আভাস পাওয়া যায় চিত্তরঞ্জন মারা যাওয়ার পরের বছর। ১৯২৬ সালের এপ্রিলে কলকাতায়, বলতে গেলে, সুপরিকল্পিতভাবে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা বাধিয়ে দেওয়া হয় মসজিদের পাশ দিয়ে যাবার সময়ে সবাই বাজনা বাজানো বন্ধ করেছিলো, একটি লোক ছাড়া। তার জবাবে মসজিদের ভেতর থেকে একদল লোক বেরিয়ে আসা অসম্ভব নয়। কিন্তু তারা লাঠিসোটা এবং ধারালো অস্ত্র কি করে পেলো কোনো পরিকল্পনা ছাড়া, বলা মুশকিল। সে যাই হোক, এই দাঙ্গাই ছিলো বঙ্গদেশের প্রথম সবচেয়ে ভয়াবহ দাঙ্গা। এতে বন্দুকও ব্যবহৃত হয়েছিলো। এর অল্প দিন পরেই কৃষ্ণনগরে কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। নজরুল এই দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে গান লেখেনকাণ্ডারী হুঁশিয়ার গানে তিনি রাজনীতিকদের মনে করিয়ে দেন তাদের দায়িত্বের কথাঅসহায় জাতি ডুবে মরছে। সময়ে ওরা হিন্দু, না মুসলিম প্রশ্ন তোলা অসঙ্গত, কারণ ওদের একমাত্র পরিচয় ওরা দেশমাতার সন্তান। কংগ্রেসের সম্মেলনে নজরুল আর দিলীপকুমার রায় গান উদাত্ত গলায় গেয়ে শোনান। কিন্তু রাজনীতিকরা তাদের আবেদনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখিয়ে চিত্তরঞ্জনের হিন্দু-মুসলিম প্যাক্ট বাতিল করেন। কেবল রাজনীতিক নন, অন্যরাও দাঙ্গার সময়ে নিজেদের গা বাচিয়ে চলেছিলেন। কলকাতায় তখন ছোটােবড়ো সংস্কৃতিকর্মী, বুদ্ধিজীবী, শিল্পীহিন্দুমুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরকম ছিলেন না। এমন কি, রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্রের মতো সাহিত্যিকও ছিলেন। সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, এই দাঙ্গার সময়ে ঠাকুরবাড়ির ভিস্তি আবদুলের দু কান কেটে দিয়েছিলো দাঙ্গাকারীরা। রক্ত ঝরতে থাকা কান নিয়েই আবদুল জোড়াসাকোর বাড়িতে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছিলো। আর-একদিন জনাচল্লিশ মুসলমান দাঙ্গাবাজদের তাড়া খেয়ে দেওয়াল টপকে বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলো। সুতরাং বাড়ির কারো দাঙ্গার কথা অজানা ছিলো না। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথেরও নয়। কিন্তু সমাজের বিশিষ্ট হিন্দু-মুসলমান কেউই নজরুলের মতো জোর গলায় কাণ্ডারী হুশিয়ার গাওয়া দূরে থাক, গুনগুন করেও হিন্দুমুসলিম ভ্রাতৃত্বের সুর ভাঁজেননি। রবীন্দ্রনাথ, ধরা যাক, খবরের কাগজে একটা বিবৃতি অন্তত দিতে পারতেন। বঙ্গভঙ্গের সময়ে তিনিই তো রাখী পরিয়েছিলেন মুসলমানের হাতে! একমাত্র কাণ্ডারী হুশিয়ার গান নয়, ১৯২৬ সালের দাঙ্গা দেখে নজরুল এতো ব্যাকুল হয়েছিলেন যে, তিনি মন্দির মসজিদ এবং হিন্দু-মুসলমাননামে দুটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন। মন্দির মসজিদ প্রবন্ধে আবেগে আপুত হয়ে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অনুসারীদের ধিক্কার দিয়েছেন।
ধর্ম যে মানুষের তৈরি এবং অর্থহীন, তারও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। হত-আহতদের ক্ৰন্দনে মসজিদ টলিল না, মন্দিরের পাষাণ দেবতা সাড়া দিল না। শুধু নির্বোধ মানুষের রক্তে তাহদের বেদী চিরকলঙ্কিত হইয়া রহিল।' কিন্তু হতাশা দিয়েই তার বক্তব্য তিনি শেষ করেননি। আশা করেছেন সেই রুদ্র আসিতেছেন, যিনি ধর্ম-মাতালদের আডডা মন্দিরমসজিদ-গীর্জা ভাঙিয়া সকল মানুষকে এক আকাশের গম্বুজতলে লইয়া আসিবেন। হিন্দু-মুসলমান প্রবন্ধে লিখেছেন, এই দুই সম্প্রদায়ের বিরোধের প্রধান কারণ মোল্লা-পুরুতের দেওয়া শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা হিন্দুত্ব মুসলমানত্ব দুই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্ব দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা দুটোই মারামারি বাধায়। টিকিত্ব হিন্দুত্ব নয়, ওটা হয়ত পণ্ডিতত্ব! তেমনি দাড়িও ইসলামত্ব নয়, ওটা মোল্লাত্ব!দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে একবারই নয়, নজরুল বারবার হিন্দু-মুসলমানের মিলন এবং ভ্রাতৃত্বের কথা বলেছেন। মনে করিয়ে দিয়েছেন মোরা একটি বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান। কখনো বলেছেন হিন্দু-মুসলমান দেশমাতার দুই আঁখি-তারার মতো। ভুল বোঝাবুঝি থেকে তাদের মনোমালিন্য হতে পারে, মারামারিও অসম্ভব নয়। কিন্তু তারা একই মায়ের দু সন্তান। তারা একই ভাষায় মাকে ডাকেন। বস্তুত, সংক্ষেপে বলা যায়, তিনি যেভাবে বারংবার হিন্দু-মুসলমানের মিলনের চেষ্টা করেছেন, বাংলা সাহিত্যে অন্য কেউ তা করেননি। অন্তরের অনুভূতি দিয়ে তো নয়ই, এমন কি, সামাজিক দায়িত্ব হিশেবেও নয়। আরও একটি জিনিশ বিশেষ করে লক্ষ্য করার মতোতিনিই প্রথম হিন্দু এবং মুসলিম ঐতিহ্যের অসামান্য মিলন ঘটিয়েছিলেন। কবিতার একই চরণে তিনি দেবতা এবং ফেরেশতা, অবতার এবং পয়গম্বরের কথা বলতে পারতেন। তিনিই বাংলা সাহিত্যের একমাত্র কবি, যিনি একই সঙ্গে হিন্দু এবং মুসলমানী ধর্মীয় সঙ্গীত রচনা করেছেন। কেবল তাই নয়, একই সঙ্গে রচনা করেছেন কীর্তন এবং শ্যামাসঙ্গীত তার শ্যামাসঙ্গীতে তিনি আবার শ্যামামায়ের সঙ্গে মিলন ঘটাতে পেরেছেন শ্যামের তার ভক্তির দৃষ্টিতে সব ধর্ম, সব বর্ণ একাকার হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলেন, নজরুলের সাহিত্যে বৈদগ্ধ্যের অভাব ছিলো তার নিজের ভাষায় "সেই চিরকেলে বাণী ছিলো না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার আগে অথবা পরে কেউই সব্যসাচীর মতো হিন্দু-মুসলিম ঐহিত্যের এমন সমন্বয় ঘটাতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথও নন। সাহিত্যের মান বিচার করলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের কোনো তুলনা চলে না, কিন্তু ঐতিহ্য সমন্বয়ের প্রশ্ন উঠলে স্বীকার করতেই হবে যে, নজরুল যেমন করে হিন্দু-মুসলিম ঐহিত্যের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তা আদৌ করতে পারেননি। করার চেষ্টাও করেননি। বস্তুত, বাড়ির কাছের পড়শিদের প্রাঙ্গণের ধারে গেলেও তিনি তাদের বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করেননি। অপর পক্ষে, নজরুল তা কেবল করেননি, সার্থকভাবে করেছিলেন তিনি যেভাবে তৎসম-তদ্ভব শব্দের সঙ্গে আরবি-ফারসি শব্দের মিলন ঘটিয়েছিলেন, তাও একমাত্র তারই রচনায় দেখা যায়। এবং তিনি এটা করেছিলেন, আধুনিক বাংলা ভাষার জন্মদাতা এবং পালক রবীন্দ্রনাথ যখন খুনশব্দের ব্যবহারে বিরক্ত হয়েছেন, সেই প্রতিকূল সময়ে।
হিন্দু-মুসলমানের মিলনের প্রয়াসে তিনি যে-ভূমিকা রেখেছিলেন, নজরুল নিজেই তার মূল্যায়ন করেছেন: 'আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ড শেক করাবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আজও হিন্দু-মুসলমান এক হতে পারেননি। স্বাধীনতা লাভের পরে শিক্ষা এবং অর্থনীতির উন্নতির ফলে তাদের পারপরিক রক্তপাত এবং হানাহানি বন্ধ হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু তা হয়নি। বরং পশ্চিমবঙ্গে গৈরিক পতাকা এখন পতপত করে উড়তে শুরু করেছে। আর বাংলাদেশে হিন্দু খেদানোর সহিংস প্রক্রিয়া আরও জোরদার হয়েছে। বাংলাদেশে ইদানীং দাঙা হলে, হিন্দু খুন করে পুণ্য অর্জনের চেষ্টা না-করে ধর্মান্ধরা হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করে আর বাড়িতে আগুন লাগায়। তাদের লক্ষ্য; ভয়ভীতি দেখিয়ে হিন্দুদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের সম্পত্তি আত্মসাৎ করা। এমন কি, তথাকথিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পরেও হিন্দুদের ওপর নেমে আসে অত্যাচারের খড়গ কৃপাণ তাদের অপরাধ: সম্ভবত তারা অসাম্প্রদায়িক প্রার্থীদের ভোট দিয়েছেন। মোট কথা, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও, হিন্দু-মুসলমানের প্রেম কিছু বৃদ্ধি পায়নি। নজরুলের প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। আশি বছর আগে চিত্তরঞ্জন সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, হিন্দু-মুসলমানের পরানে তুমিই বাধিলে সেতু! কথা সমান সত্য তার সম্পর্কেও। কিন্তু মর্মান্তিক সত্য হলো: চিত্তরঞ্জন এবং নজরুল প্রেমের আহবান জানালেও, দুজনার ললিত বাণীই হাওয়ায় ভেসে গেছে। নজরুলের অসাম্প্রদায়িকতা আমরা যে কেবল সাহিত্যের মধ্যেই লক্ষ্য করি, তাই নয়। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি আনুষ্ঠানিক ধর্মের উর্ধ্বে উঠতে পেরেছিলেন। তার বন্ধুত্ব কোনো ধর্মীয় গভীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না। এমন কি, বিয়েও তিনি করেছিলেন নিজের ধর্মের সীমানা অতিক্রম করে। এসব ক্ষেত্রে মুসলমানরা স্ত্রীকে ধর্মান্তরিত করেন। অপর পক্ষে, নজরুলের সেই সৎসাহস ছিলো যে, প্রমীলার ধর্মবিশ্বাসের ওপর প্রভাব না-খাটিয়েই তাকে বিয়ে করতে পেরেছিলেন। যে পরিবারে তিনি বিয়ে করেছিলেন, সেই পরিবারের সদস্যরা তাকে ভালোবাসতেন। কিন্তু তাদের বাড়ির কন্যাকে মুসলমানের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্যে তৈরি ছিলেন না। এই পরিবারের বিরজাসুন্দরী দেবীকে নজরুল নিজের মায়ের শূন্য আসনে বসিয়েছিলেন, কিন্তু তিনিও বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। হিন্দু সমাজের অনেক রক্ষণশীল সদস্যরাও নয়। কারণ, একে তারা বিবেচনা করেছিলেন তাদের জাত মারার একটি চোখ-ধাধানো দৃষ্টান্ত হিশেবে সন্তানদের নামকরণ এবং শিক্ষায়ও এই অসাম্প্রদায়িকতার প্রমাণ দিয়েছিলেন নজরুল। তার প্রথম সন্তানের নাম তিনি দিয়েছিলেন কৃষ্ণ মহাম্মদ। মুসলমানদের মধ্যে এখন বাংলায় নাম রাখেন অনেকেই। কিন্তু কৃষ্ণ এবং মহাম্মদের মিলন ঘটিয়ে নয়। দ্বিতীয় পুত্রের নাম দিয়েছিলেন অরিন্দম খালেদ তৃতীয় এবং চতুর্থ পুত্রের নাম দিয়েছিলেন যথাক্রমে সব্যসাচী আর অনিরুদ্ধ। অরিন্দম, সব্যসাচী এবং অনিরুদ্ধতিনটি নামেরই ধর্মনিরপেক্ষ অর্থ থাকলেও, তাদের ধর্মীয় অনুষঙ্গই প্রধান মুসলমানরা এতে তার প্রতি প্রসন্ন হতে পারেননি। কিন্তু নজরুল সে সমালোচনা অগ্রাহ্য করতে পেরেছিলেন। কারণ, আনুষ্ঠানিক ধর্মের চেয়েও মানবিক এবং ভাষিক পরিচয় তার কাছে বড়ো ছিলো। সন্তানদের তিনি কোনো ধর্মীয় শিক্ষাও দেননি। নিজেও ব্যক্তিগত জীবনে কোনো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতেন না। দ্বিতীয় পুত্র মারা যাওয়ার পর তিনি যখন শোকে প্রায় উন্মাদ হয়ে যান, তখন অবশ্য বরদাচরণ মজুমদারের প্রভাবে পড়ে তিনি কালী পূজো করতে আরম্ভ করেছিলেন বলে কেউ কেউ লিখেছেন

অদৃষ্টের পরিহাস এই যে, যে-নজরুল ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার গান গেয়েছেন, মুসলমানরা, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা সেই নজরুলের নাম ব্যবহার করেই মুসলিম জাতীয়তাবাদের নিশান উড়িয়েছেন। তারা নজরুলের নাম ভাঙিয়েছেন নিজেদের সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্যে। রবীন্দ্রনাথ থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে রাখার জন্যে পাকিস্তানীরা নজরুলকে খাড়া করেন মুসলমান-রবীন্দ্রনাথ হিশেবে তার কবিতার ভাষা সংস্কার করে তারা নজরুলের ভগবান'কে 'রহমানে পরিণত করেন। মহাশ্মশানকে বদলে করেন গোরস্থান সামগ্রিক নজরুলকে নয়, তারা খাড়া করলেন এক খণ্ডিত নজরুলকে নজরুলের ইসলামী গান বাজানো হলো বেতারে, টিভিতে। নজরুল যে শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন এবং অন্যান্য ভক্তিবাদী গানও লিখেছিলেন, তার কথা কেউ জানলোও না। পাঠ্যবইতে তিনি যে-প্রাধান্য পেলেন তা তার অবদানকে ছাড়িয়ে গেলো। এমন কি, অনেক সময়ে রবীন্দ্রনাথ স্নান হয়ে গেলেন নজরুলের ছায়ায় যে-কালে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করাকে সরকার ভালো চোখে দেখতো না, এই কালে নজরুল-জয়ন্তী পালনে সরকারের উদার পৃষ্ঠপোষণ মিললো। এমন কি, যে-নজরুলকে ১৯২০-এর দশকে মুসলমানরা নমরুদ, ফেরাউন, শয়তানের অবতার এবং কাফের বলে গাল দিয়েছিলেন, সেই নজরুল পঞ্চাশের দশকে সংস্কার-সাপেক্ষে মুসলমান হয়ে উঠলেন, আর শতাব্দীর শেষে এসে নব্যসাম্প্রদায়িকতায়-উন্মত্ত লোকেদের কাছে তিনি পাক্কা মুসলমানে পরিণত হলেন নজরুল একদিনে মরেননি তিনি নির্বাক হয়ে বেঁচেছিলেন পয়তিরিশ বছর। তারপর কেটে গেছে আরও তিরিশ বছর এই প্রায় পয়ষট্টি বছরের মধ্যে তিনি কয়েকবার মারা যান। তার গানের চরম অনাদর থেকে মনে হয়, তিনি প্রথম বার মারা যান পশ্চিমবাংলায়, দেশবিভাগের ঠিক পরে। মনে হয়, তার পেছনেও ছিলো সাম্প্রদায়িকতা। দ্বিতীয় বার তিনি মারা যান পূর্ব পাকিস্তানে, তাকে খণ্ড খণ্ড করে হাজির করায়। তৃতীয়বার মারা যান বাংলাদেশে, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করায়। চতুর্থবারও মারা যান বাংলাদেশে মৌলবাদীদের হাতে এবারে কেবল ব্যক্তি নজরুল নন, তার আদর্শও ভূত অর্থাৎ অতীত হয়ে যায়। নজরুল মরেও মুসলিম জাতীয়তাবাদের হাত থেকে রেহাই পাননি। পরিজনের মতামত ছাড়াই তাকে যে ঢাকায় সমাধিস্থ করা হয়, সেও ইসলামের প্রতীক হিশেবে তার নাম ব্যবহার করার জাতীয়তাবাদী উদ্দেশ্য থেকেই অথচ ধমীয় জাতীয়তাবাদের প্রভাবে উভয় বাংলাতেই বাঙালিত্ব যখন বিপন্ন, এমন কি, বিপন্ন যখন মনুষ্যত্ব, তখন নজরুলের বেঁচে থাকাটাই খুবই দরকার ছিলো। বস্তুত, একজন নজরুল নয়, খুবই দরকার ছিলো ঘরে ঘরে নজরুলের।

 
back to top