কাফের ফতোয়ার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, পৃথিবীর সব বড় বড় ইসলাম ধর্মের মনীষীরাই কাফের ফতোয়ায় ভূষণে ভূষিত! যেমন, বড়পীর আবদুল কাদের জিলানীকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কাফের ফতোয়া দেয়া হয়েছিলো!!
এরপর আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কোরানের তাফসিরকারক ইমাম গাজ্জালীকে যিনি সবচেয়ে বড় ১০০ খন্ডের কোরানের তাফসির লিখে গেছেন কিন্তু তৎকালীন মোল্লারা সে তাফসিরখানা পুড়িয়ে দিয়েছিলো!
ইমাম গাজ্জালির অমর বই "এহিয়াও উলুম" রাজার পাচক তথা বাবুর্চি বুদ্ধি করে পুড়িয়ে ফেলার হুকুম হতে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু কোরান- এর একশত খন্ডে রচিত তফসির বাঁচাতে পারলেন না। আজও সেই পোড়া তফসিরের অংশবিশেষ বৈরুতের জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ইমাম গাজ্জালি বলেছিলেন, ’তিন কুরি তের ফেরকার জন্ম যাতে না হতে পারে, তার জন্য অনেক পরিশ্রম করে লিখে গেলাম পৃথিবীর সবচেয়ে আয়তনে বড় একশত খন্ডে কোরান- এর তফসির।’ কিন্তু তৎকালীন দলবাজ মোল্লাদের হজম হয়নি এ তাফসির। এবং বিনিময়ে ইমাম গাজ্জালী উপহার পেয়েছেন গালাগালি এবং কাফের ফতোয়া।
ফতুয়া এ মক্কী রচনা করার জন্য বিশ্ববিখ্যাত মনীষী মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবীকে ‘শ্রেষ্ঠ কাফের' টাইটেল দেওয়া হয়েছে। মসনফী শরীফ রচনার জন্য মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি কাফের ফতোয়ায় ভূষিত হোন। হাফেজ সিরাজি, আল্লামা জামি, আহমেদ রেফাই সবাই গবেষণা করতে গিয়ে কম বেশি ফতোয়ার অপমানে জর্জরিত হয়েছেন।
পাকিস্থানের মুক্তচর্চাকারী উচ্চশিক্ষিত ডক্টরেট করা ডাবল টাইটেল ধারী মাওলানা, আল্লামা ইকবালের বিরুদ্ধে কাফের ফতোয়া দিয়েছিলেন তৎকালীন মোল্লারা। একবার আল্লামা ইকবাল গুণীজনের সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে সাংঘাতিক একটা কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দিলেন এই বলে যে, "আমার আন্তরিক সালাম আলেমদের কাছে পৌছে দিন এবং এই শ্রদ্ধেয় আলেমেরা যে কোরান-এর তফসির তথা ব্যাখ্যা লিখেছেন সেই কোরান-এর তফসির তথা ব্যাখ্যা দেখে আল্লাহ্, রসুল এবং ফেরেস্তারা সবাই তাজ্জব!! এই অালেমেরা কি সুরা কাহাফ-এর ১০৯ নম্বর আয়াত এবং সুরা লোকমানের ২৭ নম্বর আয়াত ভালো করে বার বার পড়েন নি?" ব্যস শুরু হলো তার বিরুদ্ধাচারণ। এরপর ইকবাল তার "শিকোয়া" বইয়ে আল্লাহর প্রতি কয়েকটি প্রশ্ন রেখেছিলেন। কেন তিনি প্রশ্ন রাখলেন এজন্য খেপে গিয়ে আল্লামা ইকবালকে সেই দিনের বৃটিশ শাসিত ভারতের কিছু সংখ্যক মোল্লাদের বিচার-এর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল। প্রায় হাজার খানেক আলেম নামক মোল্লা আল্লামা ইকবালকে কাফের ফতোয়া দিয়েছিল। এবং এরপর ইকবাল সেই শিকোয়ার বিতর্কের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছিলেন "জওয়াব এ শিকোয়া" গ্রন্থে!
ইসলাম ধর্মের উপর আরো যত মুক্তচর্চাকারী গবেষক ছিলেন, যারা এগুলা প্রকাশ করেছেন তারা সবাই কম বেশি কাফের ফতোয়ায় ভূষিত হয়েছেন এবং অপমানের শিকার হয়েছেন। এছাড়া ইসলাম ধর্মের উপর যত ধরনের কবি মনীষীরা বিজ্ঞান দর্শন জ্ঞান গবেষণা করে গেছেন সবাইকে কম বেশী কূপমন্ডুক মোল্লারা কাফের ফতোয়া দিয়েছে, তার আরেকটা উদাহরণ হলো জ্ঞান গবেষক ইবনে সীনা!! কূপমন্ডুকেরা যেমন কূপে বন্দি তেমনি তারা আশা করে সবাই সেখানে বন্দি হলেই ধার্মিক এবং কেউ তাদের তৈরিকৃত কূপে বন্দি না হলেই কাফের ফতোয়া! শুধু কি তাই? ৭২ দলের একদল আরেকদলের উপর ফতোয়াবাজি মারামারি তো আছেই। হাস্যকর হলো, সেসব ফতোয়া অনুযায়ী প্রতিটা মুসলমানেরাই একদল আরেকদলের নিকট কাফের ফতোয়ার আওতাধীন!!!!
মতামতকে সম্মান না জানানো, আর নতুন জ্ঞান গবেষণা মেনে না নেবার প্রবণতা আর দলাদলির ফতোয়ার বেড়াজালে পড়ে ইমাম আবু হানিফার মত মনীষীকে এন্তেকাল করতে হয় জেলখানার একটি ছোট কুঠুরিতে। ইমাম আহমদ হাম্বলের মত মনীষীকে মোতাজেলা ফেরকায় বিশ্বাসীরা কী নির্মম ভাবে শহীদ করেছেন! সুন্নি মুসলমানেরা যাকে কাফের ফতোয়া দিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে সেই মনীষী ইমাম ইবনে তাইমিয়ার নূতন গবেষণার ফসলকে সহ্য করে নেবার মন মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছে। হোক না ইমাম তাইমিয়ার গবেষণার ফসল অগ্রহণযোগ্য, কিন্তু গবেষণার ফসলে আঘাত আসলে সেই গবেষকের যখন আর কোন স্বাধীনতা থাকে না তখন আগ্রহ আর থাকে না। এভাবে মুক্তচর্চা নতুন জ্ঞান গবেষণা স্থবির হতে হতে সত্যটি হয়ে যায় আড়াল আর অন্ধ কানাগলিতে গিয়ে আটকে পড়ে একটি জাতি! দলাদলি আর ফতোয়ার ইতিহাস কতো নির্মম তাহলে বুঝুন!
যারাই প্রচলিত বিশ্বাসের থেকে বের হয়ে একটু ভিন্নভাবে সত্যটি উপস্থাপন করেছে, কিন্তু মিথ্যার বিরোধীতা করেছে সবারই গলা কাটা গিয়েছে। অপমান অপদস্ত হয়েছে। "আনাল হক্ব" তথা আমিই সত্য এ কথা বলাতে মনসুর হাল্লাজের গলা কাটা যায় নি? অথচ কথার গভীরতা কে বুঝতে চেয়েছে? যীশুকে শূলীতে চড়ানোর আদেশ হয়নি? সত্যের প্রশ্নে মিথ্যার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে ইমাম হোসাইনের মাথা দিতে হয়নি?
অথচ ধর্ম বলতে আল্লাহ কি বুঝিয়েছিলেন সৃষ্টির প্রথম থেকে?
"তুমি একনিষ্ঠ ভাবে নিজেকে ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখ। এটাই #আল্লাহর প্রকৃতি যার উপর তিনি মানব সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল ধর্ম। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। (রুম-৩০)
ধর্ম মানে প্রথমে অন্বেষণ করা এবং পরে সেটি ধারণ করা। প্রতিটি মানুষের ভেতর যে স্রষ্টার পবিত্র প্রকৃতি সেটা জ্ঞান গবেষণায় খুঁজে বের করা এবং অতঃপর ধারণ করাই তো আসল সরল ধর্ম। সব ধরনের আনুষ্ঠানিক ধর্ম পালনের মূলভাবই ওটা। এটা যারা ধারণ করতে পারে তারাই প্রকৃত ধার্মিক। আর যারা খোলস বহনে ব্যস্ত তাদের বাহিরটা দেখতে খুবি সুন্দর কিন্তু ভেতরটা মাকাল ফলের মতই নিষ্ফল আর কলুষতাপূর্ণ!
পৃথিবীর সকল বড় বড় ওলী মুনী ঋষিরা এটাই বলে গেছেন যে প্রকৃত সত্যটা ধারণ করো, মাকাল ফল হইয়ো না এবং সত্যটা বলাই তাদের একমাত্র অপরাধ ছিলো! কারণ খোলসধারী শোষক পূজিবাদি ধার্মিক শ্রেণীর এ কথাটি কখনোই পছন্দ হয়নি। তারা আজীবন খোলসের পূজা করে নিজেদের মন পেট ভারি করায় ব্যস্ত থাকতেই অধিক পছন্দ করে। ভেতরে যাই থাকুক উপরে তো মাশাল্লাহ একদম নূর বেয়ে পড়ছে! এবং এ খোলসকে যত্ন করতে করতে ভেতর দেখার সময়ও নাই।
জ্ঞান গবেষণাকে তো তারা অতি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেই এবং এগুলা খ্রিস্টান ইহুদিদের কাজ বলে সযত্নে এড়িয়ে যায়ই কিন্তু ধর্মের গবেষণার ক্ষেত্রে আরো কঠিন রুপ ধারণ করে যেনো তা করাই যাবে না, ধর্মের বেলায় তো কোন কথাই বলা যাবে না, যা জেনেছি সেটাই শেষ, আমার দলের লোকেরা যা বলেছে এটাই সর্বোচ্চ সঠিক, এরবেশি জানার ক্ষেত্রে জ্ঞানের দরজায় "একবারে তালা দিয়েছি আজীবনের মত" এই অবস্থা!!! অথচ আল্লাহ প্রতিটা জ্ঞানীর উপর অধিক জ্ঞানী বানিয়েছেন বলে কোরানের ঘোষনা পাই, কিন্তু তারা কেবল মুখস্তজ্ঞানীদেরই জ্ঞানী মানে আর মুখস্তবিদ্যায় বিদ্বানদের বানিয়েছে সর্বোচ্চ জ্ঞানী!!!
আর দুঃখজনক হলেও সত্য গবেষণা বিমুখ হতে হতে এখন মুসলমান জাতির মধ্যে অতি সাধারণভাবেই একটু ভিন্ন মতপ্রকাশের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতাটুকুও নেই বললেই চলে! বললেই হেনস্থা অপমান টিটকারি জুটে যায় কপালে!
আর সেক্ষেত্রে এখানে ধর্মের সত্য বলা কতটা দূরুহ তা সহজেই অনুমান করা যায়! দলকানা খোলসধারীরা আজীবন খোলস খসে পড়ার ভয় পায়! যারাই নতুনভাবে নতুন গবেষণায় নতুন পরিচয়ে প্রকাশিত হয়ে সত্য বলে, তখনি তারা আল্লাহর অসীম জ্ঞানের ভান্ড যা তিনি মানুষের মাধ্যমে প্রকাশ করে চলেছেন সেটিকে সরাসরি অস্বীকার করে দেয় এবং তাদের উপর ঠাট্টা বিদ্রুপ, ফতোয়া জারি, আঘাত, হত্যা, মিথ্যা অপবাদ দিতে থাকে কারণ যে করেই হোক নিজেদের খোলস তো রক্ষা করতেই হবে! খোলসকে যত্ন না করলে আর সেটা খসে পড়লে যে আসল কুৎসিত চেহারাটা বের হয়ে যাবে তাই সেটা যে করেই হোক রক্ষা করতেই হবে। কিন্তু সত্য ধর্মের বেলায় যে মানুষকে অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে, ফতোয়া দিয়ে সেটি রক্ষা করতে হয়না বরং আজীবনই স্রষ্টা কর্তৃক সেটি রক্ষিত তা কি তারা জানে?