মসজিদ হচ্ছে আল্লাহর ঘর এবং এই মহান স্রষ্টার সামনে
সেজদায় লুটিয়ে পড়ার স্থান। যুগে যুগে খোদা-প্রেমে ভক্তদের মিলনমেলা হিসেবে বিবেচিত
হয়েছে এই পবিত্র স্থান। একইসঙ্গে অনেক সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে এই
মসজিদকে কেন্দ্র করে। এমনকি, এই মসজিদে বসেই নেয়া হয়েছে
রাজনৈতিক ও সামরিক সব সিদ্ধান্ত। ইসলামি শিল্প, সংস্কৃতি
ও সভ্যতার নিদর্শন হিসেবেও মসজিদ পালন করেছে এক অনন্য ভূমিকা।
মুসলিম বিশ্বে মসজিদের এই অপরিসীম গুরুত্ব বিবেচনা করে আমরা নতুন এই
ধারাবাহিক নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। এ অনুষ্ঠানে আমরা মসজিদ সম্পর্কে পবিত্র
কুরআনের আয়াত, রাসূলুল্লাহ (সা.)’র
হাদিস এবং নিষ্পাপ ইমামদের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করব। সেইসঙ্গে এ অনুষ্ঠানে বিশ্বের
কিছু বড় ও গুরুত্বপূর্ণ মসজিদের সঙ্গেও পরিচিত হব আমরা।
পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশেষ ঐশী ধর্ম ইসলাম মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের
লক্ষ্যে মানুষের জন্য বিশেষ কিছু ইবাদতের ব্যবস্থা করেছে। এসবের মধ্যে সবচেয়ে
মর্যাদপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে নামাজ। আর 'মসজিদ' শব্দের উৎপত্তি হয়েছে সিজদা শব্দ থেকে। এই পবিত্র স্থানে মহান আল্লাহর
সামনে তাঁর বান্দা সিজদায় অবনত হয় বলে এর নাম দেয়া হয়েছে মসজিদ। নামাজকে ইসলামের
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত বলে গণ্য করা হয় এবং সিজদা হচ্ছে নামাজের সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে সিজদা করার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সামনে
পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়। সূরা নাহলের ৪৯ নম্বর আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছে,
“আল্লাহকে সেজদা করে যা কিছু নভোমন্ডলে আছে এবং যা
কিছু ভুমন্ডলে আছে এবং ফেরেশতাগণ;তারা অহংকার করে না।” সিজদা হচ্ছে ইবাদতের সর্বোচ্চ পর্যায়। অন্যান্য ইবাদতের তুলনায় এমনকি
নামাজেরই অন্যান্য অংশের তুলনায় সিজদার রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য ও মর্যাদা। ইসলামি
সংস্কৃতিতে মসজিদ- বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর হিসেবেও বিবেচিত হয়।
আসমান-জমিনসহ বিশ্বজগতের সবকিছুর মালিক আল্লাহ তায়ালা।
কিন্তু এর মাঝে একমাত্র মসজিদকেই তিনি নিজের ঘর বলে অভিহিত করেছেন। মানুষ যাতে এই
পবিত্র স্থানের মর্যাদা যথাযথভাবে উপলব্ধি করে এবং এখানে সমবেত হয়ে ইবাদত-বন্দেগী
করার মাধ্যমে আল্লাহর রহমত হাসিল করতে পারে সেজন্যই এ নামকরণ করেছেন আল্লাহ
তায়ালা। অবশ্য সব মসজিদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে সমান নয় বরং কোনো কোনো মসজিদের
গুরুত্ব তাঁর কাছে অন্যান্য মসজিদের তুলনায় বেশি। হাদিসে এসেছে, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় মসজিদ হচ্ছে মক্কার মসজিদুল হারাম বা
কাবাঘর। এরপর রয়েছে মদীনার মসজিদে নববী, কুফা মসজিদ ও
আল-আকসা মসজিদের অবস্থান। এরপর আল্লাহ পছন্দ করেন প্রতিটি শহরের কেন্দ্রীয় বা মূল
মসজিদ, তারপর পাড়া-মহল্লার মসজিদ এবং সবশেষে বাজারগুলোতে
অবস্থিত মসজিদ। মসজিদুল হারামের মর্যাদা আল্লাহর কাছে এত বেশি যে, সারাবিশ্বের মুসলমানদেরকে এই কাবাঘরের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করতে
হয়।
বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, ঘরে বসে নামাজ
আদায়ের সওয়াব এক গুণ, এলাকার মসজিদে নামাজের সওয়াব ২৫ গুণ,
শহরের প্রধান মসজিদে নামাজ আদায়ের সওয়াব ৫০০ গুণ, আল-আকসা মসজিদে নামাজের সওয়াব ৫০ হাজার গুণ, আমার
মসজিদে ( অর্থাৎ মসজিদে নববীতে) নামাজ আদায়ের সওয়াব ৫০ হাজার গুণ এবং মসজিদুল
হারামে নামাজ পড়ার সওয়াব মহান আল্লাহ ১ লক্ষ গুণ বেশি দিয়ে থাকেন। ইমাম বাকের (আ.)
পবিত্রতম এ মসজিদে নামাজ আদায়ের ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, যদি কেউ মসজিদুল হারামে এক ওয়াক্ত ফরজ নামাজ আদায় করে তাহলে তার জীবনের
আদায় করা অতীত ও ভবিষ্যতের সব ফরজ নামাজ আল্লাহর দরবারে নিশ্চিতভাবে কবুল হয়ে যায়।
হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ বলেন, “জমিনে
আমার ঘর অর্থাৎ মসজিদগুলো আসমানবাসীর কাছে সেইরকম জ্বলজ্বল করে ঠিক যেরকম আকাশের
তারাগুলো জমিনবাসীর কাছে উজ্জ্বল মনে হয়। যারা মসজিদকে আপন করে নিয়েছে তারা
সৌভাগ্যবান। সেই ব্যাক্তি ভাগ্যবান যে নিজের ঘরে ওজু করার পর আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ
লাভের জন্য আমার ঘরে আগমন করে। তোমরা জেনে রেখো, যারা আমার
সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন আমার জন্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।
যারা রাতের অন্ধকারে মসজিদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় তাদেরকে কিয়ামতের দিনের উজ্জ্বল
আলোর সুসংবাদ দিন।”
মসজিদুল হারাম ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে পুরনো ও
মর্যাদাসম্পন্ন মসজিদ। হাদিসে এসেছে, সৃষ্টির শুরুতে
প্রবল বন্যার পানির নীচে গোটা পৃথিবী তলিয়ে গিয়েছিল। এরপর ভূপৃষ্ঠের যে স্থান সবার
আগে পানির উপরে ভেসে উঠেছিল সেটি ছিল কাবা শরীফের এই স্থান। মহান আল্লাহ ভূপৃষ্ঠকে
এখান থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন, মহান আল্লাহ যখন
পৃথিবী সৃষ্টি করতে চাইলেন তখন বাতাসকে নির্দেশ দিলেন পানির উপরে প্রচণ্ড জোরে বয়ে
যেতে যাতে তাতে ফেনা তৈরি হয়। এই ফেনাগুলোকে কাবার স্থানে এনে জড়ো করে তা দিয়ে
একটি পাহাড় তৈরির আদেশ দেন। এরপর এই পাহাড়ের নীচ
থেকে ভূপৃষ্ঠকে চারিদিকে ছড়িয়ে দেন। সূরা আলে ইমরানের ৯৬ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে
বলা হয়েছে, “নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা
মানুষের জন্যে নির্ধারিত হয়েছে,সেটাই হচ্ছে এ ঘর,যা মক্কায় অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য বরকতময় ও হেদায়েতের উৎস।” কাজেই দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর বুকে প্রথম যে
স্থাপনাটি তৈরি হয়েছিল সেটি ছিল কাবা শরীফ। ইমাম সাদেক (আ.) বলেন, “পৃথিবীর
সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে মক্কা। মহান আল্লাহর কাছে মক্কার মাটির চেয়ে প্রিয়
মাটি,
মক্কার পাথরের চেয়ে প্রিয় পাথর, মক্কার
গাছের চেয়ে প্রিয় গাছ, মক্কার পাহাড়ের চেয়ে প্রিয় পাহাড়
এবং মক্কার পানির চেয়ে প্রিয় পানি আর নেই।”
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এই পবিত্র ঘরকে উদ্দেশ করে
আল্লাহর নামে শপথ করে বলেছেন, “আল্লাহর তৈরি
শ্রেষ্ঠ জমিন তুমি, আল্লাহর কাছে প্রিয়তম ভূমিও তুমি।
আল্লাহর শপথ! আমাকে যদি মক্কা থেকে বের করে দেয়া না
হতো তাহলে আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।” হাদিসে এসেছে, আদি পিতা হযরত আদম (আ.) প্রথম
কাবা শরীফ নির্মাণ করেন। এরপর এটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজ
পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)’র সহযোগিতায়
এটি পুনর্নির্মাণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)’র নবুওয়াত
প্রাপ্তির আগে তাঁর উদ্যোগ ও দিক-নির্দেশনায় প্রাথমিক নকশার ভিত্তিতে কুরাইশ
গোত্রের হাতে আবার কাবা শরীফ নির্মিত হয়। তখন থেকে এখন পর্যন্ত মসজিদুল হারাম
বহুবার পুনর্নির্মাণ করার পাশাপাশি এর উন্নতি ও সমৃদ্ধির কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
বর্তমানে মসজিদটির আকার ও আয়তন বহুগুণ বেড়েছে এবং মুসল্লির সংখ্যা
বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখনো বাড়ছে। যেসব কারণে এই মহান ঘরের পবিত্রতা ও মহত্ত্ব
উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে সেগুলোর কয়েকটি হলো- আল্লাহর
নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম ও ইসমাইল (আ.)’র হাতে এটির
নির্মাণকাজ সম্পন্ন, কাবার মধ্যে হযরত আলী (আ.)’র
জন্ম এবং কাবা সংলগ্ন ‘হিজরে ইসমাইল’-এ বিবি হাজেরা ও হযরত ইসমাইল (আ.)’র
কবরের অবস্থান। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমানে এই পবিত্র স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণের
দায়িত্ব পালনকারীরা সেখানে অসংলগ্নভাবে এত বেশি নতুন নতুন ভবন ও স্থাপনা তৈরি
করেছেন যার ফলে মসজিদুল হারামের আধ্যাত্মিক পরিবেশ ও ইবাদতের স্থানে বিঘ্ন
সৃষ্টি হয়েছে। কাবা শরীফের চারপাশের এলাকায় বর্তমানে তৈরি করা হয়েছে অনেক বড় বড়
সুউচ্চ টাওয়ার এবং অসংখ্য সুইমিং পুল যা মসজিদুল হারাম এলাকাকে একটি পর্যটন ও
বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত করেছে। অথচ বিশ্বের যেখানেই এ ধরনের অতি প্রাচীন কোনো
ধর্মীয় স্থাপনা রয়েছে সেখানে বা তার আশপাশে ওই ভবনের
চেয়ে উঁচু কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে দেয়া হয় না।
ইতিহাসে
এসেছে,
হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজের ছেলে হযরত ইসমাইলকে সঙ্গে নিয়ে কাবাঘর
নির্মাণ করেন। এক পর্যায়ে এর দেয়াল যখন উঁচু হয়ে যায় তখন তার উপরে আর নাগাল
পাচ্ছিলেন না আল্লাহর এই নবী। এ অবস্থায় হযরত ইসমাইল (আ.) একটি উঁচু পাথর এনে
দেয়ালের পাশে বসিয়ে দেন যাতে তার উপরে দাঁড়িয়ে হযতর ইব্রাহিম নির্মাণ কাজ চালিয়ে
যেতে পারেন। এই পাথরটি বারবার একস্থান থেকে আরেক স্থানে সরিয়ে তার উপর দাঁড়িয়ে
কাবাঘর নির্মাণ করতে থাকেন আল্লাহর এই নবী। পাথরটির উপর দাঁড়াতে দাঁড়াতে তার উপর
হযরত ইব্রাহিম (আ.)’র পায়ের ছাপ পড়ে যায়। কাবাঘরের
পাশে হযরত ইব্রাহিমের পায়ের ছাপ সম্বলিত সেই পাথরটি আজও সংরক্ষিত রয়েছে। ইতিহাসে
এটি মাকামে ইব্রাহিম নামেই পরিচিত। বর্গাকৃত্তি এই পাথরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৪০
সেন্টিমিটার এবং উচ্চতা ৫০ সেন্টিমিটার।
আব্বাসীয় তৃতীয় খলিফা মেহদি আব্বাসের শাসনামলে এই
পাথরকে স্বর্ণ দিয়ে মুড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি একটি বড় খাঁচার মধ্যে এটিকে সংরক্ষণ করা
হয়। এই খাঁচাটি মসজিদুল হারামের অনেকখানি জায়গা দখল করে আছে বলে ১৯৬৫ সালে এটি
ভেঙে ফেলে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি কাঠামোর মধ্যে পাথরটিকে রাখা হয়। মহান আল্লাহ এ
সম্পর্কে সূরা বাকারার ১২৫ নম্বর আয়াতে বলেন, “ যখন আমি কাবা গৃহকে মানুষের জন্যে সম্মিলন স্থল ও শান্তির আলয় করলাম,
আর (বললাম) তোমরা ইব্রাহীমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাযের জায়গা
বানাও...।” মসজিদুল হারামের
পাশে মাকামে ইব্রাহিমের অবস্থান আল্লাহর ঘর জিয়ারতকারী প্রতিটি মানুষকে মহান
আল্লাহর কাছে হযরত ইব্রাহিম (আ.)’র অতি উচ্চ
মর্যাদার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আল্লাহর প্রকৃত খলিফার মর্যাদা অর্জনের জন্য
প্রতিটি মুমিন মুসলমান এই মাকামে ইব্রাহিম থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করে।
কাবা শরিফের উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আরেকটি অংশ হচ্ছে ‘হাজরে
আসওয়াদ’ পাথর। উপবৃত্তাকার কালো রঙের প্রায়
৫০ সেন্টিমিটার আয়তনের পাথরটি রূপার তৈরি একটি ফ্রেমের মধ্যে সংরক্ষিত আছে। হজের
সময় হাজিরা এই পাথরের সামনে থেকে তাদের তাওয়াফ শুরু করেন এবং কাবাশরিফকে সাতবার
প্রদক্ষিণের পর এই পাথরের সামনে এসে তাওয়াফ শেষ করেন। এরপর তারা এই পাথরটি স্পর্শ
করেন এবং চুমু খান। আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক স্থাপনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে
এই হাজরে আসওয়াদ পাথর। এটি স্পর্শ করার মাধ্যমে বান্দা মহান আল্লাহর প্রতি
আনুগত্যের শপথ পুনর্ব্যক্ত করে।
হযরত আদম (আ.) প্রথম কাবাশরিফ নির্মাণের পর এই পাথরকে এই কাবাঘরের
পূর্ব পাশে স্থাপন করেছিলেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.) যখন এই মসজিদ পুনঃস্থাপন করেন তখন
হাজরে আসওয়াদ পার্শ্ববর্তী আবুকুবাইস পাহাড়ে পড়েছিল। হযরত ইব্রাহিম পাথরটি উঠিয়ে
তার আগের জায়গায় স্থাপন করেন। ওই ঘটনার কয়েকশ’ বছর পর বিশ্বনবী (সা.)’র বয়স যখন ৩৫
বছর তখন প্রবল বর্ষণ ও বন্যায় কাবা শরিফের মারাত্মক ক্ষতি হয়। তখনো নবুওয়াত লাভ না
করলেও উন্নত চারিত্রিক গুণাবলীর কারণে কুরাইশদের কাছে আল-আমিন নামে পরিচিত ছিলেন
তিনি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কাবা পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে কুরাইশ বংশের চারটি গোত্রের
লোকজন হাজরে আসওয়াদকে নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। কোন্ গোত্রের মানুষের হাতে এই
মূল্যবান পাথর কাবা শরীফে স্থাপিত হবে তা নিয়ে সৃষ্টি হয় এই দ্বন্দ্ব। এ অবস্থায়
রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি চাদরের উপর পাথরটি উঠিয়ে চার গোত্রের চারজনকে চাদরটির
চারকোন ধরে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যেতে বলেন। এরপর তিনি নিজের হাতে পাথরটি
জায়গামতো বসিয়ে দেন। এভাবেই নবুওয়াত প্রাপ্তির আগেই একটি মহান কাজ বিশ্বনবীর (সা.)
হাতে সম্পন্ন হয়।
‘হিজরে ইসমাইল’ হচ্ছে আল্লাহর ঘরের আরেকটি মূল্যবান অংশ। এটি কাবা শরীফের সঙ্গে লাগানো
একটি উন্মুক্ত স্থান যা অর্ধবৃত্তাকার একটি দেয়াল দিয়ে ঘেরা। কোনো কোনো সূত্রমতে,
এখানে হযরত ইসমাইল (আ.) ও তাঁর মা বিবি হাজেরা বসবাস করতেন এবং
তারা মারা গেলে তাদেরকে এখানেই দাফন করা হয়।
বিশ্বনবী (সা.)’র একজন
স্ত্রী থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, আমি একবার কাবাঘরে ভেতরে প্রবেশ করে নামাজ আদায় করতে চাইলাম। মহানবী
(সা.) আমাকে হাত ধরে হিজরে ইসমাইলের মধ্যে নিয়ে যান এবং বলেন, “যখন
তোমার কাবাঘরে নামাজ পড়তে ইচ্ছে হবে তখন এখানে এসে নামাজ আদায় করবে; কারণ এটি কাবারই অংশ। কিন্তু তোমার গোত্রের লোকেরা কাবাঘর পুনর্নিমাণের
সময় এটিকে এই ঘরের বাইরে রেখে দেয়।”
রাসূলুল্লাহ (সা.)’র এই হাদিসের সূত্র
ধরে ফকীহগণ রায় দিয়েছেন হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা পালনের সময় হিজরে ইসমাইলের ভেতর দিয়ে
হাঁটা যাবে না বরং এটিসহ কাবাঘরকে তাওয়াফ করতে হবে। বর্তমানে হিজরে ইসমাইলের
দেয়ালের উচ্চতা ১.৩২ মিটার, এর ব্যাসার্ধ ৫.৮ মিটার এবং কাবাশরীফ থেকে এই দেয়ালের
দূরত্ব ২.২২ মিটার।
কাবাঘর
নির্মিত হয়েছে কালো ও কঠিন পাথর দিয়ে যা এর উপরের গিলাফ সরালে দেখতে পাওয়া যায়।
১০৪০ হিজরি সালে বর্তমান কাবাঘরটি সর্বশেষ পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। আল্লাহর নবী
হযরত ইসমাইল (আ.) সর্বপ্রথম কাবাঘরের দেয়ালগুলোকে রক্ষা করার লক্ষ্যে এগুলোকে
পর্দা বা গিলাফ দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন। বর্তমানে কাবাঘর ঢাকতে কালো রঙের গিলাফ
ব্যবহার করা হয় যার উপরের লেখাগুলো স্বর্ণ দিয়ে লেখা। প্রতি বছর হজের মৌসুমের আগে
এই গিলাফ পরিবর্তন করা হয়। কাবাঘরের ভিতরেও রয়েছে আরেকটি গিলাফ যেটি কয়েক বছর পরপর
পরিবর্তন করা হয়। এর কারণ হচ্ছে, বাইরের গিলাফটি রোদ, বৃষ্টি, ঝড় এবং হাজিদের হাতের ছোঁয়ায় নষ্ট হয়ে যায়।
কিন্তু ভিতরের গিলাফের এ ধরনের কোনো ক্ষতি হয় না বলে এটিকে প্রতি বছর পরিবর্তন
করার প্রয়োজন পড়ে না।
কাবা শরীফের
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে জমজম কূপ। হাজরে আসওয়াদের দিকে কাবাঘর থেকে ২১
মিটার দূরে এই কূপ অবস্থিত। এই কূপ সৃষ্টি সম্পর্কে বলা হয়েছে, হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজের স্ত্রী হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাইলকে আল্লাহর
নির্দেশে মক্কার উষ্ণ ও শুষ্ক মরুদ্যানে রেখে চলে যান। তিনি স্ত্রী-পুত্রকে
আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়ে যান। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বিবি হাজেরার কাছে থাকা পানি
শেষ হয়ে যায়। এ সময় পানির সন্ধানে তিনি সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে
সাতবার দৌড়ে যাওয়া-আসা করেন। কিন্তু কোথাও পানির সন্ধান না পেয়ে শিশুপুত্রের কাছে ফিরে এসে দেখেন ইসমাইলের পায়ের ধাক্কায় অলৌকিকভাবে মাটি
ফেটে পানি বেরিয়ে আসছে। পানিকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে দেখে বিবি হাজেরা বলে ওঠেন ‘জম জম’ অর্থাৎ থেমে যাও। তিনি পানিকে ছড়িয়ে না গিয়ে এক
জায়গায় জড়ো হতে বলতে চেয়েছিলেন। সেইসঙ্গে তিনি নিজে আশপাশের মাটি ও বালু জড়ো করে
পানি জমানোর চেষ্টা করেন।
বিবি হাজেরা হয়তো ভেবেছিলেন পানির এই ঝর্ণাধারা থেমে যেতে পারে।
তাই তিনি নিজের কাছে থাকা পানির পাত্র পূর্ণ করে নেন। কিন্তু জমজমের সে পানি আর
কখনোই থেমে যায়নি। সেদিনের ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে জুরহুম গোত্রের লোকজন সেখানে
পানির অস্তিত্ব টের পেয়ে যায়। তারা এই পানির উৎসের পাশেই বসতি গড়ে তোলে। ততদিনে
পানির সে উৎসটি একটি বড় কূপে পরিণত হয়েছে। প্রথমদিকে জমজম কূপের পানি ছিল সেখানকার
বসতির একমাত্র পানির উৎস। কিন্তু ধীরে ধীরে আশপাশে আরো কিছু কূপ সৃষ্টি হয়।
প্রতি বছর হজের মৌসুমে কাবাঘরে প্রচুর মানুষের সমাগম
হওয়ার কারণে তাদের পানির চাহিদা মেটাতে আরো কিছু পানির উৎসের প্রয়োজন দেখা দেয়। এ
কারণে ইসলামের আবির্ভাবের অনেক আগে থেকে মক্কার অন্যতম পেশা ছিল হজের মৌসুমে
মানুষের পানির চাহিদা মেটানো। ইসলামের আবির্ভাবের সময় এই দায়িত্ব ছিল রাসূলুল্লাহ
(সা.)’র চাচা আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের হাতে। ইসলাম
আসার পর আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব মসজিদুল হারামের আঙিনায় রোক্ন ও মাকামের
মধ্যবর্তী স্থানে প্রথম জমজমের পানি বিতরণের স্থান নির্ধারণ করেন। পরবর্তীতে এই মসজিদ সংস্কার ও এর পরিসর বাড়াতে গিয়ে স্থানটি মসজিদুল
হারামের পূর্ব পাশে নিয়ে আসা হয়।
১৯৫৫ সালে জমজমের পানি উঠানোর জন্য সেখানে পাম্প বসানো
হয়। পরবর্তীতে হাজিদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে মসজিদুল হারামের আঙিনায় আরো কিছু
পরিবর্তন আনা হয় যার মধ্যে ছিল জমজম কূপের পানি উঠানো ও বিতরণের স্থানটি
আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে যাওয়া। ১৯৬৪ সালে এ কাজটি সম্পন্ন হয়। এ সময় কূপটিকে ভূপৃষ্ঠ
থেকে ৫ মিটার গভীরে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এটির মুখের আকারকে এক মিটার থেকে বাড়িয়ে
আড়াই মিটার করা হয়। কয়েক বছর আগে জমজম কূপের সেই ভূগর্ভস্থ স্থাপনাও ভেঙে ফেলা হয়।
বর্তমানে জমজমের পানি পাম্পের মাধ্যমে মসজিদুল হারামের বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়
এবং সেখানে পরিশোধন করার পর পাইপলাইনের সাহায্যে আবার মসজিদুল হারামে সরবরাহ করা
হয়।
জমজম কূপের পানির গুরুত্ব ও তা পান করার ফজিলত সম্পর্কে অনেক হাদিস
রয়েছে। মহানবী (সা.) জমজমকে বলেছেন, “পৃথিবীর
শ্রেষ্ঠ পানির কূপ।” তিনি সব সময় এই
কূপের পানি পান করতেন। যেখানেই যেতেন ওজু করা ও খাওয়ার জন্য সাহাবীদেরকে বলতেন
জমজমের পানি নিয়ে আসতে। বর্তমানে সারাবিশ্বের মুসলমানরা
হজ বা ওমরাহ করতে মক্কায় গেলে নিকটাত্মীয়দের জন্য উপহার হিসেবে জমজমের পানি নিয়ে
আসেন। এটি এখন মুসলিম সমাজের একটি সুন্দর সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।