Wednesday, 10 May 2017

ধরণীর বেহেশত মসজিদ (মসজিদুল হারাম)

0 Comments
মসজিদ হচ্ছে আল্লাহর ঘর এবং এই মহান স্রষ্টার সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়ার স্থান। যুগে যুগে খোদা-প্রেমে ভক্তদের মিলনমেলা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এই পবিত্র স্থান। একইসঙ্গে অনেক সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে এই মসজিদকে কেন্দ্র করে। এমনকি, এই মসজিদে বসেই নেয়া হয়েছে রাজনৈতিক ও সামরিক সব সিদ্ধান্ত। ইসলামি শিল্প, সংস্কৃতি ও সভ্যতার নিদর্শন হিসেবেও মসজিদ পালন করেছে এক অনন্য ভূমিকা।
মুসলিম বিশ্বে মসজিদের এই অপরিসীম গুরুত্ব বিবেচনা করে আমরা নতুন এই ধারাবাহিক নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। এ অনুষ্ঠানে আমরা মসজিদ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের আয়াত, রাসূলুল্লাহ (সা.)র হাদিস এবং নিষ্পাপ ইমামদের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করব। সেইসঙ্গে এ অনুষ্ঠানে বিশ্বের কিছু বড় ও গুরুত্বপূর্ণ মসজিদের সঙ্গেও পরিচিত হব আমরা।  

পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশেষ ঐশী ধর্ম ইসলাম মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের লক্ষ্যে মানুষের জন্য বিশেষ কিছু ইবাদতের ব্যবস্থা করেছে। এসবের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে নামাজ। আর 'মসজিদ' শব্দের উৎপত্তি হয়েছে সিজদা শব্দ থেকে। এই পবিত্র স্থানে মহান আল্লাহর সামনে তাঁর বান্দা সিজদায় অবনত হয় বলে এর নাম দেয়া হয়েছে মসজিদ। নামাজকে ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত বলে গণ্য করা হয় এবং সিজদা হচ্ছে নামাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে সিজদা করার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সামনে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়। সূরা নাহলের ৪৯ নম্বর আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছে, আল্লাহকে সেজদা করে যা কিছু নভোমন্ডলে আছে এবং যা কিছু ভুমন্ডলে আছে এবং ফেরেশতাগণ;তারা অহংকার করে না। সিজদা হচ্ছে ইবাদতের সর্বোচ্চ পর্যায়। অন্যান্য ইবাদতের তুলনায় এমনকি নামাজেরই অন্যান্য অংশের তুলনায় সিজদার রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য ও মর্যাদা। ইসলামি সংস্কৃতিতে মসজিদ- বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর হিসেবেও বিবেচিত হয়।
আসমান-জমিনসহ বিশ্বজগতের সবকিছুর মালিক আল্লাহ তায়ালা। কিন্তু এর মাঝে একমাত্র মসজিদকেই তিনি নিজের ঘর বলে অভিহিত করেছেন। মানুষ যাতে এই পবিত্র স্থানের মর্যাদা যথাযথভাবে উপলব্ধি করে এবং এখানে সমবেত হয়ে ইবাদত-বন্দেগী করার মাধ্যমে আল্লাহর রহমত হাসিল করতে পারে সেজন্যই এ নামকরণ করেছেন আল্লাহ তায়ালা। অবশ্য সব মসজিদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে সমান নয় বরং কোনো কোনো মসজিদের গুরুত্ব তাঁর কাছে অন্যান্য মসজিদের তুলনায় বেশি। হাদিসে এসেছে, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় মসজিদ হচ্ছে মক্কার মসজিদুল হারাম বা কাবাঘর। এরপর রয়েছে মদীনার মসজিদে নববী, কুফা মসজিদ ও আল-আকসা মসজিদের অবস্থান। এরপর আল্লাহ পছন্দ করেন প্রতিটি শহরের কেন্দ্রীয় বা মূল মসজিদ, তারপর পাড়া-মহল্লার মসজিদ এবং সবশেষে বাজারগুলোতে অবস্থিত মসজিদ। মসজিদুল হারামের মর্যাদা আল্লাহর কাছে এত বেশি যে, সারাবিশ্বের মুসলমানদেরকে এই কাবাঘরের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করতে হয়।
বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, ঘরে বসে নামাজ আদায়ের সওয়াব এক গুণ, এলাকার মসজিদে নামাজের সওয়াব ২৫ গুণ, শহরের প্রধান মসজিদে নামাজ আদায়ের সওয়াব ৫০০ গুণ, আল-আকসা মসজিদে নামাজের সওয়াব ৫০ হাজার গুণ, আমার মসজিদে ( অর্থাৎ মসজিদে নববীতে) নামাজ আদায়ের সওয়াব ৫০ হাজার গুণ এবং মসজিদুল হারামে নামাজ পড়ার সওয়াব মহান আল্লাহ ১ লক্ষ গুণ বেশি দিয়ে থাকেন। ইমাম বাকের (আ.) পবিত্রতম এ মসজিদে নামাজ আদায়ের ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, যদি কেউ মসজিদুল হারামে এক ওয়াক্ত ফরজ নামাজ আদায় করে তাহলে তার জীবনের আদায় করা অতীত ও ভবিষ্যতের সব ফরজ নামাজ আল্লাহর দরবারে নিশ্চিতভাবে কবুল হয়ে যায়।
হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ বলেন, জমিনে আমার ঘর অর্থাৎ মসজিদগুলো আসমানবাসীর কাছে সেইরকম জ্বলজ্বল করে ঠিক যেরকম আকাশের তারাগুলো জমিনবাসীর কাছে উজ্জ্বল মনে হয়। যারা মসজিদকে আপন করে নিয়েছে তারা সৌভাগ্যবান। সেই ব্যাক্তি ভাগ্যবান যে নিজের ঘরে ওজু করার পর আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভের জন্য আমার ঘরে আগমন করে। তোমরা জেনে রেখো, যারা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন আমার জন্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। যারা রাতের অন্ধকারে মসজিদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় তাদেরকে কিয়ামতের দিনের উজ্জ্বল আলোর সুসংবাদ দিন।
মসজিদুল হারাম ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে পুরনো ও মর্যাদাসম্পন্ন মসজিদ। হাদিসে এসেছে, সৃষ্টির শুরুতে প্রবল বন্যার পানির নীচে গোটা পৃথিবী তলিয়ে গিয়েছিল। এরপর ভূপৃষ্ঠের যে স্থান সবার আগে পানির উপরে ভেসে উঠেছিল সেটি ছিল কাবা শরীফের এই স্থান। মহান আল্লাহ ভূপৃষ্ঠকে এখান থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন, মহান আল্লাহ যখন পৃথিবী সৃষ্টি করতে চাইলেন তখন বাতাসকে নির্দেশ দিলেন পানির উপরে প্রচণ্ড জোরে বয়ে যেতে যাতে তাতে ফেনা তৈরি হয়। এই ফেনাগুলোকে কাবার স্থানে এনে জড়ো করে তা দিয়ে একটি পাহাড় তৈরির আদেশ দেন।  এরপর এই পাহাড়ের নীচ থেকে ভূপৃষ্ঠকে চারিদিকে ছড়িয়ে দেন। সূরা আলে ইমরানের ৯৬ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্যে নির্ধারিত হয়েছে,সেটাই হচ্ছে এ ঘর,যা মক্কায় অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য বরকতময় ও হেদায়েতের উৎস। কাজেই দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর বুকে প্রথম যে স্থাপনাটি তৈরি হয়েছিল সেটি ছিল কাবা শরীফ। ইমাম সাদেক (আ.) বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে মক্কা। মহান আল্লাহর কাছে মক্কার মাটির চেয়ে প্রিয় মাটি, মক্কার পাথরের চেয়ে প্রিয় পাথর, মক্কার গাছের চেয়ে প্রিয় গাছ, মক্কার পাহাড়ের চেয়ে প্রিয় পাহাড় এবং মক্কার পানির চেয়ে প্রিয় পানি আর নেই।
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এই পবিত্র ঘরকে উদ্দেশ করে আল্লাহর নামে শপথ করে বলেছেন, আল্লাহর তৈরি শ্রেষ্ঠ জমিন তুমি, আল্লাহর কাছে প্রিয়তম ভূমিও তুমি। আল্লাহর শপথ! আমাকে যদি  মক্কা থেকে বের করে দেয়া না হতো তাহলে আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।  হাদিসে এসেছে, আদি পিতা হযরত আদম (আ.) প্রথম কাবা শরীফ নির্মাণ করেন। এরপর এটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজ পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)র সহযোগিতায় এটি পুনর্নির্মাণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)র নবুওয়াত প্রাপ্তির আগে তাঁর উদ্যোগ ও দিক-নির্দেশনায় প্রাথমিক নকশার ভিত্তিতে কুরাইশ গোত্রের হাতে আবার কাবা শরীফ নির্মিত হয়। তখন থেকে এখন পর্যন্ত মসজিদুল হারাম বহুবার পুনর্নির্মাণ করার পাশাপাশি এর উন্নতি ও সমৃদ্ধির কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
বর্তমানে মসজিদটির আকার ও আয়তন বহুগুণ বেড়েছে এবং মুসল্লির সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখনো বাড়ছে। যেসব কারণে এই মহান ঘরের পবিত্রতা ও মহত্ত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে সেগুলোর কয়েকটি হলো-  আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম ও ইসমাইল (আ.)র হাতে এটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন, কাবার মধ্যে হযরত আলী (আ.)র জন্ম এবং কাবা সংলগ্ন হিজরে ইসমাইল-এ বিবি হাজেরা ও হযরত ইসমাইল (আ.)র কবরের অবস্থান। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমানে এই পবিত্র স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালনকারীরা সেখানে অসংলগ্নভাবে এত বেশি নতুন নতুন ভবন ও স্থাপনা তৈরি করেছেন যার ফলে মসজিদুল হারামের আধ্যাত্মিক পরিবেশ ও ইবাদতের স্থানে  বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। কাবা শরীফের চারপাশের এলাকায় বর্তমানে তৈরি করা হয়েছে অনেক বড় বড় সুউচ্চ টাওয়ার এবং অসংখ্য সুইমিং পুল যা মসজিদুল হারাম এলাকাকে একটি পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত করেছে। অথচ বিশ্বের যেখানেই এ ধরনের অতি প্রাচীন কোনো ধর্মীয় স্থাপনা রয়েছে সেখানে  বা তার আশপাশে ওই ভবনের চেয়ে উঁচু কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে দেয়া হয় না।
 ইতিহাসে এসেছে, হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজের ছেলে হযরত ইসমাইলকে সঙ্গে নিয়ে কাবাঘর নির্মাণ করেন। এক পর্যায়ে এর দেয়াল যখন উঁচু হয়ে যায় তখন তার উপরে আর নাগাল পাচ্ছিলেন না আল্লাহর এই নবী। এ অবস্থায় হযরত ইসমাইল (আ.) একটি উঁচু পাথর এনে দেয়ালের পাশে বসিয়ে দেন যাতে তার উপরে দাঁড়িয়ে হযতর ইব্রাহিম নির্মাণ কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। এই পাথরটি বারবার একস্থান থেকে আরেক স্থানে সরিয়ে তার উপর দাঁড়িয়ে কাবাঘর নির্মাণ করতে থাকেন আল্লাহর এই নবী। পাথরটির উপর দাঁড়াতে দাঁড়াতে তার উপর হযরত ইব্রাহিম (আ.)র পায়ের ছাপ পড়ে যায়। কাবাঘরের পাশে হযরত ইব্রাহিমের পায়ের ছাপ সম্বলিত সেই পাথরটি আজও সংরক্ষিত রয়েছে। ইতিহাসে এটি মাকামে ইব্রাহিম নামেই পরিচিত। বর্গাকৃত্তি এই পাথরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৪০ সেন্টিমিটার এবং উচ্চতা ৫০ সেন্টিমিটার।
আব্বাসীয় তৃতীয় খলিফা মেহদি আব্বাসের শাসনামলে এই পাথরকে স্বর্ণ দিয়ে মুড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি একটি বড় খাঁচার মধ্যে এটিকে সংরক্ষণ করা হয়। এই খাঁচাটি মসজিদুল হারামের অনেকখানি জায়গা দখল করে আছে বলে ১৯৬৫ সালে এটি ভেঙে ফেলে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি কাঠামোর মধ্যে পাথরটিকে রাখা হয়। মহান আল্লাহ এ সম্পর্কে সূরা বাকারার ১২৫ নম্বর আয়াতে বলেন, যখন আমি কাবা গৃহকে মানুষের জন্যে সম্মিলন স্থল ও শান্তির আলয় করলাম, আর (বললাম) তোমরা ইব্রাহীমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাযের জায়গা বানাও...। মসজিদুল হারামের পাশে মাকামে ইব্রাহিমের অবস্থান আল্লাহর ঘর জিয়ারতকারী প্রতিটি মানুষকে মহান আল্লাহর কাছে হযরত ইব্রাহিম (আ.)র অতি উচ্চ মর্যাদার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আল্লাহর প্রকৃত খলিফার মর্যাদা অর্জনের জন্য প্রতিটি মুমিন মুসলমান এই মাকামে ইব্রাহিম থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করে।
কাবা শরিফের উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আরেকটি অংশ হচ্ছে হাজরে আসওয়াদ পাথর। উপবৃত্তাকার কালো রঙের প্রায় ৫০ সেন্টিমিটার আয়তনের পাথরটি রূপার তৈরি একটি ফ্রেমের মধ্যে সংরক্ষিত আছে। হজের সময় হাজিরা এই পাথরের সামনে থেকে তাদের তাওয়াফ শুরু করেন এবং কাবাশরিফকে সাতবার প্রদক্ষিণের পর এই পাথরের সামনে এসে তাওয়াফ শেষ করেন। এরপর তারা এই পাথরটি স্পর্শ করেন এবং চুমু খান। আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক স্থাপনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে এই হাজরে আসওয়াদ পাথর। এটি স্পর্শ করার মাধ্যমে বান্দা মহান আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের শপথ পুনর্ব্যক্ত করে।
হযরত আদম (আ.) প্রথম কাবাশরিফ নির্মাণের পর এই পাথরকে এই কাবাঘরের পূর্ব পাশে স্থাপন করেছিলেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.) যখন এই মসজিদ পুনঃস্থাপন করেন তখন হাজরে আসওয়াদ পার্শ্ববর্তী আবুকুবাইস পাহাড়ে পড়েছিল। হযরত ইব্রাহিম পাথরটি উঠিয়ে তার আগের জায়গায় স্থাপন করেন। ওই ঘটনার কয়েকশ বছর পর বিশ্বনবী (সা.)র বয়স যখন ৩৫ বছর তখন প্রবল বর্ষণ ও বন্যায় কাবা শরিফের মারাত্মক ক্ষতি হয়। তখনো নবুওয়াত লাভ না করলেও উন্নত চারিত্রিক গুণাবলীর কারণে কুরাইশদের কাছে আল-আমিন নামে পরিচিত ছিলেন তিনি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কাবা পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে কুরাইশ বংশের চারটি গোত্রের লোকজন হাজরে আসওয়াদকে নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। কোন্ গোত্রের মানুষের হাতে এই মূল্যবান পাথর কাবা শরীফে স্থাপিত হবে তা নিয়ে সৃষ্টি হয় এই দ্বন্দ্ব। এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি চাদরের উপর পাথরটি উঠিয়ে চার গোত্রের চারজনকে চাদরটির চারকোন ধরে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যেতে বলেন। এরপর তিনি নিজের হাতে পাথরটি জায়গামতো বসিয়ে দেন। এভাবেই নবুওয়াত প্রাপ্তির আগেই একটি মহান কাজ বিশ্বনবীর (সা.) হাতে সম্পন্ন হয়।  
 ‘হিজরে ইসমাইল হচ্ছে আল্লাহর ঘরের আরেকটি মূল্যবান অংশ। এটি কাবা শরীফের সঙ্গে লাগানো একটি উন্মুক্ত স্থান যা অর্ধবৃত্তাকার একটি দেয়াল দিয়ে ঘেরা। কোনো কোনো সূত্রমতে, এখানে হযরত ইসমাইল (আ.) ও তাঁর মা বিবি হাজেরা বসবাস করতেন এবং তারা মারা গেলে তাদেরকে এখানেই দাফন করা হয়।
বিশ্বনবী (সা.)র একজন স্ত্রী থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, আমি একবার কাবাঘরে ভেতরে প্রবেশ করে নামাজ আদায় করতে চাইলাম। মহানবী (সা.) আমাকে হাত ধরে হিজরে ইসমাইলের মধ্যে নিয়ে যান এবং বলেন, যখন তোমার কাবাঘরে নামাজ পড়তে ইচ্ছে হবে তখন এখানে এসে নামাজ আদায় করবে; কারণ এটি কাবারই অংশ। কিন্তু তোমার গোত্রের লোকেরা কাবাঘর পুনর্নিমাণের সময় এটিকে এই ঘরের বাইরে রেখে দেয়। 
রাসূলুল্লাহ (সা.)র এই হাদিসের সূত্র ধরে ফকীহগণ রায় দিয়েছেন হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা পালনের সময় হিজরে ইসমাইলের ভেতর দিয়ে হাঁটা যাবে না বরং এটিসহ কাবাঘরকে তাওয়াফ করতে হবে। বর্তমানে হিজরে ইসমাইলের দেয়ালের উচ্চতা ১.৩২ মিটার, এর ব্যাসার্ধ ৫.৮ মিটার এবং কাবাশরীফ থেকে এই দেয়ালের দূরত্ব ২.২২ মিটার।
 কাবাঘর নির্মিত হয়েছে কালো ও কঠিন পাথর দিয়ে যা এর উপরের গিলাফ সরালে দেখতে পাওয়া যায়। ১০৪০ হিজরি সালে বর্তমান কাবাঘরটি সর্বশেষ পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। আল্লাহর নবী হযরত ইসমাইল (আ.) সর্বপ্রথম কাবাঘরের দেয়ালগুলোকে রক্ষা করার লক্ষ্যে এগুলোকে পর্দা বা গিলাফ দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন। বর্তমানে কাবাঘর ঢাকতে কালো রঙের গিলাফ ব্যবহার করা হয় যার উপরের লেখাগুলো স্বর্ণ দিয়ে লেখা। প্রতি বছর হজের মৌসুমের আগে এই গিলাফ পরিবর্তন করা হয়। কাবাঘরের ভিতরেও রয়েছে আরেকটি গিলাফ যেটি কয়েক বছর পরপর পরিবর্তন করা হয়। এর কারণ হচ্ছে, বাইরের গিলাফটি রোদ, বৃষ্টি, ঝড় এবং হাজিদের হাতের ছোঁয়ায় নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ভিতরের গিলাফের এ ধরনের কোনো ক্ষতি হয় না বলে এটিকে প্রতি বছর পরিবর্তন করার প্রয়োজন পড়ে না।
কাবা শরীফের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে জমজম কূপ। হাজরে আসওয়াদের দিকে কাবাঘর থেকে ২১ মিটার দূরে এই কূপ অবস্থিত। এই কূপ সৃষ্টি সম্পর্কে বলা হয়েছে, হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজের স্ত্রী হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাইলকে আল্লাহর নির্দেশে মক্কার উষ্ণ ও শুষ্ক মরুদ্যানে রেখে চলে যান। তিনি স্ত্রী-পুত্রকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়ে যান। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বিবি হাজেরার কাছে থাকা পানি শেষ হয়ে যায়। এ সময় পানির সন্ধানে তিনি সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে সাতবার দৌড়ে যাওয়া-আসা করেন। কিন্তু কোথাও পানির সন্ধান না পেয়ে  শিশুপুত্রের কাছে ফিরে এসে দেখেন ইসমাইলের পায়ের ধাক্কায় অলৌকিকভাবে মাটি ফেটে পানি বেরিয়ে আসছে। পানিকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে দেখে বিবি হাজেরা বলে ওঠেন জম জম অর্থাৎ থেমে যাও। তিনি পানিকে ছড়িয়ে না গিয়ে এক জায়গায় জড়ো হতে বলতে চেয়েছিলেন। সেইসঙ্গে তিনি নিজে আশপাশের মাটি ও বালু জড়ো করে পানি জমানোর চেষ্টা করেন।
বিবি হাজেরা হয়তো ভেবেছিলেন পানির এই ঝর্ণাধারা থেমে যেতে পারে। তাই তিনি নিজের কাছে থাকা পানির পাত্র পূর্ণ করে নেন। কিন্তু জমজমের সে পানি আর কখনোই থেমে যায়নি। সেদিনের ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে জুরহুম গোত্রের লোকজন সেখানে পানির অস্তিত্ব টের পেয়ে যায়। তারা এই পানির উৎসের পাশেই বসতি গড়ে তোলে। ততদিনে পানির সে উৎসটি একটি বড় কূপে পরিণত হয়েছে। প্রথমদিকে জমজম কূপের পানি ছিল সেখানকার বসতির একমাত্র পানির উৎস। কিন্তু ধীরে ধীরে আশপাশে আরো কিছু কূপ সৃষ্টি হয়।
প্রতি বছর হজের মৌসুমে কাবাঘরে প্রচুর মানুষের সমাগম হওয়ার কারণে তাদের পানির চাহিদা মেটাতে আরো কিছু পানির উৎসের প্রয়োজন দেখা দেয়। এ কারণে ইসলামের আবির্ভাবের অনেক আগে থেকে মক্কার অন্যতম পেশা ছিল হজের মৌসুমে মানুষের পানির চাহিদা মেটানো। ইসলামের আবির্ভাবের সময় এই দায়িত্ব ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.)র চাচা আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের হাতে। ইসলাম আসার পর আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব মসজিদুল হারামের আঙিনায় রোক্‌ন ও মাকামের মধ্যবর্তী স্থানে প্রথম জমজমের পানি বিতরণের স্থান নির্ধারণ করেন।  পরবর্তীতে এই মসজিদ সংস্কার ও এর পরিসর বাড়াতে গিয়ে স্থানটি মসজিদুল হারামের পূর্ব পাশে নিয়ে আসা হয়।
১৯৫৫ সালে জমজমের পানি উঠানোর জন্য সেখানে পাম্প বসানো হয়। পরবর্তীতে হাজিদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে মসজিদুল হারামের আঙিনায় আরো কিছু পরিবর্তন আনা হয় যার মধ্যে ছিল জমজম কূপের পানি উঠানো ও বিতরণের স্থানটি আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে যাওয়া। ১৯৬৪ সালে এ কাজটি সম্পন্ন হয়। এ সময় কূপটিকে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৫ মিটার গভীরে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এটির মুখের আকারকে এক মিটার থেকে বাড়িয়ে আড়াই মিটার করা হয়। কয়েক বছর আগে জমজম কূপের সেই ভূগর্ভস্থ স্থাপনাও ভেঙে ফেলা হয়। বর্তমানে জমজমের পানি পাম্পের মাধ্যমে মসজিদুল হারামের বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে পরিশোধন করার পর পাইপলাইনের সাহায্যে আবার মসজিদুল হারামে সরবরাহ করা হয়।
জমজম কূপের পানির গুরুত্ব ও তা পান করার ফজিলত সম্পর্কে অনেক হাদিস রয়েছে। মহানবী (সা.) জমজমকে বলেছেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পানির কূপ। তিনি সব সময় এই কূপের পানি পান করতেন। যেখানেই যেতেন ওজু করা ও খাওয়ার জন্য সাহাবীদেরকে বলতেন জমজমের পানি নিয়ে আসতে। বর্তমানে সারাবিশ্বের  মুসলমানরা হজ বা ওমরাহ করতে মক্কায় গেলে নিকটাত্মীয়দের জন্য উপহার হিসেবে জমজমের পানি নিয়ে আসেন। এটি এখন মুসলিম সমাজের একটি সুন্দর সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।

Thursday, 4 May 2017

মহারাজ পৃথ্বিরাজ চৌহান ও খাজা মইনুদ্দিন চিশতী (রঃ)

0 Comments
হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) সিস্তান রাজ্যের সন্জ্ঞর গ্রামে ৫৩৩ হিজরী ১১৩৮ ইংরেজি সালে জন্ম গ্রহন করেন।
উনার পিতার নাম গিয়াসুদ্দিন মাতার নাম সৈয়দা উম্মুল ওয়ারা।পরে স্বপরিবারে খোরাসান শহরে( বর্তমান আফগানিস্তান) হিজরত করেন।মাত্র ১৫ বৎসর বয়সে বাবামা উভয়কেই হারান।
একদিন নিজ জমিতে কাজ করে পরিশ্রান্ত অবস্তায় বিশ্রাম নিছিছলেন।এমন সময় সেখানে এসে উপস্হিত হলেন এক অচেনা আগন্তুক। কিশোর খাজা মইনুদ্দিন তাকে বাগানের কিছু আঙ্গুর এনে আপ্যায়ন করলেন। আগন্তুক ছিলেন আল্লাহর এক অলিআল্লাহ,হজরত ইব্রাহিম কান্দুযী(রঃ)।খুশী হলেন কিশোরের আপ্যায়নে।হাত তুলে দোয়া করলেন অনেকক্ষন।তারপর ঝুলি থেকে বের করলেন এক টুকরো শুকনো রুতি।রুটির একাংশ কিছুক্ষন চিবুলেন তারপর অন্য অংশটুকু মইনুদ্দিনকে খেতে দিলেন।আদেশ পালন করলেন মইনুদ্দি একটু পরেই উছ্ছিষ্ট রুটির প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হতে শুরু করলো।বিস্মিত হলেন ।অন্তরের আছছাদন যেন উবে যাছেছ একে একে।অদ্ভুত এক জ্যোতির্ময় অনুভব এসে ধীরে ধীরে আলোকিত করছে হৃদয়ের সর্বত্র।দরবেশ চলে গেলেন।অন্তরে জ্বালিয়ে দিয়ে গেলেন আল্লাহ প্রেমের
অনন্ত অনল।এই হলো অলিআল্লাহদের তাওয়াজ্জোহ এর ফল। মইনুদ্দিন বাগান ভিটে বাড়ি সহ সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে বেরিয়ে পরলেন তিনি
আল্লাহর পথে।প্রথমেই জাহেরী এলেম শিক্ষার জন্য হাজির হলেন বোখারা,সমরখন্দে।দীর্ঘ দিন সেখানে অবস্হান করে বুৎপত্তি অর্জন করলেন জাহেরী এলমের সমস্ত শাখা প্রশাখায়। তারপর বেরিয়ে পরলেন বাতেনী ইলম অর্জনের উদ্দেশ্যে।
হাদিস শরীফে উল্লেখ আছে, ”জ্ঞান দুই প্রকার।জবানী ইলম বাতেনী ইলম।” (মেশকাত শরীফ)।ইমাম মালিক (রঃ) বলেছেন-”যে ব্যক্তি
বাতেনী জ্ঞান অর্জন করলো কিন্তু ইলমে শরীয়ত শরীয়ত গ্রহন করলো না সে নিশ্চিত কাফের ,আর যে ব্যক্তি শুধু ইলমে শরীয়ত গ্রহন করল কিন্তু
বাতেনী ইলম গ্রহন করলো না সে নিশ্চয় ফাছেক।আর জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মোসলমানের উপর যেহেতু ফরয তাই বাতেনী এলেম অর্জন করাও
ফরয।এই বাতেনী জ্ঞান অর্জনের জন্য আবার খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) বের হয়ে গেলেন বাতেনী জ্ঞান সম্পন্ন শিক্ষক অন্যেশনের উদ্দেশ্য।
৫৫০ হিজরি সাল।বাগদাদে এসে সাক্ষাৎ পেলেন হজরত বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) এর।কয়েক মাস উনার সাথে অবস্হানের
পর আবার নুতন শিক্ষকের সন্ধানে বের হলেন।বিদায়ের সময় বড়পীর(রঃ) বললেন,’হে মইনুদ্দিন ।তুমি যখন হিন্দুস্হানে সফর করবে ,তখন পথে পরবে ভাতীসা রমন্ত নামে এক স্হান।সে স্হানে আছে সিংহতুল্য এক মর্দে মুমিন।তার কথা মনে রেখ তুমি।
শুরু হল নুতন শয়েখের সন্ধান।পথে বিভিন্ন অলির সাথে সাক্ষাতের পর এসে উপস্হিত হলেন খোরাসান এবং ইরাকের মধ্যবর্তী নিশাপুর অন্চলের হারুন নগরে। এই শহরেই বসবাস করেন আউলিয়া সম্প্রদায়েরমস্তকের মুকুট হজরত ওসমান হারুনী(রঃ)।উনার নিকট বায়াত হবার দরখাস্ত পেশ করলে মন্জুর হল।উনার সাথে বিশ বৎসরের অধিক সময় অতিবাহিত করে কামালিয়াতের সর্বোচ্চ স্তরে পৌছলেন।
এবার দাওয়াতের পালা।অলী আল্লাহগন হলেন নবী রাসুলদের প্রকৃত উত্তরসুরী।সেই দায়িত্বের ভার এসে পড়ল খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) এর উপর।ইতিমধ্যে নুতন এক ছাত্র এসে হাজির হয়েছে খাজার দরবারে। খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) ছাত্র জনাব কুতুবুদ্দিন বখতিকে সাথে নিয়ে হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন মক্কায়।হজ্ব পর্ব শেষ করে মদীনা শরীফ এসে হজরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) রসুলে পাক(সাঃ) এর কাছ থেকে এক অবিস্মরনীয় সুসমাচার।হযরত রসুলে পাক(সাঃ) জ্যোতির্ময় চেহারায় আবির্ভুত হয়ে জানালেন,”প্রিয় মইনুদ্দিন।তুমি আমার ধর্মের মইন(সাহায্যকারী)।আমি তোমাকে হিন্দুস্হানের বেলায়েত প্রদান করলাম।হিন্দুস্হান বুৎপরোস্তির অন্দ্ধকারে নিমজ্জিত।তুমি আজমীরে যও।সেখানে তোমর মধ্যমে পবিত্র ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটবে।
সুসমাচার শুনে পরিপৃপ্ত হলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ)
পরক্ষনেই চিন্তিত হলেন তিনি।কোথায় আজমির? বিশাল হিন্দুস্হানের কোন দেশে আছে রসূল নির্দেশিত আজমীর?
চিন্তিত অবস্হায় তন্দ্রাছ্ছন্ন হয়ে পরেছিলেন খাজা খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ)।সেই অবস্হায় তিনি দেখলেন,হজরত মোহাম্মদ(সাঃ) তার শিয়রে উপবিষ্ট।তিনি তাকে আজমীর শহরের দৃশ্য দেখিয়ে দিলেন।সেই সঙ্গে দিয়ে দিলেন প্রয়োজনীয় পথ নির্দেশনা।এরপর দয়াল নবী (সাঃ) তার হাতে দিলেন একটি সুমিষ্ট আনার।তারপর তার জন্য দোয়ায়ে খায়ের করে যাত্রা শুরু করবার নির্দেশ দিয়ে দিলেন।
সফর শুরু হলো আবার।সঙ্গে সাথী কুতুবুদ্দিন।চলতে চলতে এসে পৌছলেন লাহোর।মনে পড়ে গেল হজরত বড়পীর(রঃ) এর সেই মুল্যবান উপদেশমর্দেমুমিন সেই সিংহ পুরুষ এর কথা,সেই ভাতীসা রমস্হ জায়গার কথা। হজরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) জানতে পারলেন এই লাহোরেই আছে সেই সিংহতুল্য মর্দে মুমিনের মাজার শরীফ।তার মোবারক নাম হজরত দাতাগন্জ্ঞে বখশ(রঃ)।তিনি একাধারে দুই মাস অবস্হান করলেন।তারপর শুরু হল যাত্রা।এবারের যাত্রার গন্তব্য
দিল্লী।

এগিয়ে চলল হজরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) এর বেহেশতীকাফেলা।এখন আর কাফেলা দুইজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।বিভিন্ন স্হানে
বিরতির সময় সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কিছু খাটি আল্লাহ অনুরক্ত ফকির দরবেশ।আস্তে আস্তে এর সংখ্যা এসে দারিয়েছে চল্লিশে।সঙ্গী সাথী সহ
দিল্লী এসে উপস্হিত হলেন হজরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ)।দিল্লীর শাসক তখন হিন্দুরাজা খান্ডরাও।আজমীর অধিপতি পৃথ্বিরাজের ভাই ছিলেন তিনি।পৃথ্বিরাজই তাকে তার প্রতনিধি হিসেবে দিল্লীর শাসনভারঅর্পন করেছিলেন।
রাজমহলের অদুরেই নির্মিত হলো ফকির দরবেশদের ডেরা।নির্ভয়ে তরা শুরু করলেন তাদের নিয়মিত ইবাদত বন্দগী।ক্রমে ক্রমে ইসলামের আলো প্রসারিত হতে থাকলো।দিল্লীর আধ্যাতিক দৈন্যতায় এলো ইমানের জ্যোতির্ময় জোয়ার।পিতৃ ধর্ম ত্যাগ করে দলে দলে লোক এসে প্রবেশ
করতে থাকলো আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্ম ইসলামের সুবাসিত কাননে।বিরোধিতা যেমন বাড়তে লগলো।তামনি বাড়তে থকলো বিজয়ের বিরতিহীন অভিঘাত।কিন্তু গন্তব্যত এখানে নয় ।এগিয়ে যেতে হবে আরো সন্মুখে।রসুল পাক(সাঃ) এর নির্দেশিত সেই আজমীরের আকর্ষন একসময় উদ্বেলিত করে তুললো খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ)
এর অন্তরকে।দিল্লীর কুতুব হিসেবে নির্বাচিত করলেন হযরত কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকী(রঃ) কে।দিল্লীর দ্বীন প্রচার নওমুসলিমের বিড়াট কাফেলার হেফাজতের দায়িত্ব হযরত কাকির উপর।
খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) তার আত্নোৎসর্গকারী ফকির দরবেশদের নিয়ে রওয়ানা হলেন আজমীর অভিমুখে।পিছনে পরে থাকলো দিল্লী,দিল্লীর শোকাকুল জনতা দিল্লীর নব নিযুক্ত কুতুব হযরত বখতিয়ার কাকী(রঃ)
আজমীর শহরের উপকন্ঠে এসে উপস্হিত হলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) ।সফর সঙ্গীগন সবাই পরিশ্রান্ত।বিশ্রামের ব্যবস্হা করতেই হয়।এই সেই হিন্দুস্হানের বেলায়াতের প্রতিশ্রুত কেন্দ্রভুমি আজমীর ।চারিদিকে পাহাড়,পাথর মরুভুমি।নিকটেই বৃক্ষছায়া।এখানেই বিশ্রামের জন্য উপবেশন করলেন দরবেশদের কাফেলা।
স্হানটি ছিল রাজা পৃথ্বিরাজের উষ্ঠ্র বাহিনির বিশ্রামস্হল। রাজার লোকেরা কিছুক্ষন যেতে না যেতেই সবাইকে স্হান ত্যাগ করতে বলল।বিস্মিত হলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) ।উটের দলতো এসে পৌছবে সেই সন্দ্ধাবেলায়।অথচ লোকগুলি তাদেরকে এখনই তাড়িয়ে দিতে চায়।তিনি বললেন, ”ঠিক আছে আমরা চললাম।তোমাদের উটই এখানে বসে বসে বিশ্রাম করুক।
পরিশ্রান্ত কাফেলা আবার এগিয়ে চললো সামনের দিকে।।অদুরেআনা সাগর সাগরতো নয় একটি বিশাল হ্রদ।লোকে বলে আনা সাগর।আনা সাগরের পাড় ঘেষে অজস্র মন্দির। খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) এই হ্রদেরই এক ছোট টিলার উপর বসবাসের স্হান নির্বাচন করলেন।সে রাতেই মুখে মুখে আগন্তুক দরবেশের আগমন সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো সর্বত্র।সকালে মহা রাজ পৃথ্বিরাজও শুনতে পেলেন এক অদ্ভুত সংবাদ।উষ্ঠশালার কর্মচারীগন এসে জানালো।গতকাল সন্দ্ধায় যে উটগুলি উষ্ঠ্রশালায় আনাহয়েছিল সবগুলি এখনও শুয়ে আছে।কিছুতেই উঠবার নাম করছে না।সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান দরবেশদলের ঘতনাও বর্নীত হলো রাজার কাছে।দরবেশদলের নেতা উষ্ঠ্রশালা পরিত্যাগের সময় বলেছিলেন , ”তোমাদের উটই এখনে বসে বসে বিশ্রাম করুক।
ইতিপুর্বে বিক্ষিপ্তভাবে মুসলমান ফকিরদের সম্পর্কে এরকম অনেক কথা রাজার কর্নগোচর হয়েছিল।চিন্তিত হয়ে পড়লেন রাজা পৃথ্বিরাজ।মনে পড়ে গেল তার রাজমাতার ভবিষ্যতবানীর কথা।তিনি বলেছিলেনএক মুসলমান ফকিরের অভিসম্পাদেই পৃথ্বিরাজের রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে।
একি তবে সেই ফকির ? সম্ভবত এই ফকিরের কথাতেই এই অবস্হার সৃষ্টি হয়েছে।কর্মচারীদেরকে ফকিরদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার
জন্য নির্দেশ দিলেন রাজা। রাজ আদেশ পালন করল শ্রমিকেরা
হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) বললেন যাও।এ অবস্হা আর থাকবে না।উটশালায় ফিরে এসে বিশ্বয়ের সঙ্গে সবাই লক্ষ্য করল উটগুলো স্বাভাবিকভাবে চলাচল শুরু করেছে।ফকিরের কারামতি দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল।ধীরে ধীরে আজমীরের অবস্হান্তর ঘটতে লাগলো।কৌতুহল নিবারনের জন্য লোকজন যাতায়াত শুরু করে দিল হযরত খাজার আস্তানায়।তার পবিত্র চেহারা আর তার সাথীদের প্রানখোলা মধুর চরিত্রের প্রভাবে সম্মোহিত হতে লাগলো আজমিরবাসী। হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) এর সোহবতের(সাক্ষাৎ) বরকতে তাদের অন্তরের অন্দ্ধকার দুর হতে লাগলো।জেগে উঠলো আজমেরীর সত্যান্বেষী জনতা।কিন্তু আতংকিত হলো পুরোহিতরা,শোষক বর্নবাদী হিন্দু সমাজ।ভীত হলো হিংস্র রাজপুরুষগন এবং সামনতবাদী সম্রাট।
ইসলাম বিদ্বেসী ক্রোধান্দ্ধ শহর লোকজন রাজদরবারে গিয়ে হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) তার সহচরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলো।
অভিযোগ শুনে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন রাজা পৃথ্বিরাজ।অহংকারের নীচে চাপা পরে গেল মায়ের সদুপদেশবানী।রাজা একদল সৈন্যকে আদেশ দিলেন ফকির দরবেশদলকে এক্ষনি রাজ্য থেকে বিতাড়িত করতে। রাজার আদেশ পেয়ে ঝাপিয়ে পরলো অভিযানে। হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) নির্বিকার।আল্লাহ পাকের সাহায্য কামনা করলেন তিনি।সাথে সাথেই আক্রমনকারীদের কেউ হলেন অন্ধ,কারও শরীর হল নিঃসাড়।কেউ হলো ভুতলশায়ী।
নিরুপায় হয়ে পায়ে পড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলো তারা।দয়ার সাগর গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) ক্ষমা করে দিলেন সবাইকে।
রাজা পৃথ্বিরাজ ভেবে কুল পান না কি করবেন তিনি।সমরাস্ত্র, সুসজ্জিত সৈন্যদল কোন কিছুই যে আর কাজে আসছে না।এক দুরাগত যবন ফকিরের নিকট পরাজয় বরন করতে হবে তাকে ?ঐশ্বরিক ক্ষমতাধর এই ফকিরের আনুগত্য স্বীকার করবেন নাকি তাকে বিতাড়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। কি বিশ্বয়কর সংকট।চুপ করে থাকলেও বিপদ ।বিরুদ্ধাচরন করলেও সমস্যা।এদিকে দলে দলে লোকজন গ্রহন করছে ফকিরের প্রচারিত একত্ববাদী ধর্মমত।
রাজা ভেবে চিন্তে ঠিক করলেন ,হিন্দু ধর্মের আধ্যাধিক সিদ্ধপুরুষদের দ্বারা প্রতিরোধ করতে হবে ফকিরকে।তাই সিদ্ধপুরুষ বলে খ্যাতরামদেওকে অনুরোধ করলেন তার যোগমন্ত্র বলে এই যবন ফকিরকে বিতাড়িত করতে।রামদেও রাজী হলেন।তার ধীর্ঘ সাধনালব্দ্ধ আধ্যাধিক শক্তিতে হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) কে পরাস্ত করার বাসনায় হাজির হলেন হযরতের দরবারে।
হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) তখন ছিলেন ধ্যানমগ্ন অবস্হায়।কিছুক্ষন পর চোখ খুললেন হযরত।দৃষ্টিপাত করলেন রামদেও খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) এর জ্যোতির্ময় চেহারার দিকে।মুগ্ধ হয়ে গেলেন রামদেও।তার আধ্যাতিক শক্তি মুহুর্তের মধ্যে নিশ্চিন্ন হয়ে গেল।অন্ধকারে আলো জ্বললে মুহুর্তেই যেমন করে অন্ধকার অপসারিত হয়।হজরত খাজার কদম মোবারকে লুতিয়ে পড়লেন রামদেও।নির্দ্বধায় স্বীকার করলেন ইসলাম। খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) তার নাম রাখলেন মোহাম্মদ সাদী।
রামদেও এর ইসলাম গ্রহনের সংবাদ শুনে রাজা ক্ষোভে দঃখে অস্হির হয়ে উঠলেন।কিন্তু বিদূষী মায়ের উপর্যুপরি উপদেশের বাধ্য হয়ে সংযত হলেন রাজা।কিন্তু কিছুদিন পরই দেখা দিল আরেক বিপদ।
আনা সগরের পানি শুধুমাত্র উচ্চ বর্নের হিন্দু এবং পুরোহিত সম্প্রদায়
ছারা অন্য কেও ব্যবহার করতে পারতো না।নিম্ন বর্নের হি্ন্দুরা এটা তাদের ধর্মীয় বিধান বলে মনে করত।কিন্তু মোসলমানরা কি আর বর্নভেদের ধার ধারে ? একদিন আনাল সাগরে অজু করতে গেলন হজরত খাজার একজন সাগরেদ।পুরোহিতরা অপমান করে তাড়িয়ে দিলো তাকে।সাগরেদ সমস্ত ঘটনা বর্ননা করলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) কে।হযরত খাজা মোহাম্মদ সাদীকেআনা সাগরথেকে এক ঘটি পানি আনার নির্দেশ দিলেন।নির্দেশ মত মোহাম্মদ সাদীআনা সাগরথেকে এক ঘটি পানি আনতেই দেখা গেলো এক আশ্চর্য দৃশ্য।কোথায় সাগর ? সব পানি তার শুকিয়ে গিয়েছে একেবারে।
এই আলৌকিক ঘটনা রাজাকে জানালো প্রজারা।বিব্রত বোধ করলো রাজা।রাজা বাধ্য হয়ে আবারও তাদের প্রজাদের দুর্ব্যবহারের জন্য ফকিরের কাছে ক্ষমা চাইতে নির্দেশ দিলেন রাজা।প্রমাদ গুনলেন পুরোহিত সম্প্রদায়।কিন্তু উপায়ন্তর না দেখে তারা খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) এর কাছে গিয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন
মানুষের দুর্দশা দেখে পুরোহিতদের ক্ষমার প্রেক্ষিতে মোহাম্মদ সাদীকে পুনরায় ঘটিতে ভরা পানি আনা সাগরে ঢেলে দিতে নির্দেশ দিলেন।নির্দেশ পালিত হলো।ঘটির পানি ঢেলে দেয়ার সাথে সাথেই ভরে গেল বিশাল হ্রদআনাল সাগর।এই আলৌকিক ঘটনার পর বহুলোক ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিল খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ)এর হাত ধরে।
পৃথ্বিরাজ ভেবে পান না কি করে মোসলমান ফকিরকে প্রতিহত করা যায় ।কেউ কেউ রাজাকে বুদ্ধি দিলেন বিখ্যাত ঐন্দ্রজালিক অজয় পালকে দিয়ে কিছু করা যায় কিনা ?রাজা তাকেই ডেকে পাঠালেন এবং রাজকীয় পুরুস্কারের প্রস্তাব করলেন।অজয় পাল তার সর্বশক্তি দিয়ে খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) কে ঘায়েল করার চেষ্টা করলেন।কিন্তু মিথ্যা কি কখনো সত্যকে প্রতিহত করতে পারে ? অজয় পালও তার ভুল বুঝতে পেরে তার সঙ্গী সাথী সহ ইসলাম ধর্ম গ্রহন করলেন।খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) অজয় পালের নাম রাখলেনআব্দুল্লাহ বিয়াবানী
সংবাদ শুনে মুষড়ে পরলেন রাজা।নিজ রাজ্য রক্ষার কথা চিন্তা করে সংঘর্ষমুক্ত সহাবস্হানের পথ অবলম্বন করলেন রাজা।কিন্তু সত্য মিথার সংষর্ষ যে অবসম্ভাবী।আবারও সংঘর্ষের সূত্রপাত হলো এভাবে-
রাজদরবারের একজন কর্মচারী ছিলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) এর একান্ত অনুরক্ত।মুসলমানও হয়ে গিয়েসিলেন তিনি।রাজা একথা জেনেও তাকে খুব পছন্দ করতেন তার উত্তম স্বভাব,বিশ্বস্হতা সততার জন্য।কিন্তু রাজদরবারের অন্যান্য সদস্যদের প্ররোচনায় এক সময় সেই কর্মচারীর উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন রাজা। খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) এর কাছে বার বার হেনস্ত হবার সমস্ত ক্ষোভ যেন গিয়ে পড়লো তার উপর।মুসলমান কর্মচারী সমস্ত দুঃখের কথা খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) এর কাছে বর্ননা করার পর খাজাকে অনুরোধ করলেন তার জন্য রাজার কাছে একটি সুপারিশ পত্র পাঠাতে।পর দুঃখে কাতর খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) একান্ত বিনয় নম্রতার মাধ্যমে সেই কর্মচারীর পক্ষে একটি সুপারিশ পত্র পাঠালেন।সেই সঙ্গে রাজাকে জানালেন ইসলাম গ্রহনের একান্ত আহ্বান।
চিঠি পেয়ে রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন পৃথ্বিরাজ।মুসলমান কর্মচারীকে চকুরীচ্যুত করলেন রাজা।সেই সঙ্গে খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) এর বিরুদ্ধে উচ্চারন করলেন অশালীন বক্তব্য।সংবাদ শুনে খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) এর প্রেমময় অন্টরেও প্রজ্জলিত হলো রুদ্ররোষের সর্বধ্বংসী আগুন।তিনি একটুকরা কাগজে লিখে পাঠালেন রাজা পৃথ্বিরাজকে-”মান তোরা যেন্দা বদস্তে লশকরে ইসলাম বছোপর্দম অর্থাৎ আমি তোমাকে তোমার জীবিতাবস্হাতেই মুসলিম সেনাদের হাতে সোদর্প করলাম।এর পরেই স্বপ্ন দেখলেন সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী এবং উনার নেতৃত্বেই হিন্দুস্হানে উরলো মোসলমানদের বিজয় পতাকা এবং পতন হলো মহারাজা পৃথ্বিরাজের।

নিদ্রাভিবুত ছিলেন সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী।স্বপ্নে দেখলেন শ্বেত শুভ্র বস্ত্রাবৃত এক জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ সিংহাসনে বসা।তার সামনে দন্ডায়মান অনেক অনুচর।তাদের মধ্যে একজন সুলতান ঘোরীকে হাত ধরে একদল সুসজ্জিত মুসলমান সেনাদলের নিকট নিয়ে গেল।আর সেই সময় সেই জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ তাকে লক্ষ্য করে বললেন,”যাও তোমাকে আমি হিন্দুস্হানের শাসন ক্ষমতা দান করলাম।
স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল।চমকিত হলেন সুলতান।এ নিশ্চয়ই শুভ স্বপ্ন হবে। সকালে ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে স্বপ্নের বৃত্তান্ত জানালেন।সবাই একবাক্যে বললেন ,মনে হয় অচিরেই হিন্দুস্হান আপনার করতলগত হবে।এ স্বপ্ন তারই আগাম সুসংবাদ।
সুলতান মনস্হির করলেন হিন্দুস্হান অভিযান শুরু করার। সেনাপতি কুতুবুদ্দিন আইবেককে প্রস্তুত হবার নির্দেশ দিলেন।৫৮৮ হিজরি সালে সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে হিন্দুস্হান অভিমুখে রওয়ানা হলেন।অন্তরে বিগত যুদ্ধের পরাজয়ের গ্লানি।সে গ্লানি এবার মুছতেই হবে।ইতি পুর্বে দুই দুইবার হিন্দুস্হান আক্রমন করেও সফল হতে পারেন নি।শুরু হল তুমুল যুদ্ধ। সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরীর সৈন্যসংখ্যা রাজা পৃথ্বিরাজের সৈন্যের তুলনায় একেরারেই কম।কিন্তু ইমানের বলে বলীয়ান এক আল্লাহর একছ্ছত্র শক্তির প্রতি নির্ভর করে তারা নির্ভয়ে এগিয়ে চললো। এই বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কুতুবুদ্দিন আইবেক।তারায়েনা প্রান্তরে দুই বাহিনীর মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হলো। মুসলমানদের প্রচন্ড আক্রমনের সামনে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল পৌত্তলিক সৈন্যবাহিনী।নাস্তানাবুদ হয়ে পালিয়েও নিস্তার পেল না তারা।ক্ষিপ্রগতিতে রাজপুত সৈন্যদের পশ্চাদ্ধাবন করে যাকে যেভাবে পাওয়া গেল,তাকে সেভাবেই হত্যা করতে লাগলো মুসলমান সৈন্য বাহিনী।উপায়ন্তর না দেখে যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে গেলো সেনাপতি খান্ডে রাও।রাজা পৃথ্বিরাজও সরস্বতী নদীর তীর ধরে পালাবার চেস্টা করার সময় মোসলমানদের সৈন্যদের হাতে বন্দী হয়ে গেল রাজা।শেষাবধি হত্যা করা হল তাকে।৫৮৮ হিজরী সালে ভয়াবহ যুদ্ধে সুলতান সাহাবুদ্দিন ঘোরী নিরংকুশ বিজয় লাভ করলেন।আরো সামনে এগিয়ে চললো ঘোরী বাহিনী।এর পর সহজেই এক এক করে সরস্বতী,সামানা হাশিসহ অধিকৃত হল দিল্লী।সুলতান দিল্লীর দায়িত্ব দিলেন কুতুবুদ্দিন আইবেককে ।তারপর সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী এগিয়ে চললেন আজমীরের দিকে।
তার এই এই অপ্রতিরুদ্ধ অগ্রাভিযানের সামনে অবনত হলো যুদ্ধে নিহত হিন্দু রাজাদের পুত্রগন।দেউল নামক স্হানে সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাত করলো অনেক রাজপুত্রগন।মুসলিম শাসনের প্রতি তাদের আনুগত্যের বিনিময়ে সম্রাট তাদেরকে দান করলেন বিভিন্ন রাজ্যের জায়গী। সুলতান এগিয়ে চললেন আজমীরের দিকে।
এদিকে আজমীরে ক্রমাগত বেড়েই চলছে খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) এর কাফেলা। ইসলাম কবুলকারীদের সংখ্যা এখন লক্ষ লক্ষ।শুধু আজমীরে নয় এখন খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী (রঃ) এর জামাত এখন ছড়িয়ে পরেছে হিন্দুস্হানের কোনায় কোনায়।দর্শনার্থীদের ভীর সব সময় লেগেই থাকে।
সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী অবশেষে আজমীর এসে পৌছলেন।তখন সন্ধা হয় হয়।সুর্যাস্ত হওয়ার পর সচকিত হয়ে উঠলেন সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী।দুরে কোথায় আজানের ধ্বনি শোনা যায়।সেদিকে এগিয়ে যেতেই তিনি দেখলেন একদল নুরানী জান্নাতী
লোক হাত বেধে দাড়িয়েছেন।দরবেশদের জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করলেন সুলতান।সালাত শেষে জামাতের ইমামের মুখের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলেন সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী।এইতো সেই জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ,স্বপ্নে যিনি জানিয়েছেন হিন্দুস্হান বিজয়ের সুসংবাদ।
সুলতান শ্রদ্ধাভরে পরিচিত হলেন হজরত খাজার সাথে।তিনদিন হযরতের মোবরক সহবতে অতিবাহিত করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন সুলতান।তার প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লীতে রেখে গেলেন কুতুবুদ্দিন আইবেক কে।তিনিও বায়াত গ্রহন করলেন খাজার প্রতিনিধি খাজা বখতিয়ার কাকী(রঃ) হাতে।এর পর রাজনৈতিক রুহানী শক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পৌত্তলিকতা উছ্ছেদের অভিযান চলতে থাকলো সমান্তরাল গতিতে।কুতুবুদ্দিন আইবেক ক্রমে ক্রমে প্রসারিত করলেন মুসলিম রাজ্যের সীমানা।কনৌজ,বানারস সহ আরো বহু স্হানে উড়িয়ে দিলেন মোসলমানদের বিজয় পতাকা।

(গ্রন্থ সহায়তামোহাম্মদ মামুনুর রশীদ রচিত -” চেরাগে চিশতী”,প্রকাশক-সেরহিন্দ প্রকাশন,উয়ারী ,ঢাকা।)
 
back to top