পুসিদার ভেদ জানতে পারলে
নবুয়ত তার এমনি মেলে
দলিল-কোরান না পড়লেও সে সকলই দেল-কোরানে পাবে ॥
------------------------------------------ফকির লালন শাহ
‘পুসিদার ভেদ’ অর্থ আত্মতত্ত্বের গুপ্তরহস্য তথা সৃষ্টিরহস্য। সৃষ্টি বা স্থূল সত্তা দৃশ্যমান অথচ সূক্ষ্ম স্রষ্টা বা মূলসত্তা অদৃশ্য অজানা। দেহকে দেখা যায় কিন্তু দেল বা চিত্তাকাশ কি দেখা যায় না ছোঁয়া যায় কখনও? যদিও দেলই দেহের আসল জন্মদাতা। সর্বসৃষ্টির মূলে মন তথা দেলই উৎসস্বরূপ। মানবের দেল থেকেই জন্ম নেয় ভাব বা অভিব্যক্তি। তারপর আসে ভাষা। ভাষাও মনের সম্পূর্ণ ভাবটুকু বলে কয়ে প্রকাশ করতে পারে না, চারভাগের একভাগ মাত্র তুলে ধরতে সক্ষম ধ্বনিময় রূপক-প্রতীকের আশ্রয়ে। অবশ্য ভাবকে ধরতে না পারলেও ভাষাকে ধরে রাখাই দলিলের দায়। তবে দলিল কোনও দেলের জন্ম দিতে পারে না বরং দেলের প্রকাশকে প্রামাণ্যরূপে বা বিকৃতরূপে ধরে রাখতে পাওে শুধু। দেহ ধরা যায় তাই তার নাম ‘ধরা’ আর মনকে ধরা যায় না বলেই তার নাম ‘অধরা’। শাঁইজীই কেবল অধরাকে ধরতে জানেন; যেমন বলেন, “ধররে অধর চাঁদেরে অধরে অধর দিয়ে/ যে ধরাতে অধর ধরা থেকরে সচেতন হয়ে”। কিন্তু দেল ও দলিলের দ্বন্দ্বে পড়ে মানুষের বড় মুসিবত। দেলকে দলিলের ভারি বোঝার নিচে চিড়েচ্যাপ্টা বানিয়ে ফেলা হলে যা হয় তাই তো হচ্ছে প্রথাবদ্ধ সব ধর্মকর্র্মে। হৃদয়হীন কর্মাচার আর দর্শনহীন ধর্মাচারেরর ঘোলাজলে সমাজ সংসার পাপপঙ্কের অতলে তলিয়ে আছে।
সুফির চোখে ‘দেল ও ‘পুসিদা প্রায় সমার্থক। অন্তকরণ বা চিৎপ্রকর্ষণ এরকম দোধারী অর্থ এর। ‘ভেদ’ অর্থ রহস্য বা তত্ত্বজ্ঞান। দেহমনের ভেদসমুদ্র পেরিয়ে নির্মোহ ও নির্ভার মনোজগতের বিশেষ অধিপতি হন সুফি। হেরা পর্বত মানবদেহের অপর নাম। তার গুহায় তথা মনোলোকে নির্জন সাধনালব্ধ নবুয়তজ্ঞান ঝরনার নিরন্তর অবগাহনে ¯স্নাতক হয়ে রেসালতের বঙ্কিমপথ ধরে বেলায়েতসমুদ্র পেরিয়ে মাওলাইয়াত তথা ইমামত অর্থাৎ সম্যক গুরুতন্ত্রের স্তম্ভপ্রতিম সুফিরূপে শাঁইজী স্বয়ং দেলকোরান। কারণ তিনি ‘আত্মতত্ত্বে ফাজেল’ মানে পরিসিদ্ধ আত্মবিদ বা তত্ত্ববিদ ধর্মবিজ্ঞানী বলেই সব ধর্মের উপর তিনি সদা ভাসমান সাঁতারু ‘লা শরিক’ বা ধর্ম নিরপেক্ষ মহাসত্তা। এমন মহাপুরুষ যা বলেন, যা করেন সবই কোরানের জীবন্ত অভিব্যক্তি। তিনি কোনও দলিলের পরোয়া করেন না বরং দলিলই তাঁকে অনুসরণ করে পায়ে পায়ে।
ফকির লালন শাহের পূর্বে বাংলা ভাষায় ‘দেলকোরান’ কথাটি আর কেউ এমন জোরালোভাবে উচ্চারণ করেনি এবং এমন অকপটে কোরানের জাগ্রত জীবনদর্শন তথা ধর্মসাধনার মর্মবস্তুকে চুম্বক কথায় তুলে ধরার সাহসও কদাচ পায়নি। ‘দেলকোরান’ নিয়ে তাঁর মতো এত উচ্চকিত হতে আর কাউকেও দেখা যায় না। এর কারণ কী? প্রকৃত ভাব অর্থ না বুঝে আরবীয় রাজতন্ত্রের চাপানো দলিল কোরানের উপর অন্তরের অলীক ও অন্ধ আনুগত্য বাঙালিকে দেলকোরান থেকে সরিয়ে ভুলকোরানের দুর্বিপাকে ঠেলে দিয়েছে। উপরোক্ত কালামে তাই শাঁইজী জানাচ্ছেন, যিনি সম্যক গুরুরূপে উপস্থিত ‘আলে মোহাম্মদ’ বা মোহম্মদের বংশীধারী তিনি পরিজ্ঞাত আছেন পূর্ববর্তী নবীগণের নবুয়ত তথা সত্যায়িত মহাজ্ঞান। নবুয়ত লাভের জন্য আজকের দিনে তাঁকে আর আগের মতো সাধনভজন করে সিদ্ধ হতে হয় না। তিনি জন্মসিদ্ধ মহাপুরুষ। আত্মতত্ত্বের গুপ্তভেদ যাঁর নখদর্পণে নবুয়ত তাঁর এমনিই মেলে। নবুয়তের স্তর পেরিয়ে 'বেলায়েতর' উচ্চাঙ্গিক অভিধায় তাঁরা অভিষিক্ত হন অতীন্দ্রিয় মহৎলোকে। স্কুল-মাদ্রাসায় পড়ালেখা না শিখে কাগজের দলিলকোরান পাঠ না করলেও এমন পরিসিদ্ধ সাধকপুরুষ আপন অন্তর্নিহিত মহাজ্ঞানের ফল্গুধারায় সমগ্র সৃষ্টিরহস্যের জ্ঞানে মহাজ্ঞানী-যা কোরানের পরিভাষায় ‘আল কেতাব’। ‘কোরান মিনাল কিতাব’ অর্থাৎ কেতাব থেকেই কোরানের উৎপত্তি। কেতাব মানে যে বই নয়, মহাপুরুষের অখণ্ড মানসরাজ্য-- এ নিরেট সত্যকথাটি বাঙালি কেন কেউই জানত না, আমার মহান সদগুরু সদর উদ্দিন আহমদ চিশতীই প্রথম জানালেন তাঁর ‘অখণ্ড কোরানদর্শন’এর যথার্থ শব্দসংজ্ঞায় ‘কেতাব’ আসলে কী : “নূরে মোহাম্মদীর মাধ্যমে বিচিত্র সৃষ্টিরূপে স্রষ্টার বিকাশবিজ্ঞানকে কেতাব বলে। উচ্চমানের বিশিষ্ট সাধকের উপর কেতাবজ্ঞান নাজেল হওয়া বিষয়টি সর্বকালের একটি চিরন্তন ব্যবস্থা। কেতাব হলো বিশ্বপ্রকৃতির সামগ্রিক বিকাশবিজ্ঞান। মানুষের জন্য আল্লাহর দেয়া জীবনবিধানও কেতাবের অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহর বিকাশবিজ্ঞানকে কেতাব বলে। যে যন্ত্রের মধ্যে বা যে সকল রূপের মধ্যে আল্লাহর উচ্চ বিজ্ঞানময় বিকাশ ঘটে তার মধ্যে মানবদেহই সর্বশ্রেষ্ঠ। এ জন্য মানবদেহকে ‘আল কেতাব’ বলা হয়েছে। আল কেতাবের জাহেররূপ ‘মানবদেহ’ এবং বাতেনপ্রক্রিয়া ‘বিকাশবিজ্ঞান’। আল কেতাবের উভয়প্রকার বিকাশের মূল উৎস নূর মোহাম্মদ। “আল কেতাব পাঠ করা” অর্থ আপনদেহ পাঠ করা তথা আপনদেহের মধ্যে আত্মদর্শনের অনুশীলন করা। আপনদেহই সকল জ্ঞানের মূল উৎস। সহজ কথায়, ‘কেতাব’ অর্থ মানবদেহ। ‘আল কেতাব’ অর্থ বিশিষ্ট মানবদেহ বা সিদ্ধপুরুষ অর্থাৎ প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত একজন মহাপুরুষ। আল কেতাব থেকেই ধর্মগ্রন্থসমূহের আগমন”।
মোর্শেদরূপে এমন মূর্ত ও প্রকাশ্য দেলকারানকে মেনে চলা জীবের ক্ষুদ্র দেলের সাধ্যে ভীষণ কঠিন। পালন করতে কেউ পারুক বা না পারুক তাঁর দর্শনকে স্বীকার করে নিলেই ধর্মকর্মজগতের অর্ধেক সমস্যার সমাধান এমনিতেই হয়ে যায়। কিন্তু আমরা সত্যকে সহজে স্বীকৃতি না দিয়ে বৃথা বিরোধ-বিতর্কে মূল্যবান এবং দুর্লভ মানবজীবনের অপচয় করি । যার ফলে সুদূরপ্রসারী বিপাক-বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে আছি প্রায় সবাই।
সদগুরুর স্তব্ধ সমাহিত অন্তর থেকে নিঃশব্দে ক্বাফশক্তির অর্থাৎ মহাশক্তির বিচ্চুরণ ঘটে। সে বিচ্চুরণ স্থানকালপাত্রের ভেদ মানে না। কারণ তা মহাশূন্য হতে উৎসরিত চিৎশক্তির নিত্য প্রস্রবণ। এ শক্তি ধারণ করার পূর্বে দেল তথা চিত্তকে পরিপূর্ণ শূন্য করে ফেলতে হয়। তাতে গুরুধ্যান হয়ে যায় শূন্যধ্যান। অনুগ্রহশীল গুরু ও সার্থক শিষ্যের সম্বন্ধ বাইরের কোনও শব্দাচারে বিভক্ত নয়, অন্তর্গত শক্তিবলে সুসম্পৃক্ত। অব্যক্তে না পৌছালে রূপান্তর সূচিত হয় না সার্থকভাবে। তাই গুরুকে উপলক্ষমাত্র করে ডুব দিতে হয় মহাশূন্যে। তাতেই প্রকৃতির রূপান্তর সৃষ্টি হয়। এ শূন্যতায় গেলে শুদ্ধদেল তথা চিত্ত নির্মল হতে পারে। নির্মল মানে মল-কলুষমুক্ত শুদ্ধচিত্তেই সহজে বিবেকের জাগরণ ঘটে। মন তখন আর সন্দেহ-সংশয়ের দোলাচলে অস্থির থাকে না। যা সত্য সেটাই সুফির মানসপটে ভেসে ওঠে। সে সত্যকে অনুসরণ করার বীর্যও তাঁর ভেতরে সুসংহত হয়।
"ঈসা মুসা দাউদ মোহাম্মদ রসুল / খোদার কাজে আছে মকবুল / ফরমান করিতে কবুল / পড়ছে সদাই দেলকোরান ॥ ইঞ্জিল তৌরা জুব্বুব কোরান / চার জায়গায় চার বয়ান / সিরাজ শাঁই বলে দেল ঢুঁড়িলে লালন / পাবিরে সকল সমাধান"--শাঁইজীর ভাষ্যমতে নবী দাউদ, মুসা, ঈসা ও মোহাম্মদুর রসুলাল্লাহ কেউ কোনও ধর্মগ্রন্থ লিখে যাননি। সবাই যে আপনাপন দেলকোরান পাঠ থেকেই স্বতোৎসারিত জুব্বুব, তৌরা, ইঞ্জিল ও কোরান প্রকাশ করেছেন। তাঁদের তিরোধানের ক্ষমতাসীন রাজা বাদশারা সব ধর্মগ্রন্থের উপর অবৈধ হস্তক্ষেপ ও অস্ত্রোপাচার দ্বারা নানা অদলবদল ঘটানোর ফলে তা এখন চারভাবে খণ্ডিত ও বিকৃত মনে হলেও শুদ্ধচিত্ত সাধক আপন দেল ঢুঁড়লে এ চারগ্রন্থের মধ্যে খণ্ডতা ও বিভেদের পরিবর্তে এককত্ব ও অখণ্ড সত্যের পরিচয়ই আহরণ করেন। মানুষের মগজের চাইতে কাগজের মূল্য বেশি হতে পারে না।
আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চাজগত ব্যক্তিসাধকের জীবন্ত আত্মজ্ঞান তথা তত্ত্বজ্ঞানকে একপাশে ঠেলে দিয়ে এত বেশি মাত্রায় কাগুজে দলিল তথা বইপত্র মুখস্থতা নির্ভর হয়ে পড়েছে যে, ব্যক্তির মুক্তবিকাশের কোনও সুযোগই নেই। প্রশ্ন জাগে, ছাপাখানায় মুদ্রিত সহজলভ্য বইয়ের প্রচলন যখন ছিল না তখন কি মানুষ জ্ঞানচর্চা করেনি আজ থেকে মাত্র দুশো বছর আগেও? শাহ লালন ফকির কিছু না লিখেই কীভাবে জগতে আজ এত গভীরভাবে প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য পাঠ্য হয়ে উঠতে পারেন নতুনভাবে? আরও অতীতের দিকে তাকালে ধর্মাবতার রাম, কৃষ্ণ, মহাবীর, গৌতম, নূহ, দাউদ, মুসা, ঈসা, মোহাম্মদ, আলী, হোসাইনগণ যে মহাজ্ঞানময় ‘দেলকোরান’ওয়ালা হলেন তা কোনও প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার ফসল নয়, সবই আত্মতত্ত্ব সন্ধান ও আত্মদর্শনের ফলশ্রুতি। কোন মাদ্রাসায় পড়ে কোন নবী-রসুল কোরানেওয়ালা হয়েছেন কবে যাঁরা গরু ছাগল মেষের মতো ভক্তদের লালনপালন করার জন্য ‘রাখাল’ নামে জগতে সুখ্যাত? সামাজিক প্রাতিষ্ঠানিক সমূহ প্রতিকূলতাকে ডিঙিয়ে সাধকের ব্যক্তিগত বিজয় সম্ভব, সুফির অখণ্ড দেলকোরানের অটলভাষ্য তারই স্বয়ংপ্রকাশ।
দেলকোরান পড়ে ‘ইনসানে কামেল’ তথা পূর্ণমানব না হয়ে বাহ্য দলিল কোরান পড়ে ‘হাফেজ’’ ‘মুফতি’ ‘মোহাদ্দেস’ ইত্যাদি তকমাধারী হবার নির্দেশ কোরানের কোথায় আছে? কোথাও নেই। আদি মোহাম্মদী সাধনার বিরুদ্ধে এগুলো নিষ্ঠুর উমাইয়া-আব্বাসীয়-সৌদি রাজতন্ত্রের রচিত চক্রান্তমূলক কারসাজি মিথ্যাব্যবস্থা যা মাদ্রাসাশিক্ষার নামে হাজারও লোককে রসবোধহীন হিংস্র কাঠমোল্লায় পরিণত করছে। তোতাপাখির মতো মুখস্থ বুলিবাগীশ হবার মধ্যে সত্যের লেশমাত্র অনুভবও থাকে না। কাগজের কোরান বোবা ও কালা। সে কথা বলতে পারে না, শোনেও না। কিন্তু দেলকোরান সাধকের সঙ্গে কথা বলেন যখন তখন, নিত্য নব আদেশ নির্দেশ দিয়ে চলেন, সূর্যের অনুপস্থিতিতে অন্ধকারে নিজেই মহাসূর্য হয়ে জ্বলেন।
মানুষের জানার ও বোঝার জন্যই মহানবীর মাধ্যমে জগতে কোরান প্রকাশিত হয়েছে। অর্থ না বুঝে শুধু কম্পিটারের মতো যান্ত্রিক ঢংয়ে আউড়ে যাবার বা লৌকিক আবৃত্তি প্রতিযোগিতার বিষয় নয় কোরান। অথচ সমাজ সংসারে এমন বদপ্রতিযোগিতাই চলছে। কোরান যে মোটেও জীবনবিধান নয়, বরং জীবনদর্শন সে আদ্যকথাই ভুলে গেছি সবাই ভোগসুখলোভী এজিদী ধর্মব্যবস্থার প্রবল প্রতাপে ও চাপে। কোরান বাইরে থেকে ধার করা বুলির বস্তা বা ছাপানো কাগজের ফর্মা নয়, এ হলো সাধকের শুদ্ধদেল থেকে স্বতোৎসারিত মহাভাবপ্রবাহ যাকে ‘বিজ্ঞান’ বলা হয়। ভোগবাদের হাতছানিতে বস্তুবিজ্ঞানের কঠিন চাপে অধ্যাত্মানুভবের সে সূক্ষ্মতর বোধশক্তি জগতবাসী প্রায় হারিয়ে ফেলেছে আজ। তাই দেখি ঘটা করে ‘কোরান সন্ত্রাসীর গ্রন্থ’ বলে পাশ্চাত্যের কোনও কোনও মহল কাগুজে কোরান তথা দলিল কোরান পুড়িয়ে বোকার আত্মপ্রসাদ লাভ করছে। বস্তুবাদী হৃদয়হীন বিশ্বব্যবস্থার পাষাণবাঁধ ভেঙে মুক্তধারার মতো দেলকোরানধারী মহাসাধুর পুনরুত্থান এবং নতুন মহাভাবান্দোলন সম্ভাবনাও তাতে দিনে দিনে পরিপক্ক হয়ে উঠছে।
সমস্ত সাধনার মূল কথা হলো দিনরাতব্যাপ্ত সকাল-সন্ধ্যা নিবিড় ধ্যান, জপ বা অনুস্মৃতি যাকে আরবী কোরানের পরিভাষায় বলে ‘জিকির’। এর নামই গুরুধ্যানচিত্ততা। ‘দেলকোরান না জানিলে দলিলকোরান পড়লে কিছু হবে না’- বলে ফকির লালন শাহ বাঙালিকে সাবধান করে দিয়েছেন প্রায় দুশো বছর আগে। দেলকোরান একজন মহামানুষ বা অতিমানুষ। তিনি যা বলেন যা করেন সবই মূর্ত কোরানের পরিচয়। এমন মহাপুরুষকেই বলা হয় ‘কোরানুন নাতেক’ অর্থাৎ ‘বাঙ্ময় কোরান’ বা ‘মূর্ত কোরান’ অর্থাৎ দেলকোরান। অথচ আমরা তাঁর মতো আত্মত্যাগী মহাপুরুষদের কাছে সমর্পিত হয়ে আপনাপন দেলপাঠ না শিখে বাহ্যবিদ্যার চাপে পড়ে চিড়েচ্যাপ্টা হচ্ছি প্রতিনিয়ত। বিদ নেই বিহিত নেই শুধু বই পড়ে পড়ে আমরা মস্ত বড় বিদ্যার জাহাজে পরিণত হলেও অবশেষে ভরাডুরি যে নিশ্চিত এ অলঙ্ঘনীয় সত্যটি বর্তমানে ভুলে থাকতে পছন্দ করি। ‘বিদ’ অর্থ জ্ঞানী এবং যাঁর জ্ঞান হিতের সহিত বর্তমান বা বিশেষ হিতকর সেটাই ‘বিহিত’। বিদ বিহিতের হিতাহিতবোধ হয় না তাই বিভ্রান্তির ঘোলাজলে ডুবে মরি। সংসারের কত ভার কাঁধে তুলে নিই অথচ নিজের ভারটুকু নিজে বহন করতে পারি না। প্রেমভক্তিযোগে নিজেকে পাঠ করার পথ খুঁজে পাই না অথচ অন্যের খুঁত ধরি পদে পদে। লোকেদের কাছে জ্ঞানীর তকমা পেয়ে আরও জ্ঞানহারা হই অহমিকাবশে। সদগুরুর শরণাপন্ন হয়ে আপন দেহপাঠ না শিখে নেহাত বইপত্রের বোঝাটানা গর্দভ হয়ে নিজেদের মস্ত জ্ঞানী-পণ্ডিত ভেবে বসি তা কতটা বাহ্যত্যাজ্য আর কতটুকু কী জ্ঞানগ্রাহ্য সে কুতর্কের দোকানদারী করা সুফির কাজ নয়। যার পাপে সে ভোগে একা চার যুগেরে। তুমি বা কার কেবা তোমার এই সংসারে?
মহানবীর প্রতি আত্মসমর্পিত সংখ্যায় অল্প একদল অতিউচ্চস্তরের জ্ঞানী সাধক মহাপুরুষ ভক্তদল ছিলেন যাঁরা তাঁকে অহর্নিশি ঘিরে থাকতেন এবং নিবিড়ভাবে নবীর অনুসরণ ও অনুকরণ করে চলতেন-এঁরাই ‘আসহাবে সুফফা’ নামে সুখ্যাত। ‘সাফা’ অর্থাৎ চিত্তশুদ্ধি থেকে ‘সুফ্ফা’ যা ‘সুফি’র আদি অলঙ্কার। ‘আসহাবে সুফফা’র সুফিগণ এত মহাজ্ঞানী ছিলেন যাঁদের সম্বন্ধে এখনকার দলিলওয়ালা রাজা বাদশাদের দালালেরা কিছুই জানে না। নবীর দেহত্যাগের পর মাওলা আলীর কিয়ৎকালের শাসনামল ছাড়া তাঁরা সব আমলে নানাভাবে অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত ও নির্মমভাবে নিহত হন। ইসলামের প্রকৃত মর্মবাদী সুফিচর্চার আদি উৎস এ আসহাবে সুফফার সাধুগণই এবং এঁদের প্রধান অধিপতি হলেন মাওলা আলী। অথচ আলী এবং তাঁর বংশীয় আহলে বাইতে রসুলগণকে হত্যা ও উৎখাত করার জন্য ওমর, বকর ও ওসমানেরা কাগজের কোরান থেকে তাঁদের নাম মুছে দিলেও সুফির দেলকোরানে নবীর বংশীধারীগণের কালজয়ী সুর ও স্বর অক্ষয় গৌরবে জ্যোতিষ্মান। -
ধর্মজগত এ কথা না বুঝলে চলবে না যে, ‘কোরান নাজেল হওয়া’ কথাটি সর্বকালীন এবং সার্বজনীন একটি বিষয়। এটি কোনও কালখণ্ডে খণ্ডিত নয়। সর্বকালে সাধকের নিকট তাঁর আত্মদর্শনের পূর্ণাঙ্গ যে পাঠ তা থেকে যা নাজেল হয় বা বের হয় তাকেই বলা হয়েছে কোরান। পূর্ণাঙ্গ সাধকের আত্মদর্শনের পাঠকে অর্থাৎ অভিব্যক্তিকে কোরান বলে। আরবী কোরান এদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। কোরানই মানুষের জন্য একমাত্র হেদায়েত। এটা সাধকের ‘রমজান মাস’ ব্যতীত অর্থাৎ শিরিক পরিত্যক্ত কাল ছাড়া অন্য সময় নাজেল হয় না।
চরম সাধক থেকে আগত কোরান অর্থাৎ পরম একজন গুরু হতে আগত কোরান ইনসানের জন্য হেদায়েত। ইনসান থেকে নিুপর্যায়ের মানুষের জন্য হেদায়েত নয়। সৎগুরু তাঁর নিজ থেকে আগত কোরান শিক্ষা দিয়ে অধীনস্থ ভক্ত জীবদের ইনসান বানিয়ে থাকেন (৫৫:১)। এমন ইনসানের জন্যই কোরান হেদায়েত। জীবপ্রকৃতির মানুষের জন্য কোরান বোধগম্য বা যোগ্য নয়। গুরু থেকে যোগ্য শিক্ষালাভের পর তারা কোরানের জ্ঞান লাভের যোগ্যতা অর্জন করে থাকে।
সায়েমের কাছে তাঁর সিয়ামের কালে হেদায়েতের ব্যাখ্যা এবং ফোরকান নাজেল হয়। মানবজীবন সার্থকভাবে মুক্তির দিকে পরিচালনার জন্য সামাজিক ও ব্যক্তিক জীবনের যত প্রকার হেদায়েত (দেশনা) প্রয়োজন হতে পারে তার সর্বদিকের জ্ঞানে সায়েম পরিপূর্ণ হয়ে থাকেন।
সিয়ামসাধনার সময়ে সিয়ামের ফলশ্রুতিস্বরূপ সায়েমের মধ্যে ফোরকান নাজেল হয়। অর্থাৎ ভালমন্দ প্রভেদজ্ঞান তথা সর্ববিষয়ের পার্থক্য নির্ণায়কজ্ঞান নাজেল হয় যার দ্বারা বস্তুর বন্ধন থেকে মুক্তিপথের সঠিক নির্দেশনাপ্রাপ্ত হওয়া যায়।
‘সিয়াম করা’ অর্থ সপ্ত ইন্দ্রিয় দ্বার দিয়ে যা কিছু বিষয়বস্তু মস্তিষ্কে প্রবেশ করে তার মোহ বর্জন করা। এমন বর্জনের গুরুত্ব যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় অর্থাৎ উপলব্ধি করে সেই ব্যক্তিই কেবল এ মাসে সিয়াম করে। অন্যলোকেরা কেবল পানাহারের সময়সূচির বিধান পালন করেই আত্মপ্রসাদ অনুভব করে।
পীড়া এবং ভ্রমণ—এগুলো দৈহিক ও মানসিক উভয় প্রকার হয়ে থাকে। মানসিকভাবে পীড়িত এবং বিষয়স্তুর উপর মনে মনে ভ্রমণরত ব্যক্তির পক্ষে সিয়াম পালন করা সম্ভবপর নয় বলেই তাদের প্রতি নির্দেশ হলো তারা যেন সিয়াম পালনের উপযুক্ত মানসিক যোগ্যতা অর্জনের পর তা পালন করতে যতœবান হয়। ‘পালন করা’ কথা কোরানে নেই, আছে ‘গণনা করা’র কথা। কোরানের কথা হলো, পরবর্তী কালসমূহের অর্থাৎ প্রতিটি ধর্ম আগমনের কালগুলো থেকে আগমনকারী সমস্ত ধর্মকে এক এক করে গণনা করা। ‘গণনা করা’র অর্থ আগমনকারী প্রতিটি ধর্মই যেন তার জ্ঞাতসারে আগমন করে এবং বিদায় গ্রহণ করে। তাহলে বস্তুবাদের মোহের ছাপ তথা শিরিক বা সংস্কার মস্তিষ্কে আবদ্ধ হয়ে থাকে না। সবই ত্যাজ্য ও পরিত্যক্ত হয়ে যায়। এটাই সিয়ামের মূল কথা। সিয়ামের অভ্যন্তরীণ কথাটি প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই আনুষ্ঠানিক সিয়াম পালনের ক্ষেত্রেও দৈহিকভাবে অসুস্থ এবং দৈহিক ভ্রমণকারীর জন্য সিয়াম পালন নিষিদ্ধ করে তা পরে পালন করা ‘ওয়াজেব’ অর্থাৎ অবশ্য পালনীয় করা হলো।
‘সহজ’ অর্থ জান্নাতের জীবন এবং ‘কঠিন’ অর্থ জাহান্নামের জীবন (৮৭:৮ ও ৯২:৭)। আল্লাহতালা রবরূপে (সম্যক গুরু) মানুষের সঙ্গেই আছেন। তিনি কখনও চান না যে, তিনি মানুষের কঠিন অবস্থার সঙ্গে অবস্থান করেন। বরং মানুষের সহজ অবস্থার সঙ্গে স্থায়ী হয়ে থাকতে চান। কিন্তু মানুষ কার্যকরীভাবে ইচ্ছে না করলে তার ‘সহজ জীবন’ আল্লাহতালা তাকে দান করতে পারেন না। অর্থাৎ জান্নাত এবং তদূর্ধ্বের স্থান দান করতে পারেন না। এটা তাঁরই রচিত বিধান।
অতএব সিয়ামের যে হেদায়েত বা নির্দেশ আমাদের দেয়া হয়েছে সে নির্দেশের উপরে আমল করে আমাদের মধ্যে আল্লাহকে বড় করে তোলার জন্য ধর্মসমূহের গণনাকার্যের অনুশীলনকে কৃতকার্য করে তোলা একান্ত প্রয়োজন। নির্ধারিত নিয়মে গণনাকার্য সম্পাদন করতে থাকলে বস্তুমোহের ছাপ তথা শিরিক থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভবপর হবে। এবং তার ফলে আল্লাহ আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয়ে উঠবেন। সব হেদায়েত মানুষের নফসের উপরই দেয়া হয়। নফসের উপরে আল্লাহকে বড় করে তোলার জন্যই হেদায়েত। নফস প্রাধান্য পেলে মানুষের মধ্যে আল্লাহর জাগরণ হয় না। সিয়ামসাধনায় বস্তুর মোহবন্ধন থেকে মানুষ মুক্ত হয়ে যায়। মুক্তমানুষ প্রকৃতিকে জয় করে পুরুষে পরিণত হন। এবং তখনই কেবল আল্লাহর প্রতি মুক্তির কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা সম্ভবপর হয়।
মোরাকাবা মোশাহেদায় আশেকজনা মশ্গুল রয়
ফানা ফিল্লায় দাখেল হলে ইরফানি কোরান তাঁরে শোনায়
বাতেনের ঘরে নূরনবী
পুরুষ কি প্রকৃতি ছবি
পড় দেলকোরান
কর তাঁর বিধান
মনের আঁধার দূরে যাবে ॥
আত্মহারা সুফির কাছে প্রেমের চেয়ে বড় কোনও ধর্ম নেই। এ মহাভাবরাজ্যে গুরু ‘মাশুক’ আর শিষ্য ‘আশেক’। "আশেক বিনে ভেদর কথা কে আর পোছে" কোরান নির্দেশিত ‘দায়েমি সালাত’ তথা সর্বমূহুর্তের নির্বিরাম ধ্যানক্রিয়া মোরাকাবা ও মোশাহেদা’ এ দু ভাগে বিন্যস্ত। ‘মোরাকাবা’ অর্থ আকারের ধ্যান এবং ‘মোশাহেদা’ অর্থ বিষয়ের ধ্যান। গুরুরূপ অখণ্ড মহাআকারের মধ্যে জগতের সব খণ্ড বিষয়ের নিহিতার্থ সুপ্তগুপ্ত আছে। আপন গুরুর রূপধ্যানে নিমগ্নতাই ‘ফানা ফিল্লা’ এবং ক্রমে মুক্তির মন্দিরে ‘বাকা বিল্লা’ পর্যায়ে পৌঁছালে সুফির কোরানজ্ঞান আপন অন্তর হতে উৎসারিত হয়। বাতেনের ঘরে তথা মনোরাজ্যে দেহপাঠ পূর্ণ হলে প্রকৃতিপুরুষভেদ আত্মস্থ করে নবীতত্ত্বের রহস্য সুফির অধিগত হয়ে যায় অনায়াসে। শাঁইজী লালনের পদে পদে এভাবে ছড়িয়ে আছে সুফিচিত্তের গুরুমুখি প্রেমভক্তিযোগ যা কোরানেরই উচ্চাঙ্গিক সিদ্ধিসাধন।
দেলকোরানের সর্বজনীন - সর্বকালীন এ মহাসত্যকে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতার ইদুরদৌড় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত বাদী ও বিবাদীগণ যত 'উপর চালাকি' করুক না কেন, কারোরই শেষরক্ষা হবে না। জগতজুড়ে বাঙলার লালনবাদী কোরানর ক্রমঃবিস্তার চলছে। এ কোরান তুলে ধরা ছাড়া আর কিছুতেই অত্যাসন্ন সমূহ বিপদ এড়াবার কোনো উপায় নেই।
নবুয়ত তার এমনি মেলে
দলিল-কোরান না পড়লেও সে সকলই দেল-কোরানে পাবে ॥
------------------------------------------ফকির লালন শাহ
‘পুসিদার ভেদ’ অর্থ আত্মতত্ত্বের গুপ্তরহস্য তথা সৃষ্টিরহস্য। সৃষ্টি বা স্থূল সত্তা দৃশ্যমান অথচ সূক্ষ্ম স্রষ্টা বা মূলসত্তা অদৃশ্য অজানা। দেহকে দেখা যায় কিন্তু দেল বা চিত্তাকাশ কি দেখা যায় না ছোঁয়া যায় কখনও? যদিও দেলই দেহের আসল জন্মদাতা। সর্বসৃষ্টির মূলে মন তথা দেলই উৎসস্বরূপ। মানবের দেল থেকেই জন্ম নেয় ভাব বা অভিব্যক্তি। তারপর আসে ভাষা। ভাষাও মনের সম্পূর্ণ ভাবটুকু বলে কয়ে প্রকাশ করতে পারে না, চারভাগের একভাগ মাত্র তুলে ধরতে সক্ষম ধ্বনিময় রূপক-প্রতীকের আশ্রয়ে। অবশ্য ভাবকে ধরতে না পারলেও ভাষাকে ধরে রাখাই দলিলের দায়। তবে দলিল কোনও দেলের জন্ম দিতে পারে না বরং দেলের প্রকাশকে প্রামাণ্যরূপে বা বিকৃতরূপে ধরে রাখতে পাওে শুধু। দেহ ধরা যায় তাই তার নাম ‘ধরা’ আর মনকে ধরা যায় না বলেই তার নাম ‘অধরা’। শাঁইজীই কেবল অধরাকে ধরতে জানেন; যেমন বলেন, “ধররে অধর চাঁদেরে অধরে অধর দিয়ে/ যে ধরাতে অধর ধরা থেকরে সচেতন হয়ে”। কিন্তু দেল ও দলিলের দ্বন্দ্বে পড়ে মানুষের বড় মুসিবত। দেলকে দলিলের ভারি বোঝার নিচে চিড়েচ্যাপ্টা বানিয়ে ফেলা হলে যা হয় তাই তো হচ্ছে প্রথাবদ্ধ সব ধর্মকর্র্মে। হৃদয়হীন কর্মাচার আর দর্শনহীন ধর্মাচারেরর ঘোলাজলে সমাজ সংসার পাপপঙ্কের অতলে তলিয়ে আছে।
সুফির চোখে ‘দেল ও ‘পুসিদা প্রায় সমার্থক। অন্তকরণ বা চিৎপ্রকর্ষণ এরকম দোধারী অর্থ এর। ‘ভেদ’ অর্থ রহস্য বা তত্ত্বজ্ঞান। দেহমনের ভেদসমুদ্র পেরিয়ে নির্মোহ ও নির্ভার মনোজগতের বিশেষ অধিপতি হন সুফি। হেরা পর্বত মানবদেহের অপর নাম। তার গুহায় তথা মনোলোকে নির্জন সাধনালব্ধ নবুয়তজ্ঞান ঝরনার নিরন্তর অবগাহনে ¯স্নাতক হয়ে রেসালতের বঙ্কিমপথ ধরে বেলায়েতসমুদ্র পেরিয়ে মাওলাইয়াত তথা ইমামত অর্থাৎ সম্যক গুরুতন্ত্রের স্তম্ভপ্রতিম সুফিরূপে শাঁইজী স্বয়ং দেলকোরান। কারণ তিনি ‘আত্মতত্ত্বে ফাজেল’ মানে পরিসিদ্ধ আত্মবিদ বা তত্ত্ববিদ ধর্মবিজ্ঞানী বলেই সব ধর্মের উপর তিনি সদা ভাসমান সাঁতারু ‘লা শরিক’ বা ধর্ম নিরপেক্ষ মহাসত্তা। এমন মহাপুরুষ যা বলেন, যা করেন সবই কোরানের জীবন্ত অভিব্যক্তি। তিনি কোনও দলিলের পরোয়া করেন না বরং দলিলই তাঁকে অনুসরণ করে পায়ে পায়ে।
ফকির লালন শাহের পূর্বে বাংলা ভাষায় ‘দেলকোরান’ কথাটি আর কেউ এমন জোরালোভাবে উচ্চারণ করেনি এবং এমন অকপটে কোরানের জাগ্রত জীবনদর্শন তথা ধর্মসাধনার মর্মবস্তুকে চুম্বক কথায় তুলে ধরার সাহসও কদাচ পায়নি। ‘দেলকোরান’ নিয়ে তাঁর মতো এত উচ্চকিত হতে আর কাউকেও দেখা যায় না। এর কারণ কী? প্রকৃত ভাব অর্থ না বুঝে আরবীয় রাজতন্ত্রের চাপানো দলিল কোরানের উপর অন্তরের অলীক ও অন্ধ আনুগত্য বাঙালিকে দেলকোরান থেকে সরিয়ে ভুলকোরানের দুর্বিপাকে ঠেলে দিয়েছে। উপরোক্ত কালামে তাই শাঁইজী জানাচ্ছেন, যিনি সম্যক গুরুরূপে উপস্থিত ‘আলে মোহাম্মদ’ বা মোহম্মদের বংশীধারী তিনি পরিজ্ঞাত আছেন পূর্ববর্তী নবীগণের নবুয়ত তথা সত্যায়িত মহাজ্ঞান। নবুয়ত লাভের জন্য আজকের দিনে তাঁকে আর আগের মতো সাধনভজন করে সিদ্ধ হতে হয় না। তিনি জন্মসিদ্ধ মহাপুরুষ। আত্মতত্ত্বের গুপ্তভেদ যাঁর নখদর্পণে নবুয়ত তাঁর এমনিই মেলে। নবুয়তের স্তর পেরিয়ে 'বেলায়েতর' উচ্চাঙ্গিক অভিধায় তাঁরা অভিষিক্ত হন অতীন্দ্রিয় মহৎলোকে। স্কুল-মাদ্রাসায় পড়ালেখা না শিখে কাগজের দলিলকোরান পাঠ না করলেও এমন পরিসিদ্ধ সাধকপুরুষ আপন অন্তর্নিহিত মহাজ্ঞানের ফল্গুধারায় সমগ্র সৃষ্টিরহস্যের জ্ঞানে মহাজ্ঞানী-যা কোরানের পরিভাষায় ‘আল কেতাব’। ‘কোরান মিনাল কিতাব’ অর্থাৎ কেতাব থেকেই কোরানের উৎপত্তি। কেতাব মানে যে বই নয়, মহাপুরুষের অখণ্ড মানসরাজ্য-- এ নিরেট সত্যকথাটি বাঙালি কেন কেউই জানত না, আমার মহান সদগুরু সদর উদ্দিন আহমদ চিশতীই প্রথম জানালেন তাঁর ‘অখণ্ড কোরানদর্শন’এর যথার্থ শব্দসংজ্ঞায় ‘কেতাব’ আসলে কী : “নূরে মোহাম্মদীর মাধ্যমে বিচিত্র সৃষ্টিরূপে স্রষ্টার বিকাশবিজ্ঞানকে কেতাব বলে। উচ্চমানের বিশিষ্ট সাধকের উপর কেতাবজ্ঞান নাজেল হওয়া বিষয়টি সর্বকালের একটি চিরন্তন ব্যবস্থা। কেতাব হলো বিশ্বপ্রকৃতির সামগ্রিক বিকাশবিজ্ঞান। মানুষের জন্য আল্লাহর দেয়া জীবনবিধানও কেতাবের অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহর বিকাশবিজ্ঞানকে কেতাব বলে। যে যন্ত্রের মধ্যে বা যে সকল রূপের মধ্যে আল্লাহর উচ্চ বিজ্ঞানময় বিকাশ ঘটে তার মধ্যে মানবদেহই সর্বশ্রেষ্ঠ। এ জন্য মানবদেহকে ‘আল কেতাব’ বলা হয়েছে। আল কেতাবের জাহেররূপ ‘মানবদেহ’ এবং বাতেনপ্রক্রিয়া ‘বিকাশবিজ্ঞান’। আল কেতাবের উভয়প্রকার বিকাশের মূল উৎস নূর মোহাম্মদ। “আল কেতাব পাঠ করা” অর্থ আপনদেহ পাঠ করা তথা আপনদেহের মধ্যে আত্মদর্শনের অনুশীলন করা। আপনদেহই সকল জ্ঞানের মূল উৎস। সহজ কথায়, ‘কেতাব’ অর্থ মানবদেহ। ‘আল কেতাব’ অর্থ বিশিষ্ট মানবদেহ বা সিদ্ধপুরুষ অর্থাৎ প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত একজন মহাপুরুষ। আল কেতাব থেকেই ধর্মগ্রন্থসমূহের আগমন”।
মোর্শেদরূপে এমন মূর্ত ও প্রকাশ্য দেলকারানকে মেনে চলা জীবের ক্ষুদ্র দেলের সাধ্যে ভীষণ কঠিন। পালন করতে কেউ পারুক বা না পারুক তাঁর দর্শনকে স্বীকার করে নিলেই ধর্মকর্মজগতের অর্ধেক সমস্যার সমাধান এমনিতেই হয়ে যায়। কিন্তু আমরা সত্যকে সহজে স্বীকৃতি না দিয়ে বৃথা বিরোধ-বিতর্কে মূল্যবান এবং দুর্লভ মানবজীবনের অপচয় করি । যার ফলে সুদূরপ্রসারী বিপাক-বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে আছি প্রায় সবাই।
সদগুরুর স্তব্ধ সমাহিত অন্তর থেকে নিঃশব্দে ক্বাফশক্তির অর্থাৎ মহাশক্তির বিচ্চুরণ ঘটে। সে বিচ্চুরণ স্থানকালপাত্রের ভেদ মানে না। কারণ তা মহাশূন্য হতে উৎসরিত চিৎশক্তির নিত্য প্রস্রবণ। এ শক্তি ধারণ করার পূর্বে দেল তথা চিত্তকে পরিপূর্ণ শূন্য করে ফেলতে হয়। তাতে গুরুধ্যান হয়ে যায় শূন্যধ্যান। অনুগ্রহশীল গুরু ও সার্থক শিষ্যের সম্বন্ধ বাইরের কোনও শব্দাচারে বিভক্ত নয়, অন্তর্গত শক্তিবলে সুসম্পৃক্ত। অব্যক্তে না পৌছালে রূপান্তর সূচিত হয় না সার্থকভাবে। তাই গুরুকে উপলক্ষমাত্র করে ডুব দিতে হয় মহাশূন্যে। তাতেই প্রকৃতির রূপান্তর সৃষ্টি হয়। এ শূন্যতায় গেলে শুদ্ধদেল তথা চিত্ত নির্মল হতে পারে। নির্মল মানে মল-কলুষমুক্ত শুদ্ধচিত্তেই সহজে বিবেকের জাগরণ ঘটে। মন তখন আর সন্দেহ-সংশয়ের দোলাচলে অস্থির থাকে না। যা সত্য সেটাই সুফির মানসপটে ভেসে ওঠে। সে সত্যকে অনুসরণ করার বীর্যও তাঁর ভেতরে সুসংহত হয়।
"ঈসা মুসা দাউদ মোহাম্মদ রসুল / খোদার কাজে আছে মকবুল / ফরমান করিতে কবুল / পড়ছে সদাই দেলকোরান ॥ ইঞ্জিল তৌরা জুব্বুব কোরান / চার জায়গায় চার বয়ান / সিরাজ শাঁই বলে দেল ঢুঁড়িলে লালন / পাবিরে সকল সমাধান"--শাঁইজীর ভাষ্যমতে নবী দাউদ, মুসা, ঈসা ও মোহাম্মদুর রসুলাল্লাহ কেউ কোনও ধর্মগ্রন্থ লিখে যাননি। সবাই যে আপনাপন দেলকোরান পাঠ থেকেই স্বতোৎসারিত জুব্বুব, তৌরা, ইঞ্জিল ও কোরান প্রকাশ করেছেন। তাঁদের তিরোধানের ক্ষমতাসীন রাজা বাদশারা সব ধর্মগ্রন্থের উপর অবৈধ হস্তক্ষেপ ও অস্ত্রোপাচার দ্বারা নানা অদলবদল ঘটানোর ফলে তা এখন চারভাবে খণ্ডিত ও বিকৃত মনে হলেও শুদ্ধচিত্ত সাধক আপন দেল ঢুঁড়লে এ চারগ্রন্থের মধ্যে খণ্ডতা ও বিভেদের পরিবর্তে এককত্ব ও অখণ্ড সত্যের পরিচয়ই আহরণ করেন। মানুষের মগজের চাইতে কাগজের মূল্য বেশি হতে পারে না।
আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চাজগত ব্যক্তিসাধকের জীবন্ত আত্মজ্ঞান তথা তত্ত্বজ্ঞানকে একপাশে ঠেলে দিয়ে এত বেশি মাত্রায় কাগুজে দলিল তথা বইপত্র মুখস্থতা নির্ভর হয়ে পড়েছে যে, ব্যক্তির মুক্তবিকাশের কোনও সুযোগই নেই। প্রশ্ন জাগে, ছাপাখানায় মুদ্রিত সহজলভ্য বইয়ের প্রচলন যখন ছিল না তখন কি মানুষ জ্ঞানচর্চা করেনি আজ থেকে মাত্র দুশো বছর আগেও? শাহ লালন ফকির কিছু না লিখেই কীভাবে জগতে আজ এত গভীরভাবে প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য পাঠ্য হয়ে উঠতে পারেন নতুনভাবে? আরও অতীতের দিকে তাকালে ধর্মাবতার রাম, কৃষ্ণ, মহাবীর, গৌতম, নূহ, দাউদ, মুসা, ঈসা, মোহাম্মদ, আলী, হোসাইনগণ যে মহাজ্ঞানময় ‘দেলকোরান’ওয়ালা হলেন তা কোনও প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার ফসল নয়, সবই আত্মতত্ত্ব সন্ধান ও আত্মদর্শনের ফলশ্রুতি। কোন মাদ্রাসায় পড়ে কোন নবী-রসুল কোরানেওয়ালা হয়েছেন কবে যাঁরা গরু ছাগল মেষের মতো ভক্তদের লালনপালন করার জন্য ‘রাখাল’ নামে জগতে সুখ্যাত? সামাজিক প্রাতিষ্ঠানিক সমূহ প্রতিকূলতাকে ডিঙিয়ে সাধকের ব্যক্তিগত বিজয় সম্ভব, সুফির অখণ্ড দেলকোরানের অটলভাষ্য তারই স্বয়ংপ্রকাশ।
দেলকোরান পড়ে ‘ইনসানে কামেল’ তথা পূর্ণমানব না হয়ে বাহ্য দলিল কোরান পড়ে ‘হাফেজ’’ ‘মুফতি’ ‘মোহাদ্দেস’ ইত্যাদি তকমাধারী হবার নির্দেশ কোরানের কোথায় আছে? কোথাও নেই। আদি মোহাম্মদী সাধনার বিরুদ্ধে এগুলো নিষ্ঠুর উমাইয়া-আব্বাসীয়-সৌদি রাজতন্ত্রের রচিত চক্রান্তমূলক কারসাজি মিথ্যাব্যবস্থা যা মাদ্রাসাশিক্ষার নামে হাজারও লোককে রসবোধহীন হিংস্র কাঠমোল্লায় পরিণত করছে। তোতাপাখির মতো মুখস্থ বুলিবাগীশ হবার মধ্যে সত্যের লেশমাত্র অনুভবও থাকে না। কাগজের কোরান বোবা ও কালা। সে কথা বলতে পারে না, শোনেও না। কিন্তু দেলকোরান সাধকের সঙ্গে কথা বলেন যখন তখন, নিত্য নব আদেশ নির্দেশ দিয়ে চলেন, সূর্যের অনুপস্থিতিতে অন্ধকারে নিজেই মহাসূর্য হয়ে জ্বলেন।
মানুষের জানার ও বোঝার জন্যই মহানবীর মাধ্যমে জগতে কোরান প্রকাশিত হয়েছে। অর্থ না বুঝে শুধু কম্পিটারের মতো যান্ত্রিক ঢংয়ে আউড়ে যাবার বা লৌকিক আবৃত্তি প্রতিযোগিতার বিষয় নয় কোরান। অথচ সমাজ সংসারে এমন বদপ্রতিযোগিতাই চলছে। কোরান যে মোটেও জীবনবিধান নয়, বরং জীবনদর্শন সে আদ্যকথাই ভুলে গেছি সবাই ভোগসুখলোভী এজিদী ধর্মব্যবস্থার প্রবল প্রতাপে ও চাপে। কোরান বাইরে থেকে ধার করা বুলির বস্তা বা ছাপানো কাগজের ফর্মা নয়, এ হলো সাধকের শুদ্ধদেল থেকে স্বতোৎসারিত মহাভাবপ্রবাহ যাকে ‘বিজ্ঞান’ বলা হয়। ভোগবাদের হাতছানিতে বস্তুবিজ্ঞানের কঠিন চাপে অধ্যাত্মানুভবের সে সূক্ষ্মতর বোধশক্তি জগতবাসী প্রায় হারিয়ে ফেলেছে আজ। তাই দেখি ঘটা করে ‘কোরান সন্ত্রাসীর গ্রন্থ’ বলে পাশ্চাত্যের কোনও কোনও মহল কাগুজে কোরান তথা দলিল কোরান পুড়িয়ে বোকার আত্মপ্রসাদ লাভ করছে। বস্তুবাদী হৃদয়হীন বিশ্বব্যবস্থার পাষাণবাঁধ ভেঙে মুক্তধারার মতো দেলকোরানধারী মহাসাধুর পুনরুত্থান এবং নতুন মহাভাবান্দোলন সম্ভাবনাও তাতে দিনে দিনে পরিপক্ক হয়ে উঠছে।
সমস্ত সাধনার মূল কথা হলো দিনরাতব্যাপ্ত সকাল-সন্ধ্যা নিবিড় ধ্যান, জপ বা অনুস্মৃতি যাকে আরবী কোরানের পরিভাষায় বলে ‘জিকির’। এর নামই গুরুধ্যানচিত্ততা। ‘দেলকোরান না জানিলে দলিলকোরান পড়লে কিছু হবে না’- বলে ফকির লালন শাহ বাঙালিকে সাবধান করে দিয়েছেন প্রায় দুশো বছর আগে। দেলকোরান একজন মহামানুষ বা অতিমানুষ। তিনি যা বলেন যা করেন সবই মূর্ত কোরানের পরিচয়। এমন মহাপুরুষকেই বলা হয় ‘কোরানুন নাতেক’ অর্থাৎ ‘বাঙ্ময় কোরান’ বা ‘মূর্ত কোরান’ অর্থাৎ দেলকোরান। অথচ আমরা তাঁর মতো আত্মত্যাগী মহাপুরুষদের কাছে সমর্পিত হয়ে আপনাপন দেলপাঠ না শিখে বাহ্যবিদ্যার চাপে পড়ে চিড়েচ্যাপ্টা হচ্ছি প্রতিনিয়ত। বিদ নেই বিহিত নেই শুধু বই পড়ে পড়ে আমরা মস্ত বড় বিদ্যার জাহাজে পরিণত হলেও অবশেষে ভরাডুরি যে নিশ্চিত এ অলঙ্ঘনীয় সত্যটি বর্তমানে ভুলে থাকতে পছন্দ করি। ‘বিদ’ অর্থ জ্ঞানী এবং যাঁর জ্ঞান হিতের সহিত বর্তমান বা বিশেষ হিতকর সেটাই ‘বিহিত’। বিদ বিহিতের হিতাহিতবোধ হয় না তাই বিভ্রান্তির ঘোলাজলে ডুবে মরি। সংসারের কত ভার কাঁধে তুলে নিই অথচ নিজের ভারটুকু নিজে বহন করতে পারি না। প্রেমভক্তিযোগে নিজেকে পাঠ করার পথ খুঁজে পাই না অথচ অন্যের খুঁত ধরি পদে পদে। লোকেদের কাছে জ্ঞানীর তকমা পেয়ে আরও জ্ঞানহারা হই অহমিকাবশে। সদগুরুর শরণাপন্ন হয়ে আপন দেহপাঠ না শিখে নেহাত বইপত্রের বোঝাটানা গর্দভ হয়ে নিজেদের মস্ত জ্ঞানী-পণ্ডিত ভেবে বসি তা কতটা বাহ্যত্যাজ্য আর কতটুকু কী জ্ঞানগ্রাহ্য সে কুতর্কের দোকানদারী করা সুফির কাজ নয়। যার পাপে সে ভোগে একা চার যুগেরে। তুমি বা কার কেবা তোমার এই সংসারে?
মহানবীর প্রতি আত্মসমর্পিত সংখ্যায় অল্প একদল অতিউচ্চস্তরের জ্ঞানী সাধক মহাপুরুষ ভক্তদল ছিলেন যাঁরা তাঁকে অহর্নিশি ঘিরে থাকতেন এবং নিবিড়ভাবে নবীর অনুসরণ ও অনুকরণ করে চলতেন-এঁরাই ‘আসহাবে সুফফা’ নামে সুখ্যাত। ‘সাফা’ অর্থাৎ চিত্তশুদ্ধি থেকে ‘সুফ্ফা’ যা ‘সুফি’র আদি অলঙ্কার। ‘আসহাবে সুফফা’র সুফিগণ এত মহাজ্ঞানী ছিলেন যাঁদের সম্বন্ধে এখনকার দলিলওয়ালা রাজা বাদশাদের দালালেরা কিছুই জানে না। নবীর দেহত্যাগের পর মাওলা আলীর কিয়ৎকালের শাসনামল ছাড়া তাঁরা সব আমলে নানাভাবে অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত ও নির্মমভাবে নিহত হন। ইসলামের প্রকৃত মর্মবাদী সুফিচর্চার আদি উৎস এ আসহাবে সুফফার সাধুগণই এবং এঁদের প্রধান অধিপতি হলেন মাওলা আলী। অথচ আলী এবং তাঁর বংশীয় আহলে বাইতে রসুলগণকে হত্যা ও উৎখাত করার জন্য ওমর, বকর ও ওসমানেরা কাগজের কোরান থেকে তাঁদের নাম মুছে দিলেও সুফির দেলকোরানে নবীর বংশীধারীগণের কালজয়ী সুর ও স্বর অক্ষয় গৌরবে জ্যোতিষ্মান। -
ধর্মজগত এ কথা না বুঝলে চলবে না যে, ‘কোরান নাজেল হওয়া’ কথাটি সর্বকালীন এবং সার্বজনীন একটি বিষয়। এটি কোনও কালখণ্ডে খণ্ডিত নয়। সর্বকালে সাধকের নিকট তাঁর আত্মদর্শনের পূর্ণাঙ্গ যে পাঠ তা থেকে যা নাজেল হয় বা বের হয় তাকেই বলা হয়েছে কোরান। পূর্ণাঙ্গ সাধকের আত্মদর্শনের পাঠকে অর্থাৎ অভিব্যক্তিকে কোরান বলে। আরবী কোরান এদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। কোরানই মানুষের জন্য একমাত্র হেদায়েত। এটা সাধকের ‘রমজান মাস’ ব্যতীত অর্থাৎ শিরিক পরিত্যক্ত কাল ছাড়া অন্য সময় নাজেল হয় না।
চরম সাধক থেকে আগত কোরান অর্থাৎ পরম একজন গুরু হতে আগত কোরান ইনসানের জন্য হেদায়েত। ইনসান থেকে নিুপর্যায়ের মানুষের জন্য হেদায়েত নয়। সৎগুরু তাঁর নিজ থেকে আগত কোরান শিক্ষা দিয়ে অধীনস্থ ভক্ত জীবদের ইনসান বানিয়ে থাকেন (৫৫:১)। এমন ইনসানের জন্যই কোরান হেদায়েত। জীবপ্রকৃতির মানুষের জন্য কোরান বোধগম্য বা যোগ্য নয়। গুরু থেকে যোগ্য শিক্ষালাভের পর তারা কোরানের জ্ঞান লাভের যোগ্যতা অর্জন করে থাকে।
সায়েমের কাছে তাঁর সিয়ামের কালে হেদায়েতের ব্যাখ্যা এবং ফোরকান নাজেল হয়। মানবজীবন সার্থকভাবে মুক্তির দিকে পরিচালনার জন্য সামাজিক ও ব্যক্তিক জীবনের যত প্রকার হেদায়েত (দেশনা) প্রয়োজন হতে পারে তার সর্বদিকের জ্ঞানে সায়েম পরিপূর্ণ হয়ে থাকেন।
সিয়ামসাধনার সময়ে সিয়ামের ফলশ্রুতিস্বরূপ সায়েমের মধ্যে ফোরকান নাজেল হয়। অর্থাৎ ভালমন্দ প্রভেদজ্ঞান তথা সর্ববিষয়ের পার্থক্য নির্ণায়কজ্ঞান নাজেল হয় যার দ্বারা বস্তুর বন্ধন থেকে মুক্তিপথের সঠিক নির্দেশনাপ্রাপ্ত হওয়া যায়।
‘সিয়াম করা’ অর্থ সপ্ত ইন্দ্রিয় দ্বার দিয়ে যা কিছু বিষয়বস্তু মস্তিষ্কে প্রবেশ করে তার মোহ বর্জন করা। এমন বর্জনের গুরুত্ব যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় অর্থাৎ উপলব্ধি করে সেই ব্যক্তিই কেবল এ মাসে সিয়াম করে। অন্যলোকেরা কেবল পানাহারের সময়সূচির বিধান পালন করেই আত্মপ্রসাদ অনুভব করে।
পীড়া এবং ভ্রমণ—এগুলো দৈহিক ও মানসিক উভয় প্রকার হয়ে থাকে। মানসিকভাবে পীড়িত এবং বিষয়স্তুর উপর মনে মনে ভ্রমণরত ব্যক্তির পক্ষে সিয়াম পালন করা সম্ভবপর নয় বলেই তাদের প্রতি নির্দেশ হলো তারা যেন সিয়াম পালনের উপযুক্ত মানসিক যোগ্যতা অর্জনের পর তা পালন করতে যতœবান হয়। ‘পালন করা’ কথা কোরানে নেই, আছে ‘গণনা করা’র কথা। কোরানের কথা হলো, পরবর্তী কালসমূহের অর্থাৎ প্রতিটি ধর্ম আগমনের কালগুলো থেকে আগমনকারী সমস্ত ধর্মকে এক এক করে গণনা করা। ‘গণনা করা’র অর্থ আগমনকারী প্রতিটি ধর্মই যেন তার জ্ঞাতসারে আগমন করে এবং বিদায় গ্রহণ করে। তাহলে বস্তুবাদের মোহের ছাপ তথা শিরিক বা সংস্কার মস্তিষ্কে আবদ্ধ হয়ে থাকে না। সবই ত্যাজ্য ও পরিত্যক্ত হয়ে যায়। এটাই সিয়ামের মূল কথা। সিয়ামের অভ্যন্তরীণ কথাটি প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই আনুষ্ঠানিক সিয়াম পালনের ক্ষেত্রেও দৈহিকভাবে অসুস্থ এবং দৈহিক ভ্রমণকারীর জন্য সিয়াম পালন নিষিদ্ধ করে তা পরে পালন করা ‘ওয়াজেব’ অর্থাৎ অবশ্য পালনীয় করা হলো।
‘সহজ’ অর্থ জান্নাতের জীবন এবং ‘কঠিন’ অর্থ জাহান্নামের জীবন (৮৭:৮ ও ৯২:৭)। আল্লাহতালা রবরূপে (সম্যক গুরু) মানুষের সঙ্গেই আছেন। তিনি কখনও চান না যে, তিনি মানুষের কঠিন অবস্থার সঙ্গে অবস্থান করেন। বরং মানুষের সহজ অবস্থার সঙ্গে স্থায়ী হয়ে থাকতে চান। কিন্তু মানুষ কার্যকরীভাবে ইচ্ছে না করলে তার ‘সহজ জীবন’ আল্লাহতালা তাকে দান করতে পারেন না। অর্থাৎ জান্নাত এবং তদূর্ধ্বের স্থান দান করতে পারেন না। এটা তাঁরই রচিত বিধান।
অতএব সিয়ামের যে হেদায়েত বা নির্দেশ আমাদের দেয়া হয়েছে সে নির্দেশের উপরে আমল করে আমাদের মধ্যে আল্লাহকে বড় করে তোলার জন্য ধর্মসমূহের গণনাকার্যের অনুশীলনকে কৃতকার্য করে তোলা একান্ত প্রয়োজন। নির্ধারিত নিয়মে গণনাকার্য সম্পাদন করতে থাকলে বস্তুমোহের ছাপ তথা শিরিক থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভবপর হবে। এবং তার ফলে আল্লাহ আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয়ে উঠবেন। সব হেদায়েত মানুষের নফসের উপরই দেয়া হয়। নফসের উপরে আল্লাহকে বড় করে তোলার জন্যই হেদায়েত। নফস প্রাধান্য পেলে মানুষের মধ্যে আল্লাহর জাগরণ হয় না। সিয়ামসাধনায় বস্তুর মোহবন্ধন থেকে মানুষ মুক্ত হয়ে যায়। মুক্তমানুষ প্রকৃতিকে জয় করে পুরুষে পরিণত হন। এবং তখনই কেবল আল্লাহর প্রতি মুক্তির কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা সম্ভবপর হয়।
মোরাকাবা মোশাহেদায় আশেকজনা মশ্গুল রয়
ফানা ফিল্লায় দাখেল হলে ইরফানি কোরান তাঁরে শোনায়
বাতেনের ঘরে নূরনবী
পুরুষ কি প্রকৃতি ছবি
পড় দেলকোরান
কর তাঁর বিধান
মনের আঁধার দূরে যাবে ॥
আত্মহারা সুফির কাছে প্রেমের চেয়ে বড় কোনও ধর্ম নেই। এ মহাভাবরাজ্যে গুরু ‘মাশুক’ আর শিষ্য ‘আশেক’। "আশেক বিনে ভেদর কথা কে আর পোছে" কোরান নির্দেশিত ‘দায়েমি সালাত’ তথা সর্বমূহুর্তের নির্বিরাম ধ্যানক্রিয়া মোরাকাবা ও মোশাহেদা’ এ দু ভাগে বিন্যস্ত। ‘মোরাকাবা’ অর্থ আকারের ধ্যান এবং ‘মোশাহেদা’ অর্থ বিষয়ের ধ্যান। গুরুরূপ অখণ্ড মহাআকারের মধ্যে জগতের সব খণ্ড বিষয়ের নিহিতার্থ সুপ্তগুপ্ত আছে। আপন গুরুর রূপধ্যানে নিমগ্নতাই ‘ফানা ফিল্লা’ এবং ক্রমে মুক্তির মন্দিরে ‘বাকা বিল্লা’ পর্যায়ে পৌঁছালে সুফির কোরানজ্ঞান আপন অন্তর হতে উৎসারিত হয়। বাতেনের ঘরে তথা মনোরাজ্যে দেহপাঠ পূর্ণ হলে প্রকৃতিপুরুষভেদ আত্মস্থ করে নবীতত্ত্বের রহস্য সুফির অধিগত হয়ে যায় অনায়াসে। শাঁইজী লালনের পদে পদে এভাবে ছড়িয়ে আছে সুফিচিত্তের গুরুমুখি প্রেমভক্তিযোগ যা কোরানেরই উচ্চাঙ্গিক সিদ্ধিসাধন।
দেলকোরানের সর্বজনীন - সর্বকালীন এ মহাসত্যকে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতার ইদুরদৌড় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত বাদী ও বিবাদীগণ যত 'উপর চালাকি' করুক না কেন, কারোরই শেষরক্ষা হবে না। জগতজুড়ে বাঙলার লালনবাদী কোরানর ক্রমঃবিস্তার চলছে। এ কোরান তুলে ধরা ছাড়া আর কিছুতেই অত্যাসন্ন সমূহ বিপদ এড়াবার কোনো উপায় নেই।