Wednesday, 6 December 2017

শাস্ত্র থেকে সত্য বড়!

0 Comments
১.আমাদের কাছে ঠাহর হচ্ছে আমরা কেবলই বই পড়ে সত্য অনুসন্ধানকারী। বইয়ের পুঁথিগত বিদ্যা, জ্ঞান, তত্ত্ব ও তথ্য অনুসন্ধানকারী। আমরা যদি সে-পুঁথিগত বিদ্যাবুদ্ধি- তত্ত্বকে আমাদের জীবনে, কর্মে কাজে বাস্তবায়ন বা রূপায়িত না করি এবং বাস্তব জীবনে প্রয়োগ ও অনুশীলনের মধ্যদিয়ে না যায় তাহলে পুঁথিগতবিদ্যার সত্যায়ন (সত্যমিথ্যার যাচাই) হয় না। কারণ শাস্ত্র থেকে সত্য বড়!
এজন্য সত্যদ্রষ্টা পুরুষোত্তম নজরুল বলেছেনঃ
★ ওরে মূর্খ ওরে জড়, শাস্ত্র চেয়ে সত্য বড়ো, (তোরা) চিনলিনে তা চিনির বলদ, সার হল তাই শাস্ত্র বওয়া॥
★ "তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান, সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা খুলে দেখ নিজ প্রাণ!"
তিনি আক্ষেপের সুরে বলেছেনঃ ★ "পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও, কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক- জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, যত সখ- কিন্তু, কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?"
আমাদের সমাজের ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধা নাই কেবল অবজ্ঞা, অবহেলা। পরমত সহিষ্ণুতা নেই বললেই চলে। ক্ষয়িষ্ণুতা দেখা যায় ভিন্ন মত ও পথের ব্যক্তির উপর। মতের ভিন্নতা দূষণীয় নয়। ধর্ম/মত/পথ যখন অন্যের উপর চড়াও হয় তখনই সমস্যা।
ধর্ম কী একটা ইন্দ্রিয়দ্বার? যে- তার অনুভূতি থাকবে, অনুভূতিতে আঘাত লাগবে! কেউ বলে মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়, কেউ বলে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, আবার কেউ বলে সপ্ত ইন্দ্রিয়। যথা: চোখ, কান, নাক, কণ্ঠ, জিহ্বা, ত্বক এবং মন দিয়ে যথাক্রমে দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ, কথা (বা ভাব), স্বাদ, স্পর্শ এবং অনুভূতি উদয়-বিলয় হয়। অন্যদিকে যার যার কর্ম তার তার ধর্ম। ধর্মকর্ম এক-, একাকার। ধর্ম থেকে কর্ম আলাদা বা স্বতন্ত্র কিছু নয়। কারণঃ ধর্ম অর্থ স্বভাব, বৈশিষ্ট্য, ব্যবহার, আচার আচরণ, চাল-চলন, গতিপ্রকৃতি। তাইতো ড. মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেছেনঃ
ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, কালচার শিক্ষিত লোকের ধর্ম।
সমাজের সর্বাধিক মানুষ যাকে ধর্ম বলে। ঐগুলি ধর্মের বাহিরের অংশ, আনুষ্ঠানিকতা, প্রাতিষ্ঠানিককরণ, শাস্ত্রকথা বা শাস্ত্রীয়করণ, বিধানসমূহ, প্রথামত, স্থূলতা, মতাবলম্বী। যেমনঃ সনাতন/খ্রিষ্টান/বৌদ্ধ/ইসলাম প্রভৃতি ধর্মাবলম্বী বা মতাবলম্বী। ধর্ম ব্যক্তিগত চর্চার বিষয়, ইহা মনের ব্যাপার ও মানসিক বিষয়, আসলে ধর্ম যখন ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে প্রাতিষ্ঠানিককরণ, সামাজিকরণ, আনুষ্ঠানিককরণ, শাস্ত্রীয়করণ করা হয় তখনই ধর্মীয় গোলযোগ, অনাচার, অবিচার, অপরাধ প্রবণতা শুরু হয়! কারণ এ-কাজগুলি ঘটে সাধারণত সমাজের অজ্ঞানী, অযোগ্য, ক্ষমতালোভী, অসুর-ইতর প্রকৃতি, বাটপার, ধর্মান্ধ, স্বার্থপর, বস্তুবাদী -ভোগবাদী, মালিকশ্রেণী মানুষের দ্বারা।
মূর্খ উগ্র গোয়ার নিষ্ঠুর ও ইতর প্রকৃতির ধর্মান্ধ, কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষের কর্মকাণ্ডকে কেউ যদি ধর্মানুভূতি বলে চালিয়ে দেয় এর চেয়ে ইতরামি, ধূর্তামি, মোটা শয়তানি বলে আর কিছু নেই।
সুতরাং ধর্মের কোন অনুভূতি নেই, ধর্ম নিরপেক্ষ। অনুভূতি থাকে মানুষের। ধর্মানুভূতি বলেও কিছু নেই!?
মরমী মহাত্মা মাওলা সুফি সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী সাহেবে'র মতের উপর অতীতে অনেক সামাজিক অবিচার- অনাচার করা হয়েছে এখনো সাম্প্রতিককালেও করা হচ্ছে নানা প্রকারে, নানা ভাবে। আমরা তাঁর মতের বিরোধিতা করতে পারি তার মানে এ- নয় ব্যক্তিগত আক্রমণ করা, ব্যক্তিবিদ্বেষী হওয়া। ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমাদের কোন অভিযোগ থাকার কথা না; কিন্তু নীতির বিরোধিতা, সমালোচনা করা যেতে পারে।
সুফি সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী তাঁর মতাদর্শের জন্য তাকে জেলে যেতে হয়েছে, উগ্রবাদী ধর্মান্ধ সমাজ তার বাড়ীঘর, আস্তানা, লাইব্রেরি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। সরকার বইগুলি বাজেয়াপ্ত, নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তার পরিবারকে সমাজে অবাঞ্ছিত- লাঞ্ছিত করা হয়েছিল। মসজিদে মসজিদে তার বিরুদ্ধে কুৎসা অপপ্রচার করা হয়েছিল। এমনকি ঢাকা শহরে তাঁর ফাঁসির দাবীতে পোষ্টার দিয়ে ছেয়ে গিয়েছিলো। এখনো তাঁদের উপর চলছে সামাজিক নির্যাতন, অন্যায়- অবিচার।
উনি পরমত সহিষ্ণুতার মানুষ ছিলেন। অন্যকে, অন্যের মতকে শ্রদ্ধা করতেন। যেমন: একদিন তার এক ভক্ত, নিজের সন্তানকে নিয়ে এসেছেন নাস্তিক বলে। সুফি সাহেব তার ভক্তকে বললেন থাক না উনাকে উনার মত থাকতে দিন।
১৯৯২ সালে ৩০ডিসেম্বরে 'জামাত-বিএনপি' সরকারের মদদে 'ওহাবি-এজিদপন্থি, মৌলবাদী জঙ্গিশক্তি'র (যাদের অপর নাম লাহাব/লাহাবী অর্থাৎ অগ্নিশিখা বা মোহাগ্নি শিখা জন্মদাতা) দ্বারা অগ্নিসংযোগের পর অগ্নিধ্বসে আজো রয়ে গেছে মাওলা সুফি সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী পোড়ানো বাড়িটি, সেই বাড়িটি সুফি সাহেব ও তাঁর স্ত্রী গওহর আরা বেগম এ-দু'জনের পেনসনের টাকায় গড়া। সেই স্মৃতি কথা বলতে গিয়ে একদিন আক্ষেপ করে গওহর আরা বেগম বলেছিলেন: যারা আমাদের গৃহহারা করলো, তারা ঠিকই একদিন গৃহহীন হবে। আশ্চর্য হলে সত্য, বাস্তবে ক্ষেত্রবিশেষে অনেকের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল ......! প্রকৃতির কি মধুর প্রতিশোধ! এইতো সেদিনের কথা, হাসিনা সরকারের আমলে স্বয়ং বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদাকে যখন তার ব্যবহৃত বাড়ি থেকে তাকে উচ্ছেদ করেছিল তখন গৃহহারা বেগম খালেদার অশ্রুসিক্ত, কান্নায় ভেঙ্গে পড়ার সেই দৃশ্য দেখে তাঁ'র সেই কথাগুলো স্মৃতির মধ্যে জেগে উঠেছিল!!
শুনেছি যারা কোরআন তফসীর আর কোরআন দর্শনের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারে না...তাদের উদ্দেশ্য করে সুফি সাহেব বলেছিলেনঃ "মোল্লারা বাংলা পড়িতে পারে কিন্তু ইংরেজী পড়িতে পারে না। যদি তফসীরের দর্শনগুলি ইংরেজীতে অনুবাদ করিয়া দিতাম, তাহা হইলে শিক্ষিত সমাজের কাছে সুগৃহীত হইতো। গাধাগুলি চেচাঁমেচি করিয়া সকলের মাথাগুলি খারাপ করিয়া ফেলিতে পারিতো না। আফসোস! সর্বসাধারণের সুবিধার কথা চিন্তা করিয়া বাংলায় রুপান্তর করিলাম। অথচ, তাহা হিতে বিপরীত হইলো।"
সুফি সাহেবের এক গুণমুগ্ধ ভক্ত তাকে উদ্দেশ্যে লেখেছেনঃ
হে আলোকিত প্রশংসিত সত্তা, তুলে ধরেছ মোহাম্মদীর ঝাণ্ডা। হাজার বছরের লুকায়িত অবগুণ্ঠিত মোহাম্মদের স্বরূপ প্রকাশে গেছে তোমার দেহকাল। উড়িয়েছ দ্বীনে মোহাম্মদীর বিজয়কেতন।
সহস্রবছরের (দ্বীনের মোহাম্মদীর উপর) চাপিয়ে দেওয়া পাহাড়সম মিথ্যাপ্রবাহকে ভেঙ্গে করেছ চুরমার। (ভেঙ্গে গুড়িয়ে, মিশিয়ে দিয়েছ সমতলে)
তোমার উপর নেমে এসেছিল বস্তুবাদী_ভোগবাদীর নিমর্ম আঘাত, অগ্নিসংযোগ, জেলজুলুম, দমননিপীড়ন, অত্যাচার। তোমার প্রকাশিত মোহাম্মদী দর্শনকে বাজেয়াপ্ত, নিষিদ্ধ করেও আটকিয়ে রাখতে পারেনি- তোমাকে, দাবিয়ে রাখতে পারেনি তোমার আনীত দর্শনকে..... (যা' জগতের ইতিহাসে বিরল!)
কোলাহলপ্রিয় নিন্দুকের দল, দলবেঁধে করে তোমার নিন্দাপাঠ, যারা বস্তুবাদী- ধর্মান্ধ, ধর্মমাতাল- ভোগের নেশায় মত্ত, অবৈধ খেলাফত ও খলিফাপ্রিয়, যারা ধর্মব্যবসায়ী, ক্ষমতালোভী- গদিনাসীন, অজ্ঞানী, ফেতনাফ্যাসাদসৃষ্টিকারী।
*২
মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য -অবজ্ঞা করে, উপেক্ষা করে বা বাদ দিয়ে এমনকি ঘৃণা করে যারা ব্যাবসাবাণিজ্য, রাজনীতি, ধর্মকর্ম, শিল্পসাহিত্য, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চা করে কিছু পেতে বা দিতে চায় তারা আসলে কি? বা কে? তাঁরা বিভিন্ন পেশায় অনেক বড়, দক্ষ বা বিশেষজ্ঞ হতে পারে, প্রচুর বইপুস্তক পড়তে, ও লেখতে পারে! কিন্তু আর যাইহোক তাঁরা মানবতাবাদী নয় বরং মানবতাবিরোধী! তাঁদের দিয়ে প্রকৃতপক্ষে মানুষের সার্বিক কল্যাণ আশা করা যায় না, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তারা মানুষের অকল্যাণ, ক্ষতিসাধন করে থাকে! তাই তাঁদেরকে হয়তো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কবি, ধার্মিক ইত্যাদি বলা যেতে পারে তাদের পেশা ও জীবিকা অনুসারে কিন্তু প্রকৃত মানুষ বলা যায় কি? মানুষের জন্য সবকিছু -এই জগতসৃষ্টি, সমাজসংসার সবকিছু। আর তাকে প্রাধান্য না-দিয়ে উপেক্ষা, অবজ্ঞা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, ঘৃণা ও বাদ দিয়ে কোনকিছু করা মানবকেন্দ্রিক না। একজন মানুষ সেই যে মানুষকে ভালবাসে, মানুষের ব্যথায় ব্যথিত হয়, মানুষের কল্যাণ করে। সবার উপরে, সবকিছু থেকে তার কাছে মানুষই বড়! মানুষই শ্রেষ্ঠ!
"সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই"- কবি চন্ডিদাসের এই সুপ্রাচীন উক্তিটি মাতবতাবাদের (Humanism) মূল কথা। এ-ধারায় পরবর্তীতে স্বভাবকবি সাইজি লালন ফকির গেয়ে উঠেনঃ

"এমন মানব সমাজ কবে গো হবে সৃজন যেদিন হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান জাতি গোত্র নাহি রবে।"
কিংবা পুরুষোত্তম নজরুলের ভাষায়ঃ "গাহি সাম্যের গান- মানুষের চেয়ে কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,"
*হিন্দু হিন্দু থাক, মুসলমান মুসলমান থাক, শুধু একবার এই মহাগগনতলের সীমা হারা মুক্তির মাঝে দাঁড়াইয়া মানব তোমার কন্ঠে সেই সৃষ্টিতে আদিমবাণী ফুটাও দেখি। বল দেখি "আমার মানুষ ধর্ম"। মানবতার এই মহান যুগে একবার গন্ডী কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বল যে, তুমি ব্রাহ্মন নও, শুদ্র নও, হিন্দু নও, মুসলমানও নও, তুমি মানুষ - তুমি ধ্রুব সত্য। _________________ পুরুষত্তোম নজরুল।
সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা--- এ তিনটি হল মানবতাবাদের ভিত্তি। মানবতাবাদ এমন একটি মতবাদ- "যা মানুষকে যথার্থ মানবধর্মী করে তোলে, যেখানে মানুষই সর্বস্ব, কোনকিছুর জন্য মানুষ নয় বরং মানুষের জন্য সবকিছু, ধর্ম, বিজ্ঞান ও দর্শন প্রভৃতির। এবং প্রকৃতি ও ইতিহাসের সে সব উপাদান তার মনকে সমৃদ্ধ করতে পারে, সে সবকিছুতেই তাকে অংশগ্রহণ করে তার অন্তরস্থিত মহত্ত্বের অভিব্যক্তি ঘটায়...
মানবতাবাদ ইশ্বরকেন্দ্রিক (Theocentric) অথবা মানবকেন্দ্রিক (Anthropocentric) হতে পারে। পাশ্চাত্যদর্শনে ইশ্বরকেন্দ্রিক মানবতাবাদের ওপর খ্রিষ্টধর্মের প্রভাব স্পষ্ট। এই মানবতা অনুযায়ী মানব জগতের তথা বিশ্বের কেন্দ্রস্থলে আছেন ইশ্বর। আর দ্বিতীয় মতবাদ অনুযায়ী সবকিছুর কেন্দ্রস্থলে রয়েছে মানুষ। ............অস্তিত্ববাদের সুফি দর্শনে- 'ওহ্‌দাতুল ওজুদ' তথা 'একক অস্তিত্ব' তত্ত্বে জগতে সকল বস্তু বা শক্তির অস্তিত্ব একটি। প্রকাশ-বিকাশ যাই হোক তা মূলত একই উৎসের বৈচিত্র্যময় উপস্থাপনা মাত্র। সুতরাং স্রষ্টা এবং সৃষ্টি স্বতন্ত্র নয়। ফলে মানুষ প্রচলিত গৎবাঁধা নিয়মে তার বিকাশকে নিশ্চিত করতে পারে না। তাকে নতুন দৃষ্টি মেলে তাকাতে হয়। অভিজ্ঞ কারো কাছে শিখতে হয়। তবে 'একক অস্তিত্ববাদ'---যা বিশেষভাবে শায়খে আকবর মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবির দ্বারা ব্যাখ্যাকৃত ও প্রচারিত হয়েছিল, তা প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হয় 'ওহ্‌দাতুশ শহুদ' মতবাদ দ্বারা। মোজাদ্দেদি তরিকার প্রতিষ্ঠাতা আহমদ সারহিন্দ (যিনি মোজাদ্দেদি আলফেসানি বলে খ্যাত) দ্বারা ওহদাতুল শহুদ ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এ মতবাদে স্রষ্টা ও সৃষ্টি স্বতন্ত্র। এমন মতবাদ ওহাবি মতবাদের মূল ভিত্তি। ফলে মানুষ বিষয়ে ভিন্ন ধারণার উদয় ও বিকাশ ঘটে চলেছে। এবং দুটো মতাদর্শন একে অপরের বিপরীতে অবস্থান করায় মানুষ নিয়ে মুসলিম অস্তিত্ববাদী দর্শন জটিলতায় রয়েছে। সমগ্র অস্তিত্বের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষকে দেখার জন্য অস্তিত্ববাদ বিশেষ ভুমিকা রাখতে প্রয়াসী হতে পারে।
(কৃতজ্ঞতা ও তথ্যসুত্রঃ *১.নুরনবি, অস্তিত্ববাদ ও মানবতাবাদঃ প্রাসঙ্গিক ভাবনা। *২.হিলালুজ্‌জামান হেলাল, কোরানে মানুষতত্ত্ব পরম্পরা-১ *৩. জেহাদুল ইসলাম ও ড. সাইফুল ইসলাম খান, দিওয়ান-ই-মুঈনুদ্দিন) ___________
★৪.
শাস্ত্র থেকে সত্য বড়, কিংবা কেন দানিয়াছ, মিছে শূল? শাস্ত্রজ্ঞানের সে-ই শূল আত্মজ্ঞান বা কাণ্ডজ্ঞানকে ঢেকে দেয়! হৃদয়ের জ্ঞান, বা প্রেম হতে যে জ্ঞান অর্থাৎ নিজের ভিতর উৎসারিত যে সত্য জ্ঞান তার বিকাশের দ্বার রুদ্ধ করে দেয়। শাস্ত্রের এলকোহল মস্তিষ্কের ভিতরে মিছে শূল বা ইন্ধন দেয়! শাস্ত্রজ্ঞান মানুষকে পণ্ডিত করে তোলে যদি না সে মানুষ দেহশাস্ত্র পাঠ না করে। কারণ দেহের মধ্যে সমস্ত জ্ঞান গুণ লুকায়িত। তাকে কর্মের মধ্য বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে এবং কর্মের মধ্যে জ্ঞানের গুণের বিস্তার সাধন করতে হবে। সেজন্য জীবনাচরণের মধ্যে পূর্বপ্রস্তুতি ও অনুশীলন থাকতে হবে। নিচে কিছু দৃষ্টান্ত দ্র.___
*'গাধার পৃষ্ঠে কেতাব বোঝা এলেম পড়া সোজারে ওহেরে পাপিষ্ঠ মর্ম না বুঝিলিরে' --খাজা শাহপির চিশতী নিজামি (.)।
★ওরে মূর্খ ওরে জড়, শাস্ত্র চেয়ে সত্য বড়ো, (তোরা) চিনলিনে তা চিনির বলদ, সার হল তাই শাস্ত্র বওয়া॥
*"পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও, কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক- জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, যত সখ- কিন্তু, কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?" --_পুরুষোত্তম নজরুল
*
*তাহাদের মেশাল, যাহারা তৌরাতের ভার গ্রহন করিয়াছে, তারপর তাহারা ইহাকে অন্তরে প্রবেশ করায় নাই, গাধার মেশালের মত-- গ্রন্থের বোঝা বহন করে। আল্লাহর পরিচয়ের উপর যে কওম মিথ্যা আরোপ করে তাহাদের মেশাল মন্দ। এবং আল্লাহ জালেম কওমকে হেদায়েত করেন না।" ---আল-কোরান (৬২:৫).
ব্যাখ্যাঃ-- ধর্ম শাস্ত্রবিদ ইহুদী পন্ডিতগণের প্রসংগ উল্লেখ করিয়া সকলকে স্পষ্ঠভাবে জানাইয়া দেওয়া হইতেছেঃ যাহারা আল্লাহ হইতে প্রেরিত গ্রন্থকে সত্য বলিয়া মানিয়া লইয়াছে, কিন্তু আমলের দারা হামেল করিয়া লইতে পারে না, অর্থাৎ উহার ভাবধারাকে অন্তরস্থ করিয়া উহা চরিত্রে অভিব্যক্ত করিয়া তুলতে পারে নাই তাহারা গাধার বোঝা বহন করে মাত্র। আল্লাহর নিদের্শিত বাণীদ্বারা চরিত্র সংগঠন না করিয়া শুধু ধর্মের বাণী বহন করাকে অতিশয় মন্দ বলিয়া গর্দভের সংগে তুলনা করা হইয়াছে। যাহারা আল্লাহর পরিচয়কে ঢাকিয়া রাখিল অর্থাৎ নিজের মধ্যে জাগ্রত করিয়া তুলিল না, অথচ বহুল পরিমাণ ধর্মের বানীর বোঝা বহন করে তাহারা আসলেই হতভাগ্য; যেহেতু কি বহন করিতেছে তাহার পরিচয় জ্ঞানও তাহাদের নাই। ইহারাই সত্যিকার জালেম, অর্থাৎ অত্যাচারী। এবং এইরূপ অত্যাচারী দলকে বা কওমকে আল্লাহ হেদায়েত করেন না বলিয়া স্পষ্ট ঘোষণা করিতেছেন। ইহাতে প্রমাণ করিতেছে যে, না বুঝিয়া কোরান পড়ার কোন মূল্য নাই। এবং কথা বুঝিয়া লইবার পর উহা আমলের দ্বারা চরিত্রগত না করিলে তাহাকেও গাধার সংগে তুলনীয় এবং অত্যাচারী অর্থাৎ জালেম বলিয়া ঘোষনা করা হইয়াছে। আল্লাহর নির্দেশের সাহায্যে নফসকে জীবন্ত করিয়া না তুলিলে তাহা নফসের প্রতি জুলুম করার সমতূল্য। (দ্র. কোরান দর্শনঃ সদর উদ্দিন আহ্‌মদ চিশতী) ________________________
★৩.
* 'ও যার আপন খবর আপনার হয় না তার আপনারে চিনতে পারলে রে যাবে অচেনারে চেনা '
* 'ক্ষ্যাপা তুই না জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়! আপন ঘর না বুঝে, বাহিরে খুঁজে পড়বি ধাঁধায়।' _________-মহামতি মহাত্মা স্বভাব কবি লালন সাঁইজি।
এখানে সাইঁজীর খুব সুন্দর ও সত্য উপস্থাপনা। যা' পাঠ করে মুগ্ধ হই বারবার। মুগ্ধতায় চিত্তে উদয় হল পূর্বসঞ্চিত দু'টি বানীঃ___
১) মহাত্মা সক্রেটিস সাহেবের একটি উক্তি আছে, "আমি কি জানি না, তা জানি, কিন্তু লোকেরা কি জানেনা সেই জানেনা" (খুব সম্ভবত: যতটুকু মনে পড়ে! )
২) বিজ্ঞানী আইনস্টাইন মহোদয় বলেছেনঃ "আমি শুধু সমুদ্র তীরের বালু নিয়ে নাড়াচাড়া করে গেলাম কিন্তু সমুদ্রের অতল রহস্য কিছুই বুঝলাম না।" (খুব সম্ভবত:)
যাইহোক, নোনাপানির সমুদ্রের তো দুই/চার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে কুল কিনারা পাওয়া যায় কিন্তু জ্ঞান-সমুদ্রের, সংস্কার-সমুদ্রের কোন সীমা-পরিসীমা, কোন সীমান্ত নাই। যেখানে নিজেকে চেনাজানাদেখা' হয় নাই মানে আমি কি/কে? আত্মদর্শন হয় নাই, সেটাই নির্ণয় বা নির্ধারণ হয় নাই! সেখানে আমি কি জানি বা জানি না? তা' তো পরের বিষয়।
সর্বযুগে প্রশংসিত প্রতিষ্ঠিত সকল মহাপুরুষগণ এই বিধান বা concept প্রদান করে থাকে (Know thyself, See thyself, Watch thyself& Read thyself ) __ ''নিজেকে জানো_চিনো_দেখো এবং পাঠ কর অর্থাৎ আত্মদর্শন (সালাত, ধ্যান, মানসিক ব্যায়াম ) করো!? সে পদ্ধতি আপন আপন সম্যক গুরুর নিকট থেকে জেনে নিতে হয়।
"মান_আরাফা_নাফসুহু_ফাক্বাদ_আরাফা_রাব্বাহু"_ (-হাদিসে_রসুল)। অর্থাৎ যে তাঁর নফসকে চিনলো জানলো সে তাঁর রবকে চিনলো/জানলো।
মাওলা সুফি সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী বলেছেনঃ যে সাধকের আত্মপরিচয় সুপরিজ্ঞাত হয় অর্থাৎ 'মান আরাফা নাফসাহু' হয় তাহার কলুষিত অস্তিত্ব চিরতরে ধ্বংস করা হয়। পরিণামে সে জন্মচক্র হইতে মুক্তি লাভ করে। "চিত্তবৃত্তির সামগ্রিক অভিব্যক্তিকে নফস বলে। নফস দর্শন তথা আত্মদর্শনকে সালাত বলে। 'নফস_দর্শন' অর্থ অসারতা দর্শন, অনাত্মা দর্শন।" অর্থাৎ নিজেকে দেখা, নিজের কর্মচিন্তাকে দেখা, নিজেকে পাঠ করা এবং নিজের মধ্যে কি আসে, কি যায়? তা' এক এক করে, অনু অনু করে, ভেঙে ভেঙে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাবে দেখা, ও পাঠ করা।
এই হাদিসটি রসুলুল্লাহ (আ) একার কথা নয়। বরং সর্বযুগের সর্বভাষার সর্বকালীন সার্বজনীন কামেল গুরুগণের পবিত্র মুখের একটি বানী চিরন্তনী পরম্পরা। যে-কোন একটি ধর্মদর্শনগ্রন্থে এর উল্লেখ থাকবেই। একমাত্র বস্তুবাদী বস্তভোগী মানুষ এ-হাদিসটির বিরোধীতা করে রেফারেন্স খোঁজে বা চাই এবং তাঁরা রসুলুল্লাহর ১৫ বৎসর ১ মাস ১৯ দিন হেরাগুহার ধ্যানের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকবে!? কাজেই ''শাস্ত্র থেকে সত্য বড়। শাস্ত্র না ঘেঁটে ডুব দাও, সখা, সত্য-সিন্ধু-জলে (-নজরুল)।'' 'সবার উপর মানুষ সত্য তার উপরে নাই।(-চণ্ডীদাস)'
এ-হাদিসটি বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনাকারী শ্রদ্ধের জহির দা (Zahirul Haque) লেখেছেন:___
সুফীবাদ তথা আধ্যাত্মবাদে বহুল প্রচারিত একটি হাদিস "মান আরাফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু" হাদিসের নামে বানোয়াট কথা বলে উল্লেখ করেছেন আই সি এস পাবলিকেশন্স এর "বিষয়ভিত্তিক আয়াত ও হাদিস সংকলন" নামক বইয়ে।
মহাগ্রন্থ আল কোরানের সঙ্গে উক্ত বাক্যটি সত্যতা ও সামঞ্জস্যতা কতটুক একটু দেখে নেই,,,
কোরানুল মাজিদে বলা হয়েছে- "ওয়াফিল আরদ্বি আইয়াতুল্লিল মুকিনীন, ওয়াফি আনফুসিকুম আফালা তুবসিরুন।" অর্থাৎ "এবং পৃথিবীর/বস্তুজগতের/দেহের মধ্যে পরিচয়/চিহ্ন বা নিদর্শন আছে দৃঢ় বিশ্বাসীদের জন্য, এবং তোমাদের নফসের মধ্যেও কিন্তু তোমরা তা দেখ না বা লক্ষ্য কর না।"
কোরানের অন্যত্র আরো বলা হয়েছে, "শীঘ্রই আমি তাদেরকে স্বীয় নিদর্শন সমূহ পৃথিবীতে এবং নিজের মধ্যে দেখিয়ে দিব যতক্ষণ না তাদের জন্য প্রকাশিত হবে যে, নিশ্চয়ই ইহা সত্য।" কাজেই কুল আলমে যা আছে তা এই জুযু আলমেও অর্থাৎ দেহের মধ্যেও আছে এবং নিশ্চিত জ্ঞানে ও ইয়াকিনে তথা হাক্কুল ইয়াকিনে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত বুঝা যাবে না। সুতরাং আপন রবের পরিচয় বা নিদর্শন সমূহের জ্ঞান লাভ করিতে চাইলে আপন দেহের মাঝে মনের ভ্রমনের দ্বারা নফসকে অর্থাৎ মানবিক চিত্তবৃত্তির অভিব্যক্তিগুলিকে চিনিয়া লইতে হইবে।
প্রিয় পাঠক ! পূর্বকালের পয়গম্বরদের গ্রন্থেও উল্লেখ রহিয়াছে যে, আল্লাহতা'লা তাহাদিগকে বলিয়াছেনঃ "আ'রিফ নাফসাকা, তা'রিফু রাব্বাকা" অর্থ- "আত্মপরিচয় লাভ করিতে পারিলে তুমি তোমার প্রভুর পরিচয় লাভ করিতে পারিবে।"
এতৎসমন্ধে সালেহীন বুযুর্গানে দ্বীনদার দ্বারা স্বীকৃত রসুলের হাদিস হিসেবে মশহুর- "মান আরাফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু" অর্থঃ যে ব্যক্তি নিজেকে চিনিতে পারিয়াছে সে তার রবকে (প্রভুকে) চিনিতে পারিয়াছে।"
প্রিয় সহৃদগণ ! সত্যিই কি ইহা হাদিসের নামে বানোয়াট কথা নাকি মুর্শিদ প্রদত্ত "মান আরাফা"-র তালিমকে সূফীবাদী সমাজ থেকে মুছে দেবার তাগুত পূজারীদের ষড়যন্ত্র ???
* যদি ইসলাম কায়েম হয় শরায় কী জন্যে নবীজি রহে পনের বছর হেরাগুহায়।। পঞ্চবেনায় শরা জারি মৌলভীদের তম্বী ভারি নবীজি কি সাধন করি নবুয়তী পায়।। না করিলে নামাজ রোজা হাসরে হয় যদি সাজা চল্লিশ বছর নামাজ কাজা করেছেন রসুল দয়াময়।। কায়েম উদ্ দ্বীন হবে কিসে অহর্নিশি ভাবছি বসে দায়েমী নামাজের দিশে লালন ফকির কয়।।
_____ স্বভাব কবি সাইজী ফকির লালন শাহ্‌।
* হেরা গুহাকে অবলম্বন করিয়া কোরানের আগমন। হেরাগুহায় প্রবেশ করিয়া ধ্যানস্থ না হইলে কেহই সত্য উদ্ধার করিতে সক্ষম হইবে না। অতএব যিনি হেরা গুহায় প্রবেশ করিয়া ধ্যান করিয়াছেন তিনি সত্য উদ্ধারকারী সাধক হইয়াছেন বা হইবেন। এই হেরাগুহা প্রত্যেক মানুষের ভিতরেই বিদ্যামান রহিয়াছে। এই হেরা গুহা হইল একমাত্র জ্ঞান কেন্দ্র। আপন দেহের গভীরে ধ্যান করাই ছিল হেরা গুহার ধ্যান। হেরা গুহা ধ্যান করা ব্যতীত অর্থাৎ আত্মদর্শনে নিমগ্ন হওয়া ব্যতীত জীবন রহস্য এবং ইহার দর্শন উদ্ধার করা কঠিন বিষয়। হেরা গুহার ধ্যান করা রসুলাল্লাহর (আ) সর্বপ্রথম সুন্নাত। যে কোন সত্য প্রকাশের উৎস হইতে হইবে হেরা গুহার ধ্যান, তথা আত্মদর্শন বা সালাত। দেহের সকল কর্মকাণ্ড লক্ষ করিবার অপর নাম সালাত। সালাত সকল মৌলিক জ্ঞানের মূল উৎস। (সংকলিত) ____সুফি দার্শনিক মাওলা সদর উদ্দিন আহমদ।
হেরা_গুহা নামক জ্ঞানকেন্দ্রকে কেন্দ্র করে কোরান বা বানীসমষ্টির অবতীর্ণ বা উদয়, আবির্ভাব বা আগমন। 'সিরুফিল_আর্দ্ তথা আপন দেহে ভ্রমণ', 'সাবাত_দিবস বা সপ্তমদিবস অর্থাৎ একদিন আল্লাহর ধ্যানে ব্যয় করা', 'শাহারুল_হারাম- বা চার মাস দুনিয়া হারাম অর্থাৎ চার মাস দুনিয়া কর্ম থেকে বিরত থাকা, একজন মুসল্লীর জন্য জীবনে অন্ততঃ একবার করে হলে তা করা বাঞ্চনীয়- এই রূপে ইত্তেকাফ, মোরাকাবা_মোশাহেদা, চিল্লা ইত্যাদি ধ্যানকেন্দ্রিক দায়েমি সালাত হেরাগুহার নামান্তর। হেরাগুহা মানব দেহের প্রতীক। হেরা গুহায় তথা মানবদেহে প্রবেশ করে আপন দেহে মানসিক ভ্রমণ তথা মানসিক ব্যায়ামের অনুশীলন না করলে প্রকৃত সত্যানুসন্ধান, সত্যুদ্ধার করা অসম্ভব ব্যাপার। আপন দেহের গভীরে ধ্যান করাই হেরা গুহার ধ্যান। দেহের সকল কর্মকাণ্ডকে এক এক করে (অনু অনু করে) ভেঙ্গে ভেঙ্গে তার স্বরূপকে জ্ঞান দ্বারা বিস্তারিত লক্ষ্য করার অপর নাম ধ্যানসালাত। সালাত মূলতঃ আপন দেহ বা নিজেকে পাঠ করা বা দর্শন করা। নিজের ভিতরের বিষয়বস্তুকে এক এক করে দেখতে (সালাত) আরম্ভ করলে ওর যে মোহ উচ্ছেদ বা ত্যাগ করার অপর নাম যাকাত। উদ্বৃত্ত আয়ের আড়াই ভাগ ট্যাক্স দেওয়াকে কোরানে কোথাও যাকাত বলে নাই। সালাত হল দায়েমি অর্থাৎ সার্বক্ষণিক, অবিরাম, ধারাবাহিক এবং স্বর্গীয় বা প্রভুর জ্ঞান ও গুণ অর্জন করা। অন্যদিকে নামাজ হলঃ "সালাতের অংশ, খণ্ডকালীন বা ওয়াক্তিয়া, আনুষ্ঠানিক, প্রাথমিক ব্যবস্থা, সালাতের মহড়া দেওয়া এবং প্রভুর গুণকীর্তন করা!"
ধ্যানসালাত কর্মপন্থা সমস্ত মহাপুরুষের আদিকর্ম। হেরাগুহার ধ্যান রসুলাল্লাহর সর্বপ্রথম সুন্নাত। হেরাগুহায় ধ্যান করা ব্যতীত অর্থাৎ আত্মদর্শনে নিমগ্ন হওয়া ব্যতীত জীবন রহস্য এবং জীবন দর্শন উদ্ধার করা কঠিন। সত্যপ্রকাশের মূল উৎস হতে হবে হেরাগুহার ধ্যান, তথা আত্মদর্শন বা সালাত। ইহা সকল মৌলিক জ্ঞানের মূল উৎস। সালাতের ফলশ্রুতি হলঃ যাকাত, কোরবানি, সদক্বা, সিয়াম, এফতার, তালাক ইত্যাদি। শুরুতে গুরুকে কেন্দ্র করে শুরু করতে হয়। তারপর গুরুভাব, গুরুপ্রেম, গুরুময়ের মধ্যদিয়ে সত্যজ্ঞান চলে আসে। তখন গুরুপ্রাপ্ত তথা আল্লাহপ্রাপ্ত সাধক, সিদ্ধপুরুষ জ্ঞানবাদী সালাতে দায়েম বা সালাতরত থাকেন। তাঁর প্রতিটি কর্মচিন্তা, প্রতিটি মুহূর্ত সালাত কর্ম ব্যতীত হয় না। তার সপ্তইন্দ্রিয় এলহাম ব্যতীত চলে না। তখনই রসুলাল্লাহর হাদিস বাস্তবায়ন হয়, তাঁর হাত আল্লাহ্‌র হাত, তাঁর চোখ আল্লাহর চোখ অর্থাৎ তিনি আল্লাওয়ালা ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হন।
★কর্মকে অনু অনু করে ভেঙ্গে ভেঙ্গে তার স্বরূপ দেখার মাধ্যমে
★গুরুভাবে গুরুপ্রেমে থেকে, গুরুমুখী হয়ে সমস্তকর্ম সম্পাদন করা অর্থাৎ গুরুকে অগ্রভাগে বা সম্মুখে রেখে সমস্ত কর্মসম্পাদন করা। অর্থাৎ গুরুময় বা গুরুপরায়ণের মাধ্যমে বা গুরু-সংযোগে কর্ম সম্পাদন করে
★সম্যককর্ম সম্যকসময় যথাবিহিত সম্পাদন করার মাধ্যমে..
প্রভৃতি....
(তথ্য উৎসঃ কোরান দর্শনঃ সদর উদ্দিন আহ্‌মদ চিশতী)
শাস্ত্রকেতাব বনাম দেহকেতাবঃ

পুরুষোত্তম নজরুলের বলেছেনঃ
'তোমাতে রয়েছে, সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান, সকল শাস্ত্র খোজে পাবে সখা খুলে দেখ নিজ প্রাণ! "
অন্যদিকে কেতাব সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে দয়াল মুর্শিদ সদরজান কেবলা বলেছেনঃ-
"নূরে মোহাম্মদীর মাধ্যমে বিচিত্র সৃষ্টিরূপে বিকাশ বিজ্ঞানকে কেতাব বলে। উচ্চমানের বিশিষ্ট সাধকের উপর কেতাব জ্ঞান নাজেল হওয়া বিষয়টি সর্বকালের একটি চিরন্তন ব্যবস্থা। কেতাব হইল বিশ্বপ্রকৃতির সামগ্রিক বিকাশ-বিজ্ঞান। মানুষের জন্য আল্লাহর দেওয়া জীবনবিধানও কেতাবের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর বিকাশ বিজ্ঞানকে কেতাব বলে। যেই যন্ত্রের মধ্যে বা যেই সকল রূপের মধ্যে আল্লাহর উক্ত বিজ্ঞানময় বিকাশ ঘটে তাহার মধ্যে মানব দেহ সর্বশ্রেষ্ঠ। এইজন্য মানবদেহকে "আল কেতাব" বলা হইয়াছে। আল কেতাবের জাহের রূপ 'মানব দেহ' এবং বাতেন প্রক্রিয়া 'বিকাশ বিজ্ঞান'। আল কেতাবের উভয় প্রকার বিকাশের মূল উৎস নূর-মোহাম্মদ (যে কোন একজন মোহাম্মদ দ্বারা অর্জিত স্বর্গীয় চরিত্র এবং গুণাবলীকেই 'নূরে-মোহাম্মদী' বলে। আল্লাহর আপন চরিত্রই সৃষ্টির মধ্যে মহা গুরুর অভিব্যক্তি রূপে যুগ যুগ যে সকল বিকাশ হইয়া থাকে তাহাকে নূরে মোহাম্মদী।)
'আল_কেতাব_পাঠ_করা' অর্থ আপন_দেহ_পাঠ_করা তথা আপন দেহের মধ্যে আত্মদর্শনের অনুশীলন করা। আপন দেহই সকল জ্ঞানের মূল উৎস। সহজ কথায় কেতাব অর্থ মানব দেহ। আল-কেতাব অর্থ বিশিষ্ট মানব দেহ বা সিদ্ধপুরুষ অর্থাৎ প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত একজন মহাপুরুষ। (অর্থাৎ যে দেহ কেতাব পাঠ হয়ে গেছে যাকে বুদ্ধ কেতাব বা আল কেতাব বলা যায়।)। আল কেতাব হইতে ধর্মগ্রন্থ সমূহের আগমন। " বিস্তারিত দ্র. নিচের লিংকেঃ______________ https://www.facebook.com/notes/mithu-shamim/%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B9-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%AC-%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%AE-%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%95-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%83%E0%A6%B8%E0%A6%A6%E0%A6%B0-%E0%A6%89%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%A8-%E0%A6%86%E0%A6%B9%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%A6-%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A6%A4%E0%A7%80/980440398718223/)
পুরুষোত্তম নজরুলের লোকোত্তর দর্শন এবং (আত্মজ্ঞানতত্ত্ব বাণী চিরন্তনী): ---- ১. *তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান, সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা খুলে দেখ নিজ প্রাণ!
২. *তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম সকল যুগাবতার, তোমার হৃদয় বিশ্ব দেউল সকলের দেবতার।
৩. *কেন খুঁজে ফের দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি কঙ্কালে হাসিছেন তিনি অমৃত হিয়ার নিভৃত অন্তরালে।
৪. *বন্ধু, বলিনি ঝুট্‌, এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট।
৫. *এই হৃদয়ই সে নীলাচল, কাশী, মাথুরা, বৃন্দাবন, বুদ্ধা-গয়া এ, জেরুজালেম্‌ এ, মদিনা, কাবা-ভবন, মসজিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয় এইখানে ব'সে ঈশা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
৬. *এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা-মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি'।
৭. *মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।
৮. * আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ! *জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
(#বিদ্রোহী) ..___________
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
মানুষকে ভালবেসে আপন করি কাছে টানি। সময়টা বড় অল্প। দমের ঘরের দম ফুরালেই সাঙ্গ হবে ভবের খেলা!
কী লাভ মানুষকে দূরে ঠেলে জীবনের প্রয়োজনে মিছে এতো সব আয়োজনে!
দমেদমে প্রতিটা কদমে রয় যেন মানুষগুরুর স্মরণে- সংযোগে প্রেম/ভক্তি/দয়ামায়া/বিশ্বাস/ক্ষমা ও ধৈর্য গুণের সাথে বড় ভালো মানুষ হয়ে উঠি মানুষের তরে। ____
* ধর্মের কাল্পনিক স্বর্গ নরক লোভ লালসায় মত্ত ধর্মান্ধ; তাই অন্যের অনিষ্ট করেও কি করে স্বর্গের আশা করে? এরা পাপিষ্ঠ বেহায়া বেহুঁশ! মান আর হুঁশকে ধুলোয় মিশিয়েছে। স্রষ্টার সৃষ্টিকে তারা ধ্বংস করে স্বর্গের আশা করে! সৃষ্টিকে না ভালবেসে স্রষ্টাকে কি ভালবাসা যায়? যাকে চেনা নেই, জানা নেই, কথা নেই তাঁর সাথে ভালবাসা হয় কি-করে? স্রষ্টা থেকে সৃষ্টি আলাদা কিছু নয়। তাই সৃষ্টিকে অর্থাৎ যাকে দেখা যায় স্পর্শ করা যায়, তাকেই ভালোবাস। মানুষ-খোদার বিধান তাহাই মানুষকে ভালবাস, আপন কর, কাছে টানো.. মানুষের মাঝে খোদা ঈশ্বর ভগবান!
★ মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি। মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।। ★ ভজ মানুষের চরণ দু’টি নিত্য বস্তু হবে খাঁটি। মরিলে সব হবে মাটি ত্বরায় এই ভেদ লও জেনে।। ___ লালন
★ মানুষ থুইয়া খোদা ভজ এই মন্ত্রণা কে দিয়াছে ।। মানুষ ভজ কোরান খুঁজ পাতায় পাতায় সাক্ষী আছে ।। __
মানুষেরি ছবি আক পায়ের ধুলো গায়ে মাখ শরীয়ত সঙ্গে রাখ তত্ত্ব বিষয় গোপন আছে ।।
★ মানুষ ধর মানুষ ভজ শোন বলি রে পাগল মন। মানুষের ভিতরে মানুষ করিতেছে বিরাজন।।
★ “ শুনহে হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই ” __ চন্ডীদাস
★ "গাহি সাম্যের গান মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান," ___ নজরুল।
★ তনমন বিদায় কর ধরিয়া মুর্শিদের চরণ রাহাতে বসি থাক সর্বদা যদি সে চাহ তাঁর মিলন' ......! ____ ডুবিয়ে যাও চরণ তলে ভেসনা কখন সংসার হাওয়ায়। ভক্তি রসে প্লাবিত হয়ে অমর হও কদম তলায়।। ___ শাহ্‌পীর।
★ আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে। সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে॥ ___
★ চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে জীবন মরণ সুখ দুখ দিয়ে বক্ষে ধরিব জড়ায়ে।। ___ রবীন্দ্রনাথ।

Sunday, 4 June 2017

মদীনায় কুবা মসজিদ ও মসজিদে নববী

0 Comments

মদীনায় প্রথম ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মসজিদ ছিল প্রথম সামাজিক প্রতিষ্ঠান যা সরাসরি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)’র উদ্যোগে নির্মিত হয়েছিল। এই পবিত্র প্রতিষ্ঠানটি গত ১৪০০ বছরে বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। কখনো কখনো মসজিদের বাহ্যিক চেহারাকে রাজপ্রাসাদের আকৃতি দেয়া হলেও ইবাদত-বন্দেগীর পবিত্র স্থান হিসেবে মসজিদের ভূমিকা কখনো ম্লান হয়ে যায়নি।
মসজিদ হচ্ছে কিবলামুখী একটি পবিত্র স্থান যা নির্ধারিত হয়েছে জামাতে নামাজ আদায় করার জন্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মসজিদ দেয়াল দিয়ে ঘেরা থাকলেও কোথাও কোথাও দেয়ালবিহীন মসজিদও দেখতে পাওয়া যায়। কোনো কোনো মসজিদে রয়েছে রেশমি কার্পেট আবার কোনো কোনো মসজিদে বালুর তপ্ত ভূমির উপরে মুসল্লিদের নামাজ আদায় করতে হয়। কোনো কোনো মসজিদে রয়েছে সুউচ্চ ছাদ, আকাশচুম্বী মিনার এবং দেয়ালে রয়েছে চোখ ধাঁধানো কারুকাজ। আবার কোনো কোনো মসজিদে এসবের কোনো কিছুর বালাই নেই। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, পবিত্রতা এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জিনের দিক দিয়ে এই দুই ধরনের মসজিদের মধ্যে কোনো গুণগত পার্থক্য নেই। ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য মসজিদের বাহ্যিক বেশভূষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তবে হ্যাঁ মসজিদে যতই দারিদ্রের ছাপ থাকুন না কেন এটিকে পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি ও পাকপবিত্র রাখতে হবে।
মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার পরপরই সর্বপ্রথম ইসলামি শাসনকাজ পরিচালনার স্থান হিসেবে মসজিদ নির্মাণের কাজে হাত দেন। শুধু নামাজ আদায় নয় সেইসঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার লক্ষ্যে তিনি এই পবিত্র স্থাপনাটি নির্মাণ করেছিলেন। যে স্থানে শাসক ও শাসিত দুজনই উপস্থিত থাকবেন এবং যেখানে আল্লাহর হুকুম-আহকাম শিক্ষা দেয়া হবে। সাহাবীদের সঙ্গে বিশ্বনবীর মিলনমেলা ছিল এই মসজিদ। রাসূলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের কাছে ধর্মের দাওয়াত দিতেন। সমাজে আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে কোনো কাজ তিনি আগে নিজে করে দেখাতেন এবং তারপর সবাইকে করতে বলতেন। দূর-দূরান্ত থেকে কেউ বিশ্বনবীর সঙ্গে দেখা করতে আসলে তার সঙ্গে তিনি মসজিদে সাক্ষাৎ করতেন। কোনোকিছু জনগণকে জানাতে চাইলে এই মসজিদে বসেই তিনি নিজে কিংবা কোনো একজন সাহাবীর মাধ্যমে তা সবাইকে জানাতেন।
মদীনায় ইসলামের প্রথম মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল কুবা নামক স্থানে। নির্ভরযোগ্য হাদিসগ্রন্থে এই মসজিদ নির্মাণের ইতিহাস এভাবে বর্ণিত হয়েছে- মহানবী (সা.) সোমবার দিন মদীনার কুবা এলাকায় প্রবেশ করেন। এলাকাটিতে ছিল প্রচুর খেজুরের বাগান। এই এলাকার মানুষ সর্বপ্রথম আল্লাহর রাসূলকে স্বাদরে গ্রহণ করেন। কুবায় প্রবেশ করার পর তিনি চারদিন সেখানেই অবস্থান করেন। এরইমধ্যে হযরত আলী (আ.) এবং ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহাসহ তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা সেখানে পৌঁছে যান। এরপর তাঁরা সবাই মিলে মদীনার দিকে যাত্রা করেন। মদীনা সে সময় ইয়াসরিব নামে বেশি পরিচিত ছিল। কুবায় অবস্থান করার দিনগুলোতে বিশ্বনবী (সা.) প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন যার নাম দেয়া হয় কুবা মসজিদ। তিনি এই মসজিদে নামাজ আদায় করার ব্যাপারে বলেন, “যে ব্যক্তি আমার নির্মিত মসজিদ অর্থাৎ কুবা মসজিদে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করবে তার আমলনামায় একটি ওমরাহ হজের সওয়াব লিখে দেয়া হবে। পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (সা.) মূল মদীনা শহরে বসবাস শুরু করলেও সপ্তাহে একবার- কখনো শনিবার বা কোনো কোনো সপ্তাহে সোমবার নামাজ আদায় করার জন্য কুবা মসজিদে যেতেন।
আগেই যেমনটি বলেছি, মহানবী (সা.) চারদিন কুবায় অবস্থানের পর সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মূল মদীনা শহরের দিকে অগ্রসর হন। স্থানীয় জনগণ বিশ্বনবী ও তাঁর সাহাবীদের বিপুল সংবর্ধনা দেন। প্রতি গোত্রের প্রতিনিধিরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিজ নিজ গোত্রে বিশ্বনবীকে আতিথেয়তা গ্রহণের আমন্ত্রণ জানাতে থাকেন। কেউ কেউ এসে রাসূলের উটের রশি ধরে টানাটানি শুরু করেন। বিশ্বনবী একটু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। কাকে রেখে কাকে খুশি করবেন! এ অবস্থায় তিনি নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানান। বলেন, আপনারা উটের রশি ছেড়ে দিন। দেখি উটটি কোথায় গিয়ে বসে পড়ে। সে যার বাড়ির সামনে বসে পড়বে আমি সেই বাড়ির আতিথেয়তা গ্রহণ করব।

এই ঘটনায় দু’টি উল্লেখযোগ্য বিষয় দেখতে পাওয়া যায়। প্রথমত, রাসূলের উটটি যেখানে থেমেছিল এবং যেখানে এখন মসজিদে নববী রয়েছে সেটি নির্বাচন করে দিয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। এমনক এটি নির্ধারণে বিশ্বনবীরও হাত ছিল না। দ্বিতীয়ত, এই পদ্ধতি অনুসরণ করার ফলে মদীনার কোনো গোত্র মন খারাপ করার সুযোগ পেল না। আল্লাহর রাসূলের উটটি বনি মালিক বিন নাজ্জার নামক স্থানে গিয়ে বসে পড়ল। বিশ্বনবী (সা.) ওই জায়গায়ই মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দেন। মসজিদ নির্মাণের কাজে আল্লাহর রাসূল নিজে অংশগ্রহণ করেন এবং তিনি অন্য সবার চেয়ে বেশি পরিশ্রম করেন। তাঁর পরিশ্রম দেখে সাহাবীরা বহুবার তাঁকে বিশ্রাম নেয়ার অনুরোধ করলেও তিনি সে অনুরোধ রক্ষা না করে সবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মসজিদ নির্মাণের কাজে অংশ নিয়েছেন।
মসজিদে নববীকে তখনকার যুগের একটি অনন্য স্থাপনা হিসেবে নির্মাণ করেছিলেন বিশ্বনবী। সে সময় অন্য কোনো স্থাপত্যশিল্প, এমনকি অন্য ধর্মের উপাসনালয়গুলোর নির্মাণশৈলির সঙ্গে এর কোনো মিল ছিল না; বরং ইসলামের গতিপ্রকৃতির সঙ্গে এই মসজিদ ছিল সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। নবুওয়াত প্রাপ্তির আগে বিশ্বনবী তৎকালীন শাম বা সিরিয়াসহ আরো কিছু দেশ সফর করেছিলেন। এসব সফরে তিনি বহু গির্জা ও সিনাগগ ঘুরে দেখেছিলেন তিনি। নিঃসন্দেহে এসব উপাসনালয়ের নির্মাণশৈলি রাসূলুল্লাহ (সা.) র মাথায় ছিল। মসজিদে নববী তৈরির সময় ওই সব উপাসনালয় থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি নকশা তিনি দাঁড় করান। ভূমি থেকে এক মিটার উচ্চতা পর্যন্ত মসজিদের দেয়াল পাথর দিয়ে নির্মিত হয়। এরপর ছাদ পর্যন্ত দেয়া হয় রোদে পোড়ানো ইট। আর ছাদ তৈরি হয় খেজুর পাতা দিয়ে।

মসজিদে নববী তৈরি হওয়ার পর এর একাংশকে দরিদ্র মানুষের বসবাসের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। এসব দরিদ্র মানুষের বেশিরভাগই ছিলেন মক্কা থেকে আসা মুহাজির। মক্কার কাফেরদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে তাঁরা নিজেদের ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্বল ফেলে এক কাপড়ে রাসূলের সঙ্গে হিজরত করে মদীনায় গিয়েছিলেন। বিশ্বনবীর এসব সাহাবীকে আসহাব আস-সুফফা বলা হয়। মসজিদে নববীর সঙ্গে বিশ্বনবী (সা.)’র বসবাসের জন্য তৈরি হয়  একটি ঘর।  পরবর্তীতে সাহাবীদের মধ্যে সামর্থ্যবানরাও মসজিদের পাশে ঘর তৈরি করে মসজিদ অভিমুখে একটি করে দরজা রেখেছিলেন। নামাজের সময় হলে তারা ওই দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতেন। তৃতীয় হিজরিতে বিশ্বনবী (সা.) আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) ছাড়া আর সবার ঘরের মসজিদ অভিমুখী দরজা বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.)’র ইন্তেকালের পর মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে মসজিদে নববীতে মুসল্লিদের স্থান সংকুলানের সমস্যা দেখা দেয়। ফলে খলিফারা এই মসজিদ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেন। মসজিদ সম্প্রসারণের এই কাজ কয়েক ধাপে চলে এবং আব্বাসীয় শাসনামলে এর আয়তন দাঁড়ায় ৯,০০০ বর্গমিটার। ওসমানীয় শাসনামলে মসজিদে নববী কয়েকবার পুনর্নির্মাণ করা হয়। ১২৬৫ হিজরিতে সুলতান আব্দুল হামিদ এই মসজিদ সংস্কারের বিশাল পরিকল্পনা হাতে নেন যা বাস্তবায়ন করতে ১৩ বছর সময় লাগে।

মসজিদে নববীর শিলালিপিতে বর্তমানে রাসূলের আহলে বাইত, নিষ্পাপ ইমাম ও খলিফাসহ আরো কয়েকজন উল্লেখযোগ্য সাহাবীর যেসব নাম আজও চোখে পড়ে তা ওসমানীয় শাসকদের লেখা। সৌদ রাজবংশ ক্ষমতায় আসার পরও কয়েক দফায় মসজিদে নববীর সংস্কার ও সম্প্রসারণ ঘটানো হয়েছে।  মদীনা শহরের সম্মান বৃদ্ধি করেছে এই মসজিদ। বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, হযরত ইব্রাহিম মক্কাকে নিরাপদ শহরে পরিণত করেছেন এবং এর অধিবাসীদের জন্য দোয়া করেছেন। আর আমি মদীনাকে করেছি নিরাপদ।
ইসলামের সোনালি যুগের সব শাসনামলে মসজিদে নববীর সাদামাটা গঠনকাঠামো ধরে রাখা হয়েছে। বিশ্বনবী (সা.)’র ওফাতের পর প্রথম খলিফার শাসনামলে এই মসজিদে কোনো ধরনের পরিবর্তন আনা হয়নি। দ্বিতীয় খলিফার আমলে শুধুমাত্র মসজিদের আয়তন এবং এর দরজার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। তৃতীয় খলিফার আমলে মসজিদের গঠনকাঠামোয় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। এর পিলারগুলোতে টিনের পাত বসানো হয়। তবে উমাইয়ারা ক্ষমতায় আসার পর ইসলামি শাসনব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনা হয় যার প্রভাব মসজিদ নির্মাণের ওপরও পড়ে। মসজিদে নববীও এই পরিবর্তনের বাইরে থাকেনি।

মসজিদে নববীর গঠনকাঠামো ছিল অত্যন্ত সাদামাটা। এটির দেয়াল নির্মিত হয় পাথর ও রোদে পোড়ানো ইট দিয়ে। ছাদ দেয়া হয় খেজুর পাতা বিছিয়ে। মসজিদের মেঝেতে নুড়ি পাথর ও বালুর মিশ্রণ ছড়িয়ে দেয়া হয় যাতে ছাদ দিয়ে বৃষ্টির পানি চুঁইয়ে পড়লে তা দ্রুত শুকিয়ে যায়। ইতিহাসে এসেছে, মসজিদে নববী তৈরির কিছুদিন পরই মসজিদের ভেতরে বৃষ্টির পানি পড়ে জমে গিয়েছিল। এ অবস্থায় সাহাবীরা নুড়ি পাথর ও বালু এনে মসজিদের মেঝেতে ছড়িয়ে দেন যার ফলে পানি শুকিয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) এটি দেখে বলেন, খুব ভালো কাজ হয়েছে। তখন থেকে বহুকাল পর্যন্ত মসজিদে নববীর মেঝেতে বালু ও নুড়ি পাথর বেছানো ছিল। অবশ্য বর্তমানে এই মসজিদের মেঝেতে রয়েছে বিশালাকৃতির দামী কার্পেট।
মসজিদটি নির্মাণের সময় এটিতে যাতায়াতের জন্য তিনটি দরজা রাখা হয়। অবশ্য পরে মসজিদুল আকসা থেকে মসজিদুল হারামের দিকে কেবলা পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পর মসজিদের পেছনের দিকের দরজাটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এর পরিবর্তে উত্তর দিকে আরেকটি দরজা খোলা হয়। মসজিদের পশ্চিম দিকে ছিল আরেকটি দরজা যার নাম ছিল বাবে আতিকা। আতিকা ছিলেন মক্কার এক নারী যিনি ইসলাম গ্রহণের পর হিজরত করে মদীনায় চলে এসেছিলেন। দরজাটি এই নারীর বসবাসের ঘরের দিকে মুখ করা ছিল বলে এর নাম দেয়া হয় বাবে আতিকা বা আতিকার দরজা। এই দরজাটি বাবে রহমত নামেও প্রসিদ্ধ। এই নামকরণ সম্পর্কে ইতিহাসে এসেছে- একবার এক ব্যক্তি মসজিদে নববীতে এসে রাসূলুল্লাহ (সা.)’র কাছে বৃষ্টির জন্য দোয়া করার অনুরোধ জানান। আল্লাহর রাসূল দোয়া করলে টানা সাতদিন ধরে মদীনায় প্রবল বর্ষণ হয়। এ অবস্থায় বন্যার আশঙ্কায় লোকজন তাঁর কাছে এসে আবার বৃষ্টি বন্ধ করার জন্য দোয়া করার অনুরোধ জানায়। এবার বিশ্বনবী আবার দোয়া করলে বৃষ্টি থেমে যায়। বৃষ্টি যেহেতু আল্লাহর রহমত তাই এই দরজার নাম রাখা হয় বাবে রহমত বা রহমতের দরজা।
এই দরজা দিয়েই রাসূলুল্লাহ মসজিদে যাতায়ত করতেন বলে এটিকে বাবে নববীও বলা হয়। মসজিদের পূর্বদিকে রয়েছে আরেকটি দরজা যেটিকে বাবে জিবরাইল বা জিবরাইলের দরজা বলে অভিহিত করা হয়। বলা হয়ে থাকে, বনু কুরাইজার যুদ্ধের সময় আল্লাহর রাসূল এই দরজার কাছে হযরত জিবরাইলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন বলে এর নাম দেয়া হয় বাবে জিবরাইল।

অবশ্য ধীরে ধীরে মসজিদে নববীর দরজার সংখ্যা বাড়তে থাকে। কারণ, অনেক সাহাবী মসজিদের আশপাশে বসবাসের জন্য ঘর নির্মাণ করেছিলেন। এসব ঘরের দু’টি দরজা থাকত। একটি ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার জন্য আরেকটি ঘর থেকে মসজিদে যাতায়াতের জন্য। এই অবস্থা তৃতীয় হিজরি পর্যন্ত চলতে থাকে। ওই বছর আল্লাহর রাসূল নির্দেশ দেন, হযরত আলী (আ.)’র ঘর ছাড়া অন্য সবার ঘরের সঙ্গে মসজিদের দরজাগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। অবশ্য বর্তমানে এই মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে সাতটি প্রধান ফটক এবং ছোটবড় ৮১টি দরজা।
মসজিদে নববীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের নাম রওজায়ে মুতাহ্‌হারা। হাদিসে এই অংশে উপস্থিত হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। বিশ্বনবী (সা.)  এই স্থানকে বেহেশতের বাগান বলে উল্লেখ করেছেন। রাসূলের পবিত্র কবর, তাঁর মিম্বর ও মেহরাব এই স্থানে অবস্থিত। যে স্থান থেকে এই মহামানবের পবিত্র ও নূরানি আত্মা আল্লাহর সাক্ষাতে চলে গেছে সেই স্থানেই তাঁর দেহ মোবারক দাফন করা হয়েছে। পরবর্তীতে প্রথম ও দ্বিতীয় খলিফাকে রাসূলুল্লাহর কবরের পাশে দাফন করা হয়। এগুলোর উত্তর পাশের একটি স্থানের নামকরণ করা হয়েছে নবীনন্দিনী হযরত ফাতেমা জাহরা সালামুল্লাহি আলাইহার কবরের নামে। যারা মনে করেন হযরত ফাতেমাকে তাঁর নিজ ঘরে দাফন করা হয়েছে তারা এই নামকরণ করেছেন। অবশ্য ইতিহাসে তাঁকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করার কথা বলা হয়েছে এবং সুন্নী মুসলমানরা এই বর্ণনাকে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করেন। রাসূলুল্লাহর কবর যে বিশাল কক্ষে অবস্থিত তাতে রয়েছে চারটি মজবুত পিলার  এবং এর উপরে রয়েছে সবুজ রঙের একটি সুদৃশ্য গম্বুজ।

মসজিদে নববীর আরেকটি পবিত্র অংশ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা.)’র মিম্বর। বর্ণনায় এসেছে, প্রথম দিকে আল্লাহর নবী একটি খেজুর গাছে হেলান দিয়ে খুতবা দিতেন। একদিন একজন সাহাবী খুতবা দেয়ার জন্য মিম্বর তৈরির প্রস্তাব দিয়ে বলেন, এটি নির্মিত হলে আল্লাহর রাসূল যেমন দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হবেন না তেমনি সমবেত সব মুসল্লি উনাকে দেখতে পাবেন। বিশ্বনবী (সা.) এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন। তৈরি হয় ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মিম্বর। এটিতে দুই ধাপ সিঁড়ি এবং এরপর রাসূলের বসার স্থান তৈরি হয়। পরবর্তীতে একজন কাঠমিস্ত্রি ওই তিন ধাপের মিম্বরের  উপর আরো ছয় ধাপ সিঁড়ি নির্মাণ করেন। ফলে এটি নয় ধাপের মিম্বরে পরিণত হয়।
আব্বাসীয় খলিফাদের শাসনামলে এই মিম্বর কয়েকবার পুনর্নির্মাণ ও সম্পূর্ণ নতুনভাবে তৈরি হয়। ৬৫৪ হিজরিতে এক দুর্ঘটনায় মসজিদে নববীতে আগুন লেগে মিম্বরটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যায়। ঐতিহাসিক দলিলে পাওয়া যায়, ওই পোড়া মিম্বরটির ভস্মীভূত ছাই বর্তমানে যে স্থানে মিম্বর আছে তার ঠিক নীচে দাফন করা হয়েছিল। বর্তমানে মসজিদে নববীতে যে মিম্বরটি আছে সেটি মর্মর পাথরের তৈরি এবং এর উপরের কারুকার্যগুলি স্বর্ণ দিয়ে করা হয়েছে। ১২ ধাপ সিঁড়ির এই মিম্বরটি ৯৯৯ হিজরিতে তৎকালীন ওসমানীয় সুলতান এ মসজিদকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন।

রাসূলুল্লাহ (সা.)’র জীবদ্দশায় মুসলমানরা মেহরাব নামক কোনো স্থানের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। পরবর্তীতে ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের শাসনামলে রাসূলুল্লাহ (সা.)’র সিজদা দেয়ার স্থানে একটি মেহরাব নির্মিত হয়। বর্তমানে মসজিদে নববীসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি মসজিদের সামনের দিকে ঠিক মাঝখানে ইমাম সাহেবের নামাজে দাঁড়ানোর জন্য যে স্থান নির্ধারিত রয়েছে সেটিকে মেহরাব বলা হয়। মেহরাবের ফজিলত সম্পর্কে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি মসজিদে নামাজ আদায় করতে এসে মেহরাবের দিকে তাকান তিনি নিজের চোখে কাবা শরীফ দেখার সওয়াব লাভ করেন। মসজিদে নববীতে বর্তমানে মূল মেহরাবের পাশাপাশি আরো কয়েকটি ছোট মেহরাব রয়েছে। এগুলোর একটিকে ‘মেহরাবে তাহাজ্জুদ’ বলা হয়। হযরত ফাতিমা জাহরা সালামুল্লাহি আলাইহার ঘরের পেছনে এই মেহরাবটি অবস্থিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) কোনো কোনো রাতে এখানে দাঁড়িয়ে নফল ইবাদতে মশগুল হতেন।
মসজিদে নববীর আরেকটি মেহরাবের নাম মেহরাবে ফাতেমা (সা. আ)। এটি তখনকার সময়ে হযরত ফাতেমা সালামুল্লাহি আলাইহার ঘরে মধ্যে ছিল এবং এখানে দাঁড়িয়ে তিনি নামাজ আদায় করতেন। বর্তমানে এই মেহরাবটি রাসূলুল্লাহ (সা.)’র হুজরার মধ্যে পড়েছে। এ মসজিদের আরেকটি মেহরাবের নাম মেহরাবে ওসমানি। ওসমানীয় সুলতানদের নামে এটির নামকরণ করা হয়েছে। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, তৃতীয় খলিফা ওসমান ইবনে আফফানের নামে এই নামকরণ হয়েছিল। রাসূলের মেহরাবের পেছনে অবস্থিত এই মেহরাবটি কিবলার দিকে মুখ করা। বর্তমানে মসজিদে নববীর ইমাম সাহেব এই মিহরাবে দাঁড়িয়ে জামাতের ইমামতি করেন
মসজিদের এই বরকতপূর্ণ ফজিলতের কারণে ইসলামের সোনালী যুগে মুসলমানরা আল্লাহর ঘর নির্মাণে ব্যাপক মনোনিবেশ করেছিলেন। মহানবী (সা.)’র বাস্তবধর্মী দাওয়াতের বাণী তাদের ওপর প্রভাব ফেলেছিল বলে দিকে দিকে মসজিদ নির্মাণের সাড়া পড়ে গিয়েছিল। আল্লাহর রাসূল মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতে করেই নিজের হাতে কুবা মসজিদ ও মসজিদে নববী নির্মাণ করেছিলেন। এরপর মদীনায় বিভিন্ন গোত্রের বসবাসের স্থানে আরো নয়টি মসজিদ নির্মিত হয়। বিশ্বনবী (সা.) নিজে গিয়ে এসব মসজিদের স্থান ও কিবলার দিক সঠিকভাবে নির্ধারণ করে দিতেন। মসজিদ নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ’র ইমামতিতে প্রথম জামাতটি অনুষ্ঠিত হতো।
রাসূলে খোদা (সা.) যেখানেই সফরে যেতেন সেখানেই নামাজ আদায় করার জন্য একটি স্থান নির্ধারণ করতেন। এভাবে তিনি মসজিদ নির্মাণের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেন। ধীরে ধীরে মুসলিম সমাজের পরিচিতির প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে মসজিদ। অমুসলিমরা ইসলাম গ্রহণের পরপরই প্রথম যে কাজটি করতেন তা হলো নিজ নিজ এলাকায় মসজিদ নির্মাণ করা। মসজিদ নির্মাণের মাধ্যমে ইবাদত-বন্দেগী করার পাশাপাশি আরেকটি লক্ষ্য অর্জিত হতো। আর তা হলো, মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা। রাসূলুল্লাহ (সা.)’র যুগে একবার মুনাফিকরা মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি ও তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার স্থান হিসেবে মসজিদ নির্মাণ করে। বিশ্বনবী এটি বুঝতে পেরে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। তিনি ওই মসজিদে নামাজ আদায় তো করেনইনি, উল্টো মসজিদটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। পবিত্র কুরআনে এই মসজিদকে ‘মসজিদে যিরার’ বা ক্ষতি সাধানকারী মসজিদ নামে অভিহিত করা হয়েছে।
মহান আল্লাহ এই মসজিদ সম্পর্কে সূরা তওবার ১০৭ নম্বর আয়াতে বলেছেন: “আর যারা জিদের বশে এবং কুফরীর তাড়নায় মসজিদ নির্মাণ করেছে মুমিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং ঐ লোকের জন্য ঘাঁটি স্বরূপ যে পূর্ব থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছে, আর তারা অবশ্যই শপথ করবে যে, আমরা কেবল কল্যাণই চেয়েছি। পক্ষান্তরে আল্লাহ সাক্ষী যে, তারা সবাই মিথ্যুক।”  
রাসূলের যুগে কিছু মুনাফিক ইসলামের পোশাক পরে মুসলমানদের ক্ষতি করতে চেয়েছিল। তারা মসজিদকে ইসলামের বিরুদ্ধে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে মুসলিম সমাজকে ভেতর থেকেই ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এ সময় বিশ্বনবী (সা.)’র বিপ্লবী ও সাহসী সিদ্ধান্তের ফলে মসজিদে যিরার ধ্বংস করে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলার স্থান নির্ধারিত হয়। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র ও শত্রুতার ঘাঁটি ধ্বংস করে ফেলতে হবে সেটিকে যদি বাহ্যিকভাবে পবিত্র স্থান বলেও মনে হয়।
আল্লাহর রাসূলের এই মসজিদের অনেকগুলো উস্তোয়ানা বা স্তম্ভ ১,৪০০ বছর পর আজও টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। এসব স্তম্ভের মধ্যে আটটি বেশি বিখ্যাত। বিশ্বনবীর জামানায়ই এগুলোর নামকরণ করা হয়েছিল। বর্তমানে এই আটটি স্তম্ভের ওপর সাদা রঙের প্রলেপ দিয়ে পরবর্তীতে নির্মিত পিলারগুলো থেকে এগুলোকে আলাদা করা হয়েছে।

মসজিদে নববীর এই ফজিলতপূর্ণ ও বিখ্যাত স্তম্ভগুলোর একটির নাম ‘উস্তোয়ানা তওবা’। আহযাবের যুদ্ধে আবুলুবাবা’র বিশ্বাসঘাতকতা ও তওবা করে তার ইসলামে প্রত্যাবর্তনের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে এই পিলারটির নামকরণ করা হয়েছে।  পঞ্চম হিজরিতে আহযাবের যুদ্ধের পর আবুলাবাবা মুসলমানদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার কারণে অনুতপ্ত হন। তার দেহমন পাপের অনুভূতিতে ছেয়ে যায়। এই পাপ থেকে মুক্তি পেতে বিশ্বনবী (সা.)’র কাছে গিয়ে ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে তিনি সোজা মসজিদে নববীতে চলে যান। সেখানে গিয়ে একটি স্তম্ভের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে ফেলে সবাইকে বলে দেন, আল্লাহর রাসূল ছাড়া কেউ যেন তার  গায়ে বাধা দড়িগুলো খুলে না দেয়। তখন থেকে এই স্তম্ভটির নাম হয় ‘উস্তোয়ানা তওবা’। বিভিন্ন বর্ণনায় এই স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করার অফুরন্ত ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বনবী (সা.)’র  হুজরা ও কবরের পাশের দ্বিতীয় স্তম্ভটিই হলো ‘উস্তোয়ানা তওবা’।
মসজিদে নববীর আরেকটি স্তম্ভের নাম ‘উস্তোয়ানা মুখাল্লাকা’। বিশ্বনবী যে স্থানে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতেন তার সবচেয়ে কাছের স্তম্ভ এটি। বর্তমানে এই স্তম্ভের শীর্ষে সোনালি রং দিয়ে গোলাকৃতিতে লেখা রয়েছে ‘উস্তোয়ানাতুল মুহাল্লাকা’। এই স্তম্ভের কাছে একটি সুগন্ধী পোড়ানো হতো যার ফলে গোটা মসজিদ আতরের ঘ্রাণে ভরে উঠত।
মসজিদে নববীর প্রধান স্তম্ভগুলোর ঠিক মাঝখানে রয়েছে ‘উস্তোয়ানা আয়েশা’। এটি মুহাজিরান বা আল-কুর’আ’ স্তম্ভ নামেও সমধিক পরিচিত। বর্তমানে এই স্তম্ভের উপরে লেখা রয়েছে ‘উস্তোয়ানাতুন আয়েশা’।
মসজিদে নববীর আরেকটি স্তম্ভের নাম ‘উস্তোয়ানা তাহাজ্জুদ’। বর্ণনায় এসেছে, সবাই যখন এশার নামাজ আদায় করে যার যার বাড়িতে চলে যেত তখন আল্লাহর রাসূল এই স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন। এ কারণে এটির নাম হয়েছে তাহাজ্জুদ স্তম্ভ। এই স্তম্ভটি নবী নন্দিনী হযরত ফাহেমা সালামুল্লাহি আলাইহার ঘরের ঠিক পেছনে অবস্থিত। এখানে মরমর পাথরে খোদাই করে আরবিতে যে কথাটি লেখা আছে তার অর্থ হলো- “এটি বিশ্বনবী (সা.)’র তাহাজ্জুদের স্থান।”
রাসূলের পবিত্র মাজার কক্ষের উত্তর অংশের সঙ্গে লাগোয়া অবস্থায় রয়েছে ‘উস্তোয়ানা মুরাব্বাআ’ল কাব্‌র’। এটিকে মাকামে জিবরাইলও বলা হয়। বর্তমানে এই স্তম্ভটি বাইরে থেকে দেখা যায় না। এই স্তম্ভের ঠিক পেছনেই হযরত আলী (আ.) ও ফাতেমা সালামুল্লাহি আলাইহার ঘরের প্রবেশ পথ ছিল। এই স্তম্ভের ফজিলত সম্পর্কে আবিল হামরা বলেছেন, আমি রাসূলে খোদাকে দেখেছি তিনি টানা ৪০ দিন ধরে প্রতিদিন আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসেইনের বাড়ির সামনে আসতেন এবং দরজার ওপর হাত রেখে বলতেন, “হে আহলে বাইত তোমাদের ওপর সালাম।” সেইসঙ্গে তিনি সূরা আহযাবের ৩৩ নম্বর আয়াত পাঠ করতেন যেখানে বলা হয়েছে, হে আহলে বাইত নিশ্চয় আল্লাহ চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।
মসজিদে নববীর তওবা স্তম্ভের ঠিক পূর্ব পাশে কিবলামুখী যে স্তম্ভটি রয়েছে তার নাম ‘উস্তোয়ানা সারীর’। রাসূলুল্লাহ (সা.) পবিত্র মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন মসজিদে নববীতে এতেকাফ করার সময় এই স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতেন এবং ইবাদত করতে করতে ক্লান্তি আসলে এখানেই বিশ্রাম নিতেন।
উস্তোয়ানা সারীরের পাশেই রয়েছে ‘উস্তোয়ানা মাহ্‌রাস’। হযরত আলী (আ.) এই স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে বিশ্বনবী (সা.)কে পাহারা দিতেন।  এ কারণে এই স্তম্ভকে ‘উস্তোয়ানা আলী ইবনে আবি তালিব’ও বলা হয়।
মাহরাসের দক্ষিণ পাশে কিবলার দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে থাকা স্তম্ভটির নাম ‘উস্তোয়ানা ওফুদ’। মহানবী (সা.)’র দৈনন্দিন একটি কাজ ছিল মদীনার গোত্র প্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। তিনি এই স্তম্ভের পাশে বসে সেই সাক্ষাতের কাজটি সম্পন্ন করতেন। এটি পরবর্তীতে ‘উস্তোয়ানাতুল ওফুদ’ নামে পরিচিতি পায় যে নামটি আজও এই স্তম্ভের গায়ে লেখা রয়েছে।

Wednesday, 10 May 2017

ধরণীর বেহেশত মসজিদ (মসজিদুল হারাম)

0 Comments
মসজিদ হচ্ছে আল্লাহর ঘর এবং এই মহান স্রষ্টার সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়ার স্থান। যুগে যুগে খোদা-প্রেমে ভক্তদের মিলনমেলা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এই পবিত্র স্থান। একইসঙ্গে অনেক সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে এই মসজিদকে কেন্দ্র করে। এমনকি, এই মসজিদে বসেই নেয়া হয়েছে রাজনৈতিক ও সামরিক সব সিদ্ধান্ত। ইসলামি শিল্প, সংস্কৃতি ও সভ্যতার নিদর্শন হিসেবেও মসজিদ পালন করেছে এক অনন্য ভূমিকা।
মুসলিম বিশ্বে মসজিদের এই অপরিসীম গুরুত্ব বিবেচনা করে আমরা নতুন এই ধারাবাহিক নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। এ অনুষ্ঠানে আমরা মসজিদ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের আয়াত, রাসূলুল্লাহ (সা.)র হাদিস এবং নিষ্পাপ ইমামদের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করব। সেইসঙ্গে এ অনুষ্ঠানে বিশ্বের কিছু বড় ও গুরুত্বপূর্ণ মসজিদের সঙ্গেও পরিচিত হব আমরা।  

পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশেষ ঐশী ধর্ম ইসলাম মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের লক্ষ্যে মানুষের জন্য বিশেষ কিছু ইবাদতের ব্যবস্থা করেছে। এসবের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে নামাজ। আর 'মসজিদ' শব্দের উৎপত্তি হয়েছে সিজদা শব্দ থেকে। এই পবিত্র স্থানে মহান আল্লাহর সামনে তাঁর বান্দা সিজদায় অবনত হয় বলে এর নাম দেয়া হয়েছে মসজিদ। নামাজকে ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত বলে গণ্য করা হয় এবং সিজদা হচ্ছে নামাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে সিজদা করার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সামনে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়। সূরা নাহলের ৪৯ নম্বর আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছে, আল্লাহকে সেজদা করে যা কিছু নভোমন্ডলে আছে এবং যা কিছু ভুমন্ডলে আছে এবং ফেরেশতাগণ;তারা অহংকার করে না। সিজদা হচ্ছে ইবাদতের সর্বোচ্চ পর্যায়। অন্যান্য ইবাদতের তুলনায় এমনকি নামাজেরই অন্যান্য অংশের তুলনায় সিজদার রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য ও মর্যাদা। ইসলামি সংস্কৃতিতে মসজিদ- বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর হিসেবেও বিবেচিত হয়।
আসমান-জমিনসহ বিশ্বজগতের সবকিছুর মালিক আল্লাহ তায়ালা। কিন্তু এর মাঝে একমাত্র মসজিদকেই তিনি নিজের ঘর বলে অভিহিত করেছেন। মানুষ যাতে এই পবিত্র স্থানের মর্যাদা যথাযথভাবে উপলব্ধি করে এবং এখানে সমবেত হয়ে ইবাদত-বন্দেগী করার মাধ্যমে আল্লাহর রহমত হাসিল করতে পারে সেজন্যই এ নামকরণ করেছেন আল্লাহ তায়ালা। অবশ্য সব মসজিদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে সমান নয় বরং কোনো কোনো মসজিদের গুরুত্ব তাঁর কাছে অন্যান্য মসজিদের তুলনায় বেশি। হাদিসে এসেছে, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় মসজিদ হচ্ছে মক্কার মসজিদুল হারাম বা কাবাঘর। এরপর রয়েছে মদীনার মসজিদে নববী, কুফা মসজিদ ও আল-আকসা মসজিদের অবস্থান। এরপর আল্লাহ পছন্দ করেন প্রতিটি শহরের কেন্দ্রীয় বা মূল মসজিদ, তারপর পাড়া-মহল্লার মসজিদ এবং সবশেষে বাজারগুলোতে অবস্থিত মসজিদ। মসজিদুল হারামের মর্যাদা আল্লাহর কাছে এত বেশি যে, সারাবিশ্বের মুসলমানদেরকে এই কাবাঘরের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করতে হয়।
বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, ঘরে বসে নামাজ আদায়ের সওয়াব এক গুণ, এলাকার মসজিদে নামাজের সওয়াব ২৫ গুণ, শহরের প্রধান মসজিদে নামাজ আদায়ের সওয়াব ৫০০ গুণ, আল-আকসা মসজিদে নামাজের সওয়াব ৫০ হাজার গুণ, আমার মসজিদে ( অর্থাৎ মসজিদে নববীতে) নামাজ আদায়ের সওয়াব ৫০ হাজার গুণ এবং মসজিদুল হারামে নামাজ পড়ার সওয়াব মহান আল্লাহ ১ লক্ষ গুণ বেশি দিয়ে থাকেন। ইমাম বাকের (আ.) পবিত্রতম এ মসজিদে নামাজ আদায়ের ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, যদি কেউ মসজিদুল হারামে এক ওয়াক্ত ফরজ নামাজ আদায় করে তাহলে তার জীবনের আদায় করা অতীত ও ভবিষ্যতের সব ফরজ নামাজ আল্লাহর দরবারে নিশ্চিতভাবে কবুল হয়ে যায়।
হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ বলেন, জমিনে আমার ঘর অর্থাৎ মসজিদগুলো আসমানবাসীর কাছে সেইরকম জ্বলজ্বল করে ঠিক যেরকম আকাশের তারাগুলো জমিনবাসীর কাছে উজ্জ্বল মনে হয়। যারা মসজিদকে আপন করে নিয়েছে তারা সৌভাগ্যবান। সেই ব্যাক্তি ভাগ্যবান যে নিজের ঘরে ওজু করার পর আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভের জন্য আমার ঘরে আগমন করে। তোমরা জেনে রেখো, যারা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন আমার জন্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। যারা রাতের অন্ধকারে মসজিদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় তাদেরকে কিয়ামতের দিনের উজ্জ্বল আলোর সুসংবাদ দিন।
মসজিদুল হারাম ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে পুরনো ও মর্যাদাসম্পন্ন মসজিদ। হাদিসে এসেছে, সৃষ্টির শুরুতে প্রবল বন্যার পানির নীচে গোটা পৃথিবী তলিয়ে গিয়েছিল। এরপর ভূপৃষ্ঠের যে স্থান সবার আগে পানির উপরে ভেসে উঠেছিল সেটি ছিল কাবা শরীফের এই স্থান। মহান আল্লাহ ভূপৃষ্ঠকে এখান থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন, মহান আল্লাহ যখন পৃথিবী সৃষ্টি করতে চাইলেন তখন বাতাসকে নির্দেশ দিলেন পানির উপরে প্রচণ্ড জোরে বয়ে যেতে যাতে তাতে ফেনা তৈরি হয়। এই ফেনাগুলোকে কাবার স্থানে এনে জড়ো করে তা দিয়ে একটি পাহাড় তৈরির আদেশ দেন।  এরপর এই পাহাড়ের নীচ থেকে ভূপৃষ্ঠকে চারিদিকে ছড়িয়ে দেন। সূরা আলে ইমরানের ৯৬ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্যে নির্ধারিত হয়েছে,সেটাই হচ্ছে এ ঘর,যা মক্কায় অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য বরকতময় ও হেদায়েতের উৎস। কাজেই দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর বুকে প্রথম যে স্থাপনাটি তৈরি হয়েছিল সেটি ছিল কাবা শরীফ। ইমাম সাদেক (আ.) বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে মক্কা। মহান আল্লাহর কাছে মক্কার মাটির চেয়ে প্রিয় মাটি, মক্কার পাথরের চেয়ে প্রিয় পাথর, মক্কার গাছের চেয়ে প্রিয় গাছ, মক্কার পাহাড়ের চেয়ে প্রিয় পাহাড় এবং মক্কার পানির চেয়ে প্রিয় পানি আর নেই।
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এই পবিত্র ঘরকে উদ্দেশ করে আল্লাহর নামে শপথ করে বলেছেন, আল্লাহর তৈরি শ্রেষ্ঠ জমিন তুমি, আল্লাহর কাছে প্রিয়তম ভূমিও তুমি। আল্লাহর শপথ! আমাকে যদি  মক্কা থেকে বের করে দেয়া না হতো তাহলে আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।  হাদিসে এসেছে, আদি পিতা হযরত আদম (আ.) প্রথম কাবা শরীফ নির্মাণ করেন। এরপর এটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজ পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)র সহযোগিতায় এটি পুনর্নির্মাণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)র নবুওয়াত প্রাপ্তির আগে তাঁর উদ্যোগ ও দিক-নির্দেশনায় প্রাথমিক নকশার ভিত্তিতে কুরাইশ গোত্রের হাতে আবার কাবা শরীফ নির্মিত হয়। তখন থেকে এখন পর্যন্ত মসজিদুল হারাম বহুবার পুনর্নির্মাণ করার পাশাপাশি এর উন্নতি ও সমৃদ্ধির কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
বর্তমানে মসজিদটির আকার ও আয়তন বহুগুণ বেড়েছে এবং মুসল্লির সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখনো বাড়ছে। যেসব কারণে এই মহান ঘরের পবিত্রতা ও মহত্ত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে সেগুলোর কয়েকটি হলো-  আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম ও ইসমাইল (আ.)র হাতে এটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন, কাবার মধ্যে হযরত আলী (আ.)র জন্ম এবং কাবা সংলগ্ন হিজরে ইসমাইল-এ বিবি হাজেরা ও হযরত ইসমাইল (আ.)র কবরের অবস্থান। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমানে এই পবিত্র স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালনকারীরা সেখানে অসংলগ্নভাবে এত বেশি নতুন নতুন ভবন ও স্থাপনা তৈরি করেছেন যার ফলে মসজিদুল হারামের আধ্যাত্মিক পরিবেশ ও ইবাদতের স্থানে  বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। কাবা শরীফের চারপাশের এলাকায় বর্তমানে তৈরি করা হয়েছে অনেক বড় বড় সুউচ্চ টাওয়ার এবং অসংখ্য সুইমিং পুল যা মসজিদুল হারাম এলাকাকে একটি পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত করেছে। অথচ বিশ্বের যেখানেই এ ধরনের অতি প্রাচীন কোনো ধর্মীয় স্থাপনা রয়েছে সেখানে  বা তার আশপাশে ওই ভবনের চেয়ে উঁচু কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে দেয়া হয় না।
 ইতিহাসে এসেছে, হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজের ছেলে হযরত ইসমাইলকে সঙ্গে নিয়ে কাবাঘর নির্মাণ করেন। এক পর্যায়ে এর দেয়াল যখন উঁচু হয়ে যায় তখন তার উপরে আর নাগাল পাচ্ছিলেন না আল্লাহর এই নবী। এ অবস্থায় হযরত ইসমাইল (আ.) একটি উঁচু পাথর এনে দেয়ালের পাশে বসিয়ে দেন যাতে তার উপরে দাঁড়িয়ে হযতর ইব্রাহিম নির্মাণ কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। এই পাথরটি বারবার একস্থান থেকে আরেক স্থানে সরিয়ে তার উপর দাঁড়িয়ে কাবাঘর নির্মাণ করতে থাকেন আল্লাহর এই নবী। পাথরটির উপর দাঁড়াতে দাঁড়াতে তার উপর হযরত ইব্রাহিম (আ.)র পায়ের ছাপ পড়ে যায়। কাবাঘরের পাশে হযরত ইব্রাহিমের পায়ের ছাপ সম্বলিত সেই পাথরটি আজও সংরক্ষিত রয়েছে। ইতিহাসে এটি মাকামে ইব্রাহিম নামেই পরিচিত। বর্গাকৃত্তি এই পাথরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৪০ সেন্টিমিটার এবং উচ্চতা ৫০ সেন্টিমিটার।
আব্বাসীয় তৃতীয় খলিফা মেহদি আব্বাসের শাসনামলে এই পাথরকে স্বর্ণ দিয়ে মুড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি একটি বড় খাঁচার মধ্যে এটিকে সংরক্ষণ করা হয়। এই খাঁচাটি মসজিদুল হারামের অনেকখানি জায়গা দখল করে আছে বলে ১৯৬৫ সালে এটি ভেঙে ফেলে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি কাঠামোর মধ্যে পাথরটিকে রাখা হয়। মহান আল্লাহ এ সম্পর্কে সূরা বাকারার ১২৫ নম্বর আয়াতে বলেন, যখন আমি কাবা গৃহকে মানুষের জন্যে সম্মিলন স্থল ও শান্তির আলয় করলাম, আর (বললাম) তোমরা ইব্রাহীমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাযের জায়গা বানাও...। মসজিদুল হারামের পাশে মাকামে ইব্রাহিমের অবস্থান আল্লাহর ঘর জিয়ারতকারী প্রতিটি মানুষকে মহান আল্লাহর কাছে হযরত ইব্রাহিম (আ.)র অতি উচ্চ মর্যাদার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আল্লাহর প্রকৃত খলিফার মর্যাদা অর্জনের জন্য প্রতিটি মুমিন মুসলমান এই মাকামে ইব্রাহিম থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করে।
কাবা শরিফের উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আরেকটি অংশ হচ্ছে হাজরে আসওয়াদ পাথর। উপবৃত্তাকার কালো রঙের প্রায় ৫০ সেন্টিমিটার আয়তনের পাথরটি রূপার তৈরি একটি ফ্রেমের মধ্যে সংরক্ষিত আছে। হজের সময় হাজিরা এই পাথরের সামনে থেকে তাদের তাওয়াফ শুরু করেন এবং কাবাশরিফকে সাতবার প্রদক্ষিণের পর এই পাথরের সামনে এসে তাওয়াফ শেষ করেন। এরপর তারা এই পাথরটি স্পর্শ করেন এবং চুমু খান। আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক স্থাপনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে এই হাজরে আসওয়াদ পাথর। এটি স্পর্শ করার মাধ্যমে বান্দা মহান আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের শপথ পুনর্ব্যক্ত করে।
হযরত আদম (আ.) প্রথম কাবাশরিফ নির্মাণের পর এই পাথরকে এই কাবাঘরের পূর্ব পাশে স্থাপন করেছিলেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.) যখন এই মসজিদ পুনঃস্থাপন করেন তখন হাজরে আসওয়াদ পার্শ্ববর্তী আবুকুবাইস পাহাড়ে পড়েছিল। হযরত ইব্রাহিম পাথরটি উঠিয়ে তার আগের জায়গায় স্থাপন করেন। ওই ঘটনার কয়েকশ বছর পর বিশ্বনবী (সা.)র বয়স যখন ৩৫ বছর তখন প্রবল বর্ষণ ও বন্যায় কাবা শরিফের মারাত্মক ক্ষতি হয়। তখনো নবুওয়াত লাভ না করলেও উন্নত চারিত্রিক গুণাবলীর কারণে কুরাইশদের কাছে আল-আমিন নামে পরিচিত ছিলেন তিনি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কাবা পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে কুরাইশ বংশের চারটি গোত্রের লোকজন হাজরে আসওয়াদকে নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। কোন্ গোত্রের মানুষের হাতে এই মূল্যবান পাথর কাবা শরীফে স্থাপিত হবে তা নিয়ে সৃষ্টি হয় এই দ্বন্দ্ব। এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি চাদরের উপর পাথরটি উঠিয়ে চার গোত্রের চারজনকে চাদরটির চারকোন ধরে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যেতে বলেন। এরপর তিনি নিজের হাতে পাথরটি জায়গামতো বসিয়ে দেন। এভাবেই নবুওয়াত প্রাপ্তির আগেই একটি মহান কাজ বিশ্বনবীর (সা.) হাতে সম্পন্ন হয়।  
 ‘হিজরে ইসমাইল হচ্ছে আল্লাহর ঘরের আরেকটি মূল্যবান অংশ। এটি কাবা শরীফের সঙ্গে লাগানো একটি উন্মুক্ত স্থান যা অর্ধবৃত্তাকার একটি দেয়াল দিয়ে ঘেরা। কোনো কোনো সূত্রমতে, এখানে হযরত ইসমাইল (আ.) ও তাঁর মা বিবি হাজেরা বসবাস করতেন এবং তারা মারা গেলে তাদেরকে এখানেই দাফন করা হয়।
বিশ্বনবী (সা.)র একজন স্ত্রী থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, আমি একবার কাবাঘরে ভেতরে প্রবেশ করে নামাজ আদায় করতে চাইলাম। মহানবী (সা.) আমাকে হাত ধরে হিজরে ইসমাইলের মধ্যে নিয়ে যান এবং বলেন, যখন তোমার কাবাঘরে নামাজ পড়তে ইচ্ছে হবে তখন এখানে এসে নামাজ আদায় করবে; কারণ এটি কাবারই অংশ। কিন্তু তোমার গোত্রের লোকেরা কাবাঘর পুনর্নিমাণের সময় এটিকে এই ঘরের বাইরে রেখে দেয়। 
রাসূলুল্লাহ (সা.)র এই হাদিসের সূত্র ধরে ফকীহগণ রায় দিয়েছেন হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা পালনের সময় হিজরে ইসমাইলের ভেতর দিয়ে হাঁটা যাবে না বরং এটিসহ কাবাঘরকে তাওয়াফ করতে হবে। বর্তমানে হিজরে ইসমাইলের দেয়ালের উচ্চতা ১.৩২ মিটার, এর ব্যাসার্ধ ৫.৮ মিটার এবং কাবাশরীফ থেকে এই দেয়ালের দূরত্ব ২.২২ মিটার।
 কাবাঘর নির্মিত হয়েছে কালো ও কঠিন পাথর দিয়ে যা এর উপরের গিলাফ সরালে দেখতে পাওয়া যায়। ১০৪০ হিজরি সালে বর্তমান কাবাঘরটি সর্বশেষ পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। আল্লাহর নবী হযরত ইসমাইল (আ.) সর্বপ্রথম কাবাঘরের দেয়ালগুলোকে রক্ষা করার লক্ষ্যে এগুলোকে পর্দা বা গিলাফ দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন। বর্তমানে কাবাঘর ঢাকতে কালো রঙের গিলাফ ব্যবহার করা হয় যার উপরের লেখাগুলো স্বর্ণ দিয়ে লেখা। প্রতি বছর হজের মৌসুমের আগে এই গিলাফ পরিবর্তন করা হয়। কাবাঘরের ভিতরেও রয়েছে আরেকটি গিলাফ যেটি কয়েক বছর পরপর পরিবর্তন করা হয়। এর কারণ হচ্ছে, বাইরের গিলাফটি রোদ, বৃষ্টি, ঝড় এবং হাজিদের হাতের ছোঁয়ায় নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ভিতরের গিলাফের এ ধরনের কোনো ক্ষতি হয় না বলে এটিকে প্রতি বছর পরিবর্তন করার প্রয়োজন পড়ে না।
কাবা শরীফের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে জমজম কূপ। হাজরে আসওয়াদের দিকে কাবাঘর থেকে ২১ মিটার দূরে এই কূপ অবস্থিত। এই কূপ সৃষ্টি সম্পর্কে বলা হয়েছে, হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজের স্ত্রী হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাইলকে আল্লাহর নির্দেশে মক্কার উষ্ণ ও শুষ্ক মরুদ্যানে রেখে চলে যান। তিনি স্ত্রী-পুত্রকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়ে যান। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বিবি হাজেরার কাছে থাকা পানি শেষ হয়ে যায়। এ সময় পানির সন্ধানে তিনি সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে সাতবার দৌড়ে যাওয়া-আসা করেন। কিন্তু কোথাও পানির সন্ধান না পেয়ে  শিশুপুত্রের কাছে ফিরে এসে দেখেন ইসমাইলের পায়ের ধাক্কায় অলৌকিকভাবে মাটি ফেটে পানি বেরিয়ে আসছে। পানিকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে দেখে বিবি হাজেরা বলে ওঠেন জম জম অর্থাৎ থেমে যাও। তিনি পানিকে ছড়িয়ে না গিয়ে এক জায়গায় জড়ো হতে বলতে চেয়েছিলেন। সেইসঙ্গে তিনি নিজে আশপাশের মাটি ও বালু জড়ো করে পানি জমানোর চেষ্টা করেন।
বিবি হাজেরা হয়তো ভেবেছিলেন পানির এই ঝর্ণাধারা থেমে যেতে পারে। তাই তিনি নিজের কাছে থাকা পানির পাত্র পূর্ণ করে নেন। কিন্তু জমজমের সে পানি আর কখনোই থেমে যায়নি। সেদিনের ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে জুরহুম গোত্রের লোকজন সেখানে পানির অস্তিত্ব টের পেয়ে যায়। তারা এই পানির উৎসের পাশেই বসতি গড়ে তোলে। ততদিনে পানির সে উৎসটি একটি বড় কূপে পরিণত হয়েছে। প্রথমদিকে জমজম কূপের পানি ছিল সেখানকার বসতির একমাত্র পানির উৎস। কিন্তু ধীরে ধীরে আশপাশে আরো কিছু কূপ সৃষ্টি হয়।
প্রতি বছর হজের মৌসুমে কাবাঘরে প্রচুর মানুষের সমাগম হওয়ার কারণে তাদের পানির চাহিদা মেটাতে আরো কিছু পানির উৎসের প্রয়োজন দেখা দেয়। এ কারণে ইসলামের আবির্ভাবের অনেক আগে থেকে মক্কার অন্যতম পেশা ছিল হজের মৌসুমে মানুষের পানির চাহিদা মেটানো। ইসলামের আবির্ভাবের সময় এই দায়িত্ব ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.)র চাচা আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের হাতে। ইসলাম আসার পর আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব মসজিদুল হারামের আঙিনায় রোক্‌ন ও মাকামের মধ্যবর্তী স্থানে প্রথম জমজমের পানি বিতরণের স্থান নির্ধারণ করেন।  পরবর্তীতে এই মসজিদ সংস্কার ও এর পরিসর বাড়াতে গিয়ে স্থানটি মসজিদুল হারামের পূর্ব পাশে নিয়ে আসা হয়।
১৯৫৫ সালে জমজমের পানি উঠানোর জন্য সেখানে পাম্প বসানো হয়। পরবর্তীতে হাজিদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে মসজিদুল হারামের আঙিনায় আরো কিছু পরিবর্তন আনা হয় যার মধ্যে ছিল জমজম কূপের পানি উঠানো ও বিতরণের স্থানটি আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে যাওয়া। ১৯৬৪ সালে এ কাজটি সম্পন্ন হয়। এ সময় কূপটিকে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৫ মিটার গভীরে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এটির মুখের আকারকে এক মিটার থেকে বাড়িয়ে আড়াই মিটার করা হয়। কয়েক বছর আগে জমজম কূপের সেই ভূগর্ভস্থ স্থাপনাও ভেঙে ফেলা হয়। বর্তমানে জমজমের পানি পাম্পের মাধ্যমে মসজিদুল হারামের বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে পরিশোধন করার পর পাইপলাইনের সাহায্যে আবার মসজিদুল হারামে সরবরাহ করা হয়।
জমজম কূপের পানির গুরুত্ব ও তা পান করার ফজিলত সম্পর্কে অনেক হাদিস রয়েছে। মহানবী (সা.) জমজমকে বলেছেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পানির কূপ। তিনি সব সময় এই কূপের পানি পান করতেন। যেখানেই যেতেন ওজু করা ও খাওয়ার জন্য সাহাবীদেরকে বলতেন জমজমের পানি নিয়ে আসতে। বর্তমানে সারাবিশ্বের  মুসলমানরা হজ বা ওমরাহ করতে মক্কায় গেলে নিকটাত্মীয়দের জন্য উপহার হিসেবে জমজমের পানি নিয়ে আসেন। এটি এখন মুসলিম সমাজের একটি সুন্দর সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।

 
back to top