Friday, 6 November 2015

" গন্ধম কি ? আদম ও হাওয়ার গন্ধম খাওয়ার রহস্য কি ? "

2 Comments
গন্ধম ফার্সি শব্দ । পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফে গন্ধম শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি । বরং পবিত্র কুরআনে ‘শাজারাত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ বৃক্ষ । প্রচলিত ধারণামতে, আদম ও হওয়া গন্ধম খাওয়ার অপরাধে বেহেশত হতে বিতাড়িত হয়েছিলেন ।
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে-
অর্থ-”আমি বললাম, হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেথা ইচ্ছা আহার কর, কিন্তু এই বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না, হলে তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে” (সূরা- বাকারা, আয়াত- ৩৫) ।
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে-
অর্থ-”অতঃপর তাদের লজ্জাস্থান, যা গোপন রাখা হয়েছিল, তা প্রকাশ করার জন্য; শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল- পাছে তোমরা উভয়ে ফেরেশতা হয়ে যাও কিংবা তোমরা স্থায়ী (বাসিন্দা) হও, এ জন্যই তোমাদের প্রতিপালক এই বৃক্ষ সম্বন্ধে নিষেধ করেছেন” (সূরা- আরাফ, আয়াত- ২০) ।
অন্যত্র আল্লাহ্‌ এরশাদ করেন-
অর্থ-”এভাবে যে তাদেরকে প্রবঞ্চিত করল, তৎপর যখন তারা সে বৃক্ষ ফলের আস্বাদ গ্রহণ করল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের নিকট প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং তারা উদ্যানপত্র দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করতে লাগল, তখন তাদের প্রতিপালক তাদের সম্বোধন করে বললেন, আমি কি তোমাদের এ বৃক্ষ সম্বন্ধে সাবধান করিনি এবং শয়তান যে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু আমি কি তা তোমাদেরকে বলিনি?” (সূরা- আরাফ, আয়াত- ২২) ।
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে-
অর্থ-”হে বনী আদম ! শয়তান যেন তোমাদেরকে কিছুতেই প্রলোভিত না করে, যেভাবে তোমাদের পিতা-মাতাকে জান্নাত হতে সে বহিষ্কৃত করেছিল, তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান দেখাবার জন্য বিবস্র করেছিল, সে নিজে এবং তার দল তোমাদেরকে এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে না পাও, যারা বিশ্বাস করে না- আমি শয়তানকে তাদের অবিভাবক বানিয়ে দিয়েছি” (সূরা- আরাফ, আয়াত- ২৭) ।
কোন কোন আধুনিক তাফসীরকারকগণের মতে- আদম ও হাওয়ার বাসস্থান বা স্বর্গোদ্যান, হযরত আদম ও হাওয়ার শৈশবের মনোহর বাসস্থান ব্যতিত আর কিছুই নয় । উহা ভুতলেই অবস্থিত ছিল, নচেৎ উহার মধ্যে কখনোই প্রবঞ্চনা; প্রতারণা অথবা পাপকার্য সংঘটিত হতো না 
এই নবীন তাফসীরকারকগণ নিষিদ্ধ গাছের ‘ফল’ অর্থ হযরত হাওয়া বিবির বিকাশোম্মুখ যৌবন চিহ্ন বলে প্রকাশ করেছেন । তাদের মতে ‘ফল ভক্ষন’ বলতে উভয়ের দাম্পত্য সম্পর্কে এবং ‘বেহেশতি বসন খুলে গিয়ে লজ্জিত হওয়ার’ অর্থ- ঐ ফল ভক্ষণের পরে উভয়ের মনের অনাবিল পবিত্রতা বিলুপ্ত হওয়া এবং তজ্জন্য লজ্জা অনুভব করা । ইতিপূর্বে মনের ঐ অনাবিল পবিত্র ভাবের জন্যই তারা বস্রহীন নগ্ন অবস্থায়ও কোনরূপ লজ্জা বা সংকোচ অনুভব করেনি । কিন্তু ঐ ঘটনার পরে লজ্জা অনুভব হয়েছিল বলে তারা বৃক্ষপত্রে স্ব স্ব লজ্জাস্থান আচ্ছাদন করেছিলেন । শয়তানের প্ররোচনাকে এরা যৌবন-সুলভ কাম প্রবৃত্তির উত্তেজনা ও উন্মাদনা বলে ব্যাখ্যা করেছেন । উক্ত তাফসীরকারকদের এই চিন্তাধারা অত্যন্ত চমৎকার বটে, কিন্তু যদিও কোন কোন তাফসীরকারক এ মত স্বীকার করেন না । (তাফসীরে কুরআনুল হাকীম)
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্‌ আদমকে লক্ষ্য করে বলেছেন- ঐ গাছের নিকটবর্তী হইও না তবে তোমরা অত্যাচারীদের মধ্যে গণ্য হবে । অনেক তাফসীরকারক এটাকে ফলদার বৃক্ষ বলেছেন । অলী-আল্লাহ্‌গণের মতে ঐ ফলদার বৃক্ষই হলেন হযরত হাওয়া (আঃ) । কেননা তিনি ছিলেন নারী । আর নারীগণই ফলদার বৃক্ষের ন্যায় সন্তান প্রসব করে থাকেন ।
আল্লাহ্‌ প্রাপ্ত সাধক অলী-আল্লাহ্‌গণ আদম ও হওয়ার গন্ধম খাওয়া সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদীসের জাহেরী অর্থের পাশাপাশি তাঁদের সাধনালব্ধ জ্ঞান থেকে বাতেনী ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, ‘শাজারাতুন’ থেকে সেজরা অর্থাৎ বংশ বৃদ্ধির ক্রমধারাকে বুঝানো হয়েছে । সাজারাতুন অর্থ গন্ধম নয়, ফলদার বৃক্ষ, যার দ্বারা বিবি হওয়াকে বুঝায় । আদমকে বিবি হাওয়ার কাছে যেতে এ জন্য নিষেধ করা হয়েছিল যে, তারা উভয়ে একত্রিত হয়ে দাম্পত্য মিলনে জড়িয়ে পড়লে বংশ বিস্তার শুরু হবে, যা বেহেশতে সমীচীন নয় ।
পবিত্র কুরআনে আদম ও হাওয়া সম্পর্কিত যে কয়টি আয়াত নাজিল হয়েছে তাতে কোথাও শয়তানের প্ররোচনায় তাদের লজ্জাস্থান প্রকাশ হওয়ার কথা, কোথাও তাদের লজ্জাস্থান দেখাবার জন্য বিবস্র করা, আবার কোথাও বৃক্ষ ফলের আস্বাদ গ্রহণ করায় তাদের লজ্জাস্থান তাদের নিকট প্রকাশ হয়ে পড়লো এবং তারা উদ্যানপত্র দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করতে লাগলো বলা হয়েছে । আল্লাহ্‌র এ বাণী থেকেই সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, গন্ধম বলতে কোন ফল নয়, উহা ছিল আদম ও হাওয়ার দাম্পত্য মিলন । কারণ, ফল ভক্ষণ করতে লজ্জাস্থানকে উন্মোচন করতে হয় না ।
অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন সূক্ষ্ম জ্ঞানের অধিকারী অলী-আল্লাহ্‌গণের মতে- হযরত আদম ও হাওয়া (আঃ) যে স্বর্গোদ্যানে ছিলেন তা দুনিয়ারই একটি সুন্দর ও মনোরম বাগান ছিল । আল্লাহ্‌র কুদরতে ভিন্ন ভূম বা পৃথিবী হতে এ দু’জন নর ও নারীকে শৈশবে উক্ত বাগানে এনে রাখা হয় । তারা উভয়ে এখানেই বড় হয়ে যখন বয়ঃপ্রাপ্ত হলেন, তখন কাম প্রবৃত্তির প্ররোচনায় তারা এই ফলের আস্বাদ গ্রহণ করেছিলেন । এখানে বেহেশত বলতে যে সুন্দর স্বর্গোদ্যান বুঝানো হয়েছে, তা স্থূল জগতের । আর আদম ও হওয়ার স্বর্গ সুখ বলতে তাঁদের শৈশবের কু-প্রবৃত্তিমুক্ত আত্মার অনাবিল প্রশান্তিকে বুঝানো হয়েছে । যৌবনে কাম রিপুর প্ররোচনায় গন্ধম ফলের আস্বাদ গ্রহণ এই দুনিয়াতেই সংঘটিত হয়েছিল । কেননা, সূক্ষ্ম জগতের কু-রিপু চরিতার্থ করার কোন সুযোগ নেই এবং সেখানে পুষ্পোদ্যান ও ফলমূলের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায় না । এ পৃথিবী ছাড়া অসংখ্য ভূম বা পৃথিবী আছে বলে সূফী সাধকগণ যে মত প্রকাশ করেছেন, তার সত্যতা প্রমাণিত হয়, এ যুগের কতগুলি অদ্ভুত ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে । উড়ন্ত ‘সসার’ নামক যে রহস্যময় বস্তুটির পৃথিবীতে আগমনের খবর পাওয়া যায় তা ভিন্ন গ্রহ থেকে আগত উন্নত মানুষের বাহন বলে অনেক বৈজ্ঞানিক একমত হয়েছেন । সুতরাং হযরত আদম ও হাওয়াকে ভিন্ন ভূম থেকে এ পৃথিবীতে আগমন বিচিত্র ও অবান্তর কোন ঘটনা নয় । অতএব, হযরত আদম ও হাওয়ার দাম্পত্যমিলন এবং এর কারণে লজ্জিত হয়ে পরস্পর পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং শয়তানের প্ররোচনা বলতে কামরিপুর অশান্ত উন্মাদনাকে বুঝানো হয়েছে ।
পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফের উপরোক্ত আলোচনা থেকে পরিশেষে বলা যায় যে, গন্ধম কোন ফল নয় । উহা আদম ও হওয়ার দাম্পত্য মিলন, যা বেহেশতে তাঁদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল । কারণ, বেহেশতে বংশ বিস্তার সমীচিন নয়। এ কারণেই তাঁদেরকে দুনিয়াতে প্রেরণ করা হয়েছে, যা দুনিয়ার জন্য প্রযোজ্য ।
*** এই পোস্ট এর লেখক Matinur

Monday, 19 October 2015

এক সুতায় গাঁথা, মিনা ট্র্যাজেডি, ইয়েমেনে আগ্রাসন ও আলে সৌদের ইতিহাস

0 Comments
১. ক্রেন দুর্ঘটনা

১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫, জুমাবার।

মসজিদুল হারাম সম্প্রসারণের কাজে নিয়োজিত বিন লাদেন গ্রুপের প্রায় ১০০টি বিশালায়তন ক্রলার ক্রেন মসজিদের চতুর্দিকে বসানো। বিকেল পাঁচটা বিশের দিকে ঝোড়ো আবহাওয়ায় এর একটি ক্রেন ভেঙে মসজিদের পূর্ব পাশের ছাদের উপর পড়ে এবং ছাদ ভেঙে কংক্রিটের স্তুপের নিচে চাপা পড়ে শহীদ হন শতাধিক হাজি। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সংবাদ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ছবি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই সৌদি সরকারের হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যেখানে সাধারণ নির্মাণকাজেই ক্রেনের আশপাশ থেকে মানুষ সরিয়ে নেয়া হয়, সেখানে হজ মওসুমে লক্ষ লক্ষ হাজির আগমণ হবে জেনেও সৌদি সরকার কেন হাজার কেজি ওজনের ক্রেনগুলোকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখল না, এই অভিযোগ মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সকল বিবেকবান মানুষের। সৌদি রাজা বা সৌদি প্রিন্সদের কেউ কি এমন অনিরাপদ কনস্ট্রাকশন সাইটে যেতেন? এই মর্মান্তিক ক্রেন দুর্ঘটনায় আল্লাহর মেহমান হাজিদের প্রতি সৌদি সরকারের এই উদাসীনতাই ফুটে উঠেছে যে, আল্লাহর মেহমানদের জীবনের কোনো মূল্য আলে সৌদের কাছে নেই।

২. হোটেলে অগ্নিকাণ্ড
এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই ১৭ সেপ্টেম্বর এবং তার তিনদিন বাদে ২১ সেপ্টেম্বর দুটি হোটেলে পৃথক অগ্নিকাণ্ডে বেশ কয়েকজন হাজি আহত হন, সহস্রাধিক হাজিকে সরিয়ে নেয়া হয়। প্রথমে সৌদি সরকারের উদাসীনতার ফলস্বরুপ ক্রেন দুর্ঘটনায় শতাধিক হাজির মৃত্যু এবং তার কিছুদিন পর একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা হাজিদেরকে অনিরাপত্তায় ফেলেছে, একইসঙ্গে প্রায় ২০ লাখ হাজির আত্মীয় স্বজনসহ গোটা মুসলিম উম্মাহকে উদ্বিগ্ন করেছে। এই অনিরাপত্তাকে চরম মাত্রায় নিয়ে গেল ২৪ সেপ্টেম্বরের হত্যাকাণ্ড।

৩. মিনা ট্র্যাজেডি

২৪ সেপ্টেম্বর ২০‌‌১৫, ঈদুল আযহা।
হজের নিয়মানুযায়ী সকালবেলা মুজদালিফা থেকে মিনার জামারাতের (শয়তানের প্রতিকৃতি হিসেবে তৈরি পাথরের স্তম্ভ) উদ্দেশ্যে হাজিরা যাত্রা শুরু করবেন এবং সেখানে পৌঁছে শয়তানের প্রতিকৃতিতে পাথর নিক্ষেপ করবেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে, হাজিদের সুবিধার্থে এই পথে বেশ কয়েকটি রাস্তা তৈরি করা হয়েছে এবং গোটা হজ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য কয়েক হাজার ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরাও ইনস্টল করা হয়েছে। সেভাবেই গত ২৪ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার হাজিরা যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু সকাল নয়টার দিকে জামারাতে পৌঁছবার কয়েক কিলোমিটার আগে হঠাৎই কোনো এক কারণে কাফেলার সামনের দিকে হাজিরা থেমে যান, আর পেছন থেকে হাজিদের স্রোত অব্যাহত থাকায় প্রায় দুই হাজার হাজি পদপিষ্ট হয়ে, অত্যধিক চাপে ও দম বন্ধ হয়ে মারা যান। যদিও সৌদি সরকার নিহতের সংখ্যা ৭৬৯ বলে দাবি করছে।

(সৌদি প্রিন্স আল ওয়ালিদ বিন তালাল আল সৌদ এর আংশিক মালিকানাধীন) লেবানিজ দৈনিক আদ-দিয়ার অভিযোগ করেছে যে, সৌদি প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান আল সৌদ শতাধিক নিরাপত্তারক্ষীর গাড়িবহর নিয়ে ওই রাস্তা দিয়ে যাবার সময় প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পথ বিনা নোটিশে আটকে দেয়ায় এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে। অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি ভিডিও ফুটেজ অভিযোগটিকে দৃঢ়তা প্রদান করেছে।

এদিকে সৌদি সরকারের কেন্দ্রীয় হজ কমিটির খালেদ আল ফয়সাল "আফ্রিকান হাজিরাই এজন্য দায়ী” – বলে বর্ণবাদী মন্তব্য করায় সোশাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছেন। মাত্র দুটি রাস্তা খোলা রেখে বাকিগুলো কেন বন্ধ করা হলো এবং ঠিক কী কারণে কিভাবে এই ঘটনা ঘটল তার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা সৌদি সরকার দিতে পারেনি; এমনকি কোনো ভিডিও ফুটেজও প্রকাশ করেনি, যদিও এলাকাটি সার্বক্ষণিক ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার অধীনে ছিল।

সৌদি সরকার বলছে যে, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পেলেই কারণ জানা যাবে, অথচ এরই মাঝে তারা হাজিদের দোষ দিয়ে বসে আছেন, বর্ণবাদী মন্তব্যও করেছেন। আর দরবারী আলেম সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি শেখ আব্দুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আল শেখ তার প্রিন্সকে রক্ষা করতে এই হত্যাকাণ্ডকে "ভাগ্য” বলে আখ্যায়িত করে বলেছেন যে, এতে মানুষের কোনো হাত নেই এবং তার প্রিন্স মোটেও দোষী নন। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের আগেই নিজেদেরকে অভিযোগ থেকে রক্ষা করতে কখনো আফ্রিকান হাজিদের দোষ দিয়ে আর কখনো আল্লাহকে দোষ দিয়ে দেয়া সৌদি সরকারের রেডি বক্তব্য দৈনিক আদ-দিয়ার এর অভিযোগকেই আরো দৃঢ় করেছে।

যে গৃহকে আল্লাহ তায়ালা নিরাপদ করেছেন (সূরা কুরাইশ, ১০৬:৪), সহস্রাধিক হাজির এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তার নিরাপত্তাকে লঙ্ঘিত করেছে আলে সৌদ। অবশ্য হাজিদের রক্তে আলে সৌদের হাত আজ নতুন করে রঞ্জিত হয়নি, বরং এর ইতিহাস আরো পুরনো।
৪. ১৯৮৭ সালের হত্যাকাণ্ড

৩১ জুলাই ১৯৮৭, জুমাবার।
জুমার নামাজের আগ দিয়ে লক্ষাধিক ইরানী হাজিসহ অন্যান্য দেশের হাজিরা মক্কায় এক মিছিলের আয়োজন করেন। তারা 'আল্লাহু আকবার', 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ', 'আমেরিকা আল্লাহর দুশমন', 'ইসরাইল আল্লাহর দুশমন' 'বিশ্বের সকল মুসলিম এক হও', 'আমরা ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষে' ইত্যাদি বলে শ্লোগান দেন। মিছিলে এমনকি সৌদি আরব কিংবা সৌদি রাজ পরিবার আলে সৌদের বিরুদ্ধে একটি শ্লোগানও দেয়া হয়নি, তবুও সৌদি পুলিশ হাজিদের উপর চড়াও হয়। মিছিলকারীদের কেউ কেউ পবিত্র কা'বা ঘরে আশ্রয় নিতে চাইলেও পুলিশ তাদেরকে সেখানেও যেতে দেয়নি। এসময় আল্লাহর মেহমান প্রায় পাঁচশত হাজিকে গুলি করে হত্যা করে সৌদি সরকার। যে গৃহকে আল্লাহ তায়ালা নিরাপদ করেছেন, যে হারাম শরীফে রক্তপাত নিষিদ্ধ করেছেন, সেখানে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অমান্য করে আল্লাহরই মেহমানদের নির্মমভাবে হত্যা করল আলে সৌদ।

এহেন জঘন্য অপকর্মের ইতিহাস ঘাঁটলে আলে সৌদকে ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া ছাড়া আর সাথে তুলনা করা যেতে পারে? যে কিনা তার তিন বছরের অবৈধ শাসনামলে কারবালায় হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) কে শহীদ করে, মক্কা আক্রমণ করে গোলা বারুদ নিক্ষেপ করে কাবাগৃহের ক্ষতিসাধন করে এবং মদীনার জনগণ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে সেনাবাহিনীকে তিনদিনের জন্য অবাধে খুন, ধর্ষণসহ যেকোনো ধরণের অপরাধের অনুমতি দিয়ে প্রেরণ করে; এবং তার সেনাবাহিনী সেই নিকৃষ্ট অপরাধগুলো সংঘটিত করে। মক্কা-মদীনার ওপর চেপে বসেছিল অভিশপ্ত ইয়াজিদ আর এখন চেপে বসেছে আলে সৌদ। ইসলামের রীতিনীতির কোনো তোয়াক্কা যেমন ইয়াজিদ করেনি, তেমনি তোয়াক্কা করে না এই আলে সৌদ। ইসলামের চারটি সম্মানিত মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ ও রক্তপাত নিষিদ্ধ যার মাঝে জিলহজ একটি। ইসলামের দুটি পবিত্র স্থানে রক্তপাত নিষিদ্ধ, মদীনা ও বিশেষভাবে মক্কার হারাম শরীফ। ১৯৮৭ সালে হাজিদের হত্যা করে ইসলামের এই দুটি নিষেধাজ্ঞাই লঙ্ঘন করেছিল আলে সৌদ। আর ২০১৫ সালেও তারা তা লঙ্ঘন করছে।

৫. ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসন

২৫ মার্চ, ২০১৫।
ইয়েমেনে সৌদি তাঁবেদার প্রেসিডেন্ট মানসুর হাদির ২২ জানুয়ারির পদত্যাগের পর জনপ্রিয় হুসি বিপ্লবীরা সরকারের দখল নিয়ে নিলে হুসি বিপ্লবীদের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২৫শে মার্চ মানসুর হাদি পালিয়ে যান সৌদি আরব। আর তাঁবেদার প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতায় পুনর্বহাল করতে একই দিনে সৌদি আরব ইয়েমেনে বোমা হামলার মাধ্যমে আগ্রাসনের সূচনা করে, যা আজ অবধি চলছে। ইসলামে যে চারটি মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ ও রক্তপাতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সে মাসগুলোর তোয়াক্কা না করেই রজব ও যিলক্বদ মাসে সৌদি আরব আগ্রাসন চালিয়ে গিয়েছে। এবং এই হজের মাস যিলহজ্জ এও তা থেমে নেই; যদিও এই মাসটিও নিষিদ্ধ মাস। ১৯৮৭ সালে যেমন তারা আল্লাহর মেহমানদের হত্যা করেছিল নিষিদ্ধ মাসের তোয়াক্কা না করেই, এই ২০১৫ সালেও তারা সেটি করে যাচ্ছে ইয়েমেন। বেসামরিক এলাকায় হামলা করে এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার ইয়েমেনিকে হত্যা করেছে সৌদি জোট, যার অধিকাংশই নারী-শিশু।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লজিস্টিক সাপোর্টে সৌদি আরবের নেতৃত্বে মিশর, বাহরাইন, কাতার, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আরো কয়েকটি দেশ একত্রে দরিদ্র রাষ্ট্র ইয়েমেনে হামলা চালিয়ে আসছে গত মার্চ মাস থেকে। এমনকি রমজান মাসেও তারা হামলা চালিয়ে গিয়েছে। উপরন্তু দরবারি আলেম সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি ফতোয়া জারি করে আগ্রাসনে অংশ নেয়া সৌদি যোদ্ধাদের জন্য রোজা মওকুফ করে দিয়েছেন!

৬. সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি ও সৌদি ইসলাম

সৌদি সংবিধান অনুযায়ী- সৌদি আরবের শাসনক্ষমতা সর্বদা আলে সৌদের (অর্থাৎ আবদুল আজিজ আল সৌদ এর বংশধর) হাতে থাকবে। (অতএব স্বাভাবিকভাবেই এখানে নিজেদের নেতা / শাসক বেছে নেয়ার কোনো সুযোগ জনগণের নেই।) এরপর বলা হয়েছে যে, কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে এদের মাঝে সবচে' নীতিবান ব্যক্তি রাজা হবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, প্রধানতঃ অলিখিত সংবিধানের এই রাজতন্ত্রে রাজা ও রাজবংশের সবাই কার্যতঃ আইনের ঊর্ধ্বে থাকেন। গ্র্যান্ড মুফতিকে রাজা নিজে নিয়োগ দেন ও পদচ্যুত করার ক্ষমতা রাখেন। আর এই গ্রান্ড মুফতির প্রভাবের অধীনেই দেশের বিচারকার্য পরিচালিত হয়। যেকারণে আমরা কখনও সৌদি গ্র্যান্ড মুফতিকে আলে সৌদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে দেখি না, কোনো শাস্তি প্রদান করতে দেখি না। যদিও সৌদি রাজবংশের ব্যাপারে বহুসংখ্যক রক্ষিতা রাখাসহ অস্বাভাবিক রকম নিষিদ্ধ ভোগ বিলাসে মত্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়, তবুও সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি ও শরিয়া বোর্ড নীরব! ইসলামের স্বর্ণযুগে বায়তুল মালের খরচের ব্যাপারে খলিফাকে একজন সাধারণ মুসলমান পর্যন্ত প্রশ্ন করার সুযোগ পেত, কিন্তু সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি আলে সৌদের বিলিয়ন ডলারের বিলাসিতার কাছে এসে নীরব! বরং সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি ও শরিয়া বোর্ড যত উদ্ভট ফতোয়া দিতে ব্যস্ত। যেমন, ইসরাইলের বিরুদ্ধে মিছিল করা হারাম, সিটবেল্ট বাঁধা শিরক, ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা হারাম, আরবের সকল গির্জা ধ্বংস করতে হবে, দশ বছরের মেয়েদেরকে বিবাহে বাধ্য করা যাবে, নবীজির অবমাননার প্রতিবাদে মিছিল করা হারাম, মেয়েরা কলা স্পর্শ করতে পারবে না, দেয়ালের দিকে মুখ করে শু'তে পারবে না.. এবং এমন আরো অনেক কিছু। আর সম্প্রতি হাজিদের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তো বলেই দিয়েছে যে, এটা হলো ভাগ্য, এখানে হজ কমিটির প্রধান সৌদি প্রিন্সকে দোষারোপ করা যাবে না।

এরপরও যদি কেউ মনে করেন সৌদি আরবে ইসলামী শাসন কায়েম রয়েছে, তবে সে ব্যক্তির ন্যূনতম বিচারবুদ্ধিও লোপ পেয়েছে। বরং সেখানে জারি আছে নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থা, ইসলামের নামে মানুষের মৌলিক অধিকার পর্যন্ত হরণ করে নেয়া, আর সৌদি বাদশাহসহ আলে সৌদের হাজার হাজার প্রিন্সকে আইনের ঊর্ধ্বে রেখে বিলিয়ন ডলারের ভোগ বিলাসে মত্ত থাকবার বৈধতা। আর তাইতো ১৯৮৭ সালের পাঁচশত হাজির হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি, বিচার হবে না ২০১৫’র এই হত্যাকাণ্ডের, বিচার হবে না ইয়েমেনে অবৈধ আগ্রাসনের, বিচার হবে না আলে সৌদের কোনো অন্যায় অপকর্মেরই! সকল আইনের ঊর্ধ্বে থেকে দরবারি আলেমদের দিয়ে ইসলামের নামে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছে এই আলে সৌদ। আর তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে যেন মুসলিম বিশ্ব কোনো প্রশ্ন না তোলে, সেজন্যে দুটি অস্ত্র তারা ব্যবহার করছে: এক. মক্কা মদিনার জিম্মাদার হওয়া, দুই. তেলের টাকায় বিশ্বব্যাপী বিকৃত ওহাবী ইসলাম প্রচার করা।


৭. ওহাবী ইসলাম, সৌদি আরব ও ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

অস্ত্রের দ্বারা একের পর এক রাজ্য জয় করে "মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি" করাটা প্রকৃতই ইসলামের পন্থা, নাকি ইসলামের মূল স্পিরিট থেকে বিচ্যুতি, তা ভিন্ন আলোচনার দাবি রাখে। তবে মুহাম্মদ (সা.) এর জীবদ্দশায় ইসলামের রাজনৈতিক (অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা) ও ধর্মীয় দিকে নানান মতের অস্তিত্ব ছিল না। ইসলামের রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় ও ধর্মীয়-রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের পথ কেমন হবে সে বিষয়ে নবী-পরবর্তী চার খলিফার মাঝে গুরুত্বপূর্ণ মত-পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়, যার ঐতিহ্য ধরে আজকে ইসলামের শত মত ও পথের উদ্ভব ঘটেছে। তবে নবী-পরবর্তী মুসলমানদের বিগত প্রায় চৌদ্দশ' বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, অল্প কয়েক বছর বাদে অধিকাংশ সময়েই রাজনৈতিকভাবে মুসলমানেরা সাম্রাজ্য বিস্তার ও নানান রূপের রাজতন্ত্রের চর্চা করেছে, তা সেটার যে নামই তারা দিয়ে থাকুক না কেন (খিলাফত অথবা সাম্রাজ্য)। যাহোক, রাজনৈতিকভাবে মুসলিম সাম্রাজ্য খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক অঞ্চলকে নিজেদের অধীনে নিয়ে আসে, তবে মোটামুটিভাবে তা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনেই ছিল, কেবল সময় সময় শাসনকর্তা/রাজার পরিবর্তন হয়েছিল মাত্র। সর্বশেষ "ওসমানী খিলাফতের” পতন ও খণ্ড খণ্ড হয়ে যাবার পিছনে খিলাফতের ভেতরের ও বাইরের নানান ষড়যন্ত্র কাজ করেছিল। ইউরোপ ও রাশিয়া এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তবে ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র ছিল সবচে' জটিল ও কার্যকরী। যেই জ্ঞানচর্চায় মুসলিম জাতি একদা আলোর দিশারী ছিল, সেই বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ছেড়ে দেবার কারণে তারা পিছিয়ে পড়ল, নানামুখী সামরিক আক্রমণ ও ষড়যন্ত্রে কাবু হয়ে পড়ল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন ছিল ওসমানী খিলাফতের বিরুদ্ধে। ওসমানী খিলাফতকে খণ্ডিত করে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে হিজাজের শাসক শরিফ হোসাইনকে খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উস্কানি দেয় ব্রিটেন। ইরান ও আফগানিস্তান ছাড়া গোটা আরব তখন তুর্কি খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯১৬ সালে নিজেকে আরবের সুলতান বলে ঘোষণা করেন শরিফ হোসাইন। ১৯১৮ সালে ওসমানীরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে যায়। কিন্তু ব্রিটেন একইসাথে  নজদ অঞ্চলের আবদুল আজিজ বিন সৌদকেও ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছিল। ১৯২৪ সালে ব্রিটেন তার এক সেবাদাস শরিফ হোসাইনের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে অপর সেবাদাস আবদুল আজিজ বিন সৌদকে হেজাজের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯২৭ সালে "জেদ্দা চুক্তিতে” আবদুল আজিজ আল সৌদ ব্রিটেনকে এই মর্মে দাসখত লিখে দেয় যে, সে অত্র অঞ্চলে ব্রিটেনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোথাও যুদ্ধ পরিচালনা করবে না, বিনিময়ে ব্রিটেন তার সাম্রাজ্যকে স্বীকৃতি দেবে। ১৯০২ সাল থেকে আরবের একটু একটু করে দখল করতে শুরু করা আবদুল আজিজ বিন সৌদ ১৯৩২ সালে তার সাম্রাজ্য বৃদ্ধি সমাপ্ত করে, এবং হিজাজসহ দখলীকৃত সংলগ্ন অঞ্চলের নাম পরিবর্তন করে তার নিজ বংশের নামে "সৌদি আরব” নাম রাখে। এভাবেই মুসলিম জাতির পবিত্র আবেগের স্থান হিজাজ (মক্কা ও মদীনা) ব্রিটিশ প্রভাবের অধীন হয়ে গেল। এটাই হলো বর্তমান সৌদি আরবের রাজনৈতিক ইতিহাস। আর ধর্মীয় দিক থেকে আবদুল আজিজ বিন সৌদ ওয়াহাবী মতবাদকে তার দখলীকৃত এলাকার (বর্তমান সৌদি আরবের) মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দেয়।

প্রসিদ্ধ চার সুন্নি মাযহাব ও শিয়া মাযহাবের বহু বিষয়কে শিরক, বিদআত ইত্যাদি ফতোয়া দেয়া ইবনে তাইমিয়া (১২৬৩-১৩২৮) ইসলামের আধ্যাত্মিকতা বিবর্জিত এক রুক্ষ ইসলামের প্রচার করেন, এবং শিয়াদের বিরুদ্ধে একপ্রকার ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করেন। আবদুল ওয়াহহাব নজদী (১৭০৩-১৭৯২) ইবনে তাইমিয়ার মতবাদকে পুনরুজ্জীবিত করেন ও সেইসাথে নিজস্ব কিছু চিন্তাধারাও প্রচার করেন। এভাবেই প্রসিদ্ধ সুন্নি চার মাযহাব ও শিয়া মাযহাবের বিপরীতে ওহাবী মতবাদ দাঁড়িয়ে যায় (যদিও তারা নিজেদেরকে সালাফি বলতেই বেশি পছন্দ করে)। এই ওহাবী মতবাদের বাইরের যে কাউকে (মূলতঃ শিয়া ও সূফিদেরকে) কাফির আখ্যা দেয়া হয় ও হত্যা করা বৈধ ঘোষণা করা হয়। আজকের ISIL এর ধর্মীয় ভিত্তিও এটা। (তাদেরকে তাকফিরি গোষ্ঠী একারণেই বলা হয় যে, তারা মানুষকে তাকফির করে, অর্থাৎ কাফির ঘোষণা করে।) আধ্যাত্মিকতা বিবর্জিত ওহাবী-সালাফি এই রুক্ষ ইসলাম আল্লাহ তায়ালাকে শরীরি সত্ত্বা হিসেবে গণ্য করে, এবং তাদের মতবাদের সাথে পার্থক্য থাকা যেকোনো মুসলিম গ্রুপকে কাফির ও হত্যাযোগ্য গণ্য করে। (আজকে মধ্যপ্রাচ্যে ISIL কেবল শিয়াদেরই যে হত্যা করছে তা নয়, তারা বহু সুন্নি মুসলমানকেও হত্যা করেছে।)

মুসলিম বিশ্বে ব্রিটিশ গুপ্তচর হ্যামফার এর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে, উদ্ধত অস্থিরমনা যুবক আবদুল ওয়াহহাব নজদীকে মুসলিম বেশধারী ব্রিটিশ গুপ্তচর হ্যামফার বিকৃত ইসলাম প্রচারে উদ্বুদ্ধ করে। এই মতবাদ প্রচারের জন্য ১৭৪৪ সালে সৌদি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ বিন সৌদের (যার বংশধারায় আধুনিক সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতার জন্ম) সাথে আবদুল ওয়াহহাব নজদী চুক্তিবদ্ধ হন এই শর্তে যে, মুহাম্মদ বিন সৌদ যুদ্ধের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে রাজ্য সম্প্রসারণ করবেন, আর আবদুল ওয়াহহাব নজদী ধর্মীয় নেতা হিসেবে সর্বদা তাকে সমর্থন দেবেন ও দখলীকৃত অঞ্চলের মানুষদের উপর "ওয়াহাবী ইসলাম" প্রয়োগ করবেন। আজকের সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি কিভাবে সৌদি বাদশাহ ও প্রিন্সদের অনুগত দাসের ন্যায় আচরণ করেন, তা বুঝতে হলে এই ইতিহাস কাজে লাগবে।

এই হলো সংক্ষেপে বর্তমান সৌদি আরব প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক ইতিহাস ও আরবে রুক্ষ তাকফিরি ওহাবী ইসলামের শিকড় গেড়ে বসবার ইতিহাস। এরপর বিগত প্রায় একশত বছর ধরে ব্রিটিশ মার্কিন সেবাদাস এই আলে সৌদ তেলের টাকায় বিশ্বব্যাপী তাকফিরি ওহাবী ইসলামের প্রচার করেছে যা সুন্নি মাযহাবগুলোকে ক্রমশঃ গ্রাস করছে। ১৯১৭ সালের "ব্যালফোর ঘোষণায়” আবদুল আজিজ বিন সৌদ এর কাছ থেকে ব্রিটেন লিখিত সম্মতি আদায় করে যে, ফিলিস্তিন দখল করে ব্রিটেন যদি ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, তবে তাতে সে আপত্তি জানাবে না। পরবর্তীতে ১৯২৪ সালে এই আবদুল আজিজ বিন সৌদকেই তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে। ১৯৪৮ সালে প্রত্যক্ষ্য ব্রিটিশ সহযোগীতায় ফিলিস্তিন দখল করে জন্ম হয় যায়নবাদী ইসরাইলের।

সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ বিন সৌদ ব্রিটেনকে যে দাসখত লিখে দিয়েছিলেন, তা ছিল এই:
আমি বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে আবদুর রহমান – ফয়সলের বংশধর ও সৌদের বংশধর – হাজারবার স্বীকার করছি ও জেনেশুনে বলছি যে, মহান ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি স্যার কুকাস-এর সামনে স্বীকারোক্তি করছি এই মর্মে যে, গরিব ইহুদিদেরকে বা অন্য কাউকে ব্রিটিশ সরকার যদি ‘ফিলিস্তিন’ দান করে দেন তাহলে এতে আমার কোনো ধরনের আপত্তি নেই। বস্তুতঃ আমি কিয়ামত পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের অভিমতের বাইরে যাব না।” (নাসিরুস সাইদ প্রণীত ‘আলে সৌদের ইতিহাস’)

কেন সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি ইসরাইলের বিরুদ্ধে মিছিল করা হারাম ফতোয়া দেন, কিংবা তাকফিরি ISIL কেন শুধু মুসলমানদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করে যাচ্ছে, অথচ জুলুমবাজ ইসরাইলের বিরুদ্ধে একটি গুলিও ছুঁড়ছে না, তা বুঝতে হলে এই ইতিহাসটি কাজে লাগবে। ১৯৮৭ সালে ফিলিস্তিনের পক্ষে আর ইসরাইল-আমেরিকার বিপক্ষে শ্লোগান দেয়া হাজিদের কেন তারা হত্যা করেছিল, তা বুঝতে হলেও এই ইতিহাস জানতে হবে।

৮. মুসলিম বিশ্ব নীরব

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বিগত একশত বছর যাবত সৌদি পেট্রোডলার দেশে দেশে ইসলামপন্থীদের কিনে নিয়েছে। এ কারণেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের সিংহভাগ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ইতিহাস খুব কমই আলোচিত হয়, খুব কম মানুষই জানে হিজাজের নাম পরিবর্তন করে সৌদি আরব প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। আজকে যখন মক্কায় হাজিদের হত্যাকাণ্ডে সৌদি সরকার ব্যাপকভাবে আলোচিত সমালোচিত হচ্ছে, তখন ইসলাম ও মুসলিমের মুখোশধারী শত্রু আলে সৌদের ইতিহাস জানানোর দায়বদ্ধতা অনুভব করছি।

সৌদি পেট্রোডলার এদেশের বড় বড় ইসলাপন্থী দল ও ব্যক্তিদের কিনে নিয়েছে, তাইতো আজকে আলে সৌদ যখন ইয়েমেনি ও সিরীয়দের হজ করতে বাধা দিচ্ছে, মসজিদুল হারামে রক্তপাত করছে, নিষিদ্ধ জিলহজ মাসে ইয়েমেনিদের হত্যা করছে, তখন আমাদের আলেম উলামা ও ধর্মীয় দলগুলো নীরব হয়ে রয়েছে! সৌদি পেট্রোডলারের কল্যাণে সোশ্যাল মিডিয়াতেও আমরা সৌদি অপকর্মের অনেক প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থক দেখতে পাচ্ছি; তারা বিশ্বের আর সব বিষয়ে উচ্চকিত কণ্ঠ হলেও ইহুদি-মার্কিন সেবাদাস আলে সৌদ যে হিজাজ দখল করে রেখেছে, এ বিষয়ে নীরব। তারা নীরব সৌদি রাজতন্ত্রের ব্যাপারেও, নীরব সৌদি বাদশাহদের অবৈধ ভোগবিলাসের ব্যাপারেও। তারা নীরব মজলুম ইয়েমেনিদের ব্যাপারে, নীরব তাকফিরি ISIL এর ব্যাপারে...। আজকে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র, ধর্মীয় দল ও ধর্মীয় ব্যক্তির "সিলেক্টিভ সচেতনতা” ও "সিলেক্টিভ অ্যাক্টিভিজম” এর কারণ কি, তা বুঝতে হলে সৌদি আরবের এই ইতিহাস জানতে হবে।

ইমাম খোমেনীর (র.) নেতৃত্বে স্বতঃস্ফূর্ত গণবিপ্লবের মাধ্যমে ১৯৭৯ সালে ইসলামী ইরান প্রতিষ্ঠা হলে ইহুদি-মার্কিন সেবাদাস সৌদি আরব নিজের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি অনুভব করতে শুরু করে। এ কারণেই শিশুরাষ্ট্র ইসলামী ইরানকে ধ্বংস করতে পশ্চিমা বিশ্বের সহায়তায় সাদ্দাম হোসেন ১৯৮০ সালে ইরান আক্রমণ করলে সৌদি আরব অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলোকে সাথে নিয়ে সাদ্দামকে সহায়তা করেছিল।

আজকে যখন ইয়েমেনে বিপ্লবী হুসিদের নেতৃত্বে স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলনে সৌদি তাঁবেদার সরকার উৎখাত হয়েছে, তখন সৌদি আরবের পেট্রোডলারে পুষ্ট ইসলামপন্থীরা বিশ্বব্যাপী একে "শিয়া ইরানের প্রভাব বিস্তার কৌশল” হিসেবে প্রচার করে আলে সৌদের আগ্রাসনকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন দিচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি বুঝতে হলে এই বিষয়গুলো জানতে হবে। যদিও পেট্রোডলারের কাছে নিজেদেরকে বিক্রি করে দিয়ে মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র/ ইসলামী দল/ ইসলামী ব্যক্তিত্ব নীরব হয়ে রয়েছে, তবুও ইরানের মত কিছু দেশ ও তাদের আলেমগণ নিজেদেরকে বিক্রি করে দেয়নি, ইহুদি-মার্কিন সেবাদাস হয়ে দাসখত লিখে দেয়নি। এ কারণেই বিপ্লবের অব্যবহিত পর থেকে ইসলামী ইরান ফিলিস্তিন ইস্যুতে সোচ্চার, প্রতিরোধ যোদ্ধা হামাসকে সর্বাধিক সাহায্য তারাই করে আসছে এবং আলে সৌদের পেট্রোডলারে প্রচারিত বিকৃত, রুক্ষ ওহাবী ইসলামের বিপরীতে সত্যিকার ইসলামের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তাই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ইসলামপন্থী ব্যক্তি ও দলকে যখন "শিয়া শিয়া" ধুয়া তুলে ইরানের বিরোধিতা করতে দেখি, তখন এর পিছনে পেট্রোডলারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হাতটি দেখতে অসুবিধা হয় না।

সাম্প্রতিক হাজি হত্যাকাণ্ডে সৌদি সরকারের মুখোশ যখন উন্মোচন হতে শুরু করেছে, হজ পরিচালনায় আলে সৌদের অযোগ্যতার কথা যখন মানুষের মুখে মুখে উঠে আসছে, তখন এটাকেও "শিয়া ইরানের মক্কা দখলের ষড়যন্ত্র” হিসেবে চিত্রায়িত করে সত্যকে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে। দুঃখজনক যে, এই কাজে লিপ্ত আমাদেরই ভাই, বন্ধু, আলেম-ওলামা ও ইসলামী ব্যক্তিত্বগণ।

৮. প্রতিক্রিয়া

সাম্প্রতিক হাজি হত্যাকাণ্ডের বিপরীতে ইরান সোচ্চার হয়েছে। সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছেন। অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতেও রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা প্রত্যাশিত ছিল, যদিও তা আসেনি। ইরানে আলে সৌদের এই হাজি হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। আর বিবেকের দায় থেকে অপ্রত্যাশিত অনেকেও প্রতিবাদ করছেন। ইরান এই হত্যাকাণ্ডের আন্তর্জাতিক বিচার দাবি করেছে। দাবি উঠেছে হজ পরিচালনাকে অযোগ্য আলে সৌদের হাত থেকে নিয়ে মুসলিম বিশ্বের হাতে সমর্পন করার।

নিঃসন্দেহে এটি যৌক্তিক দাবি। সৌদি আরবের মত বিলিয়ন ডলার ব্যয় না করেও বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমায় প্রতি বছর ২৫-৩০ লাখ লোক-সমাগম ঘটে, এবং খুব সুষ্ঠুভাবেই তা সম্পন্ন হয়। প্রতি বছর ইরাকের কারবালায় এর কয়েক গুণ বেশি মানুষের সমাগম ঘটে, সেটাও সুষ্ঠুভাবেই পরিচালিত হয়। ইজতেমা ও কারবালার লোকা-সমাগম হলো বড় বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার দুটি নজির মাত্র। এগুলো যখন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে বছরের পর বছর, তখন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেও সৌদি আরব কেন হজ পরিচালনায় ব্যর্থ হচ্ছে, তা একটি যৌক্তিক প্রশ্ন। আল্লাহর মেহমান হাজিদের প্রতি তাদের উদাসীনতা ও রক্তপাতের ইতিহাসকে সামনে আনলে বরং এটা গোটা মুসলিম উম্মাহর প্রাণের দাবি হওয়া উচিত যে, শুধু হজ পরিচালনা নয়, বরং মক্কা মদীনাকে আমেরিকা-ব্রিটেনের অনুগত আলে সৌদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করে গোটা মুসলিম বিশ্বের হাতে সমর্পন করা উচিত। আমি জানি এই যৌক্তিক দাবিকে অনেকেই "শিয়া ইরান কর্তৃক মক্কা মদীনা দখলের ষড়যন্ত্র” হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করবে, দেখবে। কিন্তু সেটা পেট্রোডলারের নেশার ঘোর। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে মানুষ সচেতন হবার সাথে সাথে এই নেশার ঘোর কেটে যাবে, মানুষ সচেতন হবেই এবং আল আকসা মুক্ত করার মত করেই মক্কা-মদীনা মুক্ত করার দাবি একদিন উঠবে, ইনশাআল্লাহ।

হারারা যুদ্ধ, 'ইয়াজিদ সেনারা মদীনায় ৩ দিন ধরে গণহত্যা ও গণ-ধর্ষণ'

1 Comment
১৩৭৩ চন্দ্র-বছর আগে কারবালার মহা-ট্র্যাজেডির দুই বছরেরও কম সময় পর ৬৩ হিজরির এই দিনে (২৮ জিলহজ) খোদাদ্রোহী ইয়াজিদের বাহিনী মদীনায় মসজিদে নববী ও রাসূল (সা.)’র রওজার অবমাননাসহ গণহত্যা এবং গণ-ধর্ষণের মত নানা মহাঅপরাধযজ্ঞে লিপ্ত হয়। ইয়াজিদের নর-পশু সেনারা পরে মক্কায়ও হামলা চালিয়ে পবিত্র কাবা ঘর ধ্বংস করেছিল।


নরপশু ইয়াজিদের নির্দেশে কুফায় নিযুক্ত তার গভর্নরের অনুগত সেনাদের হাতে বিশ্বনবী (সা.)’র প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর পরিবার-পরিজনসহ প্রায় ১০০ জন সঙ্গীর বেশিরভাগেরই কারবালায় শাহাদত বরণ করার  হৃদয়বিদারক এবং মহাবিয়োগান্তক ঘটনার খবর শুনে মদীনাবাসী ইয়াজিদের চরিত্র ও প্রকৃতি সম্পর্কে তদন্ত চালায়। তারা এ লক্ষ্যে দামেস্কে একটি তদন্ত-টিম পাঠায়।  তদন্ত-টিম তাকে ইসলামী মূল্যবোধ-শূন্য  ও একজন নৈতিক চরিত্রহীন ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখতে পায়। ইমাম হুসাইন (আ.) এবং তাঁর মহান বিপ্লব ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের সহযোগিতা করতে না পারার জন্য মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে গণ-অনুশোচনা ক্রমেই জোরদার হতে থাকে।
এ অবস্থায় মদীনাবাসী তাদের শহর থেকে ইয়াজিদের নিযুক্ত গভর্নরকে বের করে দেয় এবং ইয়াজিদের অনৈসলামী শাসনকে বৈধ শাসন হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে। ফলে মহাপাপিষ্ঠ ইয়াজিদ সিরিয়া থেকে  কুখ্যাত মুসলিম বিন উকবার নেতৃত্বে ১০ হাজার সেনা পাঠায়। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফও ছিল এই সেনাবাহিনীর এক সাধারণ সেনা। (হাজ্জাজ পরবর্তীকালে উমাইয়া শাসক হয়েছিল এবং হাজার হাজার সাহাবীকে হত্যা করেছিল।)

উকবা মদীনার উত্তর-পূর্ব দিকে হাররা অঞ্চলে মদীনার প্রতিরোধকামীদের ওপর হামলা চালায়। অস্ত্রে সুসজ্জিত উমাইয়ারা বিপুল সংখ্যক মুজাহিদকে হত্যার পর শহরের ভেতরেও প্রতিরোধকামীদের ওপর নৃশংস হামলা চালিয়ে তাদের শহীদ করে। এমনকি যারা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ(সা.)’র পবিত্র মসজিদে ও তাঁর পবিত্র মাজার বা রওজায় আশ্রয় নিয়েছিল তাদেরকেও নির্মমভাবে শহীদ করেছিল ইয়াজিদের পাষণ্ড সেনারা। বিশ্বনবী (সা.)’র বহু সাহাবীসহ ৭০০ জন গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব শহীদ হয় তাদের হামলায়। ইয়াজিদের সেনারা মদীনায় অন্তত ১০ হাজার মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে। এরপর উকবার নির্দেশে তার নেতৃত্বাধীন ইয়াজিদের সেনারা তিন দিন ধরে মদীনা লুট-তরাজ করে এবং নারীদের সম্ভ্রমহানি করে। তারা মদিনার মসজিদে নববীকে ঘোড়ার আস্তাবল বানায় এবং ঘোড়ার মলমূত্রে অবমাননা করা হয় মুসলিম বিশ্বের পবিত্রতম এই স্থানের।এরপর এই  অভিশপ্ত সেনাদল মক্কার দিকে যায় এবং এমনকি পবিত্র কাবা ঘরেও হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করেছিল।

মদীনায় নারীদের ওপর ইয়াজিদ-সেনাদের গণ-ধর্ষণ বা পালাক্রমিক ধর্ষণের পরিণতিতে এক হাজারেরও বেশি অবৈধ সন্তান জন্ম নিয়েছিল এবং তাদের বাবা কে ছিল তা সনাক্ত করার কোনো উপায় ছিল না। ইতিহাসে এদেরকে ‘হাররা বিদ্রোহের সন্তান’বলে উল্লেখ করা হত। হাররার যুদ্ধ বা হাররার গণহত্যা নামে পরিচিত এই ঘটনা বহু বছর ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে স্মরণ করা হয়েছে।

অনেকেই বলেন এইসব অবৈধ সন্তান ও তাদের পিতামাতাদের অজুহাত দেখিয়েই বিতর্কিত ওয়াহাবী মতবাদের নানা ধারণার পক্ষে, বিশেষ করে কবর-জিয়ারত এবং মৃতের জন্য দোয়া ও কুরআনের সুরা পড়া নিষিদ্ধের যুক্তি দেখানো হয় ।
উল্লেখ্য, ইয়াজিদ মক্কা ও কাবা ঘরে হামলার ঘটনার পর পরই মারা যায়।
অনেকের মনেই এ প্রশ্ন জাগে যে ৬৩ হিজরির মধ্যেই মুসলমানদের এত দুর্দশা কেন ঘটেছিল? মুসলমানদের মধ্যে কি মুনাফিকদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পেয়েছিল?
বলা হয়ে থাকে, কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ.) ও তার মহান সঙ্গীরা যখন শাহাদত বরণ করেন তখন ইয়াজিদ খুশি হয়ে একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিল যেখানে সে স্পষ্টভাবে এটা উল্লেখ করে যে " হুসাইনকে হত্যার মাধ্যমে আমরা উমাইয়ারা মুহাম্মাদকেই হত্যা করেছি এবং বদর, উহদ ও খন্দকের প্রতিশোধ নিয়েছি।" আসলে বনি উমাইয়াদের অনেকেই কেবল মুখে মুখে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। বিভিন্ন জিহাদে, বিশেষ করে বদর, উহুদ ও খন্দকে আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)'র হাতে ততকালীন কাফিরদের বড় বড় ব্যক্তিত্বরা নিহত হওয়ায় এবং তাদের অনেকেই বনি উমাইয়া গোত্রের লোক ছিল বলে সেই বংশীয় বা গোত্রীয় ক্ষোভ তাদের মধ্যে সুপ্ত ছিল। উমাইয়াদের অনেকেই বা বেশিরভাগই মক্কা বিজয়ের পর শক্তিহীন হয়ে পড়ায় প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে টিকে থাকার আশায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। তাদের জন্য এ ছাড়া অন্য কোনো উপায়ও ছিল না। আবু সুফিয়ানসহ অনেক উমাইয়া ব্যক্তিত্ব ইসলামের সঙ্গে শত্রুতায় সবচেয়ে অগ্রণী ছিল। তাই তারা ভেতর থেকেই ইসলামের ওপর আঘাত হানার দীর্ঘ মেয়াদী ষড়যন্ত্র করে যাতে এক সময় মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব তাদের হাতেই চলে আসে।

ইসলামী বর্ণনায় এসেছেকোনো এক সময় মহানবী (সা.) স্বপ্নে দেখেন যে, বনী উমাইয়্যা তাঁর মিম্বরে বানরের মত নাচানাচি করছে। এ স্বপ্ন দেখে তিনি এমনই শোকাহত হলেন যে, এরপর যতদিন বেঁচে ছিলেন তিনি আর হাসেননি। তাঁর এই স্বপ্ন দেখার পর পবিত্র কুরআনের সুরা বনি ইসরাইলের ৬০ নম্বর আয়াত নাজেল হয়েছিল। ওই আয়াতে বলা হয়েছে:

 “এবং (স্মরণ কর) যখন আমরা তোমাকে বলেছিলাম যে, নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক মানুষকে পরিবেষ্টন করে আছেন এবং আমরা তোমাকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম  তা কেবল মানুষের জন্য পরীক্ষার মাধ্যম ছিল এবং কুরআনে বর্ণিত অভিশপ্ত বৃক্ষটিও। আমরা মানুষকে ভীতি প্রদর্শন করতে থাকি, কিন্তু তা তাদের চরম ঔদ্ধত্যকেই কেবল বৃদ্ধি করে।”  তাফসিরে তাবারিসহ কয়েকটি সুন্নি সূত্রমতে, কুরআনে উল্লিখিত ওই “অভিশপ্ত বৃক্ষ”বলতে আবু সুফিয়ানের বংশধর তথা উমাইয়াদের বোঝানো হয়েছে এবং রাসূল (সা.) স্বপ্নে তাঁর মিম্বরে বানরদের নাচানাচির যে ঘটনাটি দেখেছিলেন তার অর্থ উমাইয়াদের মাধ্যমে খেলাফত দখল করা হবে।

Monday, 14 September 2015

হুদায়বিয়ার সন্ধি: ইসলামের মহাবিজয় ও শান্তিকামীতার সাক্ষ্য

0 Comments
ষষ্ঠ হিজরী সাল তিক্ত-মিষ্ট নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে আসছিল। হঠাৎ এক রাতে মহানবী (সা.) একটি সুন্দর স্বপ্নে দেখলেন, মুসলমানরা মসজিদুল হারামে (পবিত্র কাবাঘরের চারদিকে) হজ্বের আনুষ্ঠানিকতাগুলো পালন করছে। তিনি এ স্বপ্নের কথা তাঁর সাথীদের বললেন এবং একে একটি শুভ আলামত মনে করে বললেন, খুব শিগগিরই মুসলমানরা তাদের মনের আশা পূরণে সক্ষম হবে। 

কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি মুসলমানদের উমরার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিলেন এবং মদীনার আশে-পাশের যেসব গোত্র তখনও মূর্তিপূজক ছিল, তাদেরও আহ্বান জানালেন মুসলমানদের সফরসঙ্গী হতে। এ খবর হিজাযের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল যে, মুসলমানরা যিলকদ মাসে উমরার উদ্দেশ্যে মক্কায় যাচ্ছে।

এই আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় সফরের আত্মিক ও নৈতিক কল্যাণের দিক ছাড়াও সামাজিক ও রাজনৈতিক কল্যাণের দিকও ছিল এবং তা সমগ্র আরবোপদ্বীপে মুসলমানদের অবস্থানকে সুদৃঢ়করণ ও হিজাযের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে একত্ববাদী ধর্ম ইসলাম প্রচারের জন্য সহায়ক ছিল। কারণ :

প্রথমত আরবের মূর্তিপূজক নানা গোত্র ভাবত, মহানবী (সা.) তাদের সকল ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের বিরোধী, এমনকি তাদের অন্যতম প্রাচীন আচার হজ্ব ও উমরারও তিনি বিরোধী। এ কারণে তারা রাসূল (সা.) ও তাঁর প্রচারিত ধর্মের প্রতি ভীত ছিল। তাই এমন মুহূর্তে রাসূল (সা.) ও তাঁর সঙ্গীদের উমরা পালনে যাত্রার ঘোষণায় তাদের ঐ ভয় খানিকটা দূর হলো। মুহাম্মদ (সা.) কর্মক্ষেত্রে ব্যবহারিকভাবে দেখিয়ে দিতে চাইলেন তিনি আল্লাহর ঘরের যিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা ও একে কেন্দ্র করে আবর্তিত ধর্মীয় আচার ও অন্যান্য স্মৃতিচি‎‎হ্নগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিরোধী তো ননই; বরং এরূপ কাজকে ফরয মনে করেন এবং আরবদের আদি পিতা হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর ন্যায় এর সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবনে সচেষ্ট। যারা ইসলামকে তাদের সব ধর্মীয় ও জাতীয় আচার-অনুষ্ঠানের একশ’ ভাগ বিরোধী মনে করত, মুহাম্মদ (সা.) চেয়েছিলেন ঐ সব দল ও গোষ্ঠীকে এভাবে আকর্ষণ করতে ও তাদের মন থেকে ভয় দূর করতে।

দ্বিতীয়ত এভাবে যদি মুসলমানরা শত-সহস্র আরব মুশরিকের সামনে সফলতার সাথে ও স্বাধীনভাবে মসজিদুল হারামে উমরা পালনে সক্ষম হন, তা হলে তা ইসলামের পক্ষে প্রচারের এক বিরাট সুযোগ এনে দেবে। কারণ এ সময়ে আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুশরিকরা মুসলমানদের খবর তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে নিয়ে যাবে। ফলে যেসব স্থানে ইসলামের আহ্বান পৌঁছানো মহানবী (সা.)-এর পক্ষে সম্ভব ছিল না বা তাঁর পক্ষে কাউকে প্রচারক হিসেবে পাঠানো সম্ভব হয়ে ওঠে নি, সেখানেও তাঁর বাণী পৌঁছে যাবে। অন্ততপক্ষে এর প্রভাব কার্যকর হবে।

তৃতীয়ত মুহাম্মদ (সা.) যাত্রার পূর্বে মদীনায় অবস্থানকালেই হারাম মাসগুলোর  কথা স্মরণ করে বলেন : “আমরা শুধুই আল্লাহর ঘর যিয়ারতে যাব।” তাই সফরের সময় বহনের জন্য  আরবদের মধ্যে প্রচলিত একটি তরবারি ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র সঙ্গে না নেয়ার জন্য মুসলমানদের নির্দেশ দিলেন। এ নির্দেশের ফলে অনেকেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হলো। কারণ, আরবের মুশরিকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চালাতো যে, তিনি কোন আরব রীতি মানেন না, তারা দেখল, রাসূলও অন্যদের মতো এ মাসগুলোতে যুদ্ধকে হারাম মনে করেন ও এই প্রাচীন রীতিকে সমর্থন করেন।

ইসলামের মহান কাণ্ডারী জানতেন, এ পদ্ধতিতে মুসলমানরা সফলতা লাভ করলে তাদের বহু প্রতীক্ষিত একটি লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হবে। তা ছাড়া জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত এ দল নিজ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু ও সুহৃদদের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ পাবে। আর কুরাইশরা মক্কায় প্রবেশে মুসলমানদের বাধা দিলে সমগ্র আরবোপদ্বীপের গোত্রগুলোর কাছে অসম্মানিত হবে। কারণ আরবের সাধারণ নিরপেক্ষ গোত্রগুলোর আগত প্রতিনিধিরা দেখবে আল্লাহর ঘরের উদ্দেশে ফরয হজ্ব করতে আসা একদল নিরস্ত্র হাজীর সঙ্গে কুরাইশরা কিরূপ আচরণ করেছে; অথচ মসজিদুল হারামের ওপর সব আরবের অধিকার রয়েছে এবং কুরাইশরা কেবল তার তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে রয়েছে।

এর ফলে মুসলমানদের সত্যতার সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটবে এবং কুরাইশদের অবৈধ শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি তারা বুঝতে পারবে। ফলে কুরাইশরা ইসলামের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে তাদেরকে সঙ্গী ও চুক্তিবদ্ধ করতে পারবে না। কারণ তারা হাজার হাজার লোকের সামনেই মুসলমানদের বৈধ অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।

মহানবী (সা.) বিষয়টির নানা দিক চিন্তা করে উমরার জন্য যাত্রার নির্দেশ দিলেন। চৌদ্দ হাজার , ষোল  হাজার অথবা আঠারো হাজার , হজ্বযাত্রী ‘যুল হুলাইফা’ নামক স্থানে ইহরাম বাঁধলেন। তাঁরা কুরবানীর জন্য সত্তরটি উট সঙ্গে নিলেন এবং উটগুলোকে কোরবানীর জন্য চিহ্নিত করে সবার কাছে নিজেদের সফরের উদ্দেশ্য বর্ণনা করলেন।
রাসূল (সা.) কয়েকজন সংবাদবাহককে আগেই সংবাদ সংগ্রহের জন্য পাঠালেন যাতে কোনো শত্রু দেখলে তারা তাঁর কাছে দ্রুত সংবাদ পৌঁছান।

আসফান’ থেকে রাসূলের পাঠানো সংবাদবাহক সংবাদ নিয়ে এলেন :
কুরাইশরা আপনাদের আগমন সম্পর্কে জানতে পেরেছে এবং তাদের সৈন্যদের প্রস্তুত করে লাত ও ওজ্জার (দেবতার মূর্তি) শপথ করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে যে, আপনাকে কোনক্রমেই মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না। কুরাইশের শীর্ষস্থানীয় নেতা ও ব্যক্তিরা মক্কার নিকটবর্তী ‘যিতুয়া’য় সমবেত হয়েছে এবং মুসলমানদের অগ্রযাত্রা রোধ করতে তাদের সাহসী যোদ্ধা খালিদ ইবনে ওয়ালীদকে দু’ শ’ সৈন্যসহ আসফানের আট মাইল দূরের ‘কারাউল গামীম’-এ নিয়োজিত করেছে।  তাদের উদ্দেশ্য মুসলমানদের গতিরোধ করা, এমনকি যদি এতে তাদের নিহতও হতে হয়।”
মহানবী (সা.) এ সংবাদ শুনে বললেন : “কুরাইশদের জন্য আফসোস! যুদ্ধ তাদের শেষ করে দিয়েছে। হায়! যদি কুরাইশরা আরবের মূর্তিপূজক গোত্রগুলোর সঙ্গে আমাকে মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ দিত! সেক্ষেত্রে ঐ গোত্রগুলো আমার ওপর বিজয়ী হলে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতো, আর আমি তাদের ওপর বিজয়ী হলে হয় তারা ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নিত, নতুবা তারা তাদের বিদ্যমান শক্তি নিয়ে আমার সাথে যুদ্ধ করত। আল্লাহর শপথ! একত্ববাদী এ ধর্মের প্রচারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাব। হয় এতে আল্লাহ্ আমাদের বিজয়ী করবেন, নতুবা তাঁর পথে প্রাণ বিসর্জন দেব।” এরপর একজন অভিজ্ঞ পথপ্রদর্শককে ডেকে এমনভাবে কাফেলাকে নিয়ে যেতে বললেন যাতে খালিদের সেনাদলের মুখোমুখি না হতে হয়। আসলাম গোত্রের একজন দিশারী কাফেলা পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেছিলেন। তিনি এক দুর্গম উপত্যকা দিয়ে কাফেলাকে অতিক্রম করিয়ে ‘হুদায়বিয়া’য় পৌঁছলে মহানবী (সা.)-এর উট মাটিতে বসে পড়ল। মহানবী (সা.) বললেন : “এ উট আল্লাহর নির্দেশে এখানে বসে পড়েছে। এখানেই আমাদের করণীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে।” এরপর সবাইকে বাহন হতে নেমে তাঁবু স্থাপনের নির্দেশ দিলেন।

সময় না গড়াতেই কুরাইশ অশ্বারোহী সেনারা রাসূল (সা.)-এর নতুন পথ সম্পর্কে জানতে পেরে তাঁর অবস্থান গ্রহণের স্থানের কাছে চলে আসে। মহানবী (সা.) যাত্রা স্থগিত না করে অগ্রযাত্রার সিদ্ধান্ত নিলে অবশ্যই কুরাইশ সৈন্যদের রক্ষণব্যূহ ভেদ করে যেতে হতো। সেক্ষেত্রে তাদের হত্যা করে রক্তের ওপর দিয়ে পথ অতিক্রম করতে হতো। অথচ সবাই জানত রাসূল (সা.) উমরা ও কাবা ঘর যিয়ারত ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে আসেন নি। তাই এ রকম কিছু ঘটলে মহানবীর ব্যক্তিত্ব ও শান্তিকামী চরিত্রের ভাবমর্যাদার ওপর আঘাত আসত। উপরন্তু আগত ঐ সৈন্যদের হত্যার মাধ্যমেই ঘটনার যবনিকাপাত ঘটতো না। কারণ সাথে সাথেই একের পর এক নতুন সেনাবাহিনী তাঁদের প্রতিরোধের জন্য আসত এবং তা অব্যাহত থাকত। অন্যদিকে মুসলমানরা তরবারি ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র সঙ্গে নেন নি। এ অবস্থায় যুদ্ধ করা কখনোই কল্যাণকর হতো না। তাই আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান বাঞ্ছনীয় ছিল।
এ কারণেই বাহন হতে নামার পর মহানবী (সা.) তাঁর সঙ্গীদের উদ্দেশে বলেন : “যদি আজ কুরাইশরা আমার কাছে এমন কিছু চায় যা তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক দৃঢ় করে, তবে আমি অবশ্যই তা দেব এবং সমঝোতার পথকেই বেছে নেব।”
সবাই রাসূল (সা.)-এর কথা শুনলেন এবং শত্রুদের কানেও তা পৌঁছল। তারা রাসূলের চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কে জানার সিদ্ধান্ত নিল। তাই কয়েকজনকে তাঁর কাছে পাঠাল তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানার জন্য।
রাসূল (সা.) সকাশে কুরাইশ প্রতিনিধিদল
কুরাইশরা কয়েক দফায় রাসূলের কাছে বিভিন্ন ব্যক্তিকে পাঠিয়ে তাঁর সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইল।

সর্বপ্রথম বুদাইল খাযায়ী তার গোত্রের কয়েকজনকে নিয়ে রাসূলের কাছে এল। মহানবী (সা.) তাদের বললেন : “আমি যুদ্ধের জন্য আসি নি; বরং আল্লাহর ঘর যিয়ারতে এসেছি।” প্রতিনিধিদল কুরাইশ নেতাদের কাছে ফিরে গিয়ে প্রকৃত ঘটনা খুলে বলল। কিন্তু কুরাইশরা তাদের কথা সহজে বিশ্বাস করতে পারল না। তাই তারা বলল : “আল্লাহর শপথ! আমরা তাকে কোন অবস্থায়ই মক্কায় প্রবেশ করতে দেব না, এমনকি যদি সে উমরাও করতে আসে।”

দ্বিতীয় বার কুরাইশদের পক্ষ থেকে ‘মুকরিজ’ নামের এক ব্যক্তি রাসূলের সাথে সাক্ষাৎ করল। সেও কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে বুদাইলের অনুরূপ প্রতিবেদন দিল। কিন্তু কুরাইশরা তাদের দু’জনের কথাই বিশ্বাস করল না। তৃতীয়বার আরবের তীরন্দাজ বাহিনীর নেতা হুলাইস ইবনে আলকামাকে দ্বন্দ্ব-সংশয় অবসানের লক্ষ্যে রাসূলের কাছে পাঠালো।  তাকে দূর থেকে দেখেই রাসূল (সা.) মন্তব্য করলেন :
এই ব্যক্তি আল্লাহর পরিচয় লাভকারী পবিত্র এক গোত্রের মানুষ। তার সামনে কুরবানীর জন্য আনা উটগুলো ছেড়ে দাও যাতে সে বুঝতে পারে আমরা যুদ্ধ করতে আসি নি। উমরা করা ছাড়া আমাদের আর কোন উদ্দেশ্য নেই।” এই শীর্ণ সত্তরটি উটের উপর হুলাইসের দৃষ্টি পড়লে সে দেখল সেগুলো খাদ্যাভাবে শুকিয়ে গেছে এবং একে অপরের লোম ছিঁড়ে খাচ্ছে। সে মহানবীর সঙ্গে দেখা না করেই যত দ্রুত সম্ভব কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে বলল : “আমরা তোমাদের সাথে এ শর্তে কখনোই চুক্তিবদ্ধ হই নি যে, আল্লাহর ঘরের যিয়ারতকারীদের বাধা দেবে। মুহাম্মদ যিয়ারত ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আসেন নি। যে খোদার হাতে আমার জীবন, তাঁর শপথ! যদি মুহাম্মদকে প্রবেশে বাধা দাও, তা হলে আমি আমার গোত্রের সব লোক (যাদের অধিকাংশই তীরন্দাজ) নিয়ে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করব।”
হুলাইসের কথায় কুরাইশরা ভীত হলো এবং চিন্তা করে তাকে বলল :“শান্ত হও। আমরা এমন পথ অবলম্বন করব, যাতে তুমি সন্তুষ্ট হও।”
অবশেষে তারা বুদ্ধিমান, সমঝদার ও তাদের কল্যাণকামী উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফীকে মহানবী (সা.)-এর কাছে পাঠাল। সে প্রথমে কুরাইশদের প্রতিনিধি হিসেবে যেতে রাজী হয় নি। কারণ সে লক্ষ্য করেছে, পূর্ববর্তী প্রতিনিধিদের তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে ও তাদের বিশ্বাস না করে মানহানি ঘটিয়েছে। কিন্তু কুরাইশরা তাকে আশ্বস্ত করল এই বলে যে, তাদের কাছে তার বিশেষ সম্মান রয়েছে এবং তাকে তারা বিশ্বাসঘাতকতার অপবাদ দেবে না।
উরওয়া ইবনে মাসউদ রাসূল (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বলল : “বিভিন্ন দলকে নিজের চারদিকে সমবেত করেছ এ উদ্দেশ্যে যে, নিজ জন্মভূমি (মক্কা) আক্রমণ করবে? কিন্তু জেনে রাখ, কুরাইশরা তাদের সমগ্র শক্তি নিয়ে তোমার মোকাবেলা করবে এবং কোন অবস্থায়ই তোমাকে মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না। কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছি, তোমার চারপাশে সমবেত এরা তোমাকে একা ফেলে পালিয়ে না যায়!”

তার এ কথা বলার সময় মহানবীর পেছনে দাঁড়িয়ে প্রথম খলিফা আবূ বকর বললেন : “তুমি ভুল করছ। মহানবী (সা.)-এর সঙ্গীরা কখনোই তাঁকে ছেড়ে যাবে না।” উরওয়া মুসলমানদের মানসিক শক্তি দুর্বল করার জন্য কূটনৈতিক চাল চালছিল। সে কথা বলার সময় মহানবীকে (স) অসম্মান করার লক্ষ্যে বারবার তাঁর পবিত্র দাড়ি মুবারকে হাত দিচ্ছিল। অন্যদিকে মুগীরা ইবনে শু’বা প্রতিবারই তার হাতে আঘাত করে সরিয়ে দিচ্ছিলেন ও বলছিলেন : “সম্মান ও আদব রক্ষা করে আচরণ কর। মহানবীর সাথে বেয়াদবী করো না।” উরওয়া ইবনে মাসউদ রাসূলকে প্রশ্ন করল : “এই ব্যক্তিটি কে?” (সম্ভবত রাসূলের চারদিকে যাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা মুখ ঢেকে রেখেছিলেন)। মহানবী (সা.) বললেন : “সে তোমার ভ্রাতুষ্পুত্র শুবা’র পুত্র মুগীরা।” উরওয়া রাগান্বিত হয়ে মুগীরাকে বলল : “হে চালবাজ প্রতারক! আমি গতকাল তোর সম্মান কিনেছি (রক্ষা করেছি)। তুই ইসলাম গ্রহণের পর সাকীফ গোত্রের তের জনকে হত্যা করেছিস। আমি সাকীফ গোত্রের সঙ্গে যুদ্ধ করা থেকে রক্ষা পেতে সবার রক্তপণ শোধ করেছি।” মহানবী তার কথায় ছেদ টেনে তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বর্ণনা দিলেন যেমনটি পূর্ববর্তী প্রতিনিধিদের কাছে দিয়েছিলেন। এরপর উরওয়ার এতক্ষণের কথার দাঁতভাঙা জবাব দিতে উঠে ওযূ করতে গেলেন। উরওয়া লক্ষ্য করল মহানবীর ওযূর পানি মাটিতে পড়ার আগেই কাড়াকাড়ি করে মুসলমানরা তা নিয়ে নিচ্ছেন। উরওয়া সেখান থেকে উঠে কুরাইশদের সমাবেশস্থল ‘যি তুয়া’র দিকে যাত্রা করল। কুরাইশদের বৈঠকে প্রবেশ করে রাসূলের আসার উদ্দেশ্য ও সাক্ষাতের বিবরণ পেশ করল। এরপর বলল : “আমি বড় বড় রাজা-বাদশা দেখেছি। ক্ষমতাবান সম্রাট, যেমন পারস্য ও রোম সম্রাট, আবিসিনিয়ার বাদশাহ, সবাইকে দেখেছি। কিন্তু নিজ অনুসারী ও ভক্তদের মাঝে মুহাম্মদের মতো সম্মানের অধিকারী কাউকে দেখি নি। আমি দেখেছি তাঁর অনুসারীরা তাঁর ওযূর পানি মাটিতে পড়ার আগেই বরকত লাভের উদ্দেশ্যে তা ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে। যদি তাঁর কোন চুল বা লোমও মাটিতে পড়ে, তারা তা ত্বরিৎগতিতে তুলে নিচ্ছে। তাই তাঁর বিপজ্জনক মর্যাদাকর অবস্থান সম্পর্কে কুরাইশদের চিন্তা করা উচিত।”
মহানবী (সা.)-এর প্রতিনিধি প্রেরণ

বিশ্ব মুসলিমের নেতা মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে কুরাইশ প্রতিনিধি দলগুলোর বৈঠক সফলতা লাভ করে নি। তাই স্বাভাবিকভাবে মহানবীর ভাববার সম্ভাবনা ছিল, কুরাইশদের প্রেরিত প্রতিনিধি সঠিকভাবে তথ্য পৌঁছাতে সক্ষম হয় নি বা কেউ কেউ সঠিক তথ্য সেখানে পৌঁছাক, তা চায় নি কিংবা মিথ্যুক বলে অভিযুক্ত হওয়ার ভয়ে স্পষ্টভাবে বক্তব্য উপস্থাপন থেকে বিরত থেকেছে। এদিক চিন্তা করে মহানবী সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি পৌত্তলিক দলের নেতাদের কাছে পাঠিয়ে তাঁর উদ্দেশ্য যে উমরা করা ছাড়া অন্য কিছু নয়, তা জানিয়ে দেবেন।
তিনি খাযায়া গোত্রের একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে এ কাজের জন্য মনোনীত করলেন। তাঁর নাম খিরাশ ইবনে উমাইয়্যা। মহানবী (সা.) তাঁকে একটি উট দিয়ে কুরাইশদের কাছে যেতে বললেন। তিনি কুরাইশদের কাছে গিয়ে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলেন। কিন্তু কুরাইশরা কোন দূতের প্রতি সম্মানজনক আচরণের বিশ্বজনীন নীতি অনুসরণের বিপরীতে তাঁর উটটিকে হত্যা করল ও তাঁকেও হত্যা করতে উদ্যত হলো। কিন্তু তীরন্দাজ আরবরা কুরাইশদের এ কাজ থেকে নিবৃত্ত করল। এ কাজের মাধ্যমে কুরাইশরা প্রমাণ করল, তারা শান্তি, সন্ধি ও সমঝোতার পথ অবলম্বন করতে রাজী নয়; বরং যুদ্ধ বাঁধানোর চিন্তায় রয়েছে।
এ ঘটনার পরপরই কুরাইশদের প্রশিক্ষিত ৫০ যুবক মুসলমানদের অবস্থানের কাছে মহড়া দেয়ার দায়িত্ব পেল। সে সাথে সুযোগ পেলে মুসলমানদের সম্পদ লুট করে তাঁদের কয়েকজনকে বন্দী করে কুরাইশদের কাছে নিয়ে যেতেও তাদেরকে বলা হয়েছিল। কিন্তু তাদের এ পরিকল্পনা ব্যর্থ তো হলোই; বরং তারা সবাই মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়ে রাসূলের সামনে আনীত হলো। বন্দী হওয়ার আগে তারা মুসলমানদের উদ্দেশে তীর ও পাথর ছোঁড়া সত্বেও মহানবী (সা.) তাঁর শান্তিকামী মনোভাব প্রমাণ করতে তাদের সবাইকে মুক্তি দেয়ার নির্দেশ দিলেন এবং বুঝিয়ে দিলেন, তিনি যুদ্ধ করতে আসেননি।

মহানবী (সা.) দ্বিতীয় বারের মতো প্রতিনিধি পাঠালেন। এতকিছু সত্বেও তিনি সন্ধি ও সমঝোতার বিষয়ে নিরাশ হলেন না এবং সংলাপের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে এবং কুরাইশ নেতাদের মতের পরিবর্তন ঘটাতে চাইলেন। তিনি এমন এক ব্যক্তিকে মনোনীত করলেন কুরাইশদের রক্তে যার হাত রঞ্জিত হয়নি। তাই হযরত আলী, যুবাইরসহ ইসলামের যে সব মহাসৈনিক আরব ও কুরাইশদের মহাবীরদের মুখোমুখি হয়ে তাদের অনেককে হত্যা করেছেন, তাঁদেরকে মনোনীত করা সমীচীন মনে করলেন না। এজন্য তিনি সর্বপ্রথম দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনে খাত্তাবের কথা চিন্তা করলেন। কারণ তিনি সেদিন পর্যন্ত কোন কুরাইশের এক ফোঁটা রক্তও ঝরান নি। কিন্তু উমর এ দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে অজুহাত দেখিয়ে বললেন : “আমি আমার জীবনের বিষয়ে কুরাইশদের হতে শঙ্কিত এবং মক্কায় আমার কোন নিকটাত্মীয়ও নেই যে আমার পক্ষাবলম্বন করে আমাকে তাদের হাত থেকে বাঁচাবে। তাই আমি এমন এক ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করছি, যিনি এই দায়িত্ব পালনে সক্ষম। তিনি হলেন উসমান ইবনে আফ্ফান। যেহেতু তিনি উমাইয়্যা বংশের লোক এবং আবূ সুফিয়ানের নিকটাত্মীয়, সেহেতু তিনি আপনার বাণী কুরাইশদের কাছে পৌঁছানোর জন্য বেশি উপযুক্ত।” ফলে ভবিষ্যৎ তৃতীয় খলিফা উসমান ইবনে আফ্ফান এ কাজের দায়িত্ব পেলেন এবং মক্কার দিকে রওয়ানা হলেন। তিনি পথিমধ্যে আবান ইবনে সাঈদ ইবনে আসের সাক্ষাৎ পেলেন এবং তার আশ্রয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন। আবান প্রতিশ্রুতি দিল, কেউ  তাঁর ক্ষতি করবে না এবং সে তাঁকে নিরাপদে কুরাইশদের কাছে নিয়ে যাবে যাতে তিনি রাসূলের বাণী পৌঁছাতে পারেন। কিন্তু কুরাইশরা রাসূলের বাণী শুনে বলল : “আমরা শপথ করেছি মুহাম্মদকে জোরপূর্বক মক্কায় প্রবেশ করতে দেব না। এ শপথের ফলে সংলাপের মাধ্যমে তাকে মক্কায় প্রবেশ করতে দেয়ার পথ রুদ্ধ হয়েছে।” এরপর তারা  উসমানকে কাবা ঘর তাওয়াফের অনুমতি দিল। কিন্তু তিনি রাসূলের সম্মানে তা থেকে বিরত থাকলেন। কুরাইশরা আরো যা করল, তা হলো তৃতীয় খলিফা উসমানকে ফিরে যেতে দিল না। সম্ভবত তারা চাইল তাঁর যাত্রা বিলম্বিত করে কোন উপায় বের করতে।
বাইয়াতে রিদওয়ান

মহানবী (সা.)-এর প্রেরিত প্রতিনিধির ফিরতে বিলম্ব হওয়ায় মুসলমানদের মধ্যে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হলো এবং তাঁরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। হঠাৎ উসমানের নিহত হওয়ার সংবাদ মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল এবং তাঁরা প্রতিশোধের জন্য গর্জে উঠলেন। মহানবী (সা.) তাদের এই পবিত্র ও উজ্জীবিত চেতনাকে ধারণ ও দৃঢ় করার জন্য তাঁদের উদ্দেশে বললেন: “চূড়ান্ত কিছু না করা পর্যন্ত আমি এখান থেকে যাব না।” যেহেতু সে মুহূর্তে মুসলমানরা সমূহ বিপদের আশংকা করছিলেন এবং এজন্য তাঁরা যুদ্ধের মনোভাব নিয়ে সমবেত হয়েছিলেন, সেহেতু মহানবী (সা.) সিদ্ধান্ত নিলেন মুসলমানদের সাথে তাঁর প্রতিশ্রুত শপথ নবায়ন করবেন। তাই নতুনভাবে তাঁদেরকে তাঁর সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করার লক্ষ্যে একটি গাছের নিচে বসলেন এবং সকল সঙ্গীকে বাইয়াত (প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার জন্য শপথ) নেয়ার জন্য তাঁর হাতে হাত রাখতে আহ্বান জানালেন। তাঁরা রাসূলের হাতে হাত রেখে শপথ করলেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত ইসলামের প্রতিরক্ষায় নিবেদিত থাকবেন। এটিই সেই ঐতিহাসিক ‘বাইয়াতে রিদওয়ান’, যা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে :
لقد رضى الله عن المؤمنين إذ يُبايعونك تحت الشّجرة فعلم ما فِى قلوبِهم فأنزل السّكينة عليهم و أثابَهم فتحا قريبا
আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন, যখন তারা গাছের নিচে আপনার কাছে শপথ করল। আল্লাহ্ অবগত ছিলেন, যা তাদের অন্তরে ছিল। অতঃপর তিনি তাদের ওপর প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে পুরস্কার দিলেন আসন্ন বিজয়।” (সূরা ফাত্হ : ১৮)
বাইয়াত সম্পন্ন হওয়ার পর মুসলমানরা তাঁদের করণীয় সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন। হয় কুরাইশরা তাঁদের আল্লাহর ঘরে যাওয়ার পথ খুলে দেবে, নতুবা তাঁরা মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করবেন। মহানবী (সা.) উসমানের আগমনের প্রতীক্ষায় ছিলেন। হঠাৎ তিনি ফিরে এলেন। এটি সন্ধির সবুজ সংকেত দিল। তিনি কুরাইশদের অবস্থান সম্পর্কে রাসূল (সা.)-কে বললেন : “কুরাইশদের সমস্যা হলো তারা আল্লাহর নামে শপথ করেছে। তাই এ সমস্যার সমাধানের জন্য তাদের প্রতিনিধি আপনার নিকট আসবে।”
রাসূল (সা.)-এর সাথে কুরাইশ প্রতিনিধি সুহাইল ইবনে আমর-এর সাক্ষাৎ

কুরাইশদের পঞ্চম প্রতিনিধি হিসেবে বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে সুহাইল ইবনে আমর রাসূলের কাছে এল যাতে বিশেষ এক চুক্তির মাধ্যমে এ অচলাবস্থার অবসান হয়। সুহাইলকে দেখামাত্রই রাসূল (সা.) বললেন : “সুহাইল কুরাইশদের পক্ষ থেকে আমাদের সাথে সন্ধিচুক্তি করতে এসেছে।” সুহাইল এসে মহানবীর সামনে বসল। সে যে বিষয়েই কথা বলছিল, তার মাধ্যমে একজন ঝানু কূটনীতিকের মতই সে মহানবীর ভাবাবেগকে উদ্বেলিত করার চেষ্টা করছিল। সে বলল : “হে আবুল কাসেম! মক্কা আমাদের পবিত্র স্থান এবং আমাদের জন্য সম্মানের বস্তু। আরবের সব গোত্র জানে, তুমি আমাদের সাথে যুদ্ধ করেছ। তুমি যদি এ অবস্থায় জোরপূর্বক মক্কায় প্রবেশ কর, তবে সব আরব গোত্রই জানবে, আমরা দুর্বল ও অসহায় হয়ে পড়েছি। তখন সব আরব সম্প্রদায় আমাদের এ ভূমি দখল করার জন্য প্ররোচিত হবে। তোমার সঙ্গে আমাদের যে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে, তার কসম দিয়ে বলছি, তোমার এ জন্মভূমি মক্কার যে মর্যাদা ও সম্মান রয়েছে...”

সুহাইল এটুকু বলতেই মহানবী (সা.) তার কথায় ছেদ ঘটিয়ে বললেন : “তুমি কী বলতে চাও?” সে বলল : “কুরাইশ নেতাদের প্রস্তাব হলো : তুমি এ বছর মক্কায় প্রবেশ না করে এখান থেকেই মদীনায় ফিরে যাও এবং পরের বছর উমরা করার জন্য এসো। মুসলমানরা আগামী বছর আরবের অন্যান্য গোত্রের মতই হজ্ব করার জন্য কাবা ঘরে আসতে পারবে। তাদের হজ্বের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের শর্ত হলো তারা তিন দিনের বেশি মক্কায় অবস্থান করতে পারবে না এবং সঙ্গে একটি তরবারি ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র বহন করতে পারবে না।”
মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে সুহাইলের আলোচনার ফলে মুসলমান ও কুরাইশদের মধ্যে একটি ব্যাপক ও সার্বিক চুক্তি সম্পাদনের সুযোগ সৃষ্টি হলো। কিন্তু চুক্তির শর্ত নির্ধারণ ও ধারা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সে বেশ কঠোরতা অবলম্বন করছিল। কখনো কখনো তার প্রস্তাব এতটা অগ্রহণীয় ছিল যে, তা সন্ধির সম্ভাবনাই নাকচ করছিল। কিন্তু উভয় পক্ষই সন্ধির পক্ষে থাকায় তা যাতে ছিন্ন না হয়, সে চেষ্টাও ছিল।
অধিকাংশ ঐতিহাসিক বর্ণনামতে মহানবী (সা.) হযরত আলীকে চুক্তিপত্র লেখার নির্দেশ দেন। প্রথমে তিনি আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-কে বলেন : “লিখ : ‘বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম’” এবং আলী তা লিখলেন। কিন্তু সুহাইল বলল : “আমি এ বাক্যের সাথে পরিচিত নই। ‘রাহমান’ ও ‘রাহীম’-কে আমি চিনি না; লিখ : ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ্! তোমার নামে’।”

মহানবী (সা.) সুহাইলের কথা মেনে নিয়ে অনুরূপ লিখতে বললেন। এরপর মহানবী বললেন : “লিখ : এ সন্ধিচুক্তি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ এবং কুরাইশ প্রতিনিধি সুহাইলের মধ্যে সম্পাদিত হচ্ছে।” সুহাইল বলল : “আমরা তোমার রাসূল ও নবী হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করি না। যদি তা স্বীকারই করতাম, তবে তোমার সাথে যুদ্ধ করতাম না। অবশ্যই এ বিশেষণ চুক্তিপত্র থেকে মুছে দিয়ে নিজের নাম ও পিতার নাম লেখ।” রাসূল এ বিষয়টিও মেনে নেবেন ও তাকে ছাড় দেবেন, এ সময় কোন কোন মুসলমান তা চান নি। কিন্তু মহানবী একটি উচ্চতর লক্ষ্য সামনে রেখে-যা আমরা পরে উল্লেখ করব: সুহাইলের দাবী মেনে নিয়ে হযরত আলীকে ‘আল্লাহর রাসূল’ শব্দটি মুছে ফেলতে নির্দেশ দিলেন। হযরত আলী অত্যন্ত সম্মান ও বিনয়ের সাথে বললেন : “হে আল্লাহর নবী! আপনার পবিত্র নামের পাশে নবুওয়াতের স্বীকৃতিকে মুছে ফেলার মতো অসম্মানের কাজ করা থেকে আমাকে ক্ষমা করুন।” মহানবী হযরত আলীকে বললেন : “ঐ শব্দের ওপর আমার আঙ্গুল রাখ। আমি নিজেই তা মুছে দিই।” আলী তা-ই করলেন এবং রাসূল স্বহস্তে তা মুছে দিলেন।
মহানবী (সা.) এ সন্ধিচুক্তি লিখতে যে ব্যাপক ছাড় দেন, বিশ্বের ইতিহাসে তা বিরল। কারণ তিনি প্রবৃত্তির তাড়না ও বৈষয়িক চিন্তার অনুবর্তী ছিলেন না এবং তিনি জানতেন, মহাসত্য কখনো লেখা বা মোছার মাধ্যমে পরিবর্তিত হয় না। তাই সন্ধির ভিত্তি অটল রাখতে সুহাইলের সকল কঠোর শর্ত সমঝোতামূলক মনোভাবের পরিচয় দিয়ে মেনে নিয়েছেন।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি

মহানবীর শিক্ষালয়ের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ ছাত্র আমীরুল মুমিনীন আলী ইবনে আবি তালিবও অনুরূপ ইতিহাসের শিকার হন। এ দৃষ্টিতে রাসূল (সা.)-এর মানস-প্রতিবিম্বকেও জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই রাসূলের অনুরূপ পর্যায়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। হযরত আলী রাসূলের নাম মুছে ফেলতে অপারগতা প্রকাশ করে ক্ষমা চাইলে তিনি তাঁর দিকে তাকিয়ে তাঁর ক্ষেত্রেও যে অনুরূপ ঘটনা ঘটবে, তার ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন : “হে আলী! এদের উত্তরসূরিরাও তোমাকে এরূপ করতে বলবে এবং তুমি তাদের দ্বারা মযলুম হয়ে তা করতে বাধ্য হবে।”  এ স্মৃতি আলী (আ.)-এর মনে সিফ্ফীনের যুদ্ধের পর জাগ্রত হলো যখন আলী (আ.)-এর সরল ও অদূরদর্শী সৈন্যরা ধোঁকায় পড়ে প্রতারিত হয়ে আলীকে সন্ধি করতে বাধ্য করল। যখন আলীর পক্ষে আবদুল্লাহ্ ইবনে আবি রাফে সন্ধিপত্রে লিখলেন, هذا ما تقاضى عليه أمير المؤمنين علىআমিরুল মুমিনীন আলী যে বিষয়ে আহ্বান জানাচ্ছেন’, তখন মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে নিয়োজিত প্রতিনিধি আমর ইবনে আস ও সিরীয় সৈন্যরা আপত্তি জানিয়ে বলল : “আলী ও আলীর পিতার নাম লিখ। কারণ আমরা যদি তাকে মুমিনদের নেতা মনে করতাম, তবে তার সঙ্গে কখনো যুদ্ধে লিপ্ত হতাম না।”
একই ধারার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।” তিনি এও বললেন : “এটি রাসূল (সা.)-এর অনুসৃত রীতি এবং তাঁরই উদ্ধৃতি।” এরপর হুদায়বিয়ার স্মৃতিচারণ করলেন।
হুদায়বিয়ার সন্ধি-শর্ত

এখন আমরা মহানবী (সা.) ও কুরাইশদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির বিভিন্ন শর্ত উল্লেখ করব :
১. কুরাইশ ও মুসলমানরা সমগ্র আরব ভূ-খণ্ডে সামাজিক নিরাপত্তা ও শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে এ মর্মে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হচ্ছে যে, দশ বছর একে অপরের সাথে যুদ্ধ করবে না ও পরস্পরের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ হতে বিরত থাকবে।
২. যদি কুরাইশদের কেউ তাদের অভিভাবকদের অনুমতি ছাড়া মক্কা থেকে পালিয়ে যায় ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত হয়, মুহাম্মদ অবশ্যই তাকে কুরাইশদের কাছে ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু যদি কোন মুসলমান মদীনা থেকে মক্কায় পালিয়ে আসে, কুরাইশরা তাকে মুসলমানদের কাছে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য নয়।
৩. মুসলমান ও কুরাইশরা স্বাধীনভাবে যে কোন গোত্রের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবেন।
৪. মুহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীগণ এ বছর এখান থেকেই মদীনায় ফিরে যাবেন। কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোয় স্বাধীনভাবে মক্কায় গিয়ে হজ্ব বা উমরা পালন করতে পারবেন। তবে শর্ত হলো এই যে, তিন দিনের বেশি মক্কায় অবস্থান করতে পারবেন না ও সঙ্গে সাধারণত একজন মুসাফির যাত্রী যে ধরনের তরবারি বহন করে, তা ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র বহন করতে পারবেন না।
৫. মক্কার মুসলমানরা এ চুক্তির অধীনে মক্কায় স্বাধীনভাবে ইসলামী বিধান পালন করতে পারবেন এবং এক্ষেত্রে কুরাইশরা তাদের বাধা দিতে পারবে না। তাঁদের ধর্মান্তরিত করা ও মুসলমান হওয়ার কারণে তিরস্কার করতে পারবে না।
৬. চুক্তি স্বাক্ষরকারী পক্ষদ্বয় একে অপরের ধন-সম্পদ সম্মানিত মনে করবেন এবং বিদ্বেষমূলক দৃষ্টিতে পরস্পরকে দেখতে ও প্রতারণা করতে পারবেন না।
৭. যেসব মুসলমান মদীনা থেকে মক্কায় আসবেন, তাঁদের জীবন ও ধন-সম্পদের প্রতি সম্মান ও নিরাপত্তা দেয়া হবে। 
চুক্তিপত্র দু’টি ভিন্ন পত্রে লিখিত হয়। এরপর কয়েকজন কুরাইশ ও মুসলিম প্রতিনিধি সাক্ষী হিসেবে তাতে স্বাক্ষর করেন। পরে তার একটি অনুলিপি মহানবী (সা.)-কে এবং অন্যটি সুহাইলকে দেয়া হয়।

স্বাধীনতার বাণী
এ চুক্তিপত্রের পর্বে পর্বে স্বাধীনতা ও মুক্তির বাণী প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, যার অনুরণন প্রতিটি নিরপেক্ষ বিবেকবান ব্যক্তির কানেই পশবে। কিন্তু সবচেয়ে স্পর্শকাতর হলো দ্বিতীয় শর্ত যা অনেককেই ক্রোধান্বিত করেছিল। রাসূল (সা.)-এর কোন কোন সঙ্গী এ বৈষম্যমূলক শর্তে চরম অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং এমন কিছু কথা বলেছিলেন, যা ইসলামের নবী ও মহান নেতার প্রতি দৃষ্টিকটু ও সমালোচনামূলক। অথচ চুক্তিপত্রের এ ধারাটি উজ্জ্বল এক শিখার ন্যায় আজো প্রজ্বলিত রয়েছে। এতে ইসলামের প্রসার ও বিস্তারের পদ্ধতিতে মহানবী (সা.)-এর উন্নত চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটেছে এবং স্বাধীনতা ও মুক্তির মৌলনীতির প্রতি ইসলামের মহান নেতার অনির্বচনীয় সম্মানের প্রকাশ পেয়েছে।
কোন কোন সাহাবীর এ আপত্তির (‘কেন আমরা মুসলমানদের ফিরিয়ে দেব, অথচ তারা আমাদের থেকে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য নয়’) জবাবে বলেন : “যে মুসলমান ইসলামের পতাকার নিচ থেকে র্শিকের দিকে পালিয়ে যায় এবং তাওহীদবাদী ইসলামের পবিত্র পরিবেশের ওপর মানবতার পরিপন্থী র্শিকমিশ্রিত পরিবেশকে অগ্রাধিকার দেয়, সুস্পষ্ট যে, তার ঈমান সঠিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় নি এবং সে মন থেকে ইসলামকে গ্রহণ করে নি। এরূপ কোন মুসলমান আমাদের কোন কল্যাণে আসবে না। অন্যদিকে আমরা যদি আমাদের কাছে আশ্রয়প্রার্থী ব্যক্তিকে কাফেরদের কাছে ফিরিয়ে দিই, তা হলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আল্লাহ্ তার মুক্তির পথ করে দেবেন।”
মহানবী (সা.)-এর দৃষ্টিভঙ্গি বুদ্ধিবৃত্তিক ও যুক্তিসম্মত ছিল। সময়ের পরিক্রমায় তাঁর গৃহীত ভূমিকার যথার্থতা প্রমাণিত হয়। কারণ সময় না গড়াতেই কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ ধারাটির মন্দ প্রভাব কুরাইশদের ওপর পড়ল। ফলে তারা নিজেরাই এ ধারা বাতিলের আহ্বান জানালো। আমরা পরবর্তীতে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
হুদায়বিয়ার সন্ধির এই ধারা কোন কোন উদ্দেশ্যপ্রবণ ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রাচ্যবিদের জন্য দাঁতভাঙ্গা জবাব। কারণ তাঁরা ইসলামের বিস্তার ও অগ্রযাত্রার মূল কারণ ‘অস্ত্র’ বলে মনে করেন এবং বলে থাকেন, ইসলাম অস্ত্রের মাধ্যমে প্রসার লাভ করেছে। ইসলাম তার বিষয়বস্তুর গভীরতা ও আকর্ষণ ক্ষমতার কারণে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পৃথিবীর বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার যে গৌরব লাভ করেছিল, তা সহ্য করতে না পেরে তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ইসলাম সম্পর্কে অন্যদের দ্বিধান্বিত করতে ইসলামের অগ্রযাত্রার কারণ মুসলমানদের পেশীশক্তি বলে উল্লেখ করে থাকেন। অথচ যে সন্ধিচুক্তিটি ইসলামের মহান নেতা আরব উপদ্বীপের শত-সহস্র ব্যক্তির সামনে স্বাক্ষর করেছিলেন, তাতে ইসলামের মহান শিক্ষা ও আকর্ষণীয় রূপ সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তদুপরি যদি কেউ বলে, ইসলাম মুসলমানদের তরবারির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করেছে, তবে সে বাস্তবদর্শী ও সত্যনিষ্ঠ নয়।
খাযাআ গোত্র হুদায়বিয়া সন্ধির তৃতীয় ধারার অধীনে মুসলমানদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হলো। তাদের চিরশত্রু বনী কিনানাহ্ কুরাইশদের সাথে মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষর করলো।

সন্ধিচুক্তি বলবৎ রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা

সন্ধির পটভূমি ও এর শর্তগুলো হতে সম্পূর্ণরূপে বোঝা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই উল্লিখিত শর্ত চাপিয়ে দেয়ার শামিল ছিল ও তা অনেকটা আরোপিত বলে গণ্য। মহানবী (সা.) যে চুক্তিপত্র থেকে ‘আল্লাহর রাসূল’ বিশেষণ বাদ দিয়েছিলেন এবং জাহিলী যুগের মত পত্রের প্রথমে ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’ লিখতে রাজী হয়েছিলেন- এ সবই আরব ভূ-খণ্ডে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে করেছেন। তিনি কুরাইশ কোন মুসলমান মদীনায় আশ্রয় নিলে তাকে মুশরিকদের কাছে ফেরত দেয়ার শর্তটিও সুহাইলের একগুঁয়ে মনোভাবের ফলে মেনে নেন। যদি তিনি মদীনায় আশ্রয়প্রার্থী কুরাইশ মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার চিন্তা করতেন এবং সন্ধির বৈষম্যমূলক শর্তটি না মানার জন্য তাঁর সঙ্গীদের চাপের মুখে নতি স্বীকার করে সুহাইলের প্রস্তাব না মানতেন, তবে সংলাপের পথ বন্ধ হয়ে যেত এবং সন্ধিচুক্তিও সম্পাদিত হতো না। ফলে আল্লাহর এক বড় নিয়ামতস্বরূপ এ সন্ধির চোখ ধাঁধানো সাফল্য হতে মুসলমানরা বঞ্চিত হতো। মহান এক লক্ষ্যের চিন্তা করে মহানবী (সা.) সব ধরনের চাপ সহ্য করেছেন। কারণ ঐ মহান লক্ষ্যের তুলনায় এ প্রতিকূলতা কিছুই নয়। যদি রাসূল মুসলমানদের ঐ অংশের স্বার্থ রক্ষার চিন্তা করতেন ও সাধারণ মুসলমানদের চাপের মুখে নতি স্বীকার করতেন, তবে সুহাইল তার একগুঁয়ে চরিত্রের প্রকাশ ঘটিয়ে যুদ্ধ বাঁধানোর পরিবেশ সৃষ্টি করত। নিম্নোক্ত ঘটনাটি এর সপক্ষে একটি সুস্পষ্ট দলিল :
সন্ধির শর্তগুলো সম্পর্কে আলোচনা শেষে উভয় পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে হযরত আলী (আ.) চুক্তিপত্র লিখছিলেন, এমন সময় সুহাইলের পুত্র আবূ জান্দাল শিকলবদ্ধ অবস্থায় সভাস্থলে উপস্থিত হলেন। সবাই তাঁর আগমনে হতভম্ব হলেন। কারণ তিনি তাঁর পিতার কারাগারে শিকলবদ্ধ অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছিলেন, তা কারো জানা ছিল না। তিনি একজন নিরপরাধ বন্দী ছিলেন- যাঁর একমাত্র অপরাধ তিনি তাওহীদবাদী ধর্ম ইসলামকে মেনে নিয়েছিলেন ও মহানবী (সা.)-এর অন্যতম ভক্তে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি কোনভাবে খবর পেয়েছিলেন যে, মুসলমানরা হুদায়বিয়ায় অবস্থান করছে। তাই কৌশলে কারাগার থেকে পালিয়ে ভিন্নপথে বন্ধুর পথ পেরিয়ে মুসলমানদের কাছে পৌঁছান।

সুহাইল তার পুত্রকে দেখামাত্র এতটা ক্রোধান্বিত হলো যে, তাঁর মুখে জোরে চপেটাঘাত করল। এরপর রাসূল (সা.)-এর দিকে তাকিয়ে বলল : “সন্ধির দ্বিতীয় ধারা অনুযায়ী এরূপ প্রথম ব্যক্তি হিসেবে একে মক্কায় ফিরিয়ে দাও অর্থাৎ আমাদের থেকে পলাতক ব্যক্তিকে আমাদের হাতে সোপর্দ কর।” নিঃসন্দেহে সুহাইলের দাবী সম্পূর্ণরূপে অযৌক্তিক ছিল। কারণ তখনও চুক্তি কাগজে-কলমে লিপিবদ্ধ হয়নি এবং উভয় পক্ষ তাতে স্বাক্ষরও করেননি। যে চুক্তিনামা তখনও চূড়ান্ত হয়নি, কিভাবে তা এক পক্ষের দাবীর সপক্ষে দলিল হতে পারে? এ কারণে মহানবী (সা.) বললেন : “এখনও চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়নি।” সুহাইল বলল : “সেক্ষেত্রে আমি পুরো চুক্তিটিই অস্বীকার ও বাতিল ঘোষণা করব।” সুহাইল এতটা বাড়াবাড়ি করছিল যে, কুরাইশদের অন্য দুই প্রতিনিধি মুকরেজ ও হুয়াইতাব ক্রোধান্বিত হয়ে দ্রুত উঠে আবূ জান্দালকে তার পিতার হাত থেকে নিয়ে রাসূল (সা.)-এর হাতে দিয়ে বলল : “আবূ জান্দাল তোমার আশ্রয়ে থাকুক।” তারা এভাবে বিতর্কের অবসান ঘটাতে চেয়েছিল। কিন্তু সুহাইল তার একগুঁয়েমী অব্যাহত রেখে বলল : “চুক্তির সংলাপ শেষ হয়ে গেছে।” অবশেষে মহানবী (সা.) বাধ্য হয়ে ইসলামের প্রসারের জন্য সুবর্ণ সুযোগদানকারী এ সন্ধিচুক্তিটি রক্ষার শেষ প্রচেষ্টা হাতে নিলেন। তিনি আবূ জান্দালকে তাঁর পিতার হাতে সমর্পণের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে নির্যাতিত বন্দীকে সান্ত্বনা দানের জন্য বললেন : “আবু জান্দাল! তুমি ধৈর্য অবলম্বন কর। আমরা চেয়েছিলাম তোমার পিতা স্নেহ-ভালোবাসার বশবর্তী হয়ে তোমাকে আমাদের কাছে সমর্পণ করবে। কিন্তু সে তা করল না। তুমি সহনশীল হও এবং জেনে রাখ! আল্লাহ্ তুমি ও তোমার মত অন্যান্য নির্যাতিতের মুক্তির পথ বের করে দেবেন।”
বৈঠকের সমাপ্তি ঘটল এবং উভয় পক্ষ চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করল। সুহাইল ও তার সঙ্গীরা মক্কার পথ ধরল। আবূ জান্দাল মুকরেজ ও হুয়াইতাবের নিরাপত্তায় মক্কায় ফিরে গেল। মহানবী (সা.) ইহরাম অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে সেখানে নিজ উট কুরবানী করলেন এবং মাথার চুল কামিয়ে ফেললেন। অনেকেই তাঁকে অনুসরণ করলেন।

হুদায়বিয়ার সন্ধি : পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন

মহানবী (সা.) ও মুশরিক নেতাদের মধ্যে সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হলো। সর্বমোট ঊনিশ দিন হুদায়বিয়ায় অবস্থানের পর মুসলমানরা মদীনার পথে রওয়ানা হলেন এবং মুশরিকরা মক্কার পথে হুদায়বিয়া ত্যাগ করল। চুক্তিপত্র লেখার সময় এবং চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরবর্তীতে রাসূল (সা.) ও তাঁর কোন কোন সাহাবীর মধ্যে মতপার্থক্য ও বিতর্ক হয়েছিল। তাঁদের একদল এই সন্ধিচুক্তি মুসলমানদের স্বার্থের অনুকূল বললেন এবং কিয়দংশ একে মুসলমানদের স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে করলেন। হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হওয়ার প্রায় চৌদ্দ শ’ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আমরা বর্তমান সময়ে বসে দূর হতে গোঁড়ামী ও সংকীর্ণতা থেকে সম্পূর্ণ দূরে থেকে নিরপেক্ষভাবে বাস্তবতার দৃষ্টিতে হুদায়বিয়ার সন্ধি পর্যালোচনার করব এবং বিতর্কের উভয় পক্ষের মত যাচাই করে দেখব। আমাদের দৃষ্টিতে নিম্নোক্ত যুক্তিতে এ সন্ধি ইসলামের পক্ষে এক শ’ ভাগ গিয়েছিল এবং তার বিজয় নিশ্চিত করেছিল :
১. কুরাইশদের অনবরত আক্রমণ এবং মদীনার ভেতর ও বাইরে থেকে তাদের পরিচালিত উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে ঘটেছিল উহুদ ও আহাজাবের যুদ্ধ। এই অবিরত চাপের ফলে মহানবী (সা.) আরব ভূ-খণ্ডের বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী গোত্রগুলো ও তার বাইরের বিভিন্ন জাতির প্রতি ইসলামের দাওয়াত দেয়ার ও তাদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের সুযোগ পান নি। তাঁর মূল্যবান সময়কে (অধিকাংশ সময়ই) ইসলামের প্রতিরক্ষা ও শত্রুদের ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রগুলো নস্যাৎ করতে ব্যয় করতে হতো। কিন্তু এ সন্ধিচুক্তির ফলে ইসলামের মহান নেতা ও তাঁর অনুসারীরা মদীনার দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণের আশঙ্কামুক্ত হলেন। ফলে অন্যান্য দিকে ইসলামের প্রচারের ক্ষেত্র সৃষ্টি হলো। এ প্রশান্তিকর পরিবেশের ফল দু’বছর পর পাওয়া গেল যখন মক্কায় ইসলামের সূর্য উদ্ভাসিত হলো। মহানবী (সা.) হুদায়বিয়ায় যাওয়ার সময় চৌদ্দ শ’ সঙ্গী নিয়ে যাত্রা করেছিলেন, কিন্তু এর ঠিক দু’বছর পর মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করাকালে দশ হাজার মুসলমান ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হয়ে তাঁর সঙ্গে যাত্রা করেন। এই লক্ষণীয় পার্থক্য হুদায়বিয়ার সন্ধির প্রত্যক্ষ ফল। কারণ একদল লোক কুরাইশদের ভয়ে মুসলমান হতে সাহস পাচ্ছিল না। কিন্তু কুরাইশরা ইসলামকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়ার ফলে বিভিন্ন গোত্র ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পেল; তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত ভাব দূর হলো। মুসলমানরাও মুক্তভাবে ইসলামের প্রচারে রত হলেন।

২. দ্বিতীয় যে সুফলটি মুসলমানরা এ চুক্তির মাধ্যমে পেয়েছিল, তা হলো ইসলাম ও আরবের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে মুশরিকরা যে লৌহপ্রাচীর নির্মাণ করেছিল, এর ফলে তা বিলুপ্ত হয়েছিল। ফলে মদীনায় অবাধ যাতায়াতের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। মুসলমানদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন গোত্র ইসলামের মহান ও কল্যাণময় শিক্ষা সম্পর্কে জানতে পারল।
মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান ঈমান, মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ নির্দ্বিধায় পালনের মনোবৃত্তি, শৃঙ্খলা, নিষ্ঠা প্রভৃতি দিক মুশরিকদের বিবেক-বুদ্ধিকে আকৃষ্ট করত। নামাযের পূর্বে ওযূ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নামাযের জামাআতে সারিবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল দাঁড়ানো, মহানবীর উষ্ণ অভ্যর্থনা ও আকর্ষণীয় ভাষণ, সর্বোচ্চ সহিত্যমানের ইলাহী বাণী তথা কুরআনের বাণী শ্রবণ তাদের ইসলামের দিকে আকর্ষণ করত। অন্য দিকে এ সন্ধিচুক্তির পর মুসলমানরা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে মক্কা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সফর করতেন। এ সফরগুলোতে নিজেদের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন এবং ইসলামের বিভিন্ন দিক, বিধি-বিধান, হালাল-হারাম, নৈতিকতার বিষয়গুলো তাদের সামনে তুলে ধরতেন। এ প্রচারের ফলে অনেক মুশরিক নেতা, যেমন খালিদ ইবনে ওয়ালীদ, আমর ইবনুল আস প্রমুখ মুসলমান হন। ইসলামের মহাসত্যের সাথে মুশরিকদের পরিচয় মক্কা বিজয়ের পথ সুগম করে। আর তাই র্শিকের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র কোনরূপ রক্তক্ষয় ও প্রতিরোধ ছাড়াই মুসলমানদের পদানত হয়। ফলে দলে দলে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে।  এ মহাবিজয় পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, ভীতি দূরীভূত হওয়া, প্রচারের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা লাভ এবং মুসলমানদের প্রচারকাজের ফলে অর্জিত হয়।
৩. মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাথে সন্ধিচুক্তির আলোচনার সময় থেকেই কুরাইশদের মানসিক জটিলতার প্যাঁচ খুলতে শুরু করে। কারণ, মহানবীর উন্নত নৈতিক চরিত্র, কোমল আচরণ, প্রতিপক্ষের কঠোরতার বিপরীতে ধৈর্যশীলতার পরিচয় দান, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা প্রভৃতি তাঁর মহামানবীয় বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দান করে এবং সকল উন্নত নৈতিক বৈশিষ্ট্যের তিনি যে ধারক, এতে তা-ই প্রমাণিত হয়।

কুরাইশদের পক্ষ থেকে তাঁর ওপর অনেক কঠিন আঘাত এলেও তাদের প্রতি তাঁর আচরণ ছিল মানবপ্রেমে পূর্ণ। বিশেষত যখন কুরাইশরা প্রত্যক্ষ করল চুক্তির চাপিয়ে দেয়া শর্তগুলোর ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গীদের উল্লেখযোগ্য অংশের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ আসা সত্বেও তিনি তাঁর জন্মভূমি মক্কা ও হারাম শরীফের পবিত্রতার বিষয়কে একদল সঙ্গীর প্রত্যাশার বিপরীতে প্রাধান্য দিলেন, তখন তারা তাঁর উদ্দেশ্যের সততায় বিশ্বাস স্থাপন করল। এরূপ আচরণ মহানবীর স্বভাব ও মানসিকতা সম্পর্কে যে অপপ্রচার ছিল, তা মিথ্যা প্রমাণ করল। সে সাথে এটাও প্রমাণিত হলো যে, তিনি মানবপ্রেমী ও শান্তিকামী ব্যক্তিত্ব- যিনি এতটা বিশাল হৃদয়ের অধিকারী যে, কোন দিন সমগ্র আরব ভূ-খণ্ডের শাসনক্ষমতাও হস্তগত করলেও নিজ শক্রদের সাথে বিদ্বেষমূলক আচরণ করবেন না; বরং তাদের প্রতিও সহানুভূতিশীল আচরণ করবেন। কারণ এ বিষয়টি আলোচনার অবকাশ রাখে না যে, মহানবী (সা.) যদি সেদিনও (বাইয়াতে রিদওয়ানের শপথের পরিপ্রেক্ষিতে) কুরাইশদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতেন, তাদের সবার ওপর জয়ী হতেন। যেমনটি পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে :
و لو قاتلكم الّذين كفروا لولّوا الأدبار ثمّ لا يجدون وليّا و لا نصيرا
কাফেররা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করলে তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন (পলায়ন) করত। অতঃপর তারা কোন বন্ধু ও সাহায্যকারীও পেত না।” (সূরা ফাত্হ : ২২)
এ সত্বেও তিনি এ ক্ষেত্রে বিশেষ কোমলতার পরিচয় দিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করেছেন এবং আরব গোত্রগুলোর প্রতি তাঁর ভালবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে পরিচালিত সকল অপপ্রচার মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
এইসব যুক্তি হতে হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পর্কে ইমাম জাফর সাদিক (আ.) হতে উদ্ধৃত নিম্নোক্ত বাণীর যথার্থতা প্রমাণিত হয়। তিনি বলেছেন : و ما كان قضية أعظم بركة منها “মহানবীর জীবনে হুদায়বিয়ার সন্ধি অপেক্ষা কল্যাণকর কোন ঘটনাই ঘটে নি।”
হুদায়বিয়ার সন্ধির পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহগুলো প্রমাণ করে, মহানবীর গৃহীত সিদ্ধান্তের বিপরীতে যে সাহাবীরা অবস্থান নিয়েছিলেন-তাঁদের যুক্তিগুলো পুরাপুরি ভিত্তিহীন ছিল। ঐতিহাসিকরা প্রতিবাদকারীদের বক্তব্য ও মন্তব্যগুলো খুঁটিনাটিসহ উল্লেখ করেছেন।
হুদায়বিয়ার সন্ধির মূল্য এখান থেকেই বোঝা যায় যে, মহানবী (সা.) তখনও মদীনায় গিয়ে পৌঁছেন নি, সূরা ফাত্হ মুসলমানদের বিজয়ের সুসংবাদ দিয়ে অবতীর্ণ হলো। এরশাদ হলো :
إنّا فتحنا لك فتحا مبينا
নিশ্চয়ই আমি আপনাকে এক সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি”। (সূরা ফাত্হ : ১)
এ আয়াতকে মক্কা বিজয়ের প্রাথমিক পদক্ষেপ বলা যেতে পারে।
কুরাইশরা হুদায়বিয়ার সন্ধির একটি ধারা বাতিল ও অকার্যকর ঘোষণা করার জন্য উপর্যুপরি আহ্বান জানাতে থাকে। কিছুদিন না যেতেই কুরাইশরা এমন এক তিক্ত ঘটনার মুখোমুখি হলো যে, বাধ্য হয়ে মহানবীর নিকট সন্ধির দ্বিতীয় ধারাটি বাতিলের আহ্বান জানাল। যে ধারাটি মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাহাবীদের ক্ষুব্ধ করেছিল, কিন্তু তিনি সুহাইলের একগুঁয়ে মনোভাবের কারণে তা মেনে নেন, তাতে বলা হয়েছিল, রাসূল কুরাইশদের থেকে পলায়নকারী মুসলমানদের তাদের নিকট ফিরিয়ে দেবেন; কিন্তু কোন মুসলমান পালিয়ে মক্কায় আশ্রয় নিলে কুরাইশরা তাদের ফিরিয়ে দেবে না। মহানবী (সা.) এ ধারা মেনে নেয়ার সময় বলেছিলেন, মহান আল্লাহ্ কুরাইশদের হাতে বন্দী দুর্বল ও নির্যাতিত মুসলমানদের মুক্তির পথ করে দেবেন।
আবূ বাসির’ নামের এক মুসলমান দীর্ঘ দিন মুশরিকদের হাতে বন্দী ছিলেন। তিনি একবার সুযোগ বুঝে কৌশলে মক্কা থেকে পালিয়ে গিয়ে মদীনায় পৌঁছলেন। কুরাইশদের দু’জন বিশিষ্ট ব্যক্তি আযহার এবং আখনাস মহানবীকে সন্ধির দ্বিতীয় ধারার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আবূ বাসিরকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য পত্র লিখে পাঠাল। বনী আমের গোত্রের এক ব্যক্তিসহ স্বীয় এক দাসকে এ পত্র দিয়ে মদীনায় রাসূলের নিকট পৌঁছাতে বলল।
মহানবী (সা.) সন্ধিচুক্তি অনুযায়ী আবূ বাসিরকে বললেন : “অবশ্যই তোমাকে নিজ গোত্রের কাছে ফিরে যেতে হবে। আমি কখনোই তাদের সাথে প্রতারণার কৌশল অবলম্বন করব না। আমি নিশ্চিত, মহান আল্লাহ্ তোমার ও অন্যদের মুক্তির পথ করে দেবেন।” আবূ বাসির বললেন: “হে নবী! আপনি কি আমাকে মুশরিকদের হাতে অর্পণ করতে চান যাতে তারা আমাকে আমার ধর্ম হতে ফিরিয়ে নিতে পারে?” মহানবী (সা.) তাঁর আগের কথার পুনরাবৃত্তি করে কুরাইশ প্রতিনিধিদের হাতে তাঁকে অর্পণ করলেন। তারা মক্কার দিকে যাত্রা করে যখন ‘যুল হুলাইফা’  নামক স্থানে পৌঁছল, তখন আবূ বাসির ক্লান্ত হয়ে একটি দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লেন। এরপর বনী আমেরের ঐ ব্যক্তিকে নিজের কাছে ডেকে গল্প জমালেন। এক ফাঁকে তার তরবারিটি দেখার নাম করে হাতে নিয়ে তা খাপ থেকে বের করলেন এবং আকস্মিকভাবে ঐ ব্যক্তির ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাকে হত্যা করলেন। এ ঘটনা দেখে দাসটি ভয়ে পালিয়ে যায়।

দাসটি মদীনায় পৌঁছে মহানবীকে ঘটনা খুলে বলল। কিছুক্ষণ পর আবূ বাসিরও সেখানে এসে মহানবীকে বললেন : “হে আল্লাহর নবী! আপনি আপনার শর্ত অনুযায়ী কাজ করেছেন। কিন্তু আমি কখনোই আমার ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে কাফেরদের ছিনিমিনি খেলার সুযোগ দেব না”। এই বলে তিনি লোহিত সাগরের তীরে কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলার চলার পথের ‘ঈস’ নামক একটি স্থানের দিকে যাত্রা করলেন এবং সেখানে একাকী বসবাস শুরু করলেন। মক্কার মুসলমানরা আবূ বাসিরের ঘটনা জানতে পারলেন এবং তাঁর অবস্থান সম্পর্কেও অবহিত হলেন। ফলে তাঁদের মধ্যে সত্তর জন মক্কা থেকে পালিয়ে আবূ বাসিরের প্রতিবেশী হলেন। এই সত্তর জন সক্ষম যুবক কুরাইশদের চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন- তাঁদের কোন স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা ছিল না; ঈস-এ পৌঁছেও তাঁদের কোন জীবিকার উপায় ছিল না। তাই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলায় আক্রমণ চালাবেন এবং তাদের যাকেই পাবেন, হত্যা করবেন। তাঁরা দক্ষতার সাথে কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলাগুলোর ওপর আক্রমণ চালাতে থাকলেন এবং তাঁদের অনবরত হামলার ফলে কুরাইশরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। ফলে তারা বাধ্য হয়ে মহানবী (সা.)-এর কাছে এ মর্মে পত্র দিল যে, হুদায়বিয়ার সন্ধির দ্বিতীয় ধারা অকার্যকর ঘোষণা করা হোক এবং ঈস হতে মুসলমানদের মদীনায় নিয়ে যাওয়া হোক। মহানবী (সা.) উভয় পক্ষের সম্মতিতে তা অকার্যকর ঘোষণা করলেন এবং ঈস-এ সমবেত মুসলমানদের মদীনায় চলে আসতে নির্দেশ দিলেন।
এ ঘটনার ফলে কুরাইশরা বুঝতে পারল ঈমানদার ব্যক্তিদের সব সময় বন্দী করে রাখা যায় না এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের বন্দী করে রাখা স্বাধীনতা দান অপেক্ষা বিপজ্জনক। কারণ, একদিন তাদের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠবে এবং তারা শত্রুদের নিকট থেকে চরম প্রতিশোধ গ্রহণ করবে।

কুরাইশদের কাছে মুসলিম নারীদের ফিরিয়ে না দেয়া

হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর উকবা ইবনে আবি মুঈতের কন্যা উম্মে কুলসুম মক্কা থেকে মদীনায় গেলেন। তাঁর দুই ভাই আম্মারাহ্ এবং ওয়ালীদ মহানবীর কাছে সন্ধির দ্বিতীয় ধারা অনুযায়ী তাঁকে মক্কায় ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানান। মহানবী জানালেন, নারীরা এ ধারার অন্তর্ভুক্ত নয় এবং ধারাটি কেবল পুরুষদের জন্যই প্রযোজ্য।
সূরা মুমতাহিনার দশম আয়াত এক্ষেত্রে করণীয় বিষয় সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে :
يا أيّها الّذين آمنوا إذا جائكم المؤمنات مهاجرات فامتحنوهنّ الله أعلم بإيمانهنّ فإن علمتموهنّ مؤمنات فلا ترجعوهنّ إلى الكفّار لا هنّ حلّ لهم و لا هم يحلّون لهنّ و آتوهم ما أنفقوا
হে ঈমানদারগণ! যখন তোমাদের কাছে ঈমানদার নারীরা হিজরত করে আসে, তখন তাদেরকে পরীক্ষা কর। আল্লাহ্ তাদের ঈমান সম্পর্কে সম্যক অবগত আছেন।  যদি তোমরা জান, তারা ঈমানদার, তবে আর তাদেরকে কাফেরদের কাছে ফেরত পাঠিয়ো না। এরা কাফেরদের জন্য হালাল নয় এবং কাফেররা এদের জন্য হালাল নয়। কাফেররা যা ব্যয় করেছে, তা তাদের ফিরিয়ে দাও।”
হুদায়বিয়ার সন্ধির পর মহানবী (সা.) শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের নিকট পত্র দেয়ার এবং ইসলাম ও তাঁর নবুওয়াতের আহ্বানকে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছানোর সুযোগ পেয়েছিলেন।
 সূত্র: আয়াতুল্লাহ জা'ফর সুবহানির লেখা বই 'চিরভাস্বর মহানবী (সা)'

 
back to top